ডিসেম্বর 4, 2025
WhatsApp Image 2025-10-20 at 17.41.36_9ae7ab8f ka
স্মিটের কাছে রোমের পদযাত্রা জরুরি অবস্থাকেই বাস্তবে হাজির করেছিল। প্রবল পাণ্ডিত্য দিয়েও স্মিট তাঁর ফ্যাসিবাদ-মুখী আগ্রহকে লুকায়ে রাখতে পারেননি।

This post has already been read 16 times!

লিখেছেন, রিচার্ড ওলিন।

রিচার্ড ওলিন নিউ ইয়র্কের CUNY গ্র্যাজুয়েট সেন্টারে ইন্টেলেকচুয়াল ইতিহাসের অধ্যাপক। বিশ শতকের ইউরোপীয় চিন্তা ও দর্শনের ইতিহাস নিয়ে তিনি কাজ করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে Walter Benjamin: An Aesthetic of Redemption; Heidegger in Ruins: Between Philosophy and Ideology; The Seduction of Unreason: The Intellectual Romance with Fascism from Nietzsche to Postmodernism; The Frankfurt School Revisited প্রমুখ। তাঁর The Cult of Carl Schmitt প্রবন্ধটি প্রথম প্রকাশিত হয় Liberties Journal (Autumn 2022 Volume 3 – Number 1)। কথকতার পক্ষ থেকে এ-আই দিয়ে প্রাথমিক অনুবাদের পর এটি সম্পাদনা করেছেন সহুল আহমদ।    

জার্মান দার্শনিক কার্ল স্মিট প্রতীক/সিম্বল এবং মিথের প্রতি বিশেষভাবে মুগ্ধ ছিলেন। তাঁর জীবনীকার দেখিয়েছেন, ১৯৩০-এর দশকে স্মিট দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে জাতীয় সমাজতন্ত্রের যৌক্তিক জায়েজিকরণ স্ববিরোধী ও নিষ্ফল প্রচেষ্টা। একজন রক্ষণশীল বুদ্ধিজীবী ও নাজি পার্টির সভ্য হিসেবে স্মিট ধর্ম ও মিথের জগতের প্রতীক ও চিত্রকল্পকে এস্তেমাল করে তৃতীয় রাইখের বৈধতা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। ধারণার (concepts) মূল্যমান সম্পর্কে তাঁর সংশয় থেকেই প্রতীক এবং মিথের প্রতি তাঁর এই আকর্ষণ সৃষ্টি হয়েছিল, কেননা তিনি ‘ধারণা’কে নিছক একটি হাতিয়ার হিসেবে দেখতেন, জার্মান ভাষায় Kampfbegriffe বা লড়াইয়ের হাতিয়ার। হবসের লেভিয়াথন পাঠে স্মিট বলেছিলেন, ‘কীভাবে ধারণা হাতিয়ারে পরিণত হয় আমরা সেটাই শিখেছি’। তাঁর ‘প্রতিটি রাজনৈতিক ধারণাই আসলে পলেমিক্যাল বা তর্কমূলক ধারণা’ দাবির মধ্যেই তাঁর চিন্তার এসেনশিয়াল যুদ্ধংদেহী ভাব ফুটে উঠে। 

মানব অস্তিত্বের রহস্য উদঘাটনের ক্ষেত্রে, স্মিট জোর দিয়েছিলেন যে প্রতীক ও মিথের জ্ঞানগত মূল্য ধারণাগত জ্ঞানের তুচ্ছ ফলাফলের চেয়ে অনেক বেশি উন্নত। যুক্তির প্রতি তাঁর এই গভীর অবিশ্বাস ‘রাজনৈতিক ধর্মতত্ত্বের’ প্রতি তাঁর গভীর শ্রদ্ধার সাথে সম্পর্কিত ছিল। স্মিট এটাকে আধুনিক রাজনৈতিক চিন্তাধারার মূল স্রোতে নিয়ে এসেছিলেন। সেকুলার জ্ঞানকে স্মিট যে তুচ্ছ মনে করতেন, তা তাঁর ‘সকল আধুনিক রাজনৈতিক ধারণাই হলো ধর্মতাত্ত্বিক ধারণার সেকুলারকরণ’ উক্তিতেই ধরা পড়ে। এই দাবি এনলাইটেনমেন্টের যুক্তিবাদী ঐতিহ্যের প্রতি তাঁর চরম অবজ্ঞাকে তুলে ধরে। এই অবজ্ঞাই আমাদের বর্তমানের বিষণ্ণ ও উত্তপ্ত সময়ে শ্মিটের চিন্তাধারাকে নতুন জীবন দিয়েছে।।

স্মিট ১৮৮৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৮৫ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি ছিলেন সাংবিধানিক তাত্ত্বিক; সংসদীয় গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে এবং একনায়কতান্ত্রিক শাসনের পক্ষে বিস্তর লিখেছেন। নাজিদের ক্ষমতা দখলকে ছদ্ম-আইনি ভিত্তি দিতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি উগ্র ইহুদিবিদ্বেষীও ছিলেন। ১৯২০-এর দশকের গোড়ার দিকে যে মিথটি স্মিটের কল্পনাকে দখল করেছিল তা হলো ‘জাতির মিথ’। মুসোলিনিও এটাকে ইতালীয় ফ্যাসিবাদের মূলনীতি হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন। স্মিট ১৯২৩ সালে তাঁর The Crisis of Parliamentary Democracy গ্রন্থের শেষাংশে এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন। যুক্তিহীনতার প্রতি তাঁর অকুণ্ঠ উৎসাহ তাঁর আসন্ন রাজনৈতিক আনুগত্যের বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত দেয়।

সেই বছর প্রয়াত হওয়া প্রোটো-ফ্যাসিবাদী এবং ড্রেফাস-বিরোধী মরিস বারেসের ভাষা ধার করে স্মিট মুসোলিনির রোমের পদযাত্রাকে [মার্চ অন রোম] ‘জাতীয় শক্তির’ বিজয় হিসেবে প্রশংসা করেছিলেন। তিনি স্বীকার করে নেন যে ফ্যাসিবাদের আধুনিক রাজনীতিতে এমন এক প্রাণশক্তি সঞ্চার করার ক্ষমতা রয়েছে যা রাজনৈতিক উদারতাবাদের স্থবির কার্যপ্রণালীতে অনুপস্থিত ছিল। ১৯২১ সালে স্মিট মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে উপস্থিত ছিলেন, যখন ম্যাক্স ওয়েবার ‘Science as a Vocation’ শীর্ষক তাঁর বিখ্যাত বক্তৃতা দিয়েছিলেন। আধুনিকতাকে ওয়েবার যে ‘লোহার খাঁচা’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন, স্মিট তার সাথে পুরোপুরি একমত পোষণ করেছিলেন: এমন এক বিশ্ব যেখানে ‘যুক্তিকরণ’ এবং ‘মোহমুক্তি’-এর ক্ষয়কারী শক্তিগুলি ‘অর্থহীনতা’-এর সংকটের জন্ম দিয়েছে।

আধুনিকার এই অস্বস্তি এবং উদারতাবাদের বুদ্ধিবৃত্তিক স্থবিরতার প্রতিকার হিসেবে স্মিট ‘সিদ্ধান্তবাদ’ (decisionism) এর কথা বলেন। এটি ছিল সার্বভৌমত্বের ধারণার একটি নতুন ব্যাখ্যা—যা ‘জরুরি অবস্থার’ (state of exception) বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। কেবল শাসকই পারবেন জরুরি অবস্থা জারি ও কার্যকর করতে। স্মিট ‘নিয়ম’ (norm) এবং ‘বিধির’ (rule) বিপরীতে ‘জরুরি/ব্যতিক্রম’ (exception) অবস্থাকে একটি সাংস্কৃতিক এবং এমনকি জ্ঞানতাত্ত্বিক শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছিলেন। এটি ছিল ওয়েবারের মোহমুক্তির এন্টিথিসিস। স্মিট উল্লাস করে বলেছিলেন, ‘জরুরি অবস্থার মধ্যেই প্রকৃত জীবনের শক্তি নিস্তেজ যান্ত্রিকতার কঠিন আবরণ ভেদ করে বেরিয়ে আসে’। রাজনৈতিক ধর্মতত্ত্বের ডিসকোর্সের সাথে তাল মিলিয়ে স্মিট আইনের ‘জরুরি অবস্থা’কে ধর্মতত্ত্বের ‘কেরামতি’ আকারে পাঠ করেছিলেন। 

স্মিট ফ্যাসিবাদী অভ্যুত্থানকে বুর্জোয়াদের বিধিমোতাবেক ‘নিয়মতান্ত্রিকতা’র (normativism) কঠোর শৃঙ্খলকে উপড়ে ফেলার লড়াইয়ের একটি ঐতিহাসিক ও দার্শনিক বাঁক হিসেবে মহিমান্বিত করেছিলেন। এই নিয়মতান্ত্রিকতা ছিল আলোকায়নের সিলসিল। নিৎসে ও স্পেংলাররা আধুনিকতাকে ‘নিহিলিজিম’ দিকে ধাবিত করার জন্য এর সমালোচনা করেছিলেন। স্মিটের কাছে রোমের পদযাত্রা জরুরি অবস্থাকেই বাস্তবে হাজির করেছিল। প্রবল পাণ্ডিত্য দিয়েও স্মিট তাঁর ফ্যাসিবাদ-মুখী আগ্রহকে লুকায়ে রাখতে পারেননি। তিনি লিখেন, “এখন পর্যন্ত কেবল একবারই মিথের দোহাই দিয়ে মানবজাতির গণতন্ত্র ও পার্লামেন্টারিজমকে অবজ্ঞাভরে সরিয়ে দেয়া সম্ভব হয়েছে, এবং এটা ছিল জাতীয় মিথের অযৌক্তিক ক্ষমতার নজির। ১৯২২ সালের অক্টোবরে ন্যাপলসে পদযাত্রার পূর্বে মুসোলিনি বলেছিলেন, ‘আমরা একটি মিথ তৈরি করেছি, এই মিথ একটি বিশ্বাস, এক মহান উদ্দীপনা। এটা বাস্তব হওয়ার প্রয়োজন নেই, বরঞ্চ এটা আকাঙ্ক্ষা, আশা, বিশ্বাস এবং সাহসিকতা। আমাদের মিথ হচ্ছে জাতি; যে মহান জাতিকে আমরা আমাদের জন্য মূর্ত বাস্তবে পরিণত করতে চাই”।

স্মিট মুসোলিনির ‘জাতীয় মিথের’ এই সমাবেশকে ‘এংগ্লো-স্যাক্সন লিবারেলবাদ ও সংসদীয় গণতন্ত্রের চিন্তার যুক্তিবাদের পতনের সবচেয়ে শক্তিশালী আলামত’ হিসেবে উদযাপন করেছিলেন। (আমরা এখন স্মিটের অবস্থানকে পোস্ট-লিবারেলিজম বা উত্তর-লিবারেলবাদ বলে ডাকতে পারি)। ইতালীয় ফ্যাসিবাদ ছিল রক্ষণশীল বিপ্লবী রাজনৈতিক উত্থানের এক নতুন সাহসী বিশ্বের পূর্বাভাস: এটি ছিল ‘শৃঙ্খলা, নিয়মানুবর্তিতা এবং ক্রমাধিকারতন্ত্রের’ (order, discipline, and hierarchy) মূল্যবোধের ওপর প্রতিষ্ঠিত ‘কর্তৃত্বের’ (Herrschaft) এক গৌরবময় রূপ।  মুসোলিনির এই ক্ষমতা দখল নিছক একটি ‘শাসন পরিবর্তন’ (regime change) ছিল না। এটি ছিল ‘১৭৮৯ সালের ধারণাসমূহের’ জন্য একটি গুণগত পরাজয়, এবং প্রতিবিপ্লবী চেতনার এক জোরালো বিজয়। এই প্রতিবিপ্লবী চেতনার প্রতিনিধিত্ব করতেন ‘রাষ্ট্রের ক্যাথলিক দার্শনিকেরা’—যাদের স্মিট অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন। তাঁরা হলেন: জোসেফ দে মেস্ত্রে (১৭৫৩-১৮২১), লুই দে বোনাদ (১৭৫৪-১৮৪০) এবং অপেক্ষাকৃত স্বল্প পরিচিত স্প্যানিশ দার্শনিক হুয়ান দোনোসো কোর্তেস (১৮০৯-১৮৫৩)।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর স্মিট যে রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছিলেন তা হলো কীভাবে একটি ঈশ্বরহীন সেকুলার যুগে প্রতিবিপ্লবী চিন্তার মূলনীতিগুলিকে ‘বাস্তবায়ন’ করা যায়। কারণ, এই যুগ ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক কর্তৃত্বের দুটি স্তম্ভ—সিংহাসন এবং বেদি —এর ওপর আক্রমণ চালিয়ে নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্রকে একটি কার্যকর রাজনৈতিক বিকল্প হিসেবে বিলীন করে দিয়েছিল। অ্যাকশন ফ্রাঁসেসের নেতা, স্মিটের ফরাসি প্রতিরূপ চার্লস মরাও (Charles Maurras) এই দ্বিধার সাথে সংগ্রাম করেছিলেন। মরা সম্পাদিত অ্যাকসিওঁ ফ্রঁসেজ (Action Française) এর একজন আগ্রহী পাঠক ছিলেন স্মিট। তিনি ম্যুরসকে ফ্রান্সের সবচেয়ে আকর্ষণীয় চিন্তাবিদ হিসেবে গণ্য করতেন। মরার যদিও ১৭৮৯ সালের ঐতিহ্যের প্রতি প্রতিবিপ্লবী বিরাগ ছিল, তবুও তিনি ঐতিহাসিকভাবে রাজতন্ত্রের প্রতি অনড় ছিলেন। বিপরীতে, স্মিট একটি অগ্রবর্তী প্রতিরক্ষামূলক [ফরোয়ার্ড ডিফেন্স] পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, অর্থাৎ, তিনি আক্রমণের দিকে ঝুঁকেছিলেন। তিনি যাকে বলতেন লিবারেলত্তোর যুগের সূচনা, সেখানে স্মিট স্বৈরতন্ত্রের এক বিশেষ মত দিয়ে ঐতিহ্যবাহী বা প্রাচীনপন্থী সকল কিছুর সাথে বিচ্ছিন্নতা ঘটিয়েছিলেন।

স্মিট তাঁর কর্তৃত্ববাদী মতবাদের জন্য মেস্ত্রে এবং দোনোসো কোর্তেসের প্রতিবিপ্লবী মতবাদগুলিতে প্রচুর আদর্শিক সমর্থন খুঁজে পেয়েছিলেন। এঁরা দুজনই স্মিটের বুদ্ধিবৃত্তিক পূর্বসূরিদের মধ্যে এক বিশেষ স্থান অধিকার করেছিলেন। ১৮২১ সালে মেস্ত্রে Les Soirées de St. Petersbourg গ্রন্থে স্মিটের মতোই ‘রাজনৈতিক ধর্মতত্ত্বের’ একজন প্রবক্তা হিসেবে বলেন, জল্লাদ হচ্ছেন পৃথিবীতে ঈশ্বরের দূত এবং খোদাবি ইনসাফের কর্তা। মেস্ত্রে জল্লাদকে একটি puissance créatrice, অর্থাৎ একটি সৃজনশীল শক্তি, এবং একটি être extraordinaire, অর্থাৎ একটি অসাধারণ সত্তা হিসেবে দেবত্ব আরোপ করেছিলেন। মেস্ত্রে মনে করতেন যে, মানবজাতির মন্দের প্রতি জন্মগত প্রবণতার পরিপ্রেক্ষিতে, জল্লাদই ছিলেন সেকুলার শৃঙ্খলার চূড়ান্ত নিশ্চয়তাদানকারী। এই কারণেই, কেবল তিনিই মানব সমাজকে নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলার অতল গহ্বরে দ্রুত পতিত হওয়া থেকে রক্ষা করতে পারেন।

