This post has already been read 14 times!
সিরিয়ার রাসায়নিক অস্ত্র-বিষয়ক সংকট মোচনে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকলেও, তার চূড়ান্ত পরিণতি কী হবে তা এখনও নিশ্চিত করে বলা অসম্ভব। ইংরেজিতে চালু একটা কথা হচ্ছে– ‘শয়তান লুকিয়ে থাকে বিস্তারিতের মধ্যে’। এ ক্ষেত্রেও আমরা বলতে পারি যে, প্রস্তাবের বিস্তারিত বর্ণনা এবং তা বাস্তবায়নের পদ্ধতির প্রশ্নেই ভিন্নমতের অবকাশ রয়েছে। তার কিছু লক্ষণ আমরা ইতোমধ্যেই দেখতে পেয়েছি। তদুপরি হোয়াইট হাউসের পক্ষ থেকে বুধবার বলা হয়েছে সিরিয়া বিষয়ে যে চুক্তিই শেষ পর্যন্ত হোক না কেন, তাতে রাসায়নিক অস্ত্র বাশার আল আসাদের নিয়ন্ত্রণে নেই সেটা যাচাই করার ব্যবস্থা থাকতে হবে।জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের মাধ্যমে সিরিয়ার রাসায়নিক অস্ত্র বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা এবং সিরিয়ার সম্মতির ব্যাপারে যারা আশাবাদী তারা এটা জোর দিয়ে বলছেন যে, রাসায়নিক অস্ত্রভাণ্ডারের অবস্থান নিশ্চিত এবং তা ধ্বংস সাধনের কাজটি মোটেই সহজ নয়।
ফলে নীতিগত ঐকমত্যই রাসায়নিক অস্ত্রভাণ্ডার বিষয়ে আশু কোনো সমাধান তৈরি করতে পারবে না। তারা এই নিয়েও সন্দিহান যে আদৌ সিরিয়া এবং রাশিয়া তাদের কথা রাখবে কিনা। তবে সবচেয়ে হতাশাবাদীও আশা করছেন যে জাতিসংঘের মাধ্যমে এই প্রক্রিয়া শুরু করা গেলে তার প্রথম ধাপ হবে রাসায়নিক অস্ত্র বিষয়ক কনভেনশনে সিরিয়ার সাক্ষর। এতে করে ভবিষ্যতে বাশার আল আসাদের পক্ষে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার সম্ভব হবে না।
এ পর্যন্ত এই কনভেনশন অনুমোদন করেছে ১৮৯ দেশ; ইসরাইল ও মিয়ানমার এতে সই করলেও তা অনুমোদন করেনি। পৃথিবীর মোট রাসায়নিক অস্ত্রের প্রায় ৭৮ শতাংশ ইতোমধ্যেই ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। সিরিয়ার রাসায়নিক অস্ত্রভাণ্ডার নিষ্ক্রিয় করা গেলে একটা বড় ধরনের অর্জন হবে। তবে তার জন্যে দরকার হবে সময়ের, এটা সংশ্লিষ্ট সকলেই উপলব্ধি করতে পারছেন। এ কথা অনুমান করা ভুল হবে না যে এই ‘সময়’ বাশার আল আসাদের জন্যে লাভই বয়ে আনবে।
একুশে আগস্টের রাসায়নিক অস্ত্র হামলার পরে এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিমান হামলার হুমকির মুখে গত কয়েক দিনে এমন এক পরিস্থিতির সূচনা হয়েছে যে অনেকের ধারণা হতে পারে যেন সিরিয়ার সংকটটা রাসায়নিক অস্ত্র নিয়েই। রাসায়নিক অস্ত্র বিষয়ে আন্তর্জাতিক ঐকমত্য, সিরিয়ার তাতে সম্মতি এবং তা বাস্তবায়ন করা গেলেই যেন সেখানে বিরাজমান পরিস্থিতির নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে যাবে।
কিন্ত বাস্তব পরিস্থিতি মোটেই তা নয়। গত তিরিশ মাস ধরে যে অব্যাহত গৃহযুদ্ধ চলছে, যে সহিংসতায় লাখ খানেক মানুষ নিহত হয়েছে, তার কোনো সমাধান এখনকার আলোচনায় মোটেই বিবেচ্য হচ্ছে না। অনেকেই বলতে পারেন যে আশু সমস্যা সমাধান না করে, বিশেষত সম্ভাব্য মার্কিন হামলার বিষয়ে নিষ্পত্তি না করে সিরিয়ার সংকট সমাধানের কথা ভাবা যাবে না। তাদের কথায় যুক্তি অবশ্যই রয়েছে। কিন্ত যে জরুরি তাগিদ নিয়ে এই বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে তার কিয়দংশও কেন সেখানকার রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে গত তিরিশ মাসে দেখা যায়নি?
