March 28, 2024

বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান ধর্ষণের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় সংসদে মঙ্গলবার এই বিষয়ে আলোচনায় পাঁচজন সংসদ সদস্য যে ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন এবং এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় যে প্রতিকারের কথা বলেছেন, তার তাৎপর্য কেবল আলোচিত বিষয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। তাঁদের বক্তব্য দেশের বিরাজমান শাসনব্যবস্থা, আইনের শাসন এবং বিচারব্যবস্থার বিষয়কে সামনে নিয়ে এসেছে। ধর্ষণের ঘটনা মোকাবিলায় এই পাঁচজন সদস্য অভিযুক্তদের বিনা বিচারে হত্যা করার দাবি জানিয়েছেন। তাঁরা এই বিনা বিচারে হত্যার কৌশল হিসেবে ‘গুলি করে মেরে ফেলার’ কথা বলেছেন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ, একসময়ে একই সরকারের অংশগ্রহণকারী দল জাতীয় পার্টির সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ বলেছেন, সমাজকে ধর্ষণমুক্ত করতে ‘এনকাউন্টার মাস্ট’। তিনি এবং মুজিবুল হক প্রস্তাব করেছেন যে ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্তদের ‘এনকাউন্টারে’ মেরে ফেলা হোক। তাঁদের এই বক্তব্যকে সমর্থন করে বক্তব্য দিয়েছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অন্যতম জ্যেষ্ঠ নেতা তোফায়েল আহমেদ এবং ওই দলের আরেকজন সদস্য। তা ছাড়া, তরীকত ফেডারেশনের নেতা নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী বলেছেন, ‘আমি টুপি–দাড়ি মাথায় নিয়ে আল্লাহকে হাজির নাজির জেনে বলছি, এদের ক্রসফায়ার করলে বেহেশতে যাওয়া যাবে, কোনো অসুবিধা নাই (বিডিনিউজ২৪, ১৪ জানুয়ারি ২০২০)।’

জাতীয় সংসদে এই প্রথমবারের মতো ক্রসফায়ারে কথিত অপরাধীকে হত্যার পক্ষে বলা হলো, তা নয়। ২০১৬ সালেও একই ধরনের দাবি করেছিলেন কাজী ফিরোজ রশীদ। ২৭ সেপ্টেম্বর নারী ও শিশু নির্যাতনকারীদের বিচারের আওতায় না নিয়ে ক্রসফায়ারে গুলি করে মেরে ফেলার দাবি করেছিলেন তিনি। কিন্তু মঙ্গলবারের এই আলোচনার গুরুত্ব আগের চেয়ে বেশি এই কারণে যে, ওই সময় এই বক্তব্যের জবাবে ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়া বলেছিলেন, ‘দিস গভর্নমেন্ট ডাজ নট বিলিভ ইন ক্রসফায়ার (এ সরকার ক্রসফায়ারে বিশ্বাস করে না)’ (প্রথম আলো, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬)। সরকার ক্রসফায়ারে বিশ্বাস করে কি না, সেটা তাদের কাজেই প্রমাণিত—২০১৫ সালে বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছিলেন ১৮৬ জন, ২০১৬ সালে ১৭৮ জন। এই রেকর্ড সত্ত্বেও, অন্ততপক্ষে ডেপুটি স্পিকার এই ধরনের বক্তব্যের সঙ্গে কণ্ঠ মেলাননি। দ্বিতীয় গুরুত্ব হচ্ছে যে সেই সময়ে ফিরোজ রশীদকে সমর্থন করার জন্য ক্ষমতাসীন দলের কোনো সদস্যই এগিয়ে আসেননি; এবার আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের একজন নেতাও তাঁকে সমর্থন করেছেন। আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে ইশতেহারে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ক্ষমতায় গেলে তারা বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধ করবে। ২০১৪ বা ২০১৮-এর নির্বাচনী ইশতেহারে এমন কোনো প্রতিশ্রুতি আওয়ামী লীগ দেয়নি; অবশ্য এই দুই নির্বাচনে প্রতিশ্রুতি দেওয়া না দেওয়ায় কিছু যায়-আসে কি না, সেটাও প্রশ্ন। 