তবে, দোনোসো কোর্তেসের অতুলনীয় রাজনৈতিক দূরদর্শিতাই শ্মিটের দিগন্তকে প্রসারিত করেছিল। এর ফলে স্মিট প্রাচীনপন্থী রক্ষণশীলতার সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করতে সক্ষম হন—যে রক্ষণশীলতা (যেমন চার্লস মরার ক্ষেত্রে দেখা যায়) অতীত নিয়ে আচ্ছন্ন এবং নিস্ফল ছিল। স্মিট Political Theology-তে ডোনোসো কর্টেসকে দোনোসো কোর্তেসকে ‘সিদ্ধান্তবাদী চিন্তার’ এক আদর্শ উদাহরণ এবং ‘একজন ক্যাথলিক রাষ্ট্র দার্শনিক’ হিসেবে প্রশংসা করেন, যিনি ‘সমস্ত রাজনীতির অধিবিদ্যক সারবস্তু সম্পর্কে গভীরভাবে সচেতন ছিলেন’। স্মিটের মতে, ১৮৪৮ সালের বিপ্লবের ধ্বংসাত্মক প্রকৃতি থেকে সহি-উপসংহার টানা একমাত্র প্রতি-বিপ্লবী চিন্তাবিদ ছিলেন দোনোসো কোর্তেস। বাকুনিন এবং প্রুধোঁর মতো ‘খোদাহীন নৈরাজ্যবাদীরা’ প্রাচীন/পূর্বতন শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে এই বিপ্লবকে পরিচালিত করেছিলেন। সেই সহি-উপসংহারটি হলো: নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্র নিঃসন্দেহে অতীতের বিষয় হয়ে গেছে। এটর সমাপ্তি ঘটে গিয়েছে।’ স্মিট Political Theology-তেবলছেন, ‘আর কোনো রাজা নেই, রাজতন্ত্র যুগের অবসান ঘটেছে’। ফলে এমতাবস্থায় দোনোসো কোর্তেস যে উপসংহারে পৌঁছেছিলেন তা হলো, যেহেতু ‘প্রথাগত অর্থে রাজতন্ত্রের আর বৈধতা ছিল না, … একমাত্র সমাধান ছিল : স্বৈরতন্ত্র/ একনায়কত্ব’।   

দোনোসো কোর্তেস একনায়কত্বকে একটি অলঙ্ঘনীয় এবং পবিত্র সিদ্ধান্ত হিসেবে মহিমান্বিত করেছিলেন। স্মিটের কাছে এই সিদ্ধান্ত ছিল এমন একটি ‘সিদ্ধান্ত যা যুক্তিভিত্তিক প্রমাণের উপর নির্ভর করে না’ এবং যা ‘কোনো সন্দেহ বা আলোচনাকে সমাপ্ত করে দেয়’। দোনোসো কোর্তেসের ‘সিদ্ধান্তবাদের’ সাথে স্মিটের মোলাকাত ছিল তাঁর রাজনৈতিক দর্শনের আদি দৃশ্য। ১৯২৫ সালে Roman Catholicism as Political Form-এ স্মিট যাকে রাজনৈতিক ধর্মতত্ত্ব এবং সেকুলার রাজনৈতিক শাসনের মধ্যেকার ‘পরস্পরবিরোধী উপাদানসমূহের জটিলতা’ বর্ণনা করছেন, তা আসলে কোর্তেসের সাথে সেই মোলাকাতেরই ফল। এনার্কিস্ট ও সমাজতান্ত্রিকদের সম্পর্কে দোনোসো কোর্তেসের যে খ্রিষ্টতাত্ত্বিক মনোভাব  ছিল সেটাই গ্রহণ করেছিলেন স্মিট। তিনি/তারা মনে করতেন এনার্কিস্ট ও সমাজতান্ত্রিকরা খ্রিষ্ট-বিরোধী, যাদের লক্ষ্যই হচ্ছে ‘শয়তানের প্রচার’। স্মিট মনে করতেন, দোনোসো কোর্তেস সঠিকভাবেই বুঝেছিলেন যে, ‘নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্র’ এবং ‘খোদাহীন নৈরাজ্যবাদ’ মধ্যেকার ঐতিহাসিক লড়াইটি নিছক আরেকটি দুনিয়াবি রাজনৈতিক সংঘাতের ঘটনা ছিল না, বরঞ্চ এটা ছিল এমন এক ঘটনা যেখানে কেয়ামতের বা শেষবিচারের পূর্বাভাস ছিল।  

রাজনীতিকে ভালো ও মন্দের মধ্যেকার একটি চূড়ান্ত সংগ্রাম হিসেবে দেখার দোনোসো কোর্তেসে যে এপোক্যালিপ্টিক দৃষ্টিভঙ্গি সেটাই স্মিটের ‘সিদ্ধান্তবাদ’ ভিত্তিমূল হয়ে উঠেছিল। স্মিট ‘সিদ্ধান্ত’কে এমন একটি শক্তি হিসেবে প্রশংসা করেছিলেন যা ‘সমস্ত নিয়মতান্ত্রিক বাঁধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে এবং এর মাধ্যমে পরম ক্ষমতা হয়ে ওঠে’। তাই, স্মিটের মতে, এটি ছিল একনায়কত্বের দিকে যাবার ‘রাজকীয় পথ’। তিনি যেমন Political Theology-তে ব্যাখ্যা করেছেন:

রাষ্ট্রের প্রতি-বিপ্লবী দার্শনিকদের (যেমন: মেইস্ত্র, দে বোনাদ এবং দোনোসো কোর্তেস) প্রকৃত তাৎপর্য নিহিত রয়েছে তাঁরা যার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন তা-তে। তাঁরা সিদ্ধান্তের মুহূর্তটিকে এমন স্তরে উন্নীত করেছিলেন যেখানে বৈধতার (legitimacy) ধারণাটি শেষ পর্যন্ত বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। দোনোসো কোর্তেস যখন উপলব্ধি করলেন যে রাজতন্ত্রের যুগের অবসান ঘটেছে কারণ আর কোনো রাজা নেই… তিনি তাঁর সিদ্ধান্তবাদকে তার যৌক্তিক উপসংহারে টানেন: তিনি একটি রাজনৈতিক স্বৈরতন্ত্রের দাবি জানান।…দোনোসো কোর্তেস নিশ্চিত ছিলেন যে চূড়ান্ত যুদ্ধ আসন্ন। চরম মন্দের (radical evil) মুখে, একমাত্র সমাধান হলো স্বৈরতন্ত্র।

রাজনৈতিক-ধর্মতাত্ত্বিক তাৎপর্য সম্পর্কে দোনোসো কোর্তেসের যে স্বৈরতন্ত্র-বিষয়ক দিব্যোপলব্ধি, তা দস্তয়েভস্কির ‘দ্য ব্রাদার্স কারামাজভ’ উপন্যাসের ‘গ্র্যান্ড ইনকুইজিটর’ উপাখ্যানটির পূর্বাভাস দিয়েছিল। স্বৈরতন্ত্র নিয়ে স্মিটের দৃষ্টিভঙ্গি এবং দস্তয়েভস্কির এই রূপক আলোচনার মধ্যে যে গুরুত্বপূর্ণ সাদৃশ্য ছিল, তা ইহুদি ধর্মতত্ত্ববিদ জ্যাকব টাউবেসের চোখ এড়ায়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, টাউবেস গভীর মনোযোগ সহকারে শ্মিটের সঙ্গে বিতর্ক করেছিলেন, যাঁকে তিনি ‘প্রতি-বিপ্লবের সর্বনাশা ভাববাদী’ বলে আখ্যায়িত করেন এবং যাঁর সঙ্গে তাঁর আগ্রহদ্দীপক চিঠিপত্র বিনিময় হয়েছিল। মানবজাতির পাপের রাজনৈতিক পরিণতি সম্পর্কে দস্তয়েভস্কির এই উপাখ্যানকে শ্মিট যে টোটোমিক (পবিত্র) গুরুত্ব দিয়েছিলেন, সে বিষয়ে টাউবেসের মন্তব্যগুলি বিশেষভাবে উদ্ধৃত করার মতো:

‘আমি দ্রুতই কার্ল স্মিটকে দস্তয়েভস্কির গ্র্যান্ড ইনকুইজিটরের একটি প্রতিমূর্তি হিসেবে দেখতে শুরু করেছিলাম। ১৯৮০ সালে প্লেটেনবার্গে এক উত্তপ্ত কথোপকথনের সময় শ্মিট আমাকে বলেছিলেন যে, যে কেউ যদি এটা বুঝতে ব্যর্থ হয় যে গ্র্যান্ড ইনকুইজিটর জেসুইটদের ভাবপ্রবণ ধার্মিকতা (sentimentality of Jesuitical piety) সম্পর্কে সঠিক ছিলেন, তবে সে গির্জা কীসের জন্য, কিংবা দস্তয়েভস্কি—নিজের বিশ্বাসের বিপরীতে গিয়েও—’সমস্যা উত্থাপনের নিছক শক্তির দ্বারা বাধ্য হয়ে সত্যিই কী প্রকাশ করেছেন’, তা কিছুই বুঝতে পারেনি।… আমি সবসময় আগ্রহ নিয়ে কার্ল শ্মিটকে পড়তাম, তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক দীপ্তি এবং সংক্ষিপ্ত শৈলীতে প্রায়শই মুগ্ধ হতাম। কিন্তু প্রতিটি শব্দে আমি আমার কাছে এলিয়েন কিছু অনুভব করতাম; ঝড়ের পূর্বে যে ভয় ও উদ্বেগ হয় সেটা অনুভব করতাম, যেই উদ্বেগ মার্কসবাদের সেকুলার মসিহ-কেন্দ্রিক শিল্পের মধ্যে লুকিয়ে আছে। আমার কাছে কার্ল শ্মিটকে সমস্ত ধর্মদ্রোহীর গ্র্যান্ড ইনকুইজিটর বলে মনে হয়েছিল’।

জ্যাকব টাউবেসের অনুভূতির পক্ষে সমর্থন পাওয়া যায় স্মিটের মিউনিখ জীবনের এক বন্ধুর কাছ থেকে। ১৯২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে লেখা একটি চিঠিতে, হারমান মের্ক শ্মিটকে কিছুটা কৌতুকের সুরে প্রস্তাব করেছিলেন: ‘যদি কেউ মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে স্প্যানিশ ইনকুইজিশনকে ন্যায্য প্রতিপন্ন করার জন্য একটি ‘অধ্যাপক পদ’ (Lehrstuhl) প্রতিষ্ঠা করে, তবে সেই পদটি দখল করার জন্য আপনিই হবেন আদর্শ ব্যক্তি, এবং আমি হতাম আপনার সবচেয়ে অনুগত ছাত্র!’

সিদ্ধান্তগ্রহণে একনায়কত্ব/ স্বৈরতন্ত্রের সার্বভৌম এখতিয়ারকে মহিমান্বিত করে স্মিট যে বলেন, এটা এমন কিছু যা ‘যে কোনো আলোচনার সমাপ্তি টেনে দেয়’, তা ১৯৩১ সালের বিখ্যাত আইনবিদ হ্যানস কেলসেনের সাথে ‘সংবিধানের রক্ষক কে’ বিষয়ে ঐতিহাসিক বাহাসের কালে আবারও ফিরে আসে। দুই বছর পরে ইহুদি হওয়ার কারণে কেলসেন জার্মানি ছাড়তে বাধ্য হন। স্মিটের অসংখ্য সমর্থক তাঁর নির্বাহী সার্বভৌমত্বের পক্ষের সমর্থনকে রাজনৈতিক চরমপন্থা, বাম এবং ডান উভয় দিক থেকে, ভায়মার প্রজাতন্ত্রকে রক্ষা করার শেষ চেষ্টা হিসেবে চিত্রিত করেছেন। তাঁরা স্মিটের বিশ্ব-দৃষ্টিভঙ্গির রাজনৈতিক-ধর্মতাত্ত্বিক ভিত্তিকে বিবেচনায় নেননি। স্মিটের সাথে সেই বাহাসে কেলসেন শেষ অবলম্বন হিসেবে ফেডারেল সাংবিধানিক আদালতকে শক্তিশালী করার পক্ষে ওকালতি করেছিলেন। বিপরীতে, স্মিট ভায়মার সংবিধানের কুখ্যাত জরুরি ক্ষমতার বিধান, আর্টিকেল ৪৮-এর উপর ভিত্তি করে, একটি ‘সার্বভৌম’ রাষ্ট্রপতিশাসিত একনায়কত্বের পক্ষে যুক্তি দিয়েছিলেন। রাজনৈতিক ধর্মতত্ত্বে স্মিটের দৃঢ় আস্থাকে বিবেচনায় নিলে এই উপসংহার এড়িয়ে যাওয়া কঠিন যে, কেলসেনের সাথে বাহাসে তিনি গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক ও নিয়মতান্ত্রিক নিশ্চয়তাগুলোকে ধ্বংস করে গণতন্ত্রকে ‘রক্ষা’ করার পক্ষে যুক্তি দিয়েছিলেন। যেমন জুর্গেন হেবারমাস যথার্থই মন্তব্য করেছেন, “যিনি ‘সংবিধানের রক্ষক’ হিসেবে সাংবিধানিক আদালতকে নির্বাহী বিভাগের প্রধান দিয়ে প্রতিস্থাপন করতে চান’ – যেমনটি কার্লস্মিট চেয়েছিলেন তৎকালের জার্মান রাষ্ট্রপতিকে দিয়ে – তিনি সাংবিধানিক রাষ্ট্রের ক্ষমতার পৃথকীকরণ ধারণার অর্থকে একেবারে বিপরীতে প্যাচ খেয়ে দেন। 

এক বছর পরে, ১৯৩২ সালের জুলাই মাসে স্মিট কুখ্যাত Preussenschlag (প্রুশিয়ান অভ্যুত্থান) বিতর্কে একটি মূল ভূমিকা পালন করেন। এটি ছিল চ্যান্সেলর ফ্রাঞ্জ ফন প্যাপেনের প্রুশিয়ার সমাজতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে একটি সাংবিধানিক অভ্যুত্থান। স্মিট লাইপজিগের ফেডারেল আদালতে রাইখের পক্ষে জোরালোভাবে মামলা লড়েছিলেন। চ্যান্সেলর হিসেবে ফন পাপেন নাৎসিদের অনুগ্রহ লাভের একটি ভুল ধারণাপ্রসূত প্রচেষ্টায় এসএ-র (SA) উপর থেকে ফেডারেল নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়ে প্রুশিয়ার নাগরিক বিশৃঙ্খলার জন্য যথেষ্ট অবদান রেখেছিলেন। ১৯৩৩ সালের জানুয়ারী মাসে, ফন প্যাপেন হিটলারের ভাইস-চ্যান্সেলর হিসেবে মনোনীত হন। এপ্রিল মাসে, তিনি বার্লিনের ফেডারেল সরকারের সাথে Länder (প্রাদেশিক সরকার)-কে একীভূত করে আইন প্রণয়নের জন্য স্মিটকে নিযুক্ত করেন। স্মিট কর্তৃক প্রচারিত Gleichschaltung (সমলয় বা একত্রীকরণ) ব্যবস্থাগুলি প্রাদেশিক আইনি স্বায়ত্তশাসনের শেষ অবশিষ্টাংশগুলি দূর করে কার্যকরভাবে ভায়মার প্রজাতন্ত্রের মৃত্যুর ঘণ্টা বাজিয়েছিল। এই পদক্ষেপগুলি নাৎসিদের সর্বাত্মক শাসন সুসংহত করার পথে ছিল এক অপরিবর্তনীয় বিন্দু।