এ কথা বললেও অতিরঞ্জন হবে না যে, রাসায়নিক অস্ত্র বিষয়ে এক ধরনের একটা চুক্তিতে উপনীত হলে ক্ষমতাশালী দেশগুলো আবারও উনিশে আগস্টের ভূমিকায় ফিরে যাবে। যার অর্থ হবে সিরিয়ার যে নাগরিকেরা আসাদ সরকারের নিপীড়নের শিকার হচ্ছিলেন তারা সেই অবস্থাতেই থাকবেন এবং আন্তর্জাতিক সমাজ গৃহযুদ্ধের নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করবে।
সিরিয়ার রাসায়নিক অস্ত্রভাণ্ডার নিয়ে রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে এক ধরনের ঐকমত্যে যারা অবাক হচ্ছেন তারা এবং যারা ভাবছেন যে এতে করে রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্রকে একহাত নিতে পেরেছে তারা, ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখবেন যে সিরিয়ার বিষয়ে একটি অলিখিত, অঘোষিত ঐকমত্য গত এক বছরের বেশি সময় ধরেই আছে।
সিরিয়ায় বাশার আল আসাদবিরোধী গণজাগরণের গোড়াতে যুক্তরাষ্ট্র যতটা স্পষ্টভাবে আসাদের পতন চেয়েছে এখন ঠিক ততটা জোর দিয়ে আসাদের অপসারণ চায় না। যদিও যুক্তরাষ্ট্র এবং ওই অঞ্চলে তার মিত্ররা আসাদবিরোধীদের অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করে আসছে– তারা আসাদবিরোধীদের মধ্যে চরমপন্থীদের শক্তিবৃদ্ধিতে অস্বস্তিতে রয়েছে। বিশেষ করে আল-কায়েদার সমর্থকদের প্রভাব বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে যুক্তরাষ্ট্র এখনই আসাদের পতন চায় কিনা সে নিয়েও অনেকে সন্দিহান।
সামরিকভাবে পরাস্ত হয়ে আসাদ সরকারের পতনের ব্যাপারে মধ্যপ্রাচ্যের কোনো কোনো দেশের উৎসাহের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র এখন আর ঠিক আগের মতো সুর মেলাতে পারছে না। যে কারণে প্রেসিডেন্ট ওবামা এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি স্বীকার করেছেন যে বিদ্রোহীদের মধ্যে ‘খারাপ লোক’ রয়েছে। আসাদের পতন ঘটলে কী পরিস্থিতি হবে সে বিবেচনা করেই যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ার বিদ্রোহীদের হাতে ভারী অস্ত্র সরবরাহ করতে দ্বিধান্বিত।
এই দ্বিধা যুক্তরাষ্ট্রের একার নয়, তার পশ্চিমা মিত্রদেরও। রাশিয়াও এই ধরনের আশংকা করে যে যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাশার আল আসাদের পতন ঘটলে তাতে করে ইসলামপন্থীরাই বিশৃঙ্খল অবস্থার সুযোগ নেবে। আর তার প্রভাব মধ্য এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়তে পারে।
এই সমস্ত বিবেচনায় গত বছরের মাঝামাঝি থেকে সিরিয়ায় একটা রাজনৈতিক সমাধানের লক্ষ্যে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র কাজ করে আসছিল। গত বছরের জুন মাস থেকে শুরু হওয়া এই উদযোগের প্রধান উদ্যোক্তাও ছিল এই দুই দেশ।
