April 20, 2024

http://www.ralphsteadmanartcollection.com/images/collections/DEMOCRACY%20MAZE.jpg

বাংলাদেশের রাজনীতির বর্তমান চালচিত্র, নির্বাচন, নাগরিকদের গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা, ‘উন্নয়ন বনাম গণতন্ত্র’ বিতর্ক এবং জঙ্গিবাদ বিষয়ে সাম্প্রতিক দেশকাল পত্রিকার আলতাফ পারভেজকে দেয়া সাক্ষাৎকারের পূর্ণ বিবরন। সাক্ষাৎকারটি সাম্প্রতিক দেশকালে দুই পর্বে প্রকাশিত হয়।

আপনি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কাটিয়েছেন, তখন সেখানে আদর্শবাদী রাজনীতির উত্তাল সময়। আপনি তার সক্রিয় একজন। ডাকসুর নেতা। মেধাবী ছাত্র। পরিশ্রমী সংস্কৃতি ও সাহিত্য সংগঠক। তারপরও দেশ ছেড়ে বহু দূরে কাটাচ্ছেন জীবনের কর্মমুখর সময়গুলো। কেন এত দূরে থাকা?

প্রশংসার জন্য ধন্যবাদ। আমি ঠিক এগুলোর যোগ্য নই। এটা ঠিক যে আমার জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ সময় কেটেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে। আমার ‘আমি’ হয়ে ওঠার পেছনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান অনেক। সেটা কেবল ক্লাসরুমের শিক্ষা অর্থে বলছি না। বারান্দা থেকে বটতলা, মধুর ক্যানটিন থেকে ছাত্রাবাসের কক্ষ সবকিছুই আছে। শিক্ষকদের দেখে শেখার চেষ্টা করেছি, তাদের জীবনাচরণ থেকেও শিখতে চেয়েছি। ছাত্রনেতাদের কাছ থেকে শিখতে চেয়েছি, ছাত্রকর্মীদের কাছ থেকেও। সেসব স্মৃতিকে সম্পদ বলে বিবেচনা করি। প্রবাসজীবন আসলে ভেবেচিন্তে বেছে নিইনি। অনেক দিন পর্যন্ত একে সাময়িক বলে ভেবেছি। এখনো মাঝেমধ্যে তা-ই মনে হয়। তবে প্রবাসে থাকার কারণে পড়ালেখার সুযোগ হয়েছে সেটা একটা প্রাপ্তি, সেটাকে কারণ বলতে পারেন। কাজের ক্ষেত্রে অনেক সুযোগ রয়েছে, সেটাও কারণ।

শিক্ষকতা, সাংবাদিকতাসহ বিভিন্ন পেশায় যুক্ত থেকেছেন এবং এখনো আছেন। কোনটা বেশি উপভোগ করেছেন?
নিক্তিতে মাপলে শিক্ষকতাই বলতে হবে। শিক্ষকতার জীবন ছেড়ে দ্বিতীয় দফায় সাংবাদিকতায় এসেছিলাম ১৯৯৫ সালে; কিন্তু সেটাও পাঁচ বছর পরে নিজের সিদ্ধান্তেই ছাড়লাম। শিক্ষকতার জীবনে গবেষণার যে সুযোগ, সেটা একটা বড় কারণ শিক্ষকতা জীবনে ফিরে আসার। আরেকটা হলো, প্রতিনিয়ত নতুন ভাবনার সান্নিধ্যে থাকা। আমি যখন ক্লাসে যাই, তখন দেখি একগুচ্ছ তরুণ বসে আছে। আমার বয়স বাড়ে, কিন্তু শিক্ষার্থীদের বয়স বাড়ে না। তখন একধরনের তারুণ্য অনুভব করি, নিজেকেও ওদের মতোই মনে হয়। আরেকটা হলো প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়ার সুযোগ- শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন, সহকর্মীদের প্রশ্ন, একাডেমিক সম্মেলনে অন্যদের প্রশ্ন। এগুলো নতুন করে ভাবতে শেখায়, নতুন বিষয়ে আগ্রহী করে।