গত ১০ বছরে দেশে কমপক্ষে ১ হাজার ৯২১ জন এই ধরনের হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। সরকার এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বারবার বলে যে কাউকেই বিনা বিচারে হত্যা করা হচ্ছে না, অথচ ‘বন্দুকযুদ্ধ’ এবং ‘এনকাউন্টারের’ কাহিনি প্রতিদিন সরকারি বরাতেই ছাপা হয়। এগুলোকে এখন স্বাভাবিক ঘটনা বলেই বিবেচনা করা হয়। সরকার সমর্থকদের অনেকে, এমনকি যাঁরা বিশ্বের অন্যত্র মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে, টেলিভিশনে বিস্তর বেদনা প্রকাশ করেন, তাঁরাও এই ধরনের হত্যাকাণ্ডকে অকুণ্ঠ চিত্তে সমর্থন করেন। ক্ষেত্রবিশেষে কাকে কখন ‘ক্রসফায়ারে দেওয়া উচিত’ সেই পরামর্শও দেন। তাঁদের সেই কথাগুলো কথার কথা নয়, কিন্তু তার গুরুত্ব অবশ্যই সংসদের অভ্যন্তরে সংসদ সদস্যদের দেওয়া বক্তব্যের চেয়ে কম।

অতীতে সংসদের বাইরে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা এই ধরনের হত্যাকাণ্ডের পক্ষে কথা বলতে দ্বিধা করেননি। দেশে ক্রসফায়ারের পক্ষে ২০১৪ সালেই বলেছিলেন তৎকালীন মন্ত্রী শাজাহান খান। বিবিসির বাংলাদেশ সংলাপে তিনি বলেছিলেন, ‘ক্রসফায়ার গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে’ (বিবিসি বাংলা ৬ মার্চ ২০১৪)। ২০১৫ সালে এসে তিনি এর পক্ষে সাফাই গিয়েছিলেন (বিবিসি বাংলা, ২২ আগস্ট ২০১৫)। 

কার্যত একদলীয় জাতীয় সংসদে সদস্যরা, বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা যখন ক্রসফায়ারের পক্ষে সরব হন, তখন তা উদ্বেগজনক। এই ধরনের বক্তব্য আনুষ্ঠানিকভাবে সংবিধান এবং আইনের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন। বাংলাদেশের সংবিধানে বলা আছে যে ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী’ (২৭ অনুচ্ছেদ); বলা হয়েছে যে, ‘আইনের আশ্রয়লাভ এবং আইনানুযায়ী ও কেবল আইনানুযায়ী ব্যবহার লাভ যেকোনো স্থানে অবস্থানরত প্রত্যেক নাগরিকের এবং সাময়িকভাবে বাংলাদেশে অবস্থানরত অপরাপর ব্যক্তির অবিচ্ছেদ্য অধিকার এবং বিশেষত আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাইবে না, যাহাতে কোনো ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে’ (অনুচ্ছেদ ৩১)। ‘আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তি-স্বাধীনতা হইতে কোন ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাইবে না (অনুচ্ছেদ ৩২)। এই সংবিধানকে সমুন্নত রাখাই হচ্ছে সংসদ সদস্যদের কাজ। এখন তাঁরাই যখন এই ধরনের দাবি তোলেন—একজন নয়, একাধিক; তখন আমাদের বুঝতে হবে যে সংবিধানের অনেক কিছুই এখন আর ক্ষমতাসীনদের নিয়ন্ত্রণ করে না। এগুলো আইনের শাসনের অনুপস্থিতিরই লক্ষণ নয়, ভবিষ্যতের জন্য ইঙ্গিতও বটে।

যেকোনো দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার অন্যতম শর্ত হচ্ছে আইনের চোখে নাগরিকের সমতা এবং সবার বিচার পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করা। রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়ার ইতিহাস বলে যে এই অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যই আইন এবং বিচার বিভাগের উদ্ভব হয়েছে। প্রজাতন্ত্র বা রিপাবলিক যে অন্য ব্যবস্থাগুলো থেকে ভিন্ন হয়ে উঠল, তার একটি অন্যতম লক্ষণ হচ্ছে এই দিকটি। সংবিধান সেই নিশ্চয়তা দেয় বলেই তা সবার জন্য সমভাবে প্রযোজ্য। তা কেবল রাজার ইচ্ছে নয়, নাগরিকের রক্ষাকবচ। রাষ্ট্রের আইনি এবং নৈতিক বৈধতার ভিত্তি এখানেই। কিন্তু যখন কোনো সংবিধান তা থেকে দূরে সরে যায়, তখন তা আর সবার কাছে বৈধতা দাবি করতে পারে না। 

