This post has already been read 22 times!
বাংলাদেশে উর্দু ভাষায় সাহিত্যচর্চা হচ্ছে, গল্প কবিতা উপন্যাস লেখা হচ্ছে এটি আমার বহুদিন জানা ছিলো না। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের উদ্যোগেই ৯০ দশকের প্রথমদিকে যোগাযোগ ও কথাবার্তা হয়। যতদূর মনে পড়ে কবি আসাদ চৌধূরী ছিলেন যোগাযোগ মাধ্যম। তাঁর সঙ্গে উর্দু ভাষার লেখকদের নিয়মিত যোগাযোগ ছিলো, আশা করি এখনও আছে। আমরা বসেছিলাম ইলিয়াস ভাইএর বাসায়, তাঁর মৃত্যুর কয়েকবছর আগে। উর্দু ভাষার লেখক কবিদের সবার পুরো নাম সঠিকভাবে মনে পড়ছে না বলে খারাপ লাগছে। একজনের নাম মনে আছে আহমদ ইলিয়াস। তাঁরা নিজেদের লেখালেখির অভিজ্ঞতা বলছিলেন, আলোচনায় এসেছিলো ১৯৭১ এ তাঁদের ভ’মিকার প্রসঙ্গও। তাঁরা সবাই নানাভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। অনেকে নির্যাতিতও হয়েছেন। বাঙালী মানেই যেমন মুক্তিযোদ্ধা নয়, উর্দুভাষী বা বিহারী এমনকি চাকমা মানেই রাজাকার নয়। পাকিস্তানের লেখক কবি বুদ্ধিজীবীদের মধ্যেও আমরা এখন অনেকের নাম জানি যারা পাক সামরিক জান্তার গণহত্যার প্রতিবাদ করতে গিয়ে গ্রেফতার হয়েছিলেন, নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। বর্তমান সরকার তাঁদের সম্মাননাও দিয়েছেন। কাজেই পাকিস্তানের নাগরিক মানেই সামরিক জান্তার গণহত্যার সহযোগী নয়।
যাইহোক, উর্দু ভাষার লেখকদের রচিত গল্প উপন্যাস কবিতার কথা শুনেছিলাম সেদিন। জানলাম বাংলাদেশে এগুলো ছাপার ব্যবস্থা নেই। সুতরাং এগুলো ছাপা হয় মুম্বাই, দিল্লী ও লাহোরে। তবে এসব লেখার বিষয়বস্তু অবশ্যই বাংলাদেশ, তার সমাজ রাজনীতি জীবন আবহাওয়া ফল ফসল। একটা উদাহরণ দিলেন একজন কবি। তাঁর একটি প্রেমের কবিতায় তিনি প্রেমিকার উদ্দেশ্যে যা বলছেন তার সারকথা হলো, ‘তোমাকে যখন দেখি তখন আমার হৃদয়ে কালবোশেখীর ঝড় বয়ে যায়।’ কবি বললেন, ভারত পাকিস্তানের উর্দু পাঠকরা প্রেমের কথা বুঝলেন কিন্তু কালবোশেখীর মানে বুঝতে না পেরে চিঠিপত্র পাঠাতে লাগলেন, বহু চিঠি। কালবোশেখী ব্যাপারটা তো একেবারেই বাংলার। বললেন, উর্দু সাহিত্যে বাংলাদেশ এভাবে আগে কখনো আসেনি। বাংলা ভাষার ওপর উর্দু ভাষা জোর করে চাপানোর পাকিস্তানী নীতির কারণে আমাদের অনেকের মধ্যে এই ভাষার প্রতি প্রচ্ছন্ন বিরাগ তৈরি হয়েছিলো ছোটবেলা থেকেই। মাতৃভাষার অধিকার হরণ করবার চক্রান্তের সাথে উর্দু ভাষা এমনভাবে জড়িয়ে গিয়েছিলো যে এই ভাষা আমাদের কাছে শুধুই ভাষা ছিলো না, আমাদের জাতিগত অস্তিত্ব বিলীন করবার অস্ত্র মনে হতো। সেজন্য এই ভাষা শেখা হয়ে উঠেনি কখনোই। অথচ জানি উর্দু ভাষায় কতো সমৃদ্ধ সাহিত্য তৈরি হয়েছে। নির্মম পরিহাসের বিষয় উর্দু ভাষা জোর করে চাপানোর জন্য পাকিস্তানীরা এতো চক্রান্ত করলো, মানুষ হত্যা করলো সেই পাকিস্তানে খুব কম সংখ্যক মানুষেরই মাতৃভাষা উর্দু। ১৯৭১ সালে যে সামরিক বাহিনী এখানে নৃশংসতার ভয়াবহতা তৈরি করেছে তাদেরও মাতৃভাষা উর্দু ছিলো না।