বাংলাদেশের সমাজ আপনার অজানা নয়। নিয়মিতই নজর রাখছেন। লিখছেন। দেশটি স্বাধীনতার চার দশক পরও গণতন্ত্র ও সুশাসনের সংকটে হাবুডুবু খাচ্ছে। এর কারণ কী বলে মনে হয় আপনার কাছে? কোথায় ভুল হলো আমাদের? কখন?
এটি বাংলাদেশের রাষ্ট্রগঠন প্রক্রিয়ার অসম্পূর্ণতার লক্ষণ। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছে, কিন্তু রাষ্ট্রগঠনের অনেক দিক থেকেছে অনালোচিত, অপূর্ণ। আমরা কোন ধরনের রাষ্ট্র চাই, গণতন্ত্র বলতে কী বুঝি, রাষ্ট্রের ধরন কী হবে- এই নিয়ে আলোচনার সুযোগ হলো না। সংবিধান তৈরি হলো বটে, কিন্তু যেকোনো সংবিধানের প্রথম পাঠ যেমন হয়, ঠিক তেমনিভাবে বাংলাদেশের সংবিধানও অসম্পূর্ণ। একটা ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রকাঠামো উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া গেল, সেটাকে দিয়ে দেশ শাসনের কাজ শুরু হলো। কোথাও কোনো সংস্কার হলো না। শুধু তা-ই নয়, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিঃশেষ করে ফেলা হলো। জবাবদিহির ব্যবস্থা তো তৈরি হলোই না, উপরন্তু সেগুলোর মধ্যে যতটুকু পেশাদারিত্ব ছিল, সেটাও ছুড়ে ফেলে দেওয়া হলো। সংবিধানের ভেতরে ব্যক্তির ছায়া বিশাল। সমাজে যে ধরনের সম্পর্ক- আমি আর আপনি সমান নই- যাকে বলে পেট্রন-ক্লায়েন্ট সম্পর্ক, সেটাই আছে রাষ্ট্রের মধ্যে, সংবিধানের ভেতরে। রাষ্ট্র মানে যেমন কিছু প্রতিষ্ঠান, ঠিক তেমনিভাবে এটি আদর্শিক আধিপত্য তৈরির এজেন্সিও। কিন্তু এই রাষ্ট্রের আদর্শের প্রশ্নটা কথার কথা ছাড়া আর কীভাবে আলোচিত হয়েছে, বলতে পারেন? ফলে আমরা যে স্বৈরতন্ত্র দেখছি, কর্তৃত্ববাদী শাসন- সামরিক স্বৈরাচার, বেসামরিক স্বৈরাচার- দেখছি সেগুলোর উৎস এখানে।

এদেশের মানুষ সংসদীয় গণতন্ত্রের জন্য দৃষ্টিগ্রাহ্য সংগ্রাম করেছে। কিন্তু বর্তমান বাংলাদেশে সংসদ আর রাষ্ট্র পরিচালনার নীতিনির্ধারণী কেন্দ্র নয়। আপনার কি মনে হয় মানুষ গণতন্ত্রের প্রশ্নে হাল ছেড়ে দিয়েছে? কিংবা এখানকার সমাজ গণতন্ত্রের জন্য উপযোগী নয়?
মানুষের মধ্যে গণতন্ত্রের জন্য আকাক্সক্ষা আছে। আমার এই ধারণা বদলানোর মতো অবস্থা হয়নি। কিন্তু নাগরিকেরা দেখেছেন ১৯৯০ সালের পর গণতন্ত্রের নামে না প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্র হয়েছে, না মানুষের অধিকারের নিশ্চয়তা হয়েছে। সেটা একটা বিরাজনৈতিকীকরণের পরিবেশ তৈরি করেছে। এখন সেই সুবিধা পাচ্ছে বা নিচ্ছে ক্ষমতাসীনেরা। তার সঙ্গে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির ভুল-ত্রুটি তো আছেই। কৌশলের ভুল আছে, নীতির ভুল আছে, সাংগঠনিক ভুল আছে। কিন্তু আমার প্রশ্ন তো অন্য যেসব বিরোধী দল তাদের কাছে। বিএনপির ভুলের মাশুল আপনারা দিচ্ছেন কেন? আপনারা কেন নাগরিকের অধিকারের প্রশ্নে একাট্টা হতে পারছেন না? মানুষ হাল ছেড়ে দিয়েছে বলে তো মনে হয় না। ‘গণতন্ত্রের জন্য উপযোগী সমাজ’ বলে তো আলাদা কোনো সমাজ নেই, তাই না? ‘এখানকার সমাজ আদৌ গণতন্ত্রের জন্য উপযোগী নয়’- এই ধরনের কথা বলে স্বৈরাচারী শাসকেরা। সে কারণে তারা গণতন্ত্রের আগে-পরে বিশেষণ বসিয়ে একটা কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থা বহাল রাখতে চায়। আইয়ুব খানের কথা স্মরণ করুন, ‘বুনিয়াদি গণতন্ত্র’ বলে একটা ব্যবস্থা চালু করতে চেষ্টা করেছিলেন, আংশিক সফলও হয়েছিলেন। গণতন্ত্রের চেয়ে উন্নয়ন বড় বলে একটা কথা চালু করে দিয়ে ১৯৬৮-৬৯ সালে এসে ‘উন্নয়নের দশক’ পালন করেছিলেন। পশ্চিমা বিশ্বে একশ্রেণীর দক্ষিণপন্থী বিশ্লেষক অনেক দিন ধরেই বলেন, মুসলিম জনগোষ্ঠী গণতন্ত্রের জন্য প্রস্তুত নয়। তারা এগুলো বলে উত্তর আফ্রিকা ও পশ্চিম এশিয়া- যাকে আমরা মধ্যপ্রাচ্য বলি- সেখানে স্বৈরতন্ত্রকে সমর্থন দিয়েছেন। দীর্ঘ মেয়াদে তার পরিণতি তো ভালো হয়নি। অন্যদিকে, ঊনবিংশ শতাব্দীতে দক্ষিণ আফ্রিকা, কম্বোডিয়া কিংবা চিলি সম্পর্কেও এমন কথা বলা হতো।

