This post has already been read 20 times!
Share the post "ভ্যাট বিরোধী ছাত্র আন্দোলনঃ আমরা কি এই প্রশ্নগুলো আলোচনা করতে প্রস্তত আছি?"
প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সরকার আরোপিত ভ্যাটের বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন তার পরিণতি কী হতে পারে তা আমরা অনুমান করতে পারি। এর দুটি পরিণতির সম্ভাবনা রয়েছে; প্রথমত সরকার ভ্যাট আরোপরে সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নিতে পারে; দ্বিতীয়ত ছাত্ররা তাঁদের এই প্রতিবাদ বা আন্দোলনকে অব্যাহত রাখতে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যেতে পারে। সরকারের পক্ষ থেকে – প্রধানমন্ত্রী থেকে অর্থমন্ত্রী থেকে এনবিআর – এত ধরণের কথা বলা হয়েছে যে আসলেই কার ওপরে ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে সেটাই এখন বোঝা মুশকিল হয়ে গেছে। (যদিও ভ্যাট বললে তা যে সেবা বা পণ্য গ্রহণ করছে তারই পরিশোধের বাধ্যবাধকতা থাকে)। কিন্ত সেটা কাগুজে বিষয় বলা যেতে পারে, মানে কাগজে কার এই ভ্যাট দেবার কথা বলে সরকার মনে করে সেই বিষয়। এটি ইচ্ছেকৃতভাবে তৈরি করা বিভ্রান্তি বা নীতি নির্ধারকদের মধ্যে মতপার্থক্য সেটা আমরা জানিনা। কিন্ত বাস্তবে যে এই অতিরিক্ত অর্থ শিক্ষার্থিরাই দেবেন এই বিষয়ে সন্দেহের কারণ নেই। ইতিমধ্যে কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় এই টাকা নিতে শুরু করেছিলো বোঝা যায় যখন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় এই অর্থ ফেরত দেবার ঘোষণা দেয়। এখন সরকার বলতে পারে যে আপাতত এই সিদ্ধান্ত স্থগিত করা হল। প্রতিবাদী শিক্ষার্থীরা তখন ক্লাশে ফিরে যেতে পারবেন; কিন্ত পরে খানিকটা অজ্ঞাতে বা অসময়ে এটা আবার সশরীরে হাজির হতেও পারে। কিন্ত সরকার এই কথা বললে শিক্ষার্থীদের আর কিছু বলার থাকবেনা। তাঁদের আন্দোলনের সাফল্য ধরে নিয়ে তাঁরা ক্লাশে না ফিরলেই বরঞ্চ তাঁদের উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহ তৈরি হবে।
দ্বিতীয় বিকল্প হচ্ছে সরকারের অনমনীয় মনোভাব বজায় রেখে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের শেষ দেখতে চাওয়া। সেই লক্ষ্যে সরকার ও সরকার সমর্থকরা প্রতিবাদী ছাত্রদের মধ্যে বিভক্তি তৈরির চেষ্টা করতে পারেন, তাঁদের কারো কারো বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে পারেন, ইতিমধ্যে সংগঠিত হামলার মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি করতে পারেন; সর্বোপরি এই প্রতিবাদের মধ্যে রুচিহীনতা থেকে শুরু করে দলীয় রাজনীতির চিহ্ন খুঁজে পেতে পারেন। (শেষোক্ত ধরণের প্রচারণা যে কত সহজ তা আশা করি ২০১৩ সালের পরে আর কাউকে বিস্তারিতভাবে বলার দরকার হবে না)। এ সব প্রচেষ্টায় সাফল্য অর্জন খুব কঠিন হবে না; কেননা এখন পর্যন্ত আমার জানামতে এই আন্দোলনের মূল শক্তি এবং সর্বস্ব হছে স্বতঃস্ফূর্ততা। এর কোন সাংগঠনিক রূপ নেই, এঁদের কোন কোন কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব নেই, তাঁদের পক্ষে এসে দাঁড়াবার মতো কোনো রাজনৈতিক শক্তি নেই। শেষ কথাটায় অনেকে একটু নড়েচড়ে বসবেন। তাঁরা বলবেন যে এটি তো রাজনৈতিক আন্দোলন হবার কথাই নয়; আমি সে বিষয়ে