যে ব্যবস্থায় আইন নাগরিকের সমতার ধারণাকে অস্বীকার করে, তা আর গণতান্ত্রিক বলে বিবেচিত হতে পারে না। যে ব্যবস্থা নাগরিকের বিচারের নিশ্চয়তা দেয় না, অভিযুক্তকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেয় না, তা কেবল ন্যায়বিচারের পরিপন্থী বা অমানবিক নয়, তা প্রকৃতপক্ষে বিচার নয়; কেবল প্রতিহিংসা বাস্তবায়ন। প্রতিহিংসা কেবল যে ব্যক্তির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে, তা নয়। রাষ্ট্রও প্রতিহিংসাপরায়ণ হতে পারে। ব্যক্তি এবং গোষ্ঠী রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে এই প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে পারে। এমনকি যখন সবচেয়ে ভয়াবহ অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্তের বিরুদ্ধেও রাষ্ট্র প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ওঠে, তবে বুঝতে হবে এই রাষ্ট্রকাঠামো বিষয়ে চিন্তা জরুরি। 

জাতীয় পার্টির নেতা যে আইনের প্রয়োগের চেয়ে বেশি শাস্তি প্রদানেই আগ্রহী, তার প্রমাণ—একাধিকবার তিনি বিচারবহির্ভূত হত্যাকে সমাধান হিসেবে বলেছেন। তদুপরি তিনি মঙ্গলবার খোলাসা করে বলেছেন—কাজী ফিরোজের পাশ থেকে একজন সাংসদ আইন করার কথা বলেন। ফিরোজ রশীদ বলেন, ‘আইন লাগে না। পুলিশের আইন আছে তো। মাদকের আসামি পরশু দিনও মারা হয়েছে, কোন আইনে মারা হয়েছে?’ (প্রথম আলো, ১৪ জানুয়ারি ২০২০) একজন সংসদ সদস্য বলেছেন যে ‘আইন লাগে না’। একার্থে তিনি যে সত্য কথাই বলেছেন। মাদকের বিরুদ্ধে অভিযানের সময় কিংবা তার আগে থেকেই আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলে আসছে যে আইনের বাইরে গিয়েই মাদক নিয়ন্ত্রণ অভিযান হচ্ছে। 

যাঁরা এই ধরনের হত্যাকাণ্ডের পক্ষে বলেন, তাঁদের একটি বড় যুক্তি হচ্ছে, আইন ও বিচারব্যবস্থার ত্রুটির কারণে অপরাধীরা বেরিয়ে আসে; তাঁদের বক্তব্য থেকে মনে হয় যেন আইন-আদালতের ত্রুটি সারানোর চেয়ে ‘জুরি-জাজ-এক্সিকিউশনার’ সবটাই তাঁরা এক হাতে তুলে দিতে চান। কিন্তু তাতে আদৌ যে কোনো রকম ফল হয় না, তার প্রমাণ দেশে-বিদেশে অনেক। কাছের উদাহরণ হচ্ছে মাদকবিরোধী অভিযান। গত বছরেই ১৮৭ জনকে হত্যা করা হয়েছে। এই সংখ্যাসহ ২০১৯ সালে মোট ৩৮৮ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। মাদকের ব্যবসা বা ব্যবহার হ্রাস পেয়েছে—এমন প্রমাণ কেউ দিতে পারবেন না। আর সেটা আমাদের সবার জানাও ছিল (আলী রীয়াজ, ‘নির্বিচার “বন্দুকযুদ্ধ” ফল দেবে না’, প্রথম আলো, ২২ মে ২০১৮)। 

এই সব হত্যাকাণ্ড অতীতে আদালতের দেওয়া নির্দেশনারও বরখেলাপ। এক দশক আগের দুটো উদাহরণ মনে করা যায়। ২০০৯ সালের ২৯ জুন হাইকোর্ট ক্রসফায়ার কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না এবং কেন এ ধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তির বিরুদ্ধে বিভাগীয় ও ফৌজদারি কার্যক্রম গ্রহণের আদেশ দেওয়া হবে না, এই মর্মে সরকারের প্রতি রুল জারি করেছিলেন। ১১ নভেম্বর হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আরেকটি আদেশ দিয়েছিলেন। এগুলোর কোনো ফল হয়নি। 

আইন-আদালত-সংবিধানের বাইরেও এই ধরনের কথাবার্তা, আইনবহির্ভূত হত্যার প্রভাব হচ্ছে অপরিসীম। আইনের তোয়াক্কা না করার এই প্রবণতাই যে ছাত্রলীগ কর্মী এবং ক্যাসিনো সম্রাটদের নিজস্ব ‘টর্চার সেল’ গড়ার অনুপ্রেরণা জোগায়, সে কথা অস্বীকারের সুযোগ কই? ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে ‘নির্বাচিত’ আইনপ্রণেতাদের এই সব কথাবার্তা এবং রাষ্ট্রের এই আচরণের পেছনে আছে জনগণের কাছে দায়বদ্ধতার অভাব, জবাবদিহির বাধ্যবাধকতার অনুপস্থিতি। সেটা মনে রাখা জরুরি। 


প্রথম আলো, ১৬ জানুয়ারি ২০২০

Leave a Reply