ডিসেম্বর 10, 2025
Show.jpeg

This post has already been read 17 times!

বাংলাদেশের জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধি হিসাবের গরমিল এ কলামে আলোচনা হয়েছে (প্রথম আলো, ২০ মে ২০১৯)। এ মাসে প্রকাশিত এক গবেষণায় ভারতের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অরবিন্দ সুব্রামানিয়ান দেখিয়েছেন, ভারতে জিডিপির প্রকৃত প্রবৃদ্ধির হার সরকারি হিসাব থেকে ২ দশমিক ৫ শতাংশ কম। সরকারি হিসাবে, ২০১১-১২ থেকে ২০১৬-১৭ সময়ে ভারতে বার্ষিক গড় প্রবৃদ্ধির হার ছিল প্রায় ৭ শতাংশ। ভারতের সরকার এ গবেষণাকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে সাবেক পরিকল্পনা কমিশনের প্রতিস্থাপনকারী ‘নীতি-আয়োগ’ উত্থাপিত প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর দিতে চেষ্টা করেছে। তর্কবিতর্ক চলছে। অর্থাৎ তর্কাতর্কির গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বজায় রাখছে। 

বাংলাদেশের পরিকল্পনামন্ত্রী এক সেমিনারে এ নিবন্ধকারের উদ্দেশে বলেছেন, তিনি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সঙ্গে আলাপের পর ব্যুরো কর্তৃক বিভিন্ন জরিপের জন্য সংগৃহীত ডেটাবেইস ও প্রণীত হিসাবের উৎস তথ্যসমূহ পর্যায়ক্রমে ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন ও অর্থনীতিসংক্রান্ত বিভাগগুলোর জন্য উন্মুক্ত করার ব্যবস্থা করবেন। নিঃসন্দেহে বিভিন্ন ধরনের ডেটাবেইস উন্মুক্ত করে দেওয়া হলে ব্যাপক গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি হবে। ছাত্র-শিক্ষকেরা যেমন গবেষণা করতে পারবেন, তেমনি তর্কবিতর্কের মাধ্যমে সঠিক তথ্য-উপাত্ত এবং পথনির্দেশনা পাওয়া যাবে। 

প্রবৃদ্ধির হিসাবের গরমিল দূর করা যেমন জরুরি, একই সঙ্গে মৌলিক প্রশ্নগুলো উত্থাপন করা দরকার। কোন ধরনের প্রবৃদ্ধি, কী উপায়ে ওই প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে এবং কার জন্য এ প্রবৃদ্ধি—প্রশ্নগুলোর উত্তর নির্দিষ্ট করা গেলে উত্তরের মধ্যেই ভবিষ্যৎমুখী কৌশলও নিহিত থাকবে। ভবিষ্যৎমুখী কৌশলের লক্ষ্য যদি হয় স্থিতিশীল, বজায়মান ও টেকসই প্রবৃদ্ধি, তাহলে বিদেশ থেকে মানদণ্ডও ধার করতে হবে না! বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের তিনটি মূল স্তম্ভ—সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার—এগুলোর আলোকেই প্রশ্নগুলোর মীমাংসা করতে হবে। 


পরিমাণগত নয়, প্রবৃদ্ধির গুণগত মান এবং রূপান্তর যোগ্যতা নিয়েই আলোচনা করা দরকার। উদাহরণস্বরূপ, বিদ্যালয়ে অংশগ্রহণ বাড়লেও ঝরে পড়ার সংখ্যা বাড়ছে। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) প্রতিবেদন অনুযায়ী, মাধ্যমিক স্তরে ছেলেদের ঝরে পড়ার হার আড়াই শতাংশ বেড়ে ৩৬ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ হয়েছে। ছাত্রীদের ঝরে পড়ার হার সামান্য পরিমাণে কমলেও ৪০ দশমিক ১৯ শতাংশে স্থবির হয়ে আছে। আবার জিপিএ-৫-এর সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও দক্ষতা বাড়ছে না, বিধায় বিদেশ থেকে দক্ষ শ্রমিক আনতে হচ্ছে। 