দেশ থেকে দূরে থাকলেও আপনি নিশ্চয়ই জানেন দুর্নীতি কত সর্বগ্রাসী বাংলাদেশে। অতীতেও তা ছিল এবং ক্রমে তা বাড়ছে। এটা কী বাংলাদেশকে ক্রমে ব্যর্থ রাষ্ট্রের দিকে নিয়ে যাচ্ছে না?
এককভাবে দুর্নীতি বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করবে না; তবে হ্যাঁ, রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের যে সক্ষমতা বা ক্যাপাসিটি, সেটাকে ভয়াবহভাবে দুর্বল করে ফেলছে; এটা অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়। আপনি যদি এর দূরপ্রসারী প্রভাব ভাবেন, তবে হয়তো আপনি এভাবে দেখতেও পারেন। দুর্নীতির সর্বগ্রাসী রূপ সত্ত্বেও তা থেকে সুবিধা পায় একটি বিশেষ শ্রেণী। বাংলাদেশে সেই শ্রেণী হচ্ছে তারাই, যারা ক্ষমতাসীনদের অনুগত। সেই অংশটা খুব বড় এমন নয়। তাদের মধ্যে কলহের স্থানীয় রূপ আমরা প্রতিদিন দেখি। খবরের পাতা খুললেই দেখবেন। কিন্তু এতে যারা ন্যূনতম সুবিধা থেকে বঞ্চিত, তাদের মধ্যে একধরনের ক্ষোভ তৈরি হচ্ছে। সেই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ সহিংসভাবেও হতে পারে। সহিংস উগ্রপন্থার অনুসারীরা অন্যদের কাছে আবেদন তৈরি করতে পারবে কেননা তারা ওই সুবিধাবঞ্চিত। আরেকটা দিক হচ্ছে, দুর্নীতির কারণে রাষ্ট্রের ডেলিভারি ক্যাপাসিটি হ্রাস পাবে। তখন রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করা সহজ হবে। এসব বিবেচনায় মধ্য ও স্বল্প মেয়াদে দুর্নীতির ক্ষতি কেবল আর্থিক নয়, রাষ্ট্রের টিকে থাকার সঙ্গে জড়িত।