আজ যাদের কে আমরা ‘বিহারী’ নামে জানি তারা পাকিস্তান থেকে আসেননি, এসেছেন ভারত থেকে, শুধু বিহার থেকে নয়, অন্ধ্র, উত্তরপ্রদেশসহ অন্যান্য প্রদেশ থেকেও। ভারত ভাগের সেই রক্তনদীর মধ্যে, সাম্প্রদায়িক উন্মত্ততার কালে তারা এখানে আসেন মোহাজির হিসেবে। পাকিস্তান তাদের কখনোই নিজের মধ্যে গ্রহণ করেনি, কিন্তু তাদের অসহায়ত্বকে ব্যবহার করেছে। অধ্যাপক আসহাবউদ্দীন আহমদের লেখা থেকে দেখি ১৯৬৮ সালেও চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির চিকনছড়া থেকে এই মোহাজিরদের উচ্ছেদ করা হয়েছে। পুরো পাকিস্তান আমলেই তাদের সকলের স্থিতি হয়নি। এখনও পাকিস্তানে উর্দুভাষী মোহাজিররা মূলধারা থেকে আলাদা।
বাংলাদেশে (পূর্ব পাকিস্তানে) মানুষের সহমর্মিতা ও সহযোগিতার কারণে মোহাজিরদের অনেকে বাঙালী সমাজের সাথে মিশে যেতে পেরেছেন। ঈশ্বরদী, রংপুর, সৈয়দপুর, ঢাকার মিরপুর মোহাম্মদপুরে তাঁদের অধিক মানুষের আবাস দেখা যায়। রেলওয়ে, কারখানায় এদের দক্ষতা কর্মকুশলতার প্রশংসা অনেক শুনেছি। ৬০ দশকে শক্তিশালী শ্রমিক আন্দোলনে বাঙালী বিহারী একসাথেই পাকিস্তানীদের শোষণ নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগঠন করেছেন। সেজন্যই বৃহৎ পুঁজিপতি ও পাকিস্তানি শাসকদের জন্য বাঙালী বিহারী দাঙ্গা লাগানো ছিলো এক ভয়ংকর ক’টকৌশল। আদমজীসহ দেশের বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে এই দাঙ্গা উস্কে দিয়ে শ্রমিক স্বার্থের আন্দোলন বাধাগ্রস্ত করা হয়। পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের লড়াইকে ক্ষতিগ্রস্ত করবার চেষ্টা হয়। বাঙালী বিহারী মুখোমুখি হলে ফায়দা নেয় পাকিস্তানী শাসকেরা। ‘বিহারী’দের মধ্যে বাঙালী ভীতি তৈরি করে সহিংসতার দিকে ঠেলে দেয়, বিদ্বেষ বাড়ে, দূরত্ব বাড়ে। ১৯৭১ সালে এরই ভয়াবহ পর্ব দেখেছি আমরা।
স্বাধীনতার পর, এই জনগোষ্ঠীর মধ্যে যারা পাকিস্তান বাহিনীর সহযোগী হিসেবে ভ’মিকা পালন করেছে তারা, সেইসাথে স্বচ্ছল পরিবারের অনেকে ঝুঁকি বুঝে পাকিস্তানে চলে যেতে সক্ষম হন। প্রধানত রয়ে যান তুলনামূলকভাবে দরিদ্ররা। আর মধ্যবিত্তদের মধ্যেও কেউ কেউ যারা এদেশকেই নিজের দেশ মনে করেন তারা থেকে যান অনিশ্চয়তা নিয়েই। ‘বিহারী’দের অবস্থা তখন এখানে স্বচ্ছন্দ বা নিরাপদ ছিলো না। যারা পাকিস্তানে যেতে চাচ্ছিলেন তাদের নাম হয় ‘আটকে পড়া পাকিস্তানি’। তাদের পাকিস্তানে নেবার ব্যাপারে পাকিস্তানের কোন