কত কষ্ট করে বাংলাদেশিরা ১৬ বিলিয়ন ডলার পাঠানোয় গ্রামীণ অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এদিকে ছয় বিলিয়ন ডলারের বেশি চলে যাচ্ছে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসহ প্রযুক্তিগত উন্নয়নের কথা বলা হলেও বাংলাদেশ প্রযুক্তি খাতে নিরেট আমদানিনির্ভরই রয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দালানকোঠার জন্য বরাদ্দ জারি আছে, এখন দরকার গবেষণা ও উদ্ভাবন সক্ষমতা বাড়ানোর প্রয়াস। দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি হলে শিক্ষিত বেকারত্বের বোঝা ব্যাপক কমে যাবে। দক্ষতা, গবেষণা ও উদ্ভাবনের বাইরেও নাগরিক তৈরি শিক্ষার মৌলিক কাজ। কলা, সংস্কৃতি, ক্রীড়াসহ সহশিক্ষামূলক কার্যক্রম ছাড়া মনুষ্যত্ব বিকশিত হয় না। চিকিৎসাসেবা নিম্ন আয়ের মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। স্বাস্থ্যসেবার গুণগত মানে রয়েছে ব্যাপক ঘাটতি। স্বাস্থ্য খাতে কোনো সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিও নেই। 

প্রশ্ন করা দরকার, জনজীবনে প্রবৃদ্ধি কী রূপান্তরিত পরিবর্তন আনছে? বাংলাদেশে দারিদ্র্য হ্রাস বড় চ্যালেঞ্জ। ‘প্রবৃদ্ধি হবে, তারপর চুইয়ে পড়ে দারিদ্র্য বিমোচিত হবে’—এ কৌশলের মাধ্যমে ২০৩০ সালের মধ্যে ‘শূন্য দারিদ্র্য’ অর্জন হবে না। ইতিমধ্যে দারিদ্র্য কমার হার কমেছে। ২০০৫ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে প্রতিবছর দারিদ্র্য কমার হার ছিল ১ দশমিক ৭ শতাংশ। ২০১০ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যবর্তী সময়কালে এ হার কমে ১ দশমিক ২ শতাংশে নেমেছে। এ তথ্য আরও নিশ্চিত করে, এখানে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যে হারে বাড়ছে বলে দাবি করা হচ্ছে, দারিদ্র্য সে হারে কমছে না। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দারিদ্র্য হ্রাস করতে সক্ষম কি না, দারিদ্র্যের আয় স্থিতিস্থাপকতার মাধ্যমে বোঝা যায়। ‘উন্নয়ন অন্বেষণে’–এর গবেষণা অনুযায়ী, ২০০৫-১৬ সময়কালে দক্ষিণ এশিয়ায় বার্ষিক দারিদ্র্য হ্রাসের হারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে হার তুলনামূলক কম। ২০১৫ সালে বিশ্বব্যাংক দারিদ্র্যসীমা ১ দশমিক ৯০ ডলারে হালনাগাদ করেছে। নিম্ন মধ্যবর্তী থেকে মধ্যবর্তী দেশে পরিবর্তনে আকাঙ্ক্ষী দেশের জন্য এ সীমা ন্যূনতম ৩ দশমিক ২০ ডলারের কম কি যুক্তিযুক্ত? 


সংগত প্রশ্ন—কী উপায়ে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে? চলমান কর্মসংস্থান সৃষ্টিবিহীন প্রবৃদ্ধি? হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে ৪ কোটি ৮২ লাখের মতো তরুণ বেকার। তাহলে ‘জনমিতির লভ্যাংশ’ অর্জন না করতে পারায় একটি প্রজন্ম কি হারিয়ে যাবে? ধরে নেওয়া হচ্ছে প্রবৃদ্ধির ফলে কর্মসংস্থান বাড়বে। কর্মশূন্য প্রবৃদ্ধিও গেছে। তথ্য বলছে, কর্ম সৃষ্টিকারী প্রবৃদ্ধি কৌশলের দিকে যেতে হবে। তাহলে কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি ও উৎপাদনশীলতা হ্রাস রোধ করতে হবে। শিল্প খাতের পরিমাণ বাড়ছে না ও বহুমুখীকরণ হচ্ছে না। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, গত ছয় বছরে শিল্পকারখানার সংখ্যাও বাড়েনি, কমেছে ৬০৮টি। অটোমেশন আসবে, অদক্ষ শ্রমিকের চাহিদা কমবে, তাহলে দক্ষতা যেমন বাড়াতে হবে, প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে সামর্থ্য নতুন শ্রমঘন শিল্প স্থাপনাও লাগবে। 