সম্প্রতি দেশে অনেকে বলছেন, গণতন্ত্র না থাকলেও চলে, যদি উন্নয়ন হয়, মানুষের আয় বাড়ে। আপনার কি মনে হয়…গণতন্ত্র ও উন্নয়ন…একটাই বেছে নিতে হবে আমাদের?
অবশ্যই না। এই নিয়ে অনেক যুক্তি আছে। প্রথমত উন্নয়ন আর আয় বৃদ্ধি এক কথা নয়। গড় আয় বাড়লেই বৈষম্য কমবে এমন তো নয়। বাংলাদেশে কথিত উন্নয়ন হচ্ছে তার পরও বৈষম্য বাড়ছে। আপনি যদি উন্নয়নের কথা বলেন, উন্নয়ন মানে কি কেবল প্রবৃদ্ধি? উন্নয়ন তো বহুমাত্রিক বিষয়। তার মধ্যে মানবোন্নয়নের প্রশ্নকে বাদ দেওয়া যাবে না। মানুষের মৌলিক অধিকারকে বাদ দিয়ে মানবোন্নয়ন হয় না। ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে বাদ দিয়ে কার উন্নতির কথা বলা হচ্ছে, সেটা ভাবতে হবে। আমার মনে হয় না এই যুক্তিটা ধোপে টেকে।
দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের উদাহরণ অন্য রকম। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত গণতন্ত্র ছাড়া যে অবস্থা দেখলাম, সে সময়ে প্রবৃদ্ধির হার তো কম। বরং ১৯৯০ সালের পর আমরা দেখতে পাই প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র প্রবৃদ্ধির ভিত্তি তৈরি করছে। আজ যতটা সাফল্য দেখা যাচ্ছে, সেটা গত এক-দুই বছরের নয়, আগে থেকে ধীরে ধীরে তৈরি হয়েছে।
তৃতীয়ত, এখন পর্যন্ত গণতন্ত্রকে বাদ দিয়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের সাফল্য যতটা আছে এর বিপরীতে উদাহরণ আছে অনেক বেশি। যে ক্ষেত্রগুলোতে গণতন্ত্রকে বাদ দিয়ে উন্নতি অর্জনের চেষ্টা হয়েছে তার পরিণতি ভালো হয়নি। এ বিষয়ে প্রণব বর্ধনের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, উন্নয়নের জন্য কর্তৃত্ববাদ প্রয়োজনীয় পূর্বশর্ত নয়। তিনি এ প্রসঙ্গে পূর্ব ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার উদাহরণ দিয়েছেন। তা ছাড়া তিনি বলছেন, হাইতি, ডমিনিক্যান রিপাবলিক, নিকারাগুয়া, জায়ারের উদাহরণ হচ্ছে স্বৈরাচারী ব্যবস্থা উন্নয়নের নিশ্চয়তা নয়। খুব পদ্ধতিগতভাবে যেসব গবেষণা হয়েছে, যেমন এডাম প্রেজরস্কির গবেষণা, সেখানে রাজনৈতিক অধিকার ও অর্থনৈতিক সাফল্যের মধ্যে বিরোধ আছে, তা প্রমাণিত হয়নি। আমরা এমনকি নাইজেরিয়াতেও দেখলাম ভোটাররা গত বছর ‘গণতন্ত্র বাদ দিয়ে উন্নয়নের তত্ত্ব’কে প্রত্যাখ্যান করেছে। গণতন্ত্র বাদ দিয়ে প্রবৃদ্ধির জন্য খ্যাত মধ্যপ্রাচ্যে কী ঘটেছে, তা-ও দেখুন।
যেসব দেশে গণতন্ত্র বাদ দিয়ে ‘উন্নয়নের সাফল্য’ হয়েছে দাবি করা হচ্ছে, সেখানকার শাসনের দিকটা আপনাকে বিবেচনায় নিতে হবে। সেখানে দুর্নীতি নির্মূলের সাফল্য আছে, পেশাদারি জনপ্রশাসন তৈরি হয়েছে, আইনের শাসন আছে, স্বাধীন বিচার বিভাগ আছে, দলতন্ত্র নেই, পরিবারতন্ত্র নেই, বিরোধীদের কো-অপশনের পদক্ষেপ আছে, উগ্র বলপ্রয়োগের লাগামহীন উদাহরণ নেই। কিন্তু এগুলো বাদ দিয়ে আপনি এই তত্ত্ব নিয়ে হাজির হলে হবে না। এসব কথা এ দেশে পুরোনো। পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসকেরা বলতেন।
চতুর্থত, মুক্তিযুদ্ধের যে উদ্দেশ্য স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার- তার সঙ্গে এই বক্তব্য কি সাংঘর্ষিক নয়? একদিকে বলবেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা, অন্যদিকে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের প্রতিশ্রুতিকে অবজ্ঞা করবেন, সেটা কী করে সম্ভব?
এ ছাড়া গণতন্ত্র তো কেবল একগুচ্ছ প্রতিষ্ঠান নয়, কেবল নির্বাচন নয়, গণতন্ত্র একটা মূল্যবোধ। ১৯৯৯ সালে জার্নাল অব ডেমোক্রেসিতে অমর্ত্য সেনের একটা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। সেখানে তিনি বলেছেন, মানুষের রাজনৈতিক স্বাধীনতা হচ্ছে মানবিক মুক্তির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তিনি আরও বলেছেন, মানুষের মানবিক জীবন ভালো থাকার একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের চর্চা। ফলে রাজনৈতিক জীবনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত রাখা বড় ধরনের এক বঞ্চনা।