ভায়মার প্রজাতন্ত্রের সাংবিধানিক স্থিতিশীলতাকে দুর্বল করার জন্য স্মিটের সমন্বিত প্রচেষ্টা এবং নবজাতক হিটলারীয়-রাষ্ট্রকে আইনি বৈধতার একটি পাতলা আবরণ প্রদানে তিনি যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন, তার পরিপ্রেক্ষিতে, যুদ্ধোত্তরকালে তাঁকে যে ‘ভায়মার প্রজাতন্ত্রের কবর খননকারী’ হিসেবে অভিহিত করা হয়, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। ভায়মার প্রজাতন্ত্রের পতনে স্মিট যে মূল ভূমিকা পালন করেছিলেন, তা মেস্ত্রে, দে বোন্ড, এবং ডোনোসো কর্টেসের প্রতিবিপ্লবী রাজনৈতিক ধর্মতত্ত্বের প্রতি তাঁর অন্তর্নিহিত প্রতিশ্রুতি থেকে আলাদা করে বোঝা যায় না। ‘১৭৮৯ সালের ঐতিহ্য’-এর প্রতি তাঁদের আন্তরিক বিতৃষ্ণার সাথে তাল মিলিয়ে স্মিট উনিশ শতকে রাজনৈতিক লিবারেলবাদের উত্থানকে একই রকম অবজ্ঞার চোখে দেখতেন। ১৮৪৮ সালের বিপ্লবের পর, দোনোসো কোর্তেস—যিনি ছিলেন রাজতন্ত্রের এক নির্ভীক রক্ষক এবং ফ্রাঙ্কো ও সালাজারের ‘ধর্মীয় ফ্যাসিবাদ’-এর আদর্শিক অগ্রদূত—এক নতুন প্রজন্মের রাজনৈতিক উগ্রপন্থীদের ধর্মদ্রোহী প্রচেষ্টাগুলিকে ‘নিছক শয়তানবাদ’ বলে নিন্দা করেছিলেন।

তাঁর প্রতিবিপ্লবী সিলসিলার প্রতি বিশ্বস্ত থেকে, সংসদীয় রাজনীতি এবং আইনের শাসনের বিরুদ্ধে স্মিটের জীবনব্যাপী আদর্শিক বিদ্বেষ একই ধরনের রাজনৈতিক-ধর্মতাত্ত্বিক উদ্বেগের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিল। স্মিটও আধুনিক সেকুলারবাদের মূলনীতি এবং এর রাজনৈতিক নিম্নোক্ত অনুসিদ্ধান্তগুলির প্রতি প্রবল বিতৃষ্ণা প্রদর্শন করেছিলেন: মানবতাবাদ, উদারতাবাদ, সাংবিধানিকতা এবং সামাজিক গণতন্ত্র। ফলস্বরূপ, নাৎসিদের ক্ষমতা দখলের পরে, স্মিট হিটলারকে প্রতিরোধক হিসেবে মহিমান্বিত করতে কোনো দ্বিধা করেননি। স্মিটের মতে হিটলার খ্রিস্টবিরোধীদের আগমনকে ঠেকিয়ে রেখেছিলেন। এই খ্রিস্টবিরোধীদের সমসাময়িক দালাল/এজেন্ট হচ্ছেন রাজনৈতিক বামপন্থার খোদাহীন ও ধর্মদ্রোহী প্রতিনিধিরা: উদারপন্থী, সমাজতান্ত্রিক, বলশেভিক, কমিউনিস্ট, নৈরাজ্যবাদী, এবং অবশ্যই ইহুদিরা।

স্মিট The Crisis of Parliamentary Democracy গ্রন্থের ‘প্রত্যক্ষ বলপ্রয়োগের অযৌক্তিক্ তত্ত্বসমূহ’ শীর্ষক অধ্যায়ে ‘জাতীয় মিথ’-এর ধারণাকে মহিমান্বিত করেছিলেন। তার আলোচনা ছিল সময়োপযোগী। ১৯১৭ সালের অক্টোবরে লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিকরা আলেকজান্ডার কেরেনস্কির অস্থায়ী সরকারকে উৎখাত করে এবং চৌষট্টি বছরের নৃশংস একনায়কতান্ত্রিক শাসন কায়েম করেছিল। রাশিয়ার ঘটনাগুলোর একটি উল্লেখযোগ্য প্রভাব ছিল। ১৯১৯ সালে, বাভারিয়া এবং হাঙ্গেরিতে বলশেভিক-অনুপ্রাণিত ‘সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র’ ঘোষিত হয়েছিল। তবে, কয়েক মাসের মধ্যে, উভয় শাসনকে প্রতিবিপ্লবী মিলিশিয়ারা নির্মমভাবে দমন করেছিল, যাকে ‘শ্বেতসন্ত্রাস’ বলা হয়ে থাকে। 

জার্মান Freikorps এবং ইতালীয় squadre d’azione-এর মতো আধাসামরিক প্রবীণ গোষ্ঠীগুলির মধ্যে এই সহিংসতাকে একটি সেকুলার ধর্মের স্তরে উন্নীত করা হয়েছিল। মধ্য ও পূর্ব ইউরোপে, ডানপন্থী শক্তিগুলি প্রায়শই ইহুদিদের টার্গেট করে ‘বলশেভিক আপদ’ চিহ্নিত করতো, যদিওবা বেশিরভাগ ইহুদিই কমিউনিজমের বিরুদ্ধে দৃঢ়ভাবে অবস্থান নিয়েছিলেন। জার্মানিতে, বাভারিয়ার প্রধানমন্ত্রী কার্ট এইসনারকে ১৯১৯ সালে এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াল্টার রাথেনাউকে ১৯২২ সালে হত্যার পিছনে ইহুদিবিদ্বেষ ছিল আদর্শিক অনুঘটক। রাশিয়া এবং পূর্ব ইউরোপে, প্রবল ইহুদিবিদ্বেষ নির্বিচারে এবং রক্তক্ষয়ী ধ্বংসযজ্ঞে উস্কানি দিয়েছিল। ১৯১৮ থেকে ১৯২১ সাল পর্যন্ত রাশিয়ার গৃহযুদ্ধের সময় ইউক্রেনের প্রতিবিপ্লবী সেনাবাহিনী আনুমানিক ত্রিশ হাজার ইহুদিকে হত্যা করেছিল।

যুদ্ধের সময় স্মিট মিউনিখে নিযুক্ত ছিলেন, যেখানে তিনি জার্মান জেনারেল স্টাফের গোয়েন্দা পরিষেবায় কাজ করতেন। তাঁর প্রাথমিক দায়িত্ব ছিল প্রতিবেশী সুইজারল্যান্ডের বামপন্থী রাজনীতিবিদ এবং শান্তিবাদীদের মধ্যেকার যোগাযোগ পর্যবেক্ষণ করা। মিউনিখে শ্বেত সন্ত্রাস — যার বেশিরভাগই স্মিট নিজেই প্রত্যক্ষ করেছিলেন— ছিল বিশেষভাবে রক্তক্ষয়ী। ছয় শতাধিক লোক প্রাণ হারিয়েছিল, শত্রুতা শেষ হওয়ার পরেও ‘সোভিয়েত-প্রজাতন্ত্রের’ অসংখ্য সহানুভূতিশীলকে দ্রুত মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। একইভাবে, হাঙ্গেরিতে, যখন ১৯১৯ সালের আগস্ট মাসে বেলা কুনের সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের পতন ঘটে, তখন ১,৫০০ জনকে হত্যা করা হয়েছিল, যা ‘লাল’দের হাতে নিহতদের সংখ্যার তিন গুণেরও বেশি।

১৯১৮ সালের নভেম্বরে জার্মানিতে বামপন্থী বিপ্লবের পরে যে রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হয়েছিল, যখন Kaiserreich-এর পতনের পরে শ্রমিক ও সৈন্যদের কাউন্সিলগুলি দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল, তাকে সঠিকভাবে একটি স্থায়ী ‘জরুরি অবস্থা’ হিসেবে বর্ণনা করা যেতে পারে। যুদ্ধের বছরগুলি — যখন বেসামরিক শাসন বাস্তবে লুডেনডর্ফ-হিন্ডেনবার্গ একনায়কত্বের পক্ষে স্থগিত করা হয়েছিল — এবং যুদ্ধোত্তরকালে সামরিক আইনের দীর্ঘস্থায়িত্ব স্মিটকে জরুরি অবস্থাকে নতুন স্বাভাবিক হিসেবে গ্রহণ করতে উৎসাহিত করেছিল। এটি আধুনিক রাজনৈতিক দর্শনের শব্দভান্ডারে তাঁর অন্যতম অবদান হয়ে ওঠে। এটি কর্তৃত্ববাদী শাসনের প্রতি তাঁর প্রতিশ্রুতি এবং রাজনীতিতে বেসামরিক হস্তক্ষেপের প্রতি তাঁর অনাস্থাকে জোরদার করেছিল। ১৯১৬ সালে স্ট্রাসবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে স্মিটের উদ্বোধনী বক্তৃতাতে ‘Dictatorship and State of Siege’ এর সাংবিধানিক (প্যারামিটারগুলি পরীক্ষা করেছিল। ‘সাংবিধানিকতা’ এবং ‘লিগ্যালিজম’-এর উপর একনায়কত্বের শ্রেষ্ঠত্ব আরোপ করেছিলেন, কেননা, উভয়ই জরুরি অবস্থায় রাজনৈতিক সার্বভৌমকে জোরালোভাবে এবং সিদ্ধান্তমূলকভাবে কাজ করার ক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করেছিল। এটাই স্মিটের কাজের মূল বিষয় হয়ে ওঠে। অতএব, এটি মোটেও কাকতালীয় নয় যে, ১৯২১ সালে স্মিট তাঁর প্রথম প্রধান পাণ্ডিত্যপূর্ণ কাজগুলির মধ্যে একটা হচ্ছে : Dictatorship। 

Speech at the Reich Foundation Celebration on January 18, 1930, at the Berlin School of Economics

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং পরবর্তীকালে গৃহযুদ্ধের যে সহিংসতা শুরু হয়েছিল তা ১৯২৭ সালে The Concept of the Political-এ স্মিটের রাজনীতির বিখ্যাত পুনঃধারণায়নকে এমনভাবে প্রভাবিত করেছিল যে তিনি রাজনীতিকে ‘দুশমন’ থেকে ‘দোস্ত’কে আলাদা করার ক্ষমতা হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন। এটিই ছিল রাজনীতির সারমর্ম, এমনকি সম্পূর্ণতা। রাজনীতির ‘চূড়ান্ত যুক্তি’ হিসেবে যুদ্ধের মাধ্যমে সার্বভৌমত্বকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে স্মিয় ১৯১৯ সালে লীগ অফ নেশনস প্রতিষ্ঠার পরে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার পক্ষে যে ক্রমবর্ধমান ঐকমত্য তৈরি হচ্ছিল, তার বিরোধিতা করতে চেয়েছিলেন। সেই বছর স্পেংলারের Prussianism and Socialism-এ স্থাপিত নজির অনুসরণ করে, স্মিট প্রুশিয়ান সামরিকবাদের মূল্যবোধের সমর্থনে একটি জরুরি সংক্ষিপ্তসার লিখেছিলেন। স্মিট জোর দিয়েছিলেন, ‘দোস্ত, দুশমন এবং সংগ্রাম (Kampf) এই ধারণাগুলি তখনই তাদের আসল অর্থ লাভ করে, যখন তারা শারীরিক বিনাশের বাস্তব সম্ভাবনার সাথে সম্পর্কিত হয় এবং তা বজায় রাখে। শত্রুতা থেকে যুদ্ধের জন্ম হয়, [অর্থাৎ] অন্য একটি সত্তার অস্তিত্বগত অস্বীকার থেকে’। তিনি আরো লিখেন, ‘রাজনৈতিক দুশমনি হলো অপর, এলিয়েন; এবং এটাই যথেষ্ট যে তার সারবত্তায় সে বিশেষভাবে নিবিড় অর্থে অস্তিত্বগতভাবে ওপর ও এলিয়েন… যুদ্ধ, যুদ্ধরত মানুষের মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি, দুশমন শিবিরে থাকা অন্যান্য মানুষের শারীরিক বিনাশ—এই সবকিছুর কোনো আদর্শগত অর্থ নেই, আছে কেবল অস্তিত্বগত অর্থ’। আধুনিক জমানায় লেখা সবচেয়ে ভয়াবহ শব্দগুলির মধ্যে এগুলি থাকতে পারে। স্মিট যুক্তি ও নিয়মের একটি যৌক্তিক বিশ্বকে এমন এক প্রাক-যৌক্তিক, মূর্ত নির্মমতার দ্বারা প্রতিস্থাপন করতে চেয়েছিল, যেখানে সহনশীলতা বেঁচে থাকার জন্য ক্ষতিকর ছিল এবং যুদ্ধ ছিল চিরন্তন।

The Concept of the Political গ্রন্থে স্মিটের আরেকটি অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল ফ্রন্টজেনারেশন (Frontgeneration – অর্থাৎ প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেওয়া সৈনিকদের প্রজন্ম)-এর যুদ্ধবাদী নীতিকে চিরস্থায়ী করা। এটি ছিল আর্নস্ট ইয়ুঙ্গারের মতো অন্যান্য রক্ষণশীল বিপ্লবী বুদ্ধিজীবীদেরও একটি উদ্দেশ্য। ইয়ুঙ্গার ছিলেন একজন রক্ষণশীল এবং অসাধারণ লেখক, যাঁর সাথে স্মিটের পঞ্চাশ বছরের চিঠিপত্রের আদানপ্রদান শুরু হয় ১৯৩০ সালে এবং শেষ হয় ১৯৮৩ সালে। হেবারমাস উল্লেখ করেছিলেন, ‘স্মিট প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ‘স্টর্মস অফ স্টিল’ দ্বারা মুগ্ধ ছিলেন, এটি আর্নস্ট ইয়ুঙ্গারের যুদ্ধ-ডায়েরির শিরোনাম… জীবন-মৃত্যুর সংগ্রামে একত্রিত একটি জাতি বহিরাগত শত্রু এবং অভ্যন্তরীণ বিশ্বাসঘাতক উভয়ের বিরুদ্ধেই তার অনন্যতাকে জোরের সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করে।’ এক পর্যায়ে, স্মিট নিশানা করার কৌশল থেকে একটি রূপক টেনে এনে ঘোষণা করেন যে ‘বৃহৎ রাজনীতির শীর্ষবিন্দু হলো সেই মুহূর্ত, যখন শত্রু স্পষ্টভাবে শত্রু হিসেবে দৃশ্যমান হয়।’ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রতিক্রিয়াতে যে যুদ্ধবিরোধী ও আন্তর্জাতিক ঐক্যের চেতনা গড়ে উঠছিল, যা ১৯২৮ সালে কেলগ-ব্রায়াণ্ড চুক্তিতে চূড়ান্ত রূপ নিয়েছিল, স্মিট তাঁর এই গ্রন্থে এই চেতনার বিরুদ্ধে লড়াই করতে চেয়েছিলেন। 