একার্থে ভিন্নমত পোষণ করিনা, আবার এটাও মনে করি শিক্ষার প্রশ্নকে অরাজনৈতিক বলা যাবেনা। পাশাপাশি স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, বাংলাদেশ শিক্ষা বিষয়ক কোনো ছাত্র আন্দোলনই কেবল স্বতঃস্ফূর্ততার জোরে পরবর্তি ধাপে উত্তরিত হয় নি; এসব আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে ছাত্র সংগঠনগুলো দিয়ে, সাধারণ ছাত্রদের অংশগ্রহন এসেছে পরে। আমরা জানি যে, কোনো ছাত্র আন্দোলনই জাতীয় রাজনৈতিক শক্তির প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সমর্থন ছাড়া তার দ্বিতীয় ধাপে যায় নি। সেটা ১৯৬২, ১৯৬৯, ১৯৮৩, এমনকি ২০০৮ সালেও হয়নি। আবার এই ছাত্র আন্দোলনগুলো যতক্ষন না পর্যন্ত জাতীয় রাজনীতির প্রশ্নকে তাঁদের আন্দোলনের দাবিনামার অংশ করতে পেরেছে ততক্ষন পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলো তার পাশে এসে দাঁড়ায় নি। এখন বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিরাজমান দলগুলোর প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পক্ষে এসে দাঁড়াবার সুযোগ নেই, কেননা এই প্রতিবাদে যারা অংশ নিচ্ছেন তাঁরা সেটা চান বলে মনে হয় না। তা হলে আমরা ধরে নিতে পারি যে দ্বিতীয় পরিণতির সম্ভাবনাই এখন পর্যন্ত বেশি। তাতে কে কতটা লাভবান হবেন সেটি পরে হিসেব করা যাবে।
কিন্ত পরিণতি যাই হোক, এই প্রতিবাদের কতক দিক ইতিমধ্যে স্পষ্ট হয়েছে। প্রথমত পরিচিত রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনগুলোর বাইরে এসে ছাত্ররা, যেভাবে বুঝেছে সেভাবেই, একটা প্রতিবাদ করেছে। তার মানে বাংলাদেশের প্রচলিত ছাত্র রাজনীতির বিষয়ে এতদিন ধরে যে কথা বলা হচ্ছিলো যে প্রধান প্রধান ছাত্রসংগঠন বলে যারা পরিচিত তাঁরা আর সাধারণ ছাত্রদের স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করেনা; সেটা এখন হাতে কলমে প্রমাণিত হল। দ্বিতীয়ত ছাত্ররা প্রচলিত অর্থে আন্দোলন মানেই ভাংচূরের যে বিষয় থাকে তা থেকে অন্ততপক্ষে এখন পর্যন্ত দূরে থাকতে পেরেছেন। তৃতীয়ত প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কেবল ধনী পরিবারের সন্তানেরা পড়ে সেই ধারণাতে একটা আঘাত দিয়েছে। দুই দশক, এমনকি দেড় দশক, আগে এই ধারণা তৈরি হয়েছিলো যে বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে সেই প্রেক্ষাপট যে বদলে গেছে সেটা অনেকেই টের পান নি। চতুর্থত তাঁরা দুটি বিতর্কের সূচনা করে দিয়েছেন; বিতর্কগুলো যে ছিলোনা তা নয় সেগুলো এখন পাবলিক ডিবেটের বিষয়ে পরিনত হয়েছে। একটা হল শিক্ষার বানিজ্যিকীকরণ বা পণ্যায়ন; এবং অন্যটি হল প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বেতন কাঠামো, শিক্কার মান যা একার্থে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকার প্রশ্ন। উচ্চশিক্ষার বানিজ্যিকীকরনের একটা বড় ধাপ ছিলো এই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উদ্ভব। বাংলাদেশে শিক্ষা পণ্যে পরিণত হয়েছে অনেক আগেই, শিশু শিক্ষা থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত। কিন্ত এই বিষয়ে আলোচনা ছিলো অত্যন্ত সীমিত। বিভিন্ন সরকারের নীতিমালা থেকে শুরু করে নির্ভেজাল লাভ-ক্ষতির হিসেব কারণেই এসব ঘটেছে। (সেখানে