অনেকে এ-ও বলেন, সংবিধানের সর্বশেষ পরিবর্তিত দশায় শান্তিপূর্ণভাবে জনগণের মতামতের ভিত্তিতে ক্ষমতার পালাবদলের আর সুযোগ নেই। সংবিধানের সর্বশেষ সংশোধনী কি আমাদের জন্য কোনো রাজনৈতিক বিপদ তৈরি করেছে বলে আপনার মনে হয়?
আক্ষরিক দিক থেকে দেখলে আপনি হয়তো এই রকম একটা উপসংহারে পৌঁছাতে পারবেন। আমি মনে করি, ‘শান্তিপূর্ণভাবে জনগণের মতামতের ভিত্তিতে ক্ষমতার পালাবদলের’ বিষয়টি এখনো নির্ভর করেছে ক্ষমতাসীন দলের ওপর। আবার এ কথাও ঠিক-ক্ষমতাসীন দল সবার অংশগ্রহণের মতো নির্বাচন চায় না। স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনগুলো, যেখানে সবাই অংশ নিয়েছে সেগুলো দেখলেই সেটা বোঝা যায়।
কিন্তু ১৯৯০ সালের সংবিধানের মধ্যেও ক্ষমতার হাতবদলের পথ ছিল না, কিন্তু অবস্থার তাগিদে একটা সাময়িক ব্যবস্থা তৈরি করা হয়েছিল। ১৯৯৫ সালে সংসদ থেকে বিরোধী দলের পদত্যাগের পর সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থা যুক্ত করার উপায় ছিল না, কিন্তু একটা অনাকাক্সিক্ষত পথে সেটা তৈরি হয় ১৯৯৬ সালে। ২০০৭ সালের গোড়াতেও মনে হচ্ছিল আর কোনো উপায় নেই। এই উদাহরণগুলো জানিয়ে দেয়, চাইলে আপনি একটা পথ বের করতে পারেন। আবার এই উদাহরণগুলো এ-ও বলে যে, তার পরিণতি সব সময় ভালো হয় না। ক্ষমতাসীনেরা এসব ক্ষেত্রে যত বেশি সময় নিয়েছে, ক্ষতি হয়েছে তত বেশি। এরপর হচ্ছে জনগণের ক্ষমতার প্রশ্নটি। জনগণের অভিপ্রায় হচ্ছে সংবিধান। এটা কোনো ‘ডিভাইন ডকুমেন্ট’ নয়। ফলে জনগণের অভিপ্রায় যদি ভিন্ন রকম হয়, তা বাস্তবায়িত হবে।

এখানে সমাজে এমন একটা হতাশা রয়েছে, অদূর ভবিষ্যতে আর সবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন না-ও হতে পারে। এরূপ হতাশা কি যথার্থ?
এখন পর্যন্ত এই আশঙ্কার বাস্তব ভিত্তি আছে। কিন্তু সেটাকে চূড়ান্ত মনে করতে আমি নারাজ। আমি এখনো মনে করি সবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের বিকল্প নেই। যার বিকল্প নেই, সেটা আপনি কেবল কিছু সময়ের জন্য ঠেকিয়ে রাখতে পারেন। যদি সেটাকে স্থায়ী করতে চেষ্টা করেন তবে এর চেয়েও খারাপ বিকল্পের দিকে আপনি দেশকে ঠেলে দেবেন।