স্মিট মনে করতেন যুদ্ধের প্রস্তুতিই ‘রাজনীতি’র অস্তিত্বের কারণ। তাঁর দি কনসেপ্ট অফ দি পলিটিক্যাল গ্রন্থে সামাজিক ডারউইনবাদের এক চোরাগোপ্তা প্রবাহ রয়েছে। এই প্রবাহই ১৯৪০ এর দশকের প্রথম দিকে বিতর্কিত ‘Grossraum’ মতবাদের উদগাতা, যা কিনা ‘প্রাকৃতিক অধিকার’কে ‘শক্তিশালীর অধিকার’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছিলে। যদিও স্মিটের সমর্থকরা তাঁকে ম্যাকিয়াভ্যালি ও হবসের সিলসিলার রাজনৈতিক বাস্তববাদী হিসেবে চিত্রিত করতে চান, কিন্তু স্মিট যেভাবে যুদ্ধকে ‘লড়াইরত মানুষের মৃত্যুর প্রস্তুতি, দুশমন শিবিরে থাকা লোকের শারিরীক বিনাশ… [এই কারণে] অন্য সত্তার অস্তিত্বগত অস্বীকার’ হিসেবে মহিমান্বিত করতে চান, তাতে সেই সিলসিলার সাথে খাপ খায় না। দিনশেষে হবসের লেভিয়াথনের মূল কথা ছিল একটি সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে সকল যুদ্ধকে অতিক্রম করা, যুদ্ধকে উদযাপন ও প্রসারণ করা হয়।  

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে ইউরোপের আদর্শগত ও রাজনৈতিক অস্থিরতা স্মিটের মধ্যে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সম্পর্কে একটি বদ্ধমূল ভয় তৈয়ার করে। ইহুদি-বলশেভিজম সম্পর্কে অতিরঞ্জিত ও অনড় ভীতি স্মিটের ভেতর দেখা দেয়। পল হানেব্রিঙ্ক তাঁর The Myth of Judeo-Bolshevism গ্রন্থে যেমনটি পর্যবেক্ষণ করেছেন: ‘ভ্যাটিকান থেকে প্যারিসের সেলুন এবং দক্ষিণ হাঙ্গেরির আধা-সামরিক ব্যারাকে পর্যন্ত, মিউনিখ কাউন্সিল রিপাবলিকের ইতিহাসকে সভ্যতাকে উৎখাত করতে এবং ইউরোপের জাতিগুলোর উপর বিদেশী শাসন চাপিয়ে দেওয়ার জন্য ইহুদিদের ষড়যন্ত্রের প্রমাণ বলে মনে করা হয়েছিল।’ ১৯১০-এর দশক থেকে শ্মিটের ডায়রি ইহুদিবিদ্বেষী গালিতে পরিপূর্ণ। ইহুদিদের সম্পর্কে এমন এক আচ্ছন্নতা সেখানে দেখা যায়, যা প্রায় ক্লিনিক্যাল পর্যায়ের কাছাকাছি। তিনি ছাত্রজীবন এবং বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক হিসেবে তাঁর কর্মজীবনের সময় যেসকল একীভূত ইহুদিদের (assimilated Jews) সাথে নিয়মিত দেখা করতেন, তাদের ক্ষেত্রে তাঁর এই ইহুদিভীতি/বিদ্বেষ বিশেষভাবে তীব্র ছিল। তার মতে, একীভূত ইহুদিদের নিয়ে প্রধান সমস্যা ছিল এই যে, তারা দোস্ত/দুশমনের মধ্যকার স্পষ্ট বিভেদ রেখা প্রতিষ্ঠা করাকে প্রায় অসম্ভব করে তুলেছিল।

১৯১৪ সালের ১৩ অক্টোবরে ডায়েরিতে স্মিট তার ইহুদি-কমপ্লেক্স – অর্থাৎ, ইহুদিদের প্রতি তাঁর আকর্ষণ ও বিতৃষ্ণার মিশ্রণ – নিয়ে কথা বলেছিলেন। জার্মান ইহুদিদের দেখতে সাধারণ জার্মানদের মতো মনে হলেও, স্মিটের মতে, তাদের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য ছিল। দিনশেষে স্মিটের এই ইহুদিভীতি – যা কিনা ১৯১৯ সালের এপ্রিলে ভাবারিয়ান কাউন্সিল রিপাবলিক দমনের কালে ‘ইহুদি-বলশেভিক’ সংক্রান্ত হিস্টেরিয়া তীব্র হয়ে উঠেছিল – তাঁর কাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যে রূপান্তরিত হয়। রাজনৈতিক লিবারেলবাদের বিরুদ্ধে স্মিটের আজন্ম বিরোধীতা ইহুদি প্রভাবিত ‘বিঘ্ন-সৃষ্টিকারী’ এবং ‘ক্ষতিকর’ চরিত্র সম্পর্কিত ভয় থেকে অবিচ্ছেদ্য ছিল। লিবারেলবাদের বিরুদ্ধে তাঁর এই অবস্থানের চরম প্রকাশ ঘটেছিল কেলসেনের ‘নিয়মতান্ত্রিকতা’ অথবা নরম্যাটিজম বিষয়ক বাহাসের কালে। তাঁর রক্ষণশীল বিপ্লবী মিত্ররা ভাইমার রিপাবলিককে ইহুদি-রিপাবলিক বলে সমালোচনা করতেন। তাদের ভাষায় এটা ছিল ‘অ-জার্মান’। স্মিট The Crisis of Parliamentary Democracy গ্রন্থে বলেছিলেন যে, জাতিগত অভিন্নতা হচ্ছে ‘নেতাকেন্দ্রিক গণতন্ত্র’ [লিডার-ডেমোক্রেসি] এর একটি অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য। স্মিট এই নেতাকেন্দ্রিক গণতন্ত্রকে সংসদীয় গণতন্ত্রের উত্তরসূরী হিসেবে কল্পনা করেছিলেন।

স্মিটের ডায়রিতে প্রমাণিত হয় যে, তিনি ইহুদিদের ‘নেপথ্যের কারিগর’ হিসেবে দেখতেন, যারা কিনা গোপনে সকল ঘটনার কলকাঠি নাড়ে। ‘ইহুদি দুনিয়ার ষড়যন্ত্র’ ধারণা তখন রক্ষণশীল বিপ্লবী বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে একটি স্বতঃসিদ্ধ সত্য হিসেবে দেখা হতো। ইতিমধ্যে বিশের দশকেই ‘রাজনৈতিক লিবারেলবাদ’ ও ‘পুরোদস্তুর যান্ত্রিকীকরণ’-এর বিরুদ্ধে স্মিটের  সমালোচনাসমূহ এই ‘ইহুদি দুনিয়ার ষড়যন্ত্র’ ধারণার সাথে সম্পর্কিত ছিল। ঐতিহাসিক শুলামিত ভলকভ যাকে ‘সাংস্কৃতিক কোড হিসেবে ইহুদি-বিদ্বেষ’ বর্ণনা করছিলেন, তার উত্থানের সাথে আধুনিকতাকে ‘নিরপেক্ষতা ও বিরাজনীতিকরণের যুগ’ হিসেবে স্মিটের অভিযোগ খাপে খাপ খেয়ে যায়। মধ্য ইউরোপীয় Zivilisationskritik (সভ্যতার সমালোচনা) -এর আলোচনায়, ইহুদিবিদ্বেষের এজেন্ডা প্রায়শই ‘আধুনিকতা’, ‘পুঁজিবাদ’, ‘প্রযুক্তি’, এবং ‘লিবারেলবাদ’ – এর সমালোচনার শব্দার্থিক ছদ্মবেশে এগিয়ে নেওয়া হতো। ইহুদিবিদ্বেষীরা অভিযোগ করতেন যে, এসব ক্ষেত্রে ইহুদিরা ক্ষতিকর ও অতিমাত্রায় ভূমিকা পালন করেছিল। এই ধারার আক্রমণ পাওয়া যায় ১৯১১ সালে প্রকাশিত ওয়ার্নার সোমবার্টের সুপরিচিত The Jews in Modern Capitalism গ্রন্থে। তিনি সেখানে ইহুদিদের ‘মরুভূমির যাযাবার জনগণ’ হিসেবে উল্লেখ করে এবং এর সাথে সমসাময়িক আন্তর্জাতিক অর্থব্যবস্থায় ইহুদিদের extraterritoriality সখ্যতাকে তুলে ধরেন। তার মতে, এই ‘শিকড়হীনতা’ই তাদের অর্থনৈতিক সাফল্যের কারণ। তাদের এই শিকড়শীনতাই এমন মানসিকতার জন্ম দিয়েছে যা কিনা দৃঢ় বিশ্বাসের প্রতি বিরূপ এবং বিমূর্ত হিসাব-নিকাশের জন্য সহায়ক।

১৯৩৩ সালের পরে যখন রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও অনুকূল হয়ে ওঠে, তখন স্মিট কোনো দ্বিধা বা প্রতিশোধের ভয় ছাড়াই তাঁর ইহুদি-বিদ্বেষী মতামত প্রকাশ্যে প্রচার করার সুযোগ পান। তিনি এই সুযোগ নষ্ট করেননি। কেলসেনের ‘আইনি দৃষ্টবাদ’ (legal positivism)-এর প্রতি স্মিটের যে তীব্র অবজ্ঞা ছিল, তাতে নিহিত সিম্যান্টিক সহিংসতা এবার আর কোনো কল্পনার অবকাশ রাখল না। ১৯৩৪ সালে National Socialist Legal Thinking নামক প্রবন্ধে স্মিট স্পষ্টত নাৎসিদের আইনি বিপ্লবকে ইহুদি লিগ্যালিজমের উপদ্রবের বিরুদ্ধে জার্মান জাতির বিজয় হিসেবে উদযাপন করেন। তাঁর মতে, জার্মান জনগণের (Volk) এই বিজয় ‘রক্ত ও মাটি থেকে উদ্ভূত শৃঙ্খলা/অর্ডারের প্রকৃত রূপে ফিরে আসা’র কারণে অর্জিত হয়েছে। তিনি আরও যোগ করেন, বিদেশী ইহুদি জনগণের অনুপ্রবেশের কারণে ভাইমার প্রজাতন্ত্রে নরম্যাটিজমের আধিপত্য ছিল। স্মিট দাবি করেন যে, লিগ্যালিজমের প্রতি অন্ধমোহ হচ্ছে ইহুদিদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তাঁরা হাজার বছর যাবত কোনো রাষ্ট্রে বা ভূমিতে বসবাস করে না, বরঞ্চ বসবাস করে কেবল আইন ও বিধানে [নর্ম]; যা আদতে ‘existentially normativistic’। বিশের দশকে স্মিটের সংসদীয় গণতন্ত্রের সমালোচনার মধ্যে লুকিয়ে থাকা ইহুদিবিদ্বেষ হিটলার ক্ষমতায় আসার পর সমস্ত ঘৃণা নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিল। 

স্মিট কেবল রাজনৈতিক মিথের প্রতি মুগ্ধই ছিলেন না, তিনি নিজেকে নিয়া মিথরচনাকারী হিসেবেও দক্ষ ছিলেন। যুদ্ধপরবর্তীকালে তাঁর পুনর্বাসনের লড়াইয়ে এই প্রতিভা দারুণ কাজে লেগেছিল।

নাজি শাসনামলের প্রথম দিকে স্মিটের সর্বব্যাপী প্রভাব ছিল। তারই এক ছাত্র ছিলেন ভাল্ডেমার গুরিয়ান, জার্মানি থেকে পালিয়ে এসেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাথলিক রাজনৈতিক তাত্ত্বিক, এবং সর্বাত্মকবাদ বিষয়ক গবেষণায় যশ অর্জন করেছিলেন। গুরিয়ানের ভাষায়, কার্যত স্মিটই ছিলেন ‘তৃতীয় রাইখের দরবারি আইনজ্ঞ’ (Crown Jurist of the Third Reich) । নাজিরা ক্ষমতা দখলের পরপর স্মিট দ্রুততার সহিত বহু পদপধবী ও খেতাব অর্জন করেছিলেন। ১৯৩৩ সালের জুলাই মাসে হেরম্যান গ্যোরিং স্মিটকে প্রুশিয়ান স্টেট কাউন্সিল নিযুক্ত করেন। তিনি হানস ফ্রাঙ্কের জার্মান আইন একাডেমির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হিসেবেও মনোনীত হন। ১৯৩৪ সালে স্মিট বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদে একটি মর্যাদাপূর্ণ পদ গ্রহণ করেন। তিনি Association of National Socialist German Jurists এর কার্যনির্বাহী কমিটিতে কাজ করেন এবং এই সমিতির সাময়িকী Deutsche Juristen-Zeitung এর প্রধান সম্পাদক ছিলেন।

১৯৩৪ সালের জুলাই মাসে এসএ-এর বিরুদ্ধে হিটলারের রক্তক্ষীয় শুদ্ধি অভিযাজনকে [১৯৩৪ সালের জুনের এই অভিজানকে Night of the Long Knives বলা হয়]  স্মিট একটি আইনি সংক্ষিপ্তসার লিখে জায়েজ করেন। এটার নাম ছিল ‘The Führer Protects the Law’, বা ফ্যুয়েরারই আইন রক্ষা করবেন। পরবর্তীতে এটাই বিখ্যাত স্লোগানে পরিণত হয়। ফ্যুয়েরার নীতির বৈধতার উৎস হিসেবে এটা জোরালো সমর্থন তুলে ধরেছিল। এটাকে অনিয়ন্ত্রিত স্বৈরাচারী অরাজকতার আদেশ বৈ আর কিছু হিসেবে ব্যাখ্যা করা কঠিন।

এর ১২ বছর পূর্বে Political Theology গ্রন্থে স্মিট বলেছিলেন যে, সার্বভৌম অবশ্যই সংবিধানের বাইরে থেকে, লিগ্যালিটির বাঁধাবিপত্তিকে স্থায়ীভাবে সরিয়ে কাজ করতে হবে। এটাও অন্যতম কারণ যে, ১৯৪৫ সালের পরেও স্মিটের ‘ভাইমার রিপাবলিকের গোরখোদক’ উপাধিটি ঝেড়ে ফেলে দেয়াটা কঠিন ছিল; তৃতীয় রাইখের দরবারি আইনজ্ঞ হিসেবে তিনি তাঁর পূর্বেকার ‘জরুরি অবস্থা’র মহিমান্বিতকরণকে ১৯৩৩-পরবর্তী পরিস্থিতিতে স্থানান্তরিত করেছিলেন।

আত্ম-মিথ নির্মাণে স্মিটের প্রতিভার প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯৫০ সালে Ex Captivitate Salus নামক স্মৃতিকথা বা কৈফিয়তমূলক রচনাতে।  হারমান মেলভিলের উপন্যাস Benito Cereno টেনে এনে নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন। উপন্যাসে যেমন দেখা যায়, জাহাজে বিদ্রোহের পর জাহাজের ক্যাপ্টেনকে বিদ্রোহীরা তাদের কথা শোনাতে বাধ্য করেছিল, স্মিটও তেমনি যেন কেবল বেঁচে থাকার লড়াই হিসেবে নাজিদের সহযোগিতা করেছিলেন। তিনি জোরের সাথে দাবি করেছিলেন, তাঁর এই সমর্থন ছিল অনিচ্ছাকৃত, মাথায় বন্দুকের নল ঠেকিয়ে কাজ করানো হয়েছিল। স্মিটের আই আত্মপক্ষ সমর্থনের দাবিগুলো ফ্যাকচুয়ালি টিকে না। কিন্তু এই ফ্যাক্টগুলো তাঁর সমর্থকদের বেনিতো সেরেনো মিথ গ্রহণ থেকে বিরত রাখতে পারেনি। ইংরেজি ভাষাভাষী দুনিয়াতে কার্ল স্মিটের কাল্ট প্রথমে উত্তরাধুনিক অভিজাত বলশেভিকরা তৈরি করেছিলেন এবং সম্প্রতি ছোট কিন্তু সরব ‘লিবারেল-উত্তর’ আন্দোলন সেটা করছে।

স্মিটের নির্দোষিতার কিংবদন্তিটা ১৯৩৬ সালের ডিসেম্বরে এসএস-এর সাপ্তাহিক পত্রিকা Das Schwarze Korps– এ প্রকাশিত দুটি নিবন্ধ থেকে উদ্ভূত। সেখানে জাতীয় সমাজতান্ত্রিকের প্রতি স্মিটের সততা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছিল। স্মিটকে সেখানে একজন সুবিধাবাদী হিসেবে চিত্রায়ন করা হয়েছিল: তিনি তাঁর ক্যারিয়ারকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া ও ক্যাথলিকপন্থী বিশ্বাস আড়াল করার জন্য দলে ভিড়েছিলেন। স্মিটের নিন্দুকদের মধ্যে একজন ছিলেন রেইনহার্ড হ্যান। তিনি ছিলেন বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্মিটের সহকর্মী এবং রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী। নাজি আইনি মহলে স্মিটের উল্কার মতো উত্থানে তিনি নাখোশ ছিলেন। স্মিট ছিলেন হ্যান্স ফ্রাঙ্কের বলয়ের; ফ্র্যাঙ্ক পোল্যান্ডে নাজি অভিযানের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং চারটি কনসেন্ট্র্যাশন ক্যাম্পের তদারকির দায়িত্বে ছিলেন; পরবর্তীতে নুরেমবার্গে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে তার মৃত্যুদণ্ড হয়। স্মিটের বিরোধীরা আশা করতেন যে, স্মিটকে আক্রমণ করে তাঁরা ফ্রাঙ্কের রাজনৈতিক অভিলাশে বাঁধা দিতে পারবেন। এই আক্রমণের পর তাঁর পার্টির পদগুলো কেড়ে নেওয়া হয়েছল। কিন্তু গ্যোরিং্যের পৃষ্ঠপোষকতার কারণে তাঁকে বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের পদ এবং প্রুশিয়ান স্টেট কাউন্সিলর (Prussian state counselor) হিসেবে তাঁর পদ বজায় রাখার অনুমতি দেওয়া হয়। তবে, নাজি আমলের দলীয় অন্তর্কোন্দলের জায়গা থেকে দেখলে স্মিটের এই অস্থায়ী পিছিয়ে পড়া মোটেও দলত্যাগের প্রমাণ ছিল না। অধিকন্তু, এসএস দ্বারা পুনর্বাসিত হওয়ার পরে স্মিটকে অবাধে ভ্রমণ এবং বক্তৃতা দেয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। পরে স্মিটের বিরোধীরাও একইভাবে অপমানজনকভাবে বরখাস্ত হয়েছিলেন।

আসন্ন যুদ্ধের দিকে তীক্ষ্ণ নজর রেখে স্মিট নিজেকে ভূ-রাজনীতির বিশেষজ্ঞ হিসেবে আবিষ্কার করেছিলেন। স্মিটের ‘Grossraum’ (বৃহত্তর অঞ্চল) মতবাদ সামাজিক ডারউইনবাদের যুক্তির পাটাতনে দাঁড়ানো ছিল : বৃহৎ অঞ্চলীয় জাতিসমূহের ‘প্রাকৃতিক অধিকার’ হচ্ছে ‘ক্ষুদ্র অঞ্চলীয় জাতিসমূহকে গিলে ফেলা। বিদ্যমান আন্তর্জাতিক আইনকে উপহাসে পরিণত করা হয়েছিল। মূলত স্মিটের ভূ-রাজনৈতিক চিন্তা পূর্ব ইউরোপীয় হেজেমনি তৈয়ারে থার্ড রাইখের ড্র্যাকোনিয়ান পরিকল্পনাকে সমর্থন যুগিয়েছিল। স্মিট তাঁর ভূ-রাজনৈতিক তত্ত্বগুলো হাজির করেন ১৯৩৯ সালের ১ এপ্রিল কিলে-তে উপস্থাপিত Raum and Grossraum in International Law শীর্ষক এক বক্তৃতায়। চেকেস্লোভাকিয়াতে জার্মান আক্রমণের সপ্তাহ দুয়েক পরেই এই বক্তৃতা দেওয়া হয়েছিল। এই বক্তৃতায় স্মিট মধ্য-ইউরোপে ‘বৃহত্তর জার্মান’ (Grossdeutsches Reich)-এর আধিপত্যকে জায়েজ করার জন্য মনরো মতবাদের নজির টেনে আনেন। হিটলার এই মনরো মতবাদের সাদৃশ্যের প্রতি এতই মুগ্ধ হয়ে উঠেছিলেন যে তিনি তাৎক্ষণিক রাইখস্ট্যাগে দেয়া এক বক্তৃতায় এটি অন্তর্ভূক্ত করে নেন। আসন্ন ইউরোপীয় যুদ্ধে হস্তক্ষেপ না করার জন্য প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টকে হুশিয়ারি দেন। যুদ্ধ তখন মাত্র চার মাস দূরে ছিল। স্মিটের এই যুক্তি তথাকথিত ‘ক্ষুদ্র অঞ্চলীয় জাতিগুলোর’ প্রথাগত রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের দাবি এবং বিদ্যমান আন্তর্জাতিক আইনকে বাতিল করে দিয়েছিল। (জার্মানি থেকে পালিয়ে যাওয়া) ফ্রাঞ্জ নিউম্যান নাজি শাসনামল ওপর রচিত প্রথম গ্রন্থ Behemoth –তে বলেছিলেন, স্মিটের ‘Grossraum’ মতবাদ হিটলারের বৃহত্তর জার্মানিকে তার নিজস্ব অঞ্চলের জন্য আন্তর্জাতিক আইনের সৃষ্টিকারী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিল। নিউম্যান স্মিটের এই ধারণাকে তৃতীয় রাইখের উচ্চাভিলাষী ভূ-্রাজনীতিকে জায়েজ করার ছদ্ম-বৈজ্ঞানিক প্রচেষ্টা বলে খারিজ করে দিয়েছিলেন : ‘এটি নাজি সাম্রাজ্যের স্বার্থে প্রকৃত বৈজ্ঞানিক বিবেচনাবোধের বিকৃতির এক দারুণ নজির’। 

স্মিটের অনুসারীরা নাজি পররাষ্ট্রনীতিতে তাঁর অবদানকে খাটো করে দেখানোর জন্য বলে থাকেন যে, স্মিটের ‘Grossraum’ চিন্তায় রেসসংক্রান্ত মতবাদ (Nazi race doctrine) অনুপস্থিত ছিল। কিন্তু, স্মিটের মতবাদে এই অনুপস্থিতি ছিল কৌশলগত। আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞদের মহলে স্মিটের তত্ত্বগুলোকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার কায়দা ছিল এটা; অন্যথায় এটা সম্ভব ছিল না। 

তাছাড়া, নাজিবাদী রেস চিন্তার আদর্শ বা ভাষা স্মিটের যুক্তিতে পুরো অনুপস্থিত ছিল না। স্মিট ‘Grossraum and International Law’-তে ইহুদিদের ‘জাতিগত [রেসিয়ালি] ভিন্ন’ বলে যে অবমাননা করেছিলেন তা প্রায় মৃত্যুদণ্ডের সমতুল্য। কেননা, Grossraum এর মতবাদ অনুসারে ‘জাতিগত ভিন্ন’ গোষ্ঠীদের আইনি কোনো অবস্থান ছিল না। নাজি Grossraum মতবাদটি ‘অঞ্চল’ (Raum) এবং ‘মাটি’ (Boden) এর দ্বিবিধ অপরিহার্যতার ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। যেহেতু ইহুদিরা ‘শিকড়হীন’ জাতি ছিল, ফলে ‘শিকড়যুক্ত/ মাটির সাথে সম্পর্কিত’ জাতিদের জন্য প্রযোজ্য আইনসমূহের কোনো সুরক্ষা তারা পাবে না।

স্মিটের Grossraum বিষয়ক প্রবন্ধগুলো প্রকাশের পর এবং ফ্যুয়েরার কর্তৃক তাঁর মনরো মতবাদের উপমাটি গ্রহণ করার পর স্মিটের প্রত্যাবর্তন প্রায় নিশ্চিত হয়ে যায়। ১৯৩৯ সালের এপ্রিলে কিলে স্মিটের ভাষণ সম্পর্কে দি টাইমস অফ লন্ডন এর একজন প্রতিবেদক মন্তব্য করেছিলেন: ‘আজতক কোনো জার্মান রাষ্ট্রনায়ক পূর্ব-ইউরোপে হিটলারের লক্ষ্যের কোনো সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা দেননি। তবে সম্ভবত সাংবিধানিক আইন বিষয়ক নাজি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক কার্ল স্মিট সাম্প্রতিক বক্তব্যটিকে একটি নির্ভরযোগ্য নির্দেশিকা হিসেবে নেওয়া যেতে পারে।’ বার্লিনের রাইখ সিকিউরিটির মূল অফিসের (RSHA) উচ্চপদস্থ এসএস কর্মকর্তারা স্মিটের গ্রুসরোম ধারণাকে দ্রত গ্রহণ করে নেন। নাজি-শাসিত ইউরোপে জার্মান আধিপত্যকে ছদ্ম-আইনি বৈধতা দিতে স্মিটের দৃষ্টিভঙ্গিকে আরও জাতীয়তাবাদী (völkisch-ideological orientation) আদর্শের সাথে মিশিয়ে এস্তেমাল করা হয়েছিল। এই কৌশল জার্মানদের জাতিগত শ্রেষ্ঠত্ব ধারণার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল। 

যুদ্ধোত্তর স্মিটের আত্মপক্ষ সমর্থনের প্রচেষ্টাটি প্রবল ধাক্কা খায় ২০১১ সালে স্মিটের ডায়রি (১৯৩০ এর দশকের) প্রকাশের পরপর। জাতীয় সমাজতন্ত্রের রাজনৈতিক উত্থানে স্মিটের প্রতিক্রিয়া ডায়রিতে লিপিবদ্ধ করা আছে। ১৯৩২ সালের ফেব্রুয়ারিতে স্মিট লিখছেন যে, আসন্ন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তিনি হিটলারকে ভোট দেওয়ার পরিকল্পনা করছেন। ১৯৩৩ সালের ৩০শে জানুয়ারি, নাৎসিদের ক্ষমতা দখলের দিন, স্মিট মন্তব্য টুকে রাখছিলেন: ‘বার্লিনের ক্যাফে কুটশেরায় আমি জানতে পারলাম যে, হিটলার চ্যান্সেলর এবং পাপেন ভাইস-চ্যান্সেলর হয়েছেন। উত্তেজিত, আনন্দিত, সন্তুষ্ট’। স্মিটের এই ‘উত্তেজনা’র কারণ খুঁজে বের করা কঠিন নয়। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে হিটলারের ক্ষমতায় উত্থান ভাইমার ‘ব্যবস্থার’ পতন নিশ্চিত করবে। এই ব্যবস্থাকে স্মিট ঘৃণা করতেন এবং যার পতন ত্বরান্বিত করার চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। ১৯৩৩ সালের ৩০শে জানুয়ারির আগে নাজি শাসনের আগমন সম্পর্কে স্মিটের মনে যে কোনো দ্বিধার রেশ ছিল, তা খুব দ্রুতই বিলীন হয়ে যায়।

হিটলারের ক্ষমতায় আসার পর স্মিটের সন্তুষ্টির পক্ষে আরও সমর্থন পাওয়া যায় ২৩ মার্চের Enabling Act-এর প্রতি স্মিটের প্রতিক্রিয়া থেকে।  এই আইন হিটলারকে ডিক্রির মাধ্যমে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা দিয়েছিল। Deutsche-Juristen Zeitung-এ প্রকাশিত মন্তব্যে স্মিট কেবল এই আইনকে সমর্থনই করেননি, বরঞ্চ তিনি সদ্য প্রতিষ্ঠিত হিটলারীয় রাষ্ট্র দ্বারা জারি করা জরুরি ডিক্রিগুলিকে সাংবিধানিক মর্যাদা দিতেও দ্বিধা করেননি। তিনি আরও বলেছিলেন, এই ডিক্রিগুলো ভাইমার প্রজাতন্ত্রের আইনি বিধানগুলিকে বাতিল করে দিয়েছে, যদিও সংবিধানটি টেকনিক্যালি কার্যকর ছিল। মে মাসের ১২ তারিখে প্রকাশিত (Westdeutscher Beobachter পত্রিকায়) পরবর্তী প্রবন্ধে (The Good Law of the German Revolution) নামক স্মিট আরও জোর দিয়ে নিশ্চিত করে বলেন যে, ‘জার্মান বিপ্লবের ভাল আইন ভাইবার ব্যবস্থা ও তার সংবিধানের লিগ্যালিটি অনুসরণের ওপর নির্ভরশীল নয়’। স্মিট তাঁর Dictatorship গ্রন্থে কমিসারিয়াল/সাময়িক ও সার্বভৌম/স্থায়ী একনায়কত্বের ভেতর যে ভেদ করেছিলেন, সেটা এখন ঘুচে গিয়েছে। যদি কোনো ‘সার্বভৌম’ একনায়কত্ব থাকেন, তাহলে সেটা হিটলারের।

 নাজি একনায়ত্বের সমর্থনে স্মিট যে অসংখ্য রাজনৈতিক ও আইনি ভাষ্য লিখেছিলেন, তার অনেকগুলোই প্রকাশিত হয়েছিল Völkischer Beobachter এবং Westdeutscher Beobachter এর মতো সরকারি নাজি প্রকাশনাতে। স্মিটের মনোভাব ছিল তৎকালের সরকারি মনোভাবের অনুকূলে। এগুলো প্রমাণ করে যে, স্মিট দ্রুততার সাথে, নির্বিঘ্নে এবং নিঃসংকোচে নাজি শাসনের প্রতি সমর্থন দিয়েছিলেন। দেখে মনে হচ্ছিল, হিটলারের ক্ষমতাদখল একটি বাঁধ যেন ভেঙে দিয়েছিল। ভাইমার আমলে স্মিট যে রাজনৈতিক মতামতগুলো আঁটকে রাখতে বাধ্য হয়েছিলেন, সেগুলোর অর্গল যেন খুলে গেলো এবার। স্মিটের লেখাগুলো পুনরায় প্রকাশিত হওয়ার কারণে স্মিট সম্পর্কিত দীর্ঘদিনের এক বিতর্কের সমাধান মিলেছিল : ১৯৩৩ সালের ৩০ জানুয়ারি কী স্মিটের জন্য ছেদবিন্দু ছিল, নাকি পূর্বতন রাজনৈতিক বোঝাপড়ার ধারাবাহিকতাই ছিল। 

স্মিটের বোঝাপড়ার এই ধারাবাহিকতার একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিমাপক হলো জাতি/রেস বিষয়ক তাঁর চিন্তা অবিচলতা। স্মিটের ডায়রিগুলোর প্রকাশের আগ পর্যন্ত (সর্বশেষ অংশ ২০১৮ সালে প্রকাশিত হয় : Tagebücher 1924–1929) তার সমর্থকরা প্রায়শই তাঁর চিন্তাধারার ‘বহুত্ববাদী’ ও ‘বিচিত্র’ দিককে বোঝার আহ্বান জানাতেন। স্মিটের ইহুদি-বিদ্বেষের ওপর খুব বেশি মনযোগ দিতে নিরুৎসাহিত করার কৌশল হিসেবে এটা কাজে লাগতো। তবে স্মিটের ইহুদিভীতি ব বিদ্বেষের প্রমাণ হাজির হওয়ার সাথে সাথে এই ধরনের আহ্বানগুলো দ্রুত দমন ও অস্বীকারের দিকে গড়ায়। স্মিটের ডায়রি প্রকাশের পর দেখা যায় যে, ১৯১৪ সালে স্মিট যে ‘ইহুদি জটিলতা’র ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, সেটা ছিল আসলে হিমশৈলের চূড়া বা টিপস অফ দ্যা আইসবার্গ। নাজি আমলে তীব্র আঁকার ধারণ করা এক উন্মত্ত ইহুদিবিদ্বেষের পূর্বাভাস ছিল মাত্র। 

১৯৩১ সালের নভেম্বরে লেখা তাঁর দিনলিপিতে স্মিট বামপন্থী রোমানিয়ান কবি ও ঐতিহাসিক ভ্যালেরিউ মারকুকে ‘নির্বোধ ও পাতলা জাতের ভয়ঙ্কর ইহুদি’ হিসেবে তীব্র নিন্দা করেন। এর এক মাস পরে বড়দিনের প্রাক্কালে স্মিট তাঁর বার্লিনের অ্যাপার্টমেন্টে ক্রিসমাস গান গাওয়ার কথা উল্লেখ করে লেখেন যে, ‘একটি ইহুদি নগরীতে ইহুদিদের দ্বারা অপমানিত হয়ে বসবাস করার কারণে তিনি কলঙ্কিত ও শরমিন্দা।’ তাঁর এই ক্রোধ প্রায়শই একীভূত হওয়া ইহুদিদের প্রতি তীব্র আঁকার ধারণ করতো। খাটি জার্মান হিসেবে জাহির করার প্রচেষ্টার কারণে স্মিটের চোখে তারা ছিলেন দিগুন দোষী। ১৯৩৩ সালের ১৯ মার্চ তিনি লিখেন, ‘নাজিদের কারণে আশাবাদী; ইহুদি [এরিখ] কফম্যান ও এই একীভূত ইহুদিদের প্রতারণার কারণে রাগান্বিত’।  

এরিখ কফম্যান ছিলেন বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদে স্মিটের একজন সহকর্মী। ১৯৩৪ সালের ১৪ই ডিসেম্বর স্মিট শিক্ষামন্ত্রীকে লেখা একটি অভিযোগপত্রে তাঁর নাম উল্লেখ করেন। স্মিট সেখানে দাবি করেন যে কফম্যানের উপস্থিতি ‘জাতীয় সমাজতান্ত্রিক ছাত্রদের প্রতি একটি চপেটাঘাত’। স্মিট আরও বলেছিলেন যে কফম্যানের শিক্ষাদানের দক্ষতা এখানে ইস্যু নয়, বরঞ্চ কফম্যানের একীভূত ইহুদি হিসাবে মর্যাদাই ছিল প্রধান বিষয়, অর্থাৎ স্মিটের ভাষায়, ‘জার্মান আধ্যাত্মিক জীবন ও জার্মান যুব সমাজের ওপর’ কফম্যানের ক্ষতিকর প্রভাবই মূল কথা। উপসংহারে স্মিট জোর দিয়ে বলেন: ‘বিশেষ করে আজ যখন জার্মান জাতি এবং জার্মান ছাত্রদের জাতীয় সমাজতান্ত্রিক শিক্ষার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শিক্ষিত করা হচ্ছে, তখন এই ধরনের ইহুদি অনুপ্রবেশকারীদের প্রভাব কঠোরভাবে এড়িয়ে চলতে হবে’। কফম্যানকে দ্রুতই বরখাস্ত করা হয়েছিল।

“The View of the Third Reich” Cover page of the journal Der Wirtschafts-Ring, issue 47 of November 23, 1934

যুদ্ধের পরেও স্মিট ছিলেন অনুশোচনাহীন ও উদ্ধত। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫১ সালের দিনলিপিগুলো স্থূল ইহুদি-বিদ্বেষে পরিপূর্ণ। স্মিট ইহুদিদের ‘ইস্রা-এলিট’ বলে অবজ্ঞা করতেন এবং যুক্তি দিতেন যে যুদ্ধ থেকে বেঁচে যাওয়া একমাত্র ‘এলিট’ হলো তারাই। ভুক্তভোগীকে আক্রমণকারী এবং আক্রমণকারীকে ভুক্তভোগী হিসেবে তুলে ধরার এক ক্লাসিক নজির দেখা স্মিট। তিনি দাবি করেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আসল জয়ী হচ্ছে ইহুদিরাই। ১৯৪৫ সালের সেপ্টেম্বরে স্মিট মিত্রশক্তির ‘সাধারণ অভিযানে’ গ্রেফতার হোন এবং ‘নিরাপত্তাজনিত হুমকি’র কারণে আটক রাখা হয়। মুক্তি পাওয়ার পর ১৯৪৭ সালের মার্চ মাসে তাঁকে আবার গ্রেফতার করা হয়। তাঁকে নুরেমবার্গে পাঠানো হয়। সেখানে আমেরিকান প্রসিকিউটর রবার্ট কেম্পনার তাঁকে ‘সম্ভাব্য আসামী’ হিসেবে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। স্মিটের Grossraum বিষয়ক প্রবন্ধগুলোকে নাজি জার্মানির ধ্বংসাত্মক যুদ্ধের নীলনকশা হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল। কিন্তু, তাঁর তত্ত্ব ও নাজি নীতির ভেতর প্রত্যক্ষ আইনি যোগসূত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি বলে স্মিট বিচার এড়াতে সক্ষম হয়েছিলেন। দুই মাস পরে স্মিট মুক্তি পান।

এই অভিজ্ঞতা স্মিটকে তিক্ত করেছিল। তিনি নিজেকে ও জার্মানদের মিত্রশক্তির ‘যুদ্ধ বিষয়ক বৈষম্যমূলক ধারণা’ এবং তাদের অসমর্থনযোগ্য ‘শাস্তি বিষয়ক নৈতিকতা’-এর শিকার হিসেবে গণ্য করেছিলেন। স্মিটের এই আপত্তিগুলি ‘ন্যায়যুদ্ধ’ ও ভার্সাই চুক্তির ‘যুদ্ধাপরাধ’ [war guilt]-এর বিরুদ্ধে তাঁর পূর্বতন অবস্থানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল। ১৯৫৮ সালে তাঁর স্মৃতিকথার মুখবন্ধে দুঃখ করে বলেন যে, মিত্রশক্তির আইনি প্রক্রিয়া অনায্যভাবে ‘পুরো একটা জনগোষ্ঠীকে অপরাধী’ বানিয়ে ফেলেছে। তিনি আরও বলেন, ‘যখন জার্মানিরা পরাজিত হয়ে মাটিতে পড়ে ছিল…, তখন রুশ ও আমেরিকানরা গণগ্রেফতার করেছে এবং সমগ্র জার্মান জাতির বদনাম রটিয়েছে। আমেরিকানরা তাদের এই পদ্ধতির নাম দিয়েছিল ‘অটোমেটিক এরেস্ট’। এর মানে হচ্ছে, কোনো একটা গোষ্ঠীর হাজার হাজার লোককে – যেমন, সকল উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে – অধিকার বঞ্চিত করে ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।’ এই আত্ম-অসচেতনতা অথবা নিছক মিথ্যাচার ছিল স্তম্ভিত করার মতো। 

জার্মান দুর্ভোগের ওপর স্মিটের একচেটিয়া মনযোগই ছিল যুদ্ধোত্তর জার্মানিতে বিরাজমান ‘দমন’ ও ‘নীরবতা’র মেজাজের বৈশিষ্ট্য। স্মিট nulla poena sine lege [আইন দ্বারা নিষিদ্ধ নয় এমন কিছুর জন্য কাউকে শাস্তি দেওয়া যাবে না] এর নীতির বরখেলাপ হিসেবে নুরেমবার্গ ট্র্যাইব্যুনালের নিন্দা করেন। তৃতীয় রাইখ ও এর হোতাদের দ্বারা সংঘটিত অভূতপূর্ব অপরাধ এবং ব্যাপক নৃশংসতার জন্য কোন ধরনের শাস্তি উপযুক্ত হবে, সেই প্রশ্ন নিয়ে ভাববার অবকাশ খুম কম ছিল তার। নাজি কনস্যান্ট্রেশন শিবিরে ষাট লাখ ইহুদির মৃত্যু, তিরিশ লাখ সোভিয়েত যুদ্ধবন্দীর মৃত্যু, জার্মান অস্ত্র কারখানায় কাজ করতে বাধ্য হওয়া এককোটি বিশ লাখ ক্রীতদাস শ্রমিক – নাজি নির্মমতার শিকার এই ভূক্তভোগীদের প্রতি বিন্দুমাত্র সহানুভূতি প্রদর্শন করেননি স্মিট। তিনি নির্দয়ভাবে এই অপকর্মগুলোকে যুদ্ধের অনিবার্য casualties হিসেবে যৌক্তিতা দেখিয়েছিলেন। তাঁর বর্ণনায়, তারা ছিলেন আক্রমণকারী বিনা ভুক্তভোগী। তিনি যুদ্ধের এই করুণ পরিণতির জন্য ‘আধুনিক  প্রযুক্তির সর্বজয়ী অগ্রগতি’কে দায়ী করতে পছন্দ করতেন। তিনি ‘প্রগতি’র লিবারেল ধারণাকে উপহাস করে এর ‘বিপর্যয়’গুলোকে তালিকাভুক্তি করেছেন এভাবে: ‘মানব সত্তাকে আত্মসাৎ করার ক্ষেত্রে ‘প্রগতি’, গণহারে অপরাধীকরণ এবং গণহারে স্বয়ংক্রিয় করার ক্ষেত্রে ‘প্রগতি’ ঘটেছে। এক বিশাল যন্ত্র নির্বিচারে লাখ লাখ মানুষকে গিলে ফেলছে। এর তুলনায় পুরনো লেভিয়াথনকেই আরামদায়ক বলে মনে হয়’।

যুদ্ধের পরে—এবং স্মিটের আত্মপক্ষ সমর্থনের প্রচেষ্টাগুলি শেকড় গেড়ে বসার আগেই—কয়েকজন পর্যবেক্ষক নাজি শাসন সুসংহতকরণে স্মিটের গুরুত্বপূর্ণ অবদানকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। আর্নেস্ট নিকিশ ১৯৪৬ সালে প্রকাশিত তাঁর Deutsche Daseinsverfehlung গ্রন্থে অভিযোগ করেন যে, এসএ ও এসএস স্মিটের দোস্ত/দুশমন-ভেদকে নির্মমভাবে কাজে লাগিয়েছেল। বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্মিটের সাবেক সহকর্মী রুদলফ স্মেণ্ড স্মিটকে ‘জাতীয় সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার সহিংসতার আইনি অগ্রদূত’ হিসেবে নিন্দা করেন। কিন্তু স্মিট ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত দায়ের প্রশ্নগুলো পদ্ধতিগতভাবে এড়িয়ে গিয়েছিলেন। অধিকাংশের মতো তিনিও ‘জার্মান বিপর্যয়’-এর ঐতিহাসিক উৎসের অনুসন্ধানে সামান্য আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। 

আইনি ও সাংবিধানিক দৃষ্টিকোণ থেকে ফেডারেল রিপাবলিক অফ জার্মানি (১৯৪৯ সালে মৌলিক আইন বিধিবদ্ধ হয়েছিল) ছিল স্মিটের সবচেয়ে খারাপ সময়। ভাইমার রিপাবলিকের বিপরীতে বন রিপাবলিক সংসদীয় ব্যবস্থাকে বেছে নিয়েছিল। এর নির্মাতারা নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতার বাড়াবাড়িকে এড়াতে চেয়েছিলেন, কেননা ১৯২৫-৩৪ এর মধ্যে ফন হিন্ডেনবুর্গের অধীনে এটা জার্মান গণতন্ত্রকে জর্জরিত করে হিটলারের উত্থানের পথ প্রশস্থ করে দিয়েছিল। এই পুরো প্রকল্পটি স্মিটের কাছে ছিল অভিশাপস্বরূপ। তিনি এর সমর্থকদের (Grundgesetz) মৌলিক-আইনধারী (Grundgesetzler) বলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতেন, এবং মৌলিক স্বাধীনতাকে (Grundrechte) ‘গাধাদের অবিচ্ছেদ্য অধিকার’ বলে উপহাস করতেন। স্মিটের কারছে ফেডারেল রিপাবলিক দিগুণ হারে রাজনীতিকে খারিজ করে; কারণ, এটি রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের উপরে ‘সংসদ’ ও ‘বিচারবিচাগীয় পর্যালোচনা’র এর মতো ‘অ-রাজনৈতিক’ প্রতিষ্ঠানকে স্থান দিয়েছিল। ফেডারেল সাংবিধানিক আদালত ছিল স্মিটের অপছন্দের শীর্ষে। স্মিট একটি ব্যাঙ্গাত্মক ছড়াও লিখে বন্ধুদের মধ্যে প্রচার করেছিলেন, যেখানে তিনি বিচারকদের লেমুরদের সাথে তুলনা করেছিলেন। স্মিট বন রিপাবলিককে ‘Justizstaat’ (আইনি রাষ্ট্র) বলে তীব্র নিন্দা করতেন। তিনি বলতেন, এটা আদতে রাষ্ট্র নয়। এটি ‘মানব মর্যাদা’র মতো বিমূর্ত ‘values’-কে ‘কর্তৃত্বে’র উপরে স্থান দিয়েছে। স্মিটের শেষদিককার অন্যতম কাজের নাম ছিল The Tyranny of Values

১৯৮৫ সালে শ্মিটের মৃত্যুর পর, জার্মান ডানপন্থীরা জার্মান গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে স্মিটের সমালোচনাগুলোকে জনপ্রিয় করতে দ্রুত সক্রিয় হয়ে ওঠেন। নয়া ডানপন্থীদের (Neue Rechte) এর প্রধান প্রকাশনা Junge Freiheit যেমনটি লিখেছিল: ‘যারা বালিশের নিচে ‘গ্রুন্ডগেজেৎস’ (Grundgesetz) নিয়ে ঘুমান, তাদের কার্ল স্মিটের প্রয়োজন নেই। বিপরীতে, যারা মনে করেন ‘গ্রুন্ডগেজেৎস’ একটি কারাগার, যার মধ্যে জার্মান রাষ্ট্র অন্তরীণ রয়েছে, তারা তাঁর দিকে হাট বাড়াবেন’। ২০১৫-২০১৬ সালের ইউরোপীয় শরণার্থী সংকটের সময়, ডানপন্থী মতাদর্শী গ্যোটস কুবিতশেক, যিনি অতি-ডানপন্থী রাজনৈতিক দল অলটারনেটিভ ফর জার্মানি এর সাথে যুক্ত একটি রক্ষণশীল বিপ্লবী থিঙ্কট্যাঙ্ক-এর সহপ্রতিষ্ঠাতা, সিরীয় অভিবাসীদের আগমন প্রতিহত করার জন্য জরুরি ব্যবস্থা প্রয়োগের যুক্তি হিসেবে স্মিটের ‘জরুরি অবস্থা’ (state of exception)-এর উদ্ধৃতি দেন। স্মিটের ‘দোস্ত/দুশমন’ ভেদাভেদের উল্লেখ করে কুবিতশেক ঘোষণা করেন: ‘আমি নিশ্চিত যে একটি ‘জরুরি অবস্থায়’… জাতিগত, সাংস্কৃতিক এবং নাগরিক রেখা বরাবর নিজেদের গোষ্ঠীদের প্রতি হুমকি স্পষ্ট হয়ে দেখা দেয়, তখন ‘আমরা কে’ এবং আমরা কে নই’ সেই প্রশ্নটিও স্পষ্ট হয়ে উঠে। … অর্থাৎ, এই ভূমির জনগণের যথেষ্ট পেয়েছে, তখন [রাজনৈতিক] আনুগত্যের প্রশ্নটি উঠতে বাধ্য; যেমনটি ইতিমধ্যে উঠে আসছে যখন ইসলাম রীতিনীতি, মূল্যবোধ এবং দৈনন্দিন জীবনের আচরণের উপর আইনি বিধি আরোপ করছে।’

এই নিউ-রাইট শরণার্থী সংকটকে স্মিটীয় ‘জরুরি অবস্থা’র ধ্রুপদী নজির হিসেবে দেখতো। এই সঙ্কট এঞ্জেলা মার্কেলের শাসনের জোটের ভিত্তিকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। তাদের মতে, এটি ছিল এমন এক পরিস্থিতি যা ১৯৫৮ সালে ফ্রান্সে আলজেরিয়ার সঙ্কটের মতো, যা কিনা শার্ল দ্য গোলের ক্ষমতা দখলের পথ প্রশস্ত করেছিল। তারা জার্মানির ফেডারেল রিপাবলিকের বিলোপ করে একটি এথনো-পপুলিস্ট স্বৈরতন্ত্র কায়েমের ইঙ্গিত দিতো। শরণার্থী আশ্রয়প্রার্থীদের নিষিদ্ধ করার জন্য একটি নির্বাহী ডিক্রির পক্ষে কুবিতশেকের ওকালতি জার্মানির Grundgesetz বা মৌলিক আইন এবং সেইসাথে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অভিবাসন আইনের নীতিগুলি লঙ্ঘন করে। এটা তাদের কাছে উদ্বেগেরও কোনো কারণ বলে মনে হয়নি।

জার্মান রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে স্মিটের মরণোত্তর প্রভাব ছিল বিশাল। ১৯৫০-এর দশকে স্মিটের নির্বাসনের স্থান প্লেটেনবুর্গ সেইসব কট্টর রক্ষণশীল আইনজ্ঞদের কাছে একটি প্রিয় তীর্থস্থান হয়ে ওঠে, যারা কনরাড আডেনাওয়ারের অধীনে ১৯৪৯-১৯৬২ সালের ফেডারেল রিপাবলিকের ‘পাশ্চাত্যমুখিতা’ (Verwestlichung)-তে অসন্তুষ্ট ছিলেন। স্মিটের অসংখ্য শিষ্যের মধ্যে ছিলেন আইনজ্ঞ এবং পরবর্তীতে কার্লসরুহে সাংবিধানিক আদালতের সদস্য আর্নেস্ট-ভল্ফগ্যাং বকেনফ্যোর্ডে, যিনি রাষ্ট্রের স্বায়ত্তশাসনের ওপর তথাকথিত ‘সমাজকল্যাণমূলক’ হস্তক্ষেপ সম্পর্কিত রায়গুলোতে স্মিটীয় নীতির প্রয়োগ করেছিলেন। ১৯৯০ সালে জার্মানির পুনর্মিলনের পর স্মিটের বুদ্ধিবৃত্তিক মর্যাদা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। জার্মান রক্ষণশীলরা দাবি করেন যে লিবারেল বন্ প্রজাতন্ত্রের ‘বি-রাজনীতিকরণ’ এবং ‘নিরপেক্ষতাকরণ’কে ত্যাগ করে এখন বিসমার্ক-যুগের রাষ্ট্রবাদ (étatisme) এবং ক্ষমতার রাজনীতির (Machtpolitik) ঐতিহ্যের সাথে সামঞ্জস্য রেখে একটি ‘আত্মবিশ্বাসী জাতির’ বিশেষাধিকারকে স্থাপন করার সময় এসেছে। এই রূপান্তরের জন্য কার্ল স্মিটের চেয়ে ভালো আর কে হতে পারেন?

১৯৯০-এর দশকে এক দল কট্টর রক্ষণশীল বুদ্ধিজীবী স্মিটের পাশাপাশি আর্নস্ট ইয়ুঙ্গার এবং মার্টিন হাইডেগারের মতো সমমনা রক্ষণশীল বিপ্লবী চিন্তাবিদদের খ্যাতি পুনরুদ্ধারের জন্য প্রচারণা শুরু করেন। জার্মানির পুনর্মিলনের আগে, স্মিটের পক্ষে থার্ড রাইখের ‘মুকুটধারী/দরবারি আইনজ্ঞ’ হিসেবে তাঁর পূর্বতন কর্মজীবনের কলঙ্ক এড়িয়ে যাওয়া কঠিন ছিল। তবে বার্লিন প্রাচীরের পতনের পরে, জাতীয় রক্ষণশীলদের পক্ষ থেকে একটি আওয়াজ উঠতে থাকে যে, চল্লিশ বছরের গণতান্ত্রিক স্থিতিশীলতার পরে, এখন নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার সময় এসেছে। স্মিটকে ‘জার্মান ধ্রুপদী’ হিসেবে পুনরুজ্জীবিত করা হয়। হাতেগোনা কয়েকজন বুদ্ধিজীবী আপত্তি জানালেও, তাঁর পুনর্বাসন পুরোপুরিই ঘটেছিল বলে মনে হয়েছিল।

জার্মানিতে স্মিটের পুনর্বাসন ছিল আন্তর্জাতিকভাবে তাঁর কাজের বহুমাত্রিক পুনরুজ্জীবনের সূচনা। ১৯৯০-এর দশকে যারা নয়া-উদারবাদের  বিজয় এবং ‘ইতিহাসের সমাপ্তি’ নিয়ে মোহগ্রস্ত ছিলেন, তারা রাজনৈতিক বিকল্পের সন্ধানে স্মিটের কাজের ভাণ্ডার ঘাঁটতে শুরু করেন। আর এই মোহগ্রস্তদের তালিকা কেবল ডানপন্থীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। হার্বাট স্পেন্সার থেকে ধার করে ‘কোনো বিকল্প নেই’ [TINA – there is no alternative], অর্থাৎ, এই উদারনৈতিক ব্যবস্থার অনিবার্য গ্রহণযোগ্যতার শ্লোগানকে জনপ্রিয়কে করে তুলেছিলেন মারগারেট থ্যাচার। TINA -এর বামপন্থী ক্রিটিকরা তখন ভেবেছিলেন তারা স্মিটের The Crisis of Parliamentary Democracy গ্রন্থ থেকে প্রয়োজনীয় সমর্থন খুঁজে পেয়েছেন। স্মিট বলেছিলেন যে, লিবারেলবাদ ও গণতন্ত্র মিচুয়ালি এক্সক্লুসিভ রাজনৈতিক রূপ। এলেন উলফ The Future of Liberalism গ্রন্থে বলেছিলেন, ‘ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্মিটের ধারণাগুলির যে পুনরুজ্জীবন ঘটছে, তা ডানপন্থার কারণে নয়। বরং স্মিট পোস্টমডার্ন বামপন্থীদের কাছে একরকম হিরোতে পরিণত হয়েছেন’।

পশ্চিমা লিবারেলবাদের অন্তর্নিহিত দুর্নীতির বিষয়ে স্মিটের যুক্তিগুলি সাবেক মার্কসবাদীদের মধ্যে ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেছিল। কমিউনিজমের পতনের পর এবং মার্ক্সের ‘শ্রেণিসংগ্রামের অধিবিদ্যা’র ওপর বিশ্বাস উবে যাওয়ার পর তারা অ-মার্কসবাদী উৎসগুলোর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিকল্প প্যারাডাইম খুজতে শুরু করেছিলেন। যেহেতু প্রলেতারিয়েত এখন বুর্জোয়া ভোগবাদের প্রলোভনের মধ্যে স্বাচ্ছন্দ্যে ডুবে আছে, তাই একটি ‘শ্রেণিহীন সমাজের’ ইউটোপিয়া বাস্তবায়নের সম্ভাবনা আগের চেয়ে আরও দূরবর্তী বলে মনে হচ্ছিল।

এই স্ব-ঘোষিত ‘বাম স্মিটপন্থীরা’ র‍্যাডিকেল গণতন্ত্রের নামে  লিবারেলবাদের বিরুদ্ধে স্মিটের অসংযত সমালোচনাকে গ্রহণ করেছিলেন। তবে, লিবারেলবাদের নরম্যাটিভ সুরক্ষার বিরুদ্ধে তাদের বিদ্বেষ শেষ পর্যন্ত এতই শক্তিশালী এবং সর্বগ্রাসী প্রমাণিত হয়েছিল যে, স্মিটের মতোই, তারাও নির্লজ্জভাবে কর্তৃত্ববাদী রাজনৈতিক সমাধানগুলিকে সমর্থন করতে শুরু করেন। লিবারেল গণতান্ত্রিক স্থিতাবস্থাকে অতিক্রম করতে গিয়ে বাম-স্মিটপন্থীরা সর্বাত্মক গণতন্ত্রের [বহু জ্যাকব ট্যালমন totalitarian democracy বর্ণনা করেছিলেন] সাথে লিপ্ত হতে দ্বিধা করেননি। তারা এমন এক কর্তৃত্ববাদী রাজনৈতিক ধারাকে পুনরাবৃত্তি ঘটাতে চেয়েছিলেন যা ১৭৯৩-৯৪ সালের জ্যাকোবিন স্বৈরতন্ত্র থেকে শুরু করে লেনিনের ‘কী করিতে হইবে?’ হয়ে হালজমানার Chavismo পর্যন্ত বিস্তৃত। নব্বই দশক থেকে Chavismo লাতিন আমেরিকার রাজনৈতিক পরিসরে রাষ্ট্রীয় সমাজতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্রকে একটি স্থায়ী বৈশিষ্ট্য করে তুলেছেছিল।

রুশোর পরিভাষায় লিবারেল গণতন্ত্র বিষয়ক স্মিটের সমালোচনাকে এভাবে বলা যেতে পারে : যেখানে গণতন্ত্র ‘সাধারণ ইচ্ছা’ (general will) বা ‘সর্বজনীনতাকে’ (universality) উপলব্ধি করার কথা ছিল, সেখানে ‘স্বার্থের’ ওপর প্রতিষ্ঠিত লিবারেলবাদ ‘পার্টিকুলারিজম’ বা নিছক ‘সবার ইচ্ছা’ (will of all)-এর ঊর্ধ্বে উঠতে অক্ষম ছিল; এটা কখনই উচ্চতর ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারে না। স্মিট দাবি করেছিলেন যে সংসদীয় ব্যবস্থা (parliamentarism) যেহেতু ‘প্রতিনিধিত্বের’ পরিসর যেখানে কিনা ‘স্বার্থ’ প্রাধান্য পায়, সেহেতু সেটা জনগণের সার্বভৌমত্ব হিসেবে গণতন্ত্রের সর্বজনীন আকাঙ্ক্ষাগুলিকে অন্তর্নিহিতভাবে দুর্বল করে তোলে। তাই স্মিটের সিদ্ধান্ত ছিল যে লিবারেলবাদ এবং গণতন্ত্র সহজাতভাবে পরস্পরবিরোধী উপায়ে কাজ করে। (এটি হাঙ্গেরির ভিক্টর অরবানের অন্যতম প্রিয় বক্তব্য)। এই সমালোচনার ভিত্তিতে, স্মিট সংসদকে ‘গল্পগুজব করার কামরা’ বৈ আর কিছুই মনে করতেন না। দোনোসো কোর্তেসের পথ অনুসরণ করে, তিনি বুর্জোয়াদেরকে মেরুদণ্ডহীন এবং দুর্বল বলে তুচ্ছ করেন, যারা অবিরাম আলোচনা করতে পারলেও একটি সার্বভৌম সিদ্ধান্ত নিতে অক্ষম। ১৯২০-এর দশকে স্মিটের রাজনৈতিক প্রত্যাশা নেতাকেন্দ্রিক গণতন্ত্র (Führerdemokratie)-এর দিকে। স্মিট ও স্মিটপন্থীদের জন্য এই শব্দটি মোটেও স্ব-বিরোধী (oxymoronic) ছিল না: এটি ছিল বহুত্ববাদ ও সাংবিধানিক হস্তক্ষেপ মুক্ত এক রাজনৈতিক কর্তৃত্ববাদের রূপ। এই রাজনৈতিক ব্যবস্থা ‘প্রতিনিধিত্বে’র লিবারেল ধারণাকে ‘নেতা’ ও ‘জনগণ’ মধ্যকার ‘অভিন্ন সত্তা’ দিয়ে প্রতিস্থাপন করতে চায়। স্মরণ করুন, স্মিটের রাজনৈতিক অবস্থান যৌক্তিক সম্মতির পরিবর্তে ‘বিশ্বাস’ ও ‘মিথ’-এর ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত। এক আবেগময়ী বন্ধন দ্বারা ‘নেতা’ ও ‘জনগণ’ এর ভেতর অভিন্নতা জোরদার হয়।

প্রাক্তন মার্কসবাদীদের কাছে রাজনৈতিক লিবারেলবাদ বিষয়ক স্মিটের সমালোচনার একাধিক সুবিধা ছিল। মার্কসবাদের মতো এটি ইতিহাসের একটি সেকেলে হেগেলীয় দর্শনে আস্থাবান ছিল না। এটি প্রলেতারিয়েতকে ‘সর্বজনীন শ্রেণী’ হিসেবে দেখার সেকেলে ধারণার সাথেও যুক্ত ছিল না। উনিশ শতকের যে শ্রমজীবী সমাজের ওপর দাঁড়িয়ে মার্কস তাঁর রাজনৈতিক অর্থনীতির সমালোচনা লিখছিলেন, সেই সমাজও বিলীন হয়ে গিয়েছিল। কারখানা ব্যবস্থার অবসানে ‘শ্রেণি’ ও ‘শ্রেণি সংগ্রাম’-এর ধারণাও তাদের কেন্দ্রিকতা হারিয়েছে। সমাজবিজ্ঞানীরা বারবার বলে যাচ্ছিলেন, আধুনিক সমাজ বোঝার জন্য ‘সামাজিক স্তরবিন্যাস’ ও ‘সামাজিক মর্যাদার বিভাজন’ এখন ‘শ্রেণি’র স্থান দখল করে নিয়েছে। ‘শ্রেণি সংগ্রাম’ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মার্কসের বিপ্লবী তত্ত্ব যে উবে যাচ্ছিল সেটা ধরতে পারা কঠিন ছিল না।

ষাটের দশক নিশ্চিত করেছিল যে রাজনৈতিক সংগ্রামের স্থান এবং প্রকৃতি মৌলিকভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। সংঘাত আর কেবল দোকান বা কর্মস্থলের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। পরিবর্তে, ‘নতুন সামাজিক আন্দোলন’ প্রমাণ করেছিল যে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা বহুগামী হয়ে উঠেছে। নারীবাদ, সমকামী মুক্তি আন্দোলন, নাগরিক অধিকার আন্দোলন এবং পরিবেশবাদ—এগুলো ‘শ্রেণি বিশ্লেষণের’ অপর্যাপ্ততাকে উন্মোচিত করেছিল। সংগ্রামের নতুন ক্ষেত্রগুলো ‘বস্তুবাদী- উত্তর মূল্যবোধ’ (post-material values) এবং সাংস্কৃতিক বিষয়গুলির উপর কেন্দ্রীভূত হয়েছিল। এগুলো প্রথাগত মার্কসবাদের কেবল অর্থনৈতিক মনযোগের পরিসরকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। পোস্ট-মার্কিসিস্টদের মধ্যে গ্রামসির ‘হেজেমনি’ ধারণাটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। কারণ, এটি মার্কসের রাজনৈতিক অর্থনীতির সমালোচনাতে উপেক্ষিত সাংস্কৃতিক দিককে সরাসরি তুলে ধরেছিল।

যে বাম স্মিটপন্থীরা ‘ওয়াশিংটন ঐকমত্যের’ বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য সংগ্রামের নতুন রূপ খুঁজছিলেন, তাদের কাছে রাজনৈতিক লিবারেলবাদের প্রতি স্মিট সমালোচনাগুলো সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছিল; সংসদীয় বামেরা বহু আগেই সেটা ত্যাগ করেছিলেন। এই কারণে, স্মিটের বামপন্থী শিষ্যেরা স্থায়ী সংঘাতের (permanent conflict) নীতিতে র‍্যাডিক্যাল রাজনীতিকে প্রভাবিত করার জন্য তাঁর ‘দোস্ত/দুশমন’ ধারণাকে উৎসাহের সাথে গ্রহণ করেছিলেন। ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত The Challenge of Carl Schmitt গ্রন্থে শান্তাল মোউফে যুক্তি দিয়েছিলেন, স্মিটের রাজনৈতিকতার ধারণা ‘রাজনৈতিক বিরোধাত্মক’ (political agonism) – এর এক নতুন যুগের পূর্বাভাস দিয়েছিল, যেখানে লিবারেল-গণতান্ত্রিক সংসদীয় ঐকমত্যমূলক রাজনীতি ভিন্নমত এবং সংঘাতের ক্রমবর্ধমান ঢেউয়ে ভেসে গিয়েছিল। মোউফে ব্যাখ্যা করেন:  

‘[স্মিটের] নৈতিক ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও… তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি উপেক্ষা করা হলে আমরা এমন অনেক অন্তর্দৃষ্টি থেকে বঞ্চিত হবো যা লিবারেল গণতন্ত্রকে পুনর্বিবেচনা করার জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। স্মিটের চিন্তাধারা বিজয়ী লিবারেলবাদে যে আত্মতুষ্টির বিপদ জড়িত, তার বিরুদ্ধে একটি সতর্কবার্তা হিসেবে স্মিটের চিন্তা কাজ করে। রাজনৈতিকতা বিষয়ক তাঁর ধারণা প্রভাবশালী লিবারেল দৃষ্টিভঙ্গির গুরুত্বপূর্ণ ঘাটতিগুলিকে সামনে নিয়ে আসে। যারা মনে করেন বাম ও ডানের মধ্যকার সীমানা ঝাপসা হয়ে, রাজনৈতিক ডিসকোর্সের ক্রমবর্ধমান নৈতিকীকরণ আলোকিত প্রগতির মাধ্যমে একটি নয়া বিশ্বব্যবস্থা ও সর্বজনীন গণতন্ত্র কায়েম করবে, তাদের বিভ্রমকে স্মিটের চিন্তা চুরমার করে দেয়।’

স্মিটের বেশ ‘বিস্ময়কর ব্যর্থতাগুলো’কে ‘নৈতিক ত্রুটি’ হিসেবে তুচ্ছ করার মাধ্যমে শান্তাল মোউফে সেই ব্যাখ্যামূলক প্রশ্নটিকে সুবিধামত এড়িয়ে গেছেন, যা বহু দশক ধরে স্মিট বিষয়ক চিন্তারবাজারকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে: ১৯২০-এর দশকে স্বৈরতন্ত্র এবং ‘নেতাকেন্দ্রিক গণতন্ত্র’ প্রতি স্মিটের উল্লাস ১৯৩৩ সালে তাঁর হিটলারবাদে রূপান্তরের পূর্বাভাস দিয়েছিল কি না। তাছাড়া, র‍্যাডিকেল গণতন্ত্রের তাগিদে স্মিটের মতো একজন রক্ষণশীল বিপ্লবী চিন্তককে সমর্থন করে মোউফে কী নিজেই ‘বাম ও ডানের মধ্যেকার সীমানা ঝাপসা’ করে দিচ্ছেন না? পরিশেষে অভূতপূর্ব রাজনৈতিক মেরুকরনের এই যুগে যখন কিনা ক্রমাগত আদর্শগত বিভাজন বৃদ্ধি পাচ্ছে, তখন ‘রাজনৈতিক agonistics’ এর চেয়ে কমন রাজনৈতিক ডিসকোর্স তৈরি করাকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিৎ না? 

যদিও শ্মিটের ‘রাজনৈতিকতার ধারণা’ নব্য-মার্কসবাদীদেরকে ঐতিহাসিক বস্তুবাদের কাঠামো থেকে মুক্ত করেছিল, তবে স্মিটের নিজস্ব অত্যন্ত সন্দেহজনক রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিপদগুলোর কাছেও তাদেরকে উন্মুক্ত করে দিয়েছে। ‘নরম্যাটিজম-বিরোধী’ নীতি [‘নিয়মের চাইতে ব্যতিক্রমই বেশি আকর্ষনীয়’] দিয়ে স্মিট ঘোষণা করেছিলেন যে, the norm is destroyed in the exception। স্মিটের এই ‘সিদ্ধান্তবাদ’ ও অনমনীয় ‘নরম্যাটিজম-বিরোধী’ নীতিকে গ্রহণ করে স্মিটের বামপন্থী সমর্থকরা ‘বাম ফ্যাসিবাদে’র পথকে উন্মুক্ত করে দেন। এটি ছিল ‘সংগ্রামের জন্য সংগ্রাম এবং সংঘাতের জন্য সংঘাত –এর একটি কোয়াসি-এস্থেটিক উদযাপন; প্রতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতা এবং সুরক্ষামূলক বেষ্টনীকে হাসিমুখে অবজ্ঞা করে অন্তহীন যুদ্ধের মহিমান্বিতকরণ। স্মিটের সিদ্ধান্তবাদের সাথে সামঞ্জস্য রেখে, তাঁর বামপন্থী শিষ্যেরা সংগ্রামের বিষয়বস্তু এবং লক্ষ্যের প্রতি অন্ধ ছিলেন।

সংগ্রামের লক্ষ্য ঠিক করতে সিদ্ধান্তবাদী প্রত্যাখ্যান ছিল আর্জেন্টাইন রাজনৈতিক তাত্ত্বিক আর্নেস্তো লাক্লাউয়ের স্মিটবাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ২০০৭ সালে প্রকাশিত তাঁর On Populist Reason গ্রন্থে লাক্লাউ রাজনৈতিক সংগ্রামের বিষয়বস্তুকে একটি empty signifier হিসেবে বর্ণনা করেন। লাক্লাউয়ের মতে, সংগ্রামের অর্থ সরবরাহ করবেন পপুলিস্ট নেতা, যার কাজ হলো নতুন হেজেমনিক ঐক্য অর্জনের জন্য জনগণের পরস্পর-বিরোধী দাবিগুলিকে একত্রিত করা। শান্তাল মোউফের নয়া-মার্কসবাদ তাও লিবারেল গণতন্ত্রের আনুষ্ঠানিক বাহ্যিকতা মেনে নিয়েছিল, কিন্তু লাক্লাউ মনে করেন যে চির-অধরা ‘জেনারেল উইলে’র স্বার্থে সংসদীয় রাজনীতির নীতিগু্লোকে স্রেফ বাতিল করে দিতে হবে। তিনি স্মিটের The Crisis of Parliamentary Democracy  গ্রন্থের যুক্তিকে আনক্রিটিক্যালি গ্রহণ করেন, প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রকে ‘নেতাকেন্দ্রিক গণতন্ত্র’ দিয়ে প্রতিস্থাপন করতে হবে। লাক্লাউয়ের অবস্থানে স্মিটের প্রভাব আসলে তাঁর নয়া-লেনিনবাদের ব্যাখ্যা দিতে পারে। ্তার মতে, কেবল ‘নেতা’ বা ‘দল’-ই পারে ‘জনগণ’কে ঐক্যবদ্ধ ও বিপ্লবী চেতনা সরবরাহ করতে; যার মাধ্যমে বিচ্ছিন্ন জনতা হিসেবে ‘পতিত’ অবস্থা থেকে তাদের উত্তরণ ঘটতে পারে। ‘আসল জনগণ’ এর বিপরীতে ‘দুশমন’দের নির্মাণ করে, লাক্লাউ অভিজাত বা ওলিগার্কিদের শত্রু হিসেবে দাঁড় করান, যাদের থেকে ‘নেতা’ আসল জনগণকে উদ্ধার করবেন। 

স্মিট The Crisis of Parliamentary Democracy গ্রন্থে দাবি করেছিলেন যে প্রকৃত গণতন্ত্র একটি একসারি অভিন্নতার ওপর প্রতিষ্ঠিত : শাসক ও শাসিতের অভিন্নতা, সার্বভৌম ও প্রজার অভিন্নতা, রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের বিষয় ও বিষয়ীর অভিন্নতা। স্মিটের মতে, ‘গণতন্ত্র স্বৈরতন্ত্রের বিপরীত না হলেও’, এটার অংশই, কেননা স্বৈরতন্ত্র শাসক ও শাসিতের মধ্যেকার অভিন্নতা রক্ষা করে। স্মিটের মতে, স্বৈরতন্ত্র সংসদীয় ‘প্রতিনিধিত্বের’ পরিবর্তে জনগণের ‘সম্মতি জ্ঞাপনের’ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এই অভিন্নতা উপলব্ধি করে। সংক্ষেপে: ‘স্বৈরাচারী এবং সিজারবাদী পদ্ধতিগুলি গণতান্ত্রিক সারবস্তু এবং ক্ষমতার প্রত্যক্ষ অভিব্যক্তিকে মূর্ত করে’। আর্নেস্তো লাক্লাউ প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রকে একটি লিবারেল ছলনা হিসেবে স্মিটের নিন্দাটিকে সমর্থন করেন, যা কিনা জনগণের ইচ্ছাকে বিকৃত করে এবং এর ফলে ‘নেতা’ ও ‘জনগণের’ মধ্যেকার অভিন্নতাকে বাধা দেয়। তিনি লিবারেল গণতান্ত্রিক ‘ম্যান্ডেট প্রতিনিধিত্বের’ ধারণার পরিবর্তে শ্মিটের আদি-ফ্যাসিবাদী ‘প্রতীকী/সিম্বোলিক প্রতিনিধিত্বের’ ধারণাটিকে গ্রহণ করেন। এইভাবে, স্মিটের কাঠামোর সাথে সঙ্গতি রেখে, লাক্লাউ নেতাকে ‘সাধারণ ইচ্ছা’র ‘প্রতীকী প্রতিনিধি’ হিসেবে মহিমান্বিত করেন। ফ্যাসিবাদী নেতৃত্বের এই মহিমান্বিতকরণের সাথে লাক্লাউয়ের সমস্যা ছিল কেবল এই যে এটি খুবই চরম ছিল, যদিও স্বৈরাচারী ঐক্যের এমন একজন প্রবক্তার কাছে ‘চরম’ বলতে কী বোঝায়, তা বোঝা কঠিন।

লিবারেল গণতান্ত্রিক ‘প্রক্রিয়াপন্থা’র (proceduralism) প্রতি লাক্লাউয়ের অস্বীকৃতি ছিল বাম স্মিটপন্থীদের আলোকায়নের যৌক্তিকতার বিরুদ্ধে সংগ্রামের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। আলোকায়নবিরোধী এই অবস্থান একদিকে মোউফে এবং লাক্লাউয়ের মতো পোস্ট-মার্ক্সিস্ট ও অন্যদিকে দেরিদা ও ফুকোর মতো পোস্টস্ট্রাকচারালিস্টদের মধ্যেকার তাত্ত্বিক মৈত্রী ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করে। এটি ১৯৮০-এর দশকে হাবেরমাসের প্রজ্ঞাপূর্ণ সন্দেহকেও সমর্থন করে: ‘উত্তর-আধুনিকতা চূড়ান্তভাবে আধুনিকতা-বিরোধী হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করে’। হাবেরমাস আরও বলেন: ‘এই বক্তব্যটি আমাদের সময়ের একটি আবেগপ্রবণ স্রোতকে বর্ণনা করে যা বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে প্রবেশ করেছে’।

স্মিটের বামপন্থী অনুসারীদের মধ্যে প্রায়শই এক ধরনের self-marginalizing ও সেকটারিয়ান গুণাবলী দেখা যায়, বিদ্যাজগতের গণ্ডির বাইরে খুব একটা গ্রহণযোগ্যতা পায় না। কিন্তু ৯/১১ এর সন্ত্রাসী হামলার পর নয়া-রক্ষণশীলদের মধ্যে তাঁর কাজের গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে সমান মন্তব্য করা যায় না। তখন নয়া-রক্ষণশীলদের কাছে জরুরি শাসনের অপরিহার্যতা ও লিবারেল গণতন্ত্রের লিগ্যালিজমের অকার্যকারিতা সম্পর্কে স্মিটের ঘোষণাগুলো তখন প্রামাণ্য মর্যাদা লাভ করে।

এমনকি নাগরিক স্বাধীনতাপন্থীরাও, স্মিটের সিদ্ধান্তের সঙ্গে তীব্রভাবে দ্বিমত পোষণ করলেও, অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাঁর বিশ্লেষণী দূরদৃষ্টি ও আইনগত অন্তর্দৃষ্টির প্রাসঙ্গিকতাকে স্বীকার করেছিলেন। জর্জ ডব্লিউ. বুশ প্রশাসনের সময়কার নির্বাহী ক্ষমতার অস্বাভাবিক স্ফীতির বিষয়ে আলোচনাকালে অ্যালান উলফের প্রবন্ধের বুদ্ধিদীপ্ত শিরোনাম ছিল “Mr. Schmitt Goes to Washington”। রাজনৈতিক তাত্ত্বিক উইলিয়াম ই. শয়ুরম্যান তাঁর The End of Law: Carl Schmitt in the Twenty-First Century গ্রন্থে স্বীকার করেছেন: ‘গত শতাব্দীর অন্য কোনো রাজনৈতিক বা আইