March 28, 2024
http://whk25.misa.org/journalism-safety/getting-away-with-murder-violence-against-journalists/

http://whk25.misa.org/journalism-safety/getting-away-with-murder-violence-against-journalists/

আফগানিস্তানে গতকাল সোমবার একাধিক হামলায় ১০ জন সাংবাদিকসহ কমপক্ষে ৩০ জনের মৃত্যুর ঘটনা দেশটির গত কয়েক দশকের সংঘাতময় ও যুদ্ধাবস্থার ইতিহাসের বিবেচনায়ও অভূতপূর্ব। এই বিরাটসংখ্যক সাংবাদিকের মৃত্যুর ঘটনা ৩০ এপ্রিলকে বিশ্বের সাংবাদিকতার ইতিহাসে একটি কালো দিবসে পরিণত করেছে। যদিও গত এক দশকে পৃথিবীজুড়েই সাংবাদিকতা এক বিপজ্জনক পেশায় পরিণত হয়েছে; তা সত্ত্বেও একই ঘটনায় এত সাংবাদিকের নিহত হওয়ার কোনো নজির নেই। এই হামলার আগে সাংবাদিকদের ওপর ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে এপ্রিল মাসেই নিহত হয়েছেন দুজন সাংবাদিক, যাঁরা অধিকৃত গাজায় ফিলিস্তিনিদের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের খবর সংগ্রহ করছিলেন। এই সব ঘটনা প্রমাণ করে যে সাংবাদিকেরা রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রবহির্ভূত শক্তি—উভয়ের সহিংসতার শিকার হচ্ছেন।

সাংবাদিকদের আন্তর্জাতিক সংগঠন কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টের (সিপিজে) হিসাব অনুযায়ী এ বছরের গোড়া থেকে এই ঘটনার আগ পর্যন্ত নিহত সাংবাদিকের সংখ্যা ছিল ১৪। দুর্ভাগ্যজনক বাস্তবতা হচ্ছে, এখন এই বছরের চার মাসে নিহত সাংবাদিকের সংখ্যা এমন জায়গায় গিয়ে দাঁড়াল, যা ১৯৯২ সালে সারা বছরের নিহত সাংবাদিকের চেয়েও বেশি। ২০১৭ সালে মারা গেছেন ৪৬ জন সাংবাদিক।

গতকাল আফগানিস্তানে যেসব আত্মঘাতী হামলা হয়েছে, তার একটি চালানো হয়েছে কান্দাহারে একটি মাদ্রাসায়। এতে নিহত হয়েছে ১১ জন শিশু শিক্ষার্থী। এই হামলার লক্ষ্যবস্ত ছিল আন্তর্জাতিক বাহিনীর একটি কনভয়, যাতে রোমানিয়ার সৈন্যরা ছিল। শিশুদের ওপরে এই হামলার এবং বিবিসি আফগান সার্ভিসের সাংবাদিক আহমাদ শাহকে খোস্ত প্রদেশে গুলি করে হত্যার দায় এখন পর্যন্ত কেউ স্বীকার না করলেও সাংবাদিকদের ওপরে কাবুলে হামলার দায় স্বীকার করেছে ইসলামিক স্টেট (আইএস)। গত সপ্তাহগুলোয় আফগানিস্তানে গাড়িবোমা এবং আত্মঘাতী হামলার ঘটনার সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। কিছুদিন আগে হেলমন্দ প্রদেশে গাড়িবোমা হামলায় ছয় ব্যক্তি মারা গেছেন, গত ২২ এপ্রিল একটি ভোটার নিবন্ধীকরণ কেন্দ্রে আত্মঘাতী হামলায় ৫৭ ব্যক্তি মারা যান, তার আগে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে এক হামলায় মারা যান ১৩ জন, মার্চ মাসে ফারসি নববর্ষের দিনে কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে এক আত্মঘাতী হামলায় মারা যান কমপক্ষে ২৯ জন। গত কয়েক সপ্তাহের হামলার ঘটনাগুলোর অধিকাংশের দায়িত্ব স্বীকার করেছে আইএস। অন্যদিকে, গত সপ্তাহেই তালেবানের একটি গোষ্ঠী তাদের বসন্তকালীন অভিযানের ঘোষণা দিয়েছে। প্রতিবছরই শীতের শেষে আফগানিস্তানে তালেবানের হামলার সংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং তা গত এক দশকের বেশি ধরেই আমরা প্রত্যক্ষ করে আসছি। কিন্তু এই বছরের এ পরিস্থিতির দুটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখযোগ্য; প্রথমটি হচ্ছে আইএসের উপস্থিতি; দ্বিতীয়ত তালেবানের সঙ্গে আফগান সরকারের আলোচনার কথাবার্তা সত্ত্বেও তালেবানের একটি দলের তৎপরতা বৃদ্ধি।