সরকারেরই কোন আগ্রহ দেখা যায়নি। কালক্রমে পাকিস্তানে ফেরত যেতে চাওয়া মানুষেরা সংখ্যালঘু হয়ে পড়েন। এখন কথিত বিহারী জনগোষ্ঠীর মধ্যে ভোট নিলে দেখা যাবে তাদের বিপুল অধিকাংশ বাংলাদেশেই থাকতে চান। ১৯৭১ এর পর জন্ম অনেকের, বাংলাদেশই তাদের জন্মস্থান, এখানেই তারা মরতে চান। কিন্তু আইনগত জটিলতায় এখনো দূরত্ব থেকে গেছে। হাইকোর্ট তাদের নাগরিকত্ব দিতে বলেছে। পূর্ণ বাস্তবায়ন এখনও ঝুলে আছে।
বাঙালী সমাজের মতো এই কোণঠাসা জনগোষ্ঠীর সংখ্যাগরিষ্ঠই দরিদ্র। সুতরাং মোহাম্মদপুর ক্যাম্প হোক আর যেখানেই হোক তাদের প্রধান অংশের জীবন বস্তির জীবন। গত শবেবরাতের রাতে রাজধানীর কালশীতে এরকম একটা বস্তিতেই ভয়ংকর হত্যাকান্ডের শিকার হলেন তারা। আক্রান্ত মানুষদের সাক্ষè্য, আলোকচিত্রসহ প্রমাণাদি থেকে এটা স্পষ্ট যে, পুলিশের সামনেই সন্ত্রাসীরা ঘরের বাইরে তালা লাগিয়ে গান পাউডার ছড়িয়ে আগুন দিয়েছে। আটকে পুড়িয়ে যাদের হত্যা করা হল, তাঁদের অধিকাংশ একই পরিবারের, আফসানা -রোখসানা -ভুলু তাদের কজনের নাম। নারী ও শিশুই অধিকাংশ। আক্রান্ত মানুষেরা সবাই স্থানীয় এমপি ও পুলিশের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অভিযোগ করেছেন। এমপির সহযোগী কে কে হামলায় ছিলো তার নামও বলেছেন। দুদিন আগে এমপির সাথে বস্তিবাসীর বাকবিতন্ডা হয়, নারীরাই প্রতিবাদ করেছিলেন এমপির জোরজবরদস্তি করে বিদ্যুৎ নেবার বিরুদ্ধে। সেজন্যই হয়তো নারীর ওপরই নৃশংস আক্রমণের প্রধান ধাক্কা গেছে।
কালশীর অধিবাসীরা জমি গ্রাসের চক্রান্তের কথাও বলেছেন। জমিগ্রাসের শিকার হবার ক্ষেত্রে বাঙালী বিহারী চাকমা মারমা কিংবা হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রীষ্টান কোন তফাৎ পাওয়া যাবে না। কিন্তু যারা এই গ্রাস করে তারা কখনো বাঙালী কখনো মুসলমান উত্তেজনা তৈরি করেই এই অপকর্ম সমাধা করে। প্রশাসনের কোন না কোন অংশের সমর্থন ছাড়া জমি নদী বিল পাহাড় দখল সম্ভব না।
গত কয়েক দশকে ঢাকা মহানগরীতে গরীব মানুষের বসতি বা বস্তিতে আগুন লাগা, সন্ত্রাস ও তার আগে পরের ঘটনাবলীর মধ্যে বিস্ময়কর সাদৃশ্য পাওয়া যায়। দরিদ্র মানুষ বাঙালী মুসলমান হলেও কি ছাড় পান? একটুকুও না। জমি দখলে রাখার জন্য প্রথমে বস্তি করা হয়। তারপর যেসব বস্তিতে বারবার আগুন লাগে বা অশান্তি চলতে থাকে সেখানে সবকিছু স্থিত হয় বহুতল ভবন নির্মাণের মধ্যে দিয়ে। জমির ওপর দখল নিশ্চিত না হলে সুউচ্চ ভবন নির্মাণের মতো ‘উন্নয়ন’কাজ কীভাবে সম্ভব? ঢাকা মহানগরীর অনেকগুলো বহুতল ভবনের পেছনের ইতিহাস ঘাঁটলে তাই মানুষের কান্না আর রক্ত পাওয়া যাবে।