আপনি ইদানীং বলছেন, বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের সুস্পষ্ট সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। কী ধরনের প্রমাণ দেখে এরূপ অভিমত দিচ্ছেন?
জঙ্গিবাদের সম্ভাবনা নতুন কিছু নয়। আপনি যদি জঙ্গিবাদ বলতে উগ্র চরমপন্থা বোঝান, তবে সেটা অনেক দিন ধরেই আছে। এর একটা রূপ ছিল বামপন্থী চরমপন্থা, তার অবশিষ্টাংশ এখনো আছে। আপনি যদি ইসলামপন্থী উগ্র চরমপন্থা, সাধারণ কথোপকথনে যাকে ‘জঙ্গি’ বলা হয়, তাকে নির্দেশ করেন, তাও অনেক পুরোনো। আমি বিভিন্ন আলোচনায় বিশেষ করে ২০০৮ সালে প্রকাশিত বই ইসলামিস্ট মিলিট্যান্সি ইন বাংলাদেশ : আ কমপ্লেক্স ওয়েব বইয়ে দেখিয়েছি, ১৯৯০-এর দশকের গোড়াতেই এ দেশে উগ্র ইসলামপন্থীদের উত্থান ঘটে এবং তার উৎস হচ্ছে আফগানিস্তান ও পাকিস্তান। অন্যত্র আমি দেখিয়েছি, ১৯৯৭-৯৮ সালে এই ধরনের যোগাযোগ আরও বিস্তৃত হয়। ফলে এটা সাম্প্রতিক ঘটনা নয়।
প্রশ্ন হলো, কোনো দেশে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠন তার প্রভাব বিস্তারের সুযোগ কখন পায়? যখন দেশের ভেতরে অনুকূল পরিবেশ থাকে। বাংলাদেশে সেই অবস্থা বিরাজ করছে। এখানে আগে থেকে জঙ্গি সংগঠন উপস্থিত আছে, সামান্য হলেও সমর্থন আছে, সাংগঠনিক কাঠামো উপস্থিত, সহিংসতা মূলধারার রাজনীতির বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে, সংবিধানিক শক্তিগুলোর জায়গা সংকুচিত হচ্ছে, ভিন্নমত প্রকাশের পথ সীমিত হচ্ছে, সমাজে অসহিষ্ণুতা বাড়ছে, যার মধ্যে ধর্মবিষয়ক অসহিষ্ণুতা অন্যতম। এগুলো অভ্যন্তরীণ অনুকূল পরিবেশ।
আন্তর্জাতিকভাবে পরিবেশ যে অনুকূল, সেটা ব্যাখ্যার দরকার আছে বলে মনে হয় না। বাংলাদেশে দুই ধরনের মানুষ এর সঙ্গে যুক্ত হতে চাইছে। প্রথমত, যারা ইতিমধ্যে এই ধরনের দেশীয় সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত, তারা চায় আন্তর্জাতিকভাবে সমর্থন পেতে, সাহায্য পেতে, প্রচার পেতে। দ্বিতীয়ত হচ্ছে, মধ্যবিত্ত সমাজের শিক্ষিত তরুণেরা। তারা এখন এসব চরমপন্থার আদর্শে উজ্জীবিত হচ্ছে, কারণ তারা সমাজে নিজেদের বিচ্ছিন্ন ভাবেন। এগুলো হচ্ছে পরিবেশ, যা আপনাকে দেখিয়ে দিচ্ছে এটা সম্ভব এবং কারা করবে। তারপর আপনি দেখেন ইদানীং আক্রমণের প্রকৃতিগুলো। শিয়াদের ওপরে হামলা, পুলিশের ওপর হামলা, আত্মঘাতী বোমা হামলা- এগুলো হচ্ছে লক্ষণ। যদিও এখন সরকার বলছে দেশে আইএস নেই, কিন্তু কিছুদিন আগে পর্যন্ত কিন্তু সরকার বলেছে তারা আইএসের লোকজনদের আটক করছে।

এও কি সত্য নয়, জঙ্গিবাদের অজুহাতে রাজনৈতিক ভিন্নমত দলনের দৃষ্টান্ত দেখা যায়?
এটা অবশ্যই সত্য। আপনার নিশ্চয় মনে থাকবে, ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের পরে দেশে দেশে একানায়কেরা তাদের অভ্যন্তরীণ প্রতিপক্ষ ও বিরোধীদের দমনে ‘আল-কায়েদা’র জুজু ব্যবহার করেছে। মধ্য-এশিয়ার দেশগুলো সেই অবস্থা থেকে এখনো বেরোতে পারেনি। বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে সরকার ও ক্ষমতাসীন দল একই ধরনের কৌশল নিয়েছে এবং বিরোধী মত দমনে জঙ্গিবাদকে ব্যবহার করেছে।
জঙ্গিবাদের প্রশ্নটি জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন। দলীয়ভাবে তার ব্যবহার ও রাজনৈতিক বিবেচনায় তার ব্যবহার দেশের নিরাপত্তার জন্য ভয়াবহ রকমের ক্ষতিকর। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা সেটা প্রত্যক্ষ করেছি। সরকারবিরোধীদের নির্বিচারভাবে জঙ্গি বলার মধ্য দিয়ে এখন জঙ্গিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ অংশত প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল, ২৫ ফেব্রুয়ারি এবং ৩ মার্চ ২০১৬

Leave a Reply