আফগানিস্তানকে খোরাসান প্রদেশ বলে আইএস বর্ণনা করে। আফগানিস্তানে আইএস তাদের উপস্থিতির সূচনা করে ২০১৫ সালেই—দেশের পূর্বাঞ্চলে পাকিস্তানের সঙ্গে সীমান্ত এলাকায় আইএসের যোদ্ধারা উপস্থিত হলেও তারা খুব বেশি সাফল্য পায়নি। কিন্তু ২০১৬ সাল থেকে আফগানিস্তানে আইএসের উপস্থিতি বৃদ্ধি পায়। সিরিয়া ও ইরাকে পরাজিত এবং ওই সব এলাকা থেকে উৎখাত হওয়ার পর আইএসের যোদ্ধারা গত বছরের শেষ দিক থেকে ব্যাপক সংখ্যায় আফগানিস্তানে প্রবেশ করে এবং দেশের উত্তরাঞ্চলে তাদের ঘাঁটি তৈরি করেছে। এদের একটা বড় অংশই হচ্ছে বিদেশি-সিরিয়া এবং ইরাকি নাগরিক ছাড়াও উজবেকিস্তানের নাগরিকরাও আছেন বলে নিরাপত্তা সূত্রগুলো নিশ্চিত করেছে। আল-জাজিরায় গত ২৬ এপ্রিল প্রচারিত সাংবাদিক বারবার আঙ্গোপার প্রতিবেদনে এই সংখ্যা কয়েক শ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। প্রতিবেদক আফগানিস্থানের জেলে আটক এই ধরনের ব্যক্তিদের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ পান এবং তিনি বলছেন, এদের বড় অংশই হচ্ছে বিদেশি।

উপস্থিতির গোড়াতে তালেবানের সঙ্গে আইএসের মতপার্থক্য থাকলেও গত কয়েক মাসে এই দুই গোষ্ঠী পরস্পরকে সহযোগিতা করছে বলেই মনে হচ্ছে। তালেবানের একাংশ আফগান সরকারের সঙ্গে আলোচনায় আগ্রহ দেখিয়েছে; বছরের গোড়াতে পাকিস্তানের ইসলামাবাদ ও তুরস্কে এই ধরনের আলোচনার প্রস্তুতিমূলক বৈঠক হয়েছে এবং পাকিস্তানভিত্তিক তালেবান আটক ১৬ জন আফগান সৈন্যকে মুক্তি দিয়েছে। এসব ইতিবাচক ঘটনার পাশাপাশি আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি মার্চ মাসে কোনো রকম পূর্বশর্ত ছাড়াই তালেবানের সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছেন। কিন্তু এসবের কিছুই আফগানিস্তানে সহিংসতা কমাতে পারেনি; বরং তালেবান তাদের হামলা বাড়িয়েছে। জানুয়ারি মাসে কাবুলের হাসপাতালে হামলা তালেবানের বিবেচনায়ও ছিল ভয়াবহ। তারপরও এখন আইএস শক্তি সঞ্চয় করার ফলে তা আরও ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে।

আইএসের উপস্থিতির সুবাদে ২০১৬ সাল থেকে আফগানিস্তানে উপস্থিত মার্কিন সেনারা আফগান সেনাবাহিনীর সঙ্গে একত্রে এবং ক্ষেত্রবিশেষে একাই সামরিক অভিযান চালাচ্ছে। এসব অভিযানের একটি বড় অভিযান হচ্ছে আইএসের কথিত ঘাঁটি বা উপস্থিতিতে বিমান হামলা। একই সঙ্গে হামলা চালানো হচ্ছে তালেবানের নেতাদের ওপরে বা তাঁদের ঘাঁটি বলে চিহ্নিত জায়গায়। গত আগস্ট মাসে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাঁর দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক নীতি ঘোষণা করে বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র শক্তি প্রয়োগ করে তালেবানকে আলোচনায় আসতে বাধ্য করবে। আফগান প্রতিরক্ষা বাহিনী বা মার্কিনদের এসব বিমান হামলা যে অনেক ক্ষেত্রেই অসময়ে বা ভুল লক্ষ্যবস্ততে হামলা করে এবং বেসামরিক ব্যক্তিদের হত্যার কারণ হয়, তার সাম্প্রতিক প্রমাণ হচ্ছে এপ্রিলের গোড়াতে আফগান বিমানবাহিনী কর্তৃক কুন্দুজ প্রদেশে একটি মাদ্রাসায় হামলার ঘটনা। সেখানে তালেবান নেতারা উপস্থিত ছিলেন কি না, সেটা প্রমাণসাপেক্ষ হলেও এটি নিশ্চিত তা ছিল মাদ্রাসাশিক্ষার্থীদের শিক্ষা সমাপনী অনুষ্ঠান। এ কারণে নিহত ব্যক্তিদের অধিকাংশই হচ্ছে শিশু।

আইএস ও তালেবানের হামলা বৃদ্ধি করার আরেকটি কারণ হচ্ছে অক্টোবরে অনুষ্ঠেয় স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচন। দেশের ১ কোটি ৪০ লাখ ভোটারকে নিবন্ধিত করে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আফগান সরকারের ওপরে আন্তর্জাতিক চাপ আছে। একে দেখা হচ্ছে আগামী বছরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রস্তুতি হিসেবে। তালেবান মনে করে, এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে সরকার আরও বেশি বৈধতা পাবে। এই বছরের শুরুতে মার্কিন সেনাবাহিনীর হিসাব অনুযায়ী আফগানিস্তানের ১৭ শতাংশ জায়গা তালেবানের নিয়ন্ত্রণে ছিল এবং তা আগের চেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে।

আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে আফগানিস্তানের পরিস্থিতি যে আরও বেশি সহিংস হয়ে উঠেছে, তার প্রমাণ গত কয়েক মাসে উপর্যুপরি হামলা এবং সোমবারের ভয়াবহ ঘটনাবলি। ফলে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি জরুরি হয়ে পড়েছে একটি দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের পথে দ্রুত অগ্রসর হওয়া। আফগানিস্থানের আধুনিক ইতিহাস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে সহিংসতার এই বৃত্তে আফগানিস্তান প্রবেশ করেছে ১৯৭৯ সালে। ২০০১ সালে আল-কায়েদার উপস্থিতির প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের অভিযান এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্য বিদেশিদের উপস্থিতি তার অবসান ঘটায়নি বরং সহিংসতার মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। গত কয়েক দশকে আফগানিস্তান হয় আন্তর্জাতিক শক্তিসমূহের, নতুবা আঞ্চলিক শক্তিগুলোর প্রক্সি যুদ্ধের থিয়েটার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে আফগানিস্তানকে তাদের বাড়ির পেছনের উঠোন (ব্যাকইয়ার্ড) বলে বিবেচনা করার নীতি থেকে পাকিস্তানকে সরে আসতে হবে। তালেবানের একাংশকে সহযোগিতা প্রদান থেকে পাকিস্তানকে বিরত হতে হবে। অন্যদিকে, আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে ভারতকে এই প্রতিশ্রুতি দিতে হবে, আফগানিস্তানকে তার প্রভাববলয়ে নিয়ে পাকিস্তানের ওপর চাপ তৈরির চেষ্টা ভারত করবে না।

আফগানিস্তানের দীর্ঘ ইতিহাস বলে যে বিদেশিদের উপস্থিতি সেখানকার রাজনৈতিক অবস্থার কোনো সমাধান দেয়নি। ফলে আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠার পথ উন্মুক্ত করার প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীসহ সব বিদেশি সৈন্য প্রত্যাহার। আর সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্রের উচিত নির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করা। অন্যদিকে, আফগানিস্তানের সরকার এবং অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তির দায়িত্ব হচ্ছে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে তাদের ভবিষ্যৎ পথরেখা নির্ধারণ।

প্রথম আলো, ১ মে, ২০১৮

Leave a Reply