দুর্নীতির প্রশ্ন আছে। এমনকি স্কুলে ভর্তি হতে যে অর্থ দিতে হয়, তার পরিমাণ কেমন এবং তার ভাগ কারা পান সেটি অনেকেই জানেন।) এখন মনে হয় এই আলোচনাটা সামনে আসতে পারে। রাষ্ট্র যদি শিক্ষা ক্ষেত্রে বিনিয়োগে অনীহ হয় এবং ভবিষ্যতের মানব সম্পদ উন্নয়নে বিনিয়োগের চেয়ে আশু অস্ত্র ক্রয়ে, প্রতিরক্ষা বা অন্য খাতে বিনিয়োগে বেশি উৎসাহী হয় তখন মানবসম্পদ উন্নয়নের দায়িত্ব কে নেবে? পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা না করে বা সেখানে প্রয়োজনীয় সম্পদের ব্যবস্থা না করে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপরে সেই দায়িত্ব কি ছেড়ে দেয়া যায়? এখন এটা যেমন প্রশ্ন, তেমনি প্রশ্ন হল এই যে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সেগুলো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। ফলে তাঁরা আর করমুক্ত/ভ্যাটমুক্ত থাকার দাবি করতে পারেনা। এই বিশ্ববিদ্যাল্যগুলোর ছাত্র বেতন এবং অন্যান্য ফিসের পরিমাণ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। কিন্ত এগুলো সমাধান করার দায়িত্ব কার? নিশ্চয় সেটা ছাত্রদের ওপরে আমরা চাপিয়ে দিতে পারিনা, বিশেষত যখন তাঁরা একটি দাবি তুলেছে যে তাঁরা এই ভ্যাট দিতে রাজি নয়। এই বিষয়ে সরকারের কী উদযোগ ছিলো? কেবল ভ্যাট চাপিয়ে, এমনকি যদি তা শিক্ষার্থিরা না দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দেয়, তাতেই কি এইসব সমস্যার সমাধান হবে? প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় অনেক বেশি অর্থ আয় করে এই যুক্তিতে সেগুলো থেকে রাজস্ব আকারে অর্থ নেয়া তাঁদের এই কাজের বৈধতা দেয়া ছাড়া আর কি? এখন কেউ কেউ বলছেন যে শিক্ষার্থীদের উচিত হবে নিজ নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে বেতন কমানোর আন্দোলন করা, যেন বেতন না বাড়ে সেই জন্যে আন্দোলন কার; এই কথা আপাতত যুক্তিসংগত মনে হলেও এটির মধ্যে ফাঁক হল এটি আপনি গতমাসে বলেন নি। তদুপরি এটি আসল সমস্যার সমাধান নয়। এটা আসলে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাপার। আপনাকে শিক্ষার মান এবং অন্যান্য বিষয়ের নিশ্চয়তা বিধানের জন্যে প্রতিষ্ঠান তৈরি করার জন্যে কাজ করতে হবে। তার আগে স্বীকার করতে হবে উচ্চশিক্ষার মান নিরীক্ষনের প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ করছে না, স্বীকার করতে হবে যে বিরাজমান নীতি ও কৌশল দুই-ই ব্যর্থ না হোক কার্যকর ইতিবাচক ফল দেয় নি। সেই প্রেক্ষাপটে আমার কি এই যে প্রশ্নগুলো উঠেছে সেই প্রশ্নগুলো আলোচনা করতে প্রস্তত আছি?
গত কয়েক দিনে আরেকটি বিষয় লক্ষ্য করেছি তা হল অনেকে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের একটা কল্পিত বিরোধ তৈরি করার চেষ্টা করছেন। এতে করে আশু কিছু লাভ হবে, এই বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই। কিন্ত তাঁদের বিবেচনা করা দরকার যে এই পদক্ষেপ দীর্ঘ মেয়াদে কি পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে।
থাম্বনেইলের ছবিসূত্র: লিঙ্ক
Share the post "ভ্যাট বিরোধী ছাত্র আন্দোলনঃ আমরা কি এই প্রশ্নগুলো আলোচনা করতে প্রস্তত আছি?"
This post has already been read 20 times!