বাংলাদেশের বাঙালীদের দুর্ভাগ্য যে এইদেশে অ-বাঙালীদের শতকরা হার শতকরা মাত্র ১ ভাগ। আমাদের সুযোগই হয়নি অন্য জাতি ও ভাষাভাষীদের জানার বোঝার মতো তাঁদের শক্তিশালী উপস্থিতি। ধর্মীয় দিক থেকেও শতকরা প্রায় ৯০ ভাগ মুসলমান। নির্দিষ্ঠ ভাষা ও ধর্মের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা বহুজনকে অন্যজন সম্পর্কে অজ্ঞ রাখে। আর এই অজ্ঞতার সুযোগ নেয় সমাজের বৈষম্য নিপীড়নের রাজনীতি। বাঙালী উন্মাদনা সৃষ্টি করে পাহাড়ের পর পাহাড় ব্যক্তির সম্পত্তিতে পরিণত করা, উত্তরবঙ্গে সাওতাল ময়মনসিংহে গারোদের জমি গ্রাস আর কালশীর মতো বস্তির জমি দখলের পাঁয়তারা। আবার মুসলমান উন্মাদনা তৈরি করে হিন্দু বৌদ্ধ জমি আর সম্পত্তি দখল।
আক্রান্তদের কপালে কখনো ‘পাকিস্তানের দালাল’ কখনো ‘ভারতের দালাল’ দাগ লাগিয়ে এই দখল লুন্ঠন বা সহিংসতাকে বৈধতা দেবার চেষ্টা করা হয়। ফেসবুকেও বাঙালী আর মুসলমানের নামে এই খুনি উন্মাদনার সুর শোনা যায়। অন্যদিকে এই জনপদে আবার হাজার বছরের বৌদ্ধ দর্শন, সুফী দর্শন, লালনের মতো সাধকদের প্রভাব, জাতিগত নিপীড়ন ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখবার এবং খুনি উন্মাদনার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোরও শক্তি দেয়। বস্তুত লুটেরা দখলদারদের চিহ্নিত করতে পারলে ভাষা জাতি ধর্ম নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ যে খুবই সম্ভব তা এই দেশেই বহুবার প্রমাণিত হয়েছে।
সবচেয়ে বড় পরিচয় মানুষ। কালশীর এই নৃশংসতার বিচারে কোন শৈথিল্য তাই আমরা মেনে নিতে পারি না। এমপি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যারই দায় থাকুক তার বিচার হতে হবে। কথিত বিহারীদের মধ্যে এখনও যারা পাকিস্তানে যেতে চান তাদের সেখানে পাঠানোর জোর ব্যবস্থা নিতে হবে। আর বিপুল অধিকাংশ যাদের শ্রম ঘাম জীবন মরণ এদেশের সাথে বাঁধা তাদের এদেশে বৈধ নাগরিকত্ব এবং সকল মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
মনে রাখতে হবে বাংলাদেশে বাঙালী বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও এইদেশ শুধু বাঙালীর নয়। এখানে উর্দুভাষী, চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, সাঁওতাল, গারো বা মান্দিসহ অনেক ভাষা ও জাতির মানুষ বাস করেন। সংবিধান তাদের অস্তিত্ব স্বীকার করে না, এটা আমাদের সবার জন্য লজ্জা ও ক্ষোভের বিষয়। একইসঙ্গে এটাও মনে রাখতে হবে যে, বাংলাদেশে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ কিন্তু এইদেশ শুধু মুসলমানের নয়, এখানে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীষ্টান সহ বহু ধর্ম ও বিশ্বাসের মানুষ বাস করেন। এই বৈচিত্র আমাদের শক্তি।
১৯ জুন ২০১৪
This post has already been read 22 times!