তার অংশ হিসেবে জেনেভায় বৈঠক হয় এবং সেই বৈঠকের পর যে যৌথ বিবৃতি প্রকাশিত হয়েছিল তাতে এই প্রচেষ্টা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সংশ্লিষ্ট সব পক্ষই। ‘জেনেভা-২’ বলে এই প্রচেষ্টাকে চিহ্নিত করা হয়। সেখানে দুটি বিষয়ে সুস্পষ্ট ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা হয়। প্রথমত সমাধানের জন্যে দরকার যুদ্ধবিরতি এবং দ্বিতীয়ত একটি অন্তর্বর্তী সরকার।
প্রাথমিক আলোচনার পর এই বছরের মাঝামাঝি, আশা করা হচ্ছিল জুন-জুলাই মাসে, আবার বৈঠক হবে। কিন্ত এই বছরের মাঝামাঝি রাশিয়া জানায় সেপ্টেম্বরের আগে এই বৈঠক সম্ভব নয়। তারা এতে ইরানের অন্তর্ভূক্তির জন্যে চাপ দেয়।
অন্যদিকে এ বছরের জুন মাসে সিরিয়া নিয়ে রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের মধ্যে আলোচনায় অংশ নেন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েন্ডি শারম্যান এবং রাশিয়ার মিখাইল বোগদানোভ এবং গেনাদি গেতিলভ। সেখানে একথাই ঠিক হয়েছিল যে এমন একটা অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠা করা দরকার যার হাতে রাষ্ট্রের সবগুলো প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত থাকবে। যার অর্থ হচ্ছে সেনাবাহিনীর কর্তৃত্বও তাদের হাতে ন্যস্ত করতে হবে।
এই আলোচনার পর সিরিয়া সরকারের একজন মুখপাত্র বলেছিল যে বাশার আল আসাদকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে কোনো রাজনৈতিক সমাধানের ব্যাপারে তারা উৎসাহী নয়।
রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে এই ধরনের একটা রাজনৈতিক সমাধান বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া প্রশ্নে ভিন্নমত সত্বেও মনে হচ্ছিল যেন কিছুটা হলেও অগ্রগতি হচ্ছে। সে কারণে জুন মাসে জি-৮ এর বৈঠকের সময় ওবামা এবং পুতিনের দুই ঘন্টার আলোচনা ইতিবাচক বলেই ধারণা করা হচ্ছিল।
কিন্ত রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের ঘটনার পর এই রাজনৈতিক প্রক্রিয়া এখন নিশ্চল হয়ে পড়েছে। শুধু তাই নয়, সিরিয়ার বিদ্রোহীরা ঘোষণা করেছে যে তারা আর জেনেভা আলোচনায় অংশ নেবে না। আগস্ট মাসের শেষ পর্যায়ে এসে রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহার করার ফলে রাজনৈতিক সমাধানের বিষয়টি এখন আর প্রাধান্য পাচ্ছে না। কিন্ত দীর্ঘমেয়াদে সিরিয়া সমস্যার সমাধান কেবল রাসায়নিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নিহিত নেই।
সিরিয়ায় মার্কিনি হামলা যেমন সিরিয়ার প্রকৃত সমস্যার কোনো সমাধান তৈরি করতে পারত না, ঠিক একইভাবে জাতিসংঘের উদযোগে সিরিয়ার রাসায়নিক অস্ত্র-বিষয়ক চুক্তি– তার অনেক ইতিবাচক দিক থাকলেও– সিরিয়ার আসল সংকটের কোনো সমাধান দেবে না।
ওয়াশিংটন, ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৩
This post has already been read 14 times!