কার জন্য প্রবৃদ্ধি—নিঃসন্দেহে সর্বজনের জন্য না হলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে। কিন্তু সরকারি সংরক্ষণশীল হিসাবও বলছে, দিন দিন অসমতা ও বৈষম্য বাড়ছে। আয়, স্থানিক, লিঙ্গীয়, সম্পদ, সুযোগ ও ক্ষমতার বৈষম্য দেখা যাচ্ছে। বর্তমানে জারি থাকা কৌশলগুলোই অসমতা তৈরি করছে। বিশেষ করে ক্ষমতা, সুযোগ এবং সম্পদের বৈষম্য রাজনৈতিক বন্দোবস্তের মাধ্যমেই নির্ধারিত হয়ে থাকে। অন্যদিকে, রাজনৈতিক সংস্কৃতি যদি সম্পদ ও সুযোগের বৈষম্য দূর করতে না পারে তাহলে সমাজ অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে। ফলে অপরাধপ্রবণতা ও নৈরাজ্য বেড়ে যায়। ক্ষমতাহীন মানুষের ওপর অভিঘাত বেশি পড়ে। পত্রিকাগুলো থেকে জানা যায়, পাঁচ বছরে (২০১৪-১৮) ধর্ষণ, গণধর্ষণ, ধর্ষণের চেষ্টা এবং ধর্ষণজনিত হত্যার শিকার হয়েছে প্রায় ৪ হাজার নারী ও শিশু। ২০১৮ সালে ২৮ প্রতিবন্ধী শিশুসহ ৫৭১ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এ বছরের জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত ২৩৩ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এ সংখ্যাগুলো নথিভুক্ত মামলা থেকে প্রাপ্ত। প্রায়ই সামাজিক মান-মর্যাদা রক্ষা ও অপরাধীর হুমকি-ধমকির ভয়ে নিপীড়িতের পরিবার নির্যাতনের বিষয়ে মুখ খোলে না। 

রাজনৈতিক পরিসর, রাজনৈতিক কণ্ঠস্বর এবং অংশগ্রহণ সংকুচিত হলে বৈষম্য আরও বাড়ে। যেমন ঋণখেলাপির সংখ্যা বেড়েই চলছে। জবাবদিহির ব্যবস্থা না থাকায় ঋণখেলাপিদের পোষা হচ্ছে জনগণের করের টাকায়। 


প্রবৃদ্ধির উচ্চ হার দেখিয়ে রাজনৈতিক বাহবা অর্জন গতানুগতিক প্রবণতা। কিন্তু স্বল্পমেয়াদি লাভ দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতির কারণ হতে পারে। যেমন ক্রিকেটে বাংলাদেশ দলের জয়ের আনন্দে ‘গো টাইগার গো’ বলতে শোনা গেলেও আসল বাঘের আবাসস্থল ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে। সুন্দরবন থেকে মাত্র ১৪ কিলোমিটার দূরে রামপাল কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কথা তো সবারই জানা। সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরে নতুন বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র তৈরির পরিকল্পনা। গবেষণায় দেখা গেছে, ৫০ বছরের মধ্যেই সুন্দরবনের বাঘ বিলুপ্ত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। এগুলোকে প্রতিবেশ বা পরিবেশগত বিষয় হিসেবে বাক্সবন্দী করলে চলবে না। দীর্ঘ মেয়াদে ভাবতে হবে। জৈব এবং অজৈব উভয় ধরনের ভারসাম্য রক্ষা করা না গেলে স্থিতিশীল, টেকসই ও বজায় রাখার মতো উন্নয়ন সম্ভব নয়। 


প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে যাচ্ছে। আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠান যেমন ভাঙছে, তেমনি অনানুষ্ঠানিক—রীতি, রেওয়াজ, প্রথা ইত্যাদিও ভঙ্গুরমান। প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে গেলে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে না। মানুষের শ্রদ্ধাবোধ থাকবে না। রাষ্ট্রের জবাবদিহি ও ভারসাম্য থাকবে না। রাষ্ট্রের তিনটি অংশ, তথা আইন, বিচার ও নির্বাহী বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখতে হলে জবাবদিহির সংস্কৃতি দরকার। ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ বড় বাধা। সরকারি আয়-ব্যয়ের হিসাব, কর্মচারীদের দক্ষতার তদারকি প্রয়োজন। প্রকল্পগুলোর বরাদ্দ ও পরিবীক্ষণের পাশাপাশি আয়-ব্যয়ের জবাবদিহির বিষয়ে সঠিক তথ্য-উপাত্তও দরকার। 

রাষ্ট্রকে সর্বজনের এবং সর্বজনীন করতে রাজনৈতিক বন্দোবস্তের বড় রকম পরিবর্তন দরকার। অগ্রসরমাণ বাংলাদেশের জন্য ভিশন থাকতে হবে। আর এই ভিশন আসে দর্শন থেকে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় দর্শন গৌরবান্বিত মুক্তিযুদ্ধ দিয়েছে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার; তার সঙ্গে যোগ হয়েছে আন্তর্জাতিক আকাঙ্ক্ষা—‘কাউকে পেছনে না রাখা’। এই–জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়নই হতে পারে আগামীর অগ্রসর ও প্রগতিশীল বাংলাদেশ।

This post has already been read 17 times!

মন্তব্য করুন