ডিসেম্বর 29, 2025
india_bd

This post has already been read 22 times!

ভারতের নির্বাচনে বিজেপির আশাতীত ভালো ফল এবং নরেন্দ্র মোদির অভাবনীয় সাফল্যের পর সারা পৃথিবীতে এবং বাংলাদেশেও বড় ধরনের প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা গেছে। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই নির্বাচনে বিজেপির সাফল্যে যাঁরা খুশি হননি, তাঁদের প্রতিক্রিয়ায় কম-বেশি একটা প্রবণতা সহজেই লক্ষণীয়, তা হলো বিজেপির সাফল্যকে তাঁরা দেখছেন ভারতে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র অবসানের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে। তাঁদের আনুষ্ঠানিক ও ব্যক্তিগত প্রতিক্রিয়া থেকে এ ধারণা জন্মায়, যেন এই প্রথমবারের মতো ভারতের হিন্দু ধর্মভিত্তিক দক্ষিণপন্থী দল বিজেপি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে চলেছে এবং তাঁরা ক্ষমতা গ্রহণ করামাত্রই ‘একটি আদর্শস্থানীয় সেক্যুলার রাষ্ট্র’ রাতারাতি বদলে যাবে।

এই ধারণার বিভ্রান্তিগুলো ভালো করে বোঝা দরকার। প্রথমত, বিজেপি এই প্রথমবার ক্ষমতায় আসছে তা নয়; আগে এই দলটি তিনবার ক্ষমতায় এসেছে। বিজেপি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর আমরা অবশ্যই সমাজে ও রাজনীতিতে পরিবর্তন দেখেছি, তারা তাদের আদর্শের আলোকে সমাজের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে সাজাতে চেয়েছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে এই প্রচেষ্টার একটা বড় রূপও আমরা দেখেছি। এই পরিবর্তনগুলোকে অনেকে স্যাফ্রোনাইজেশন বা ‘জাফরানীকরণ’ বলে বর্ণনা করেছেন।
কিন্তু বিজেপি গোটা রাষ্ট্রব্যবস্থাকে বদলে দিয়েছে এমন ঘটনা ঘটেনি। এখন আগের বিজেপি নেতাদের তুলনায় আরও কট্টরপন্থী নরেন্দ্র মোদি, যাঁর হাতে রক্তের দাগ লেগে আছে বললে অত্যুক্তি হবে না, তিনি নিঃসন্দেহে বেশি মাত্রায় জাফরানীকরণের চেষ্টা করবেন, সেটা ধরেই নিতে পারি৷ কিন্তু ভারতের করপোরেট ক্ষমতার অধিকারীরা, যাঁদের অক্লান্ত চেষ্টায় এবং অর্থে বিজেপির এই বিজয়, তাঁরা বিজেপি এবং নরেন্দ্র মোদিকে খুব বেশি দূর যেতে দেবেন বলে মনে করার মতো কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি।

দ্বিতীয়ত, এ ধরনের বক্তব্যে ভারতকে যেভাবে একটি আদর্শস্থানীয় সেক্যুলার রাষ্ট্র হিসেবে দেখার ও দেখানোর আগ্রহ লক্ষ করা যাচ্ছে, তা কতটা বাস্তবোচিত, তা বিবেচনা করা দরকার। ভারতের রাষ্ট্রীয় নীতিমালায় সেক্যুলারিজমের কথা বলা হলেও সমাজে তার প্রয়োগের দুর্বলতার দিক নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনা চলে আসছে। (উৎসাহীরা এ বিষয়ে ২০০৭ সালে ডিউক ইউনিভার্সিটি প্রেস প্রকাশিত অনুরাধা দিংওয়ানে নিধাম সম্পাদিত দ্য ক্রাইসিস অব সেক্যুলারিজম ইন ইন্ডিয়া বইটি পড়তে পারেন।) তদুপরি সমাজের ভেতরে, বিশেষত ভারতের পপুলার কালচার বা দৈনন্দিন জীবনে এমন ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে, যেখানে বিজেপির মতো দলের উদ্ভব, বিকাশ ও সাফল্যই স্বাভাবিক ঘটনা। (এ জন্য দ্রষ্টব্য থমাস ব্লুম হ্যানসেন-এর গ্রন্থ স্যাফরন ওয়েভ: ডেমোক্রেসি এবং হিন্দু ন্যাশনালিজম ইন ইন্ডিয়া, প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৯৯)।

এসব আলোচনা থেকে এটাই বেরিয়ে এসেছে যে পশ্চিমা সেক্যুলারিজমের ধারণার বিপরীতে ভারত যে তার নিজস্ব ধরনের ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলেছে, তা আদর্শিক ও প্রায়োগিক—দুই দিক থেকেই সংকটের মধ্যে পড়েছে। ফলে ভারতকে এখন এক আদর্শস্থানীয় রাষ্ট্র মনে করার কারণ নেই। সমাজের এই পরিবর্তনের পেছনে কেবল যে বিজেপিই কাজ করেছে তা নয়, সেক্যুলারিজমের প্রতিনিধি বলে দাবিদার কংগ্রেসের কার্যকলাপও তার জন্য দায়ী।

এখন কংগ্রেস নির্বাচনে অত্যন্ত খারাপভাবে পরাজিত হওয়ার কারণে আমাদের তা ভুলে যাওয়া ঠিক হবে না। এ কথা বলার অর্থ এই নয় যে রাজনৈতিক সেক্যুলারিজমের যে মূলবাণী অর্থাৎ রাষ্ট্র এবং ধর্মের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করা, তা অগ্রহণযোগ্য হয়ে গেছে। কিন্তু সমাজের সেক্যুলারাইজেশন ছাড়া রাষ্ট্রের ওপরে ভরসা করে সেক্যুলারিজম প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়, সেটা বোঝা খুবই জরুরি।

এসবের পাশাপাশি আমাদের মনে রাখতে হবে, গত কয়েক দশকে আমরা দেখতে পেয়েছি যে দেশে দেশে ধর্মাশ্রয়ী এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতির প্রসার ঘটেছে। কেউ কেউ যদিও একে কেবল মুসলিমপ্রধান দেশের লক্ষণ বলে মনে করেন, তাঁরা
বিস্মৃত হন যে একই প্রবণতা অন্য ধর্মাবলম্বী সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশেও ঘটেছে। ভারতে বিজেপির উত্থানকে এই আলোকেও

বিবেচনা করা দরকার। দক্ষিণ এশিয়ায় এই প্রবণতা গত কয়েক দশকে ধীরে ধীরে বিস্তার লাভ করেছে। তার কারণ নিয়ে
ভিন্নমত থাকতে পারে কিন্তু তা অস্বীকার করার মধ্যে কোনো সমাধান নেই।

দেশে দেশে সেক্যুলারিজমের এই সংকটের এক অন্যতম কারণ হলো সেক্যুলার বলে এশিয়া, আফ্রিকা বা লাতিন আমেরিকায় যে রাষ্ট্রগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তাদের ক্ষমতাসীনেরা নাগরিকের প্রাত্যহিক জীবনের চাহিদা মেটানোর ক্ষেত্রে সাফল্যের চেয়ে অন্যান্য বিষয়েই বেশি আগ্রহী থেকেছে। ষাটের দশকে, এমনকি আশির দশকেও, সেটা ক্ষমতায় থাকার জন্য যথেষ্ট বলে বিবেচিত হতে পারত।

এখন, এই একবিংশ শতাব্দীতে, তার সম্ভাবনা অনেক কম। বিশ্বায়ন এবং নিও-লিবারেল অর্থনীতি এখন নাগরিকদের কাছে পারফরম্যান্স লেজিটেমেসির বা ‘কর্মযোগের বৈধতা’র বিষয়টিকে প্রধান বিষয়ে পরিণত করেছে। তাকে আপনি সঠিক মনে করেন কি না, সেটা ভিন্ন বিষয়। এ ক্ষেত্রে ভারতে বিজেপি ও নরেন্দ্র মোদি গুজরাটের ‘অর্থনৈতিক সাফল্য’কে তাঁদের নির্বাচনী পুঁজি করতে পেরেছে। যদিও সেই সাফল্য অবশ্যই প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নয়। কোনো কোনো বিচারে তা বরং অন্যদের চেয়ে কম। মানব উন্নয়ন সূচকের বিবেচনায় গুজরাট অনেক ক্ষেত্রেই পিছিয়ে আছে। কিন্তু গত কয়েক বছরে কংগ্রেসের সাফল্য তার চেয়ে কম বলে বিজেপি সহজেই এই পরীক্ষায় উতরাতে পেরেছে।

কিন্তু একটা বড় কথা হলো, গত কয়েক বছরে কংগ্রেসের শাসন যে দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হয়েছে, তাকে বিজেপি সহজেই কাজে লাগিয়েছে। দুর্নীতিপরায়ণ, পারিবারিক উত্তরাধিকারের রাজনীতির প্রতিনিধি কংগ্রেসের নেতৃত্ব আশা করেছিলেন যে চরম দক্ষিণপন্থীদের প্রতিভূ নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে তাঁদের এই বক্তব্যই যথেষ্ট বলে বিবেচিত হবে যে ভারতের সেক্যুলারিজম রক্ষার জন্য কংগ্রেসের পাশে দাঁড়ানো সবার কর্তব্য।

গত বছরগুলোতে, বিশেষত আন্না হাজারের দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনের পর, যাঁরা কংগ্রেসকে এই বলে সাহস জুগিয়েছেন, সমর্থন দিয়েছেন যে এই সবই নির্বাচনের তোড়ে ভেসে যাবে, তাঁরা হয় এক ভিন্নগ্রহের বাসিন্দা নতুবা আদর্শিক অন্ধত্বের শিকার।
কংগ্রেস যে সুশাসন নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হচ্ছে এবং কেবল আদর্শের বাতাবরণ যে তাকে নির্বাচনী বৈতরণি পার করাবে না, সেটা যাঁরা বলতে পারেননি বা বলেননি, তাঁরা কেবল কংগ্রেস নয়, ভারতের রাজনীতি এবং সেক্যুলারিজম উভয়েরই ক্ষতি করেছেন। পাশাপাশি এটাও প্রশ্ন করা দরকার যে কংগ্রেসের এই ব্যর্থতার ফসল কেন বিজেপির ঘরেই উঠল? কেন ভারতের অন্য সেক্যুলার রাজনীতিিবদেরা জাতীয়ভাবে তাঁকে তাঁদের অনুকূলে আনতে পারলেন না, সেটাও তাঁদের ভেবে দেখা দরকার।
এই নির্বাচন প্রমাণ করছে, ভারতের ভোটাররা পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুত ছিলেন; কিন্তু তাঁদের সামনে বিজেপির মতো দল যে বিকল্প দিতে পেরেছে, অন্য দলগুলো তা দিতে সক্ষম হয়নি। যাঁরা পরিবর্তন চান, এটি তাঁদের জন্য দুঃসংবাদ।

১৮ মে, প্রথম আলোতে প্রকাশিত

This post has already been read 22 times!

মন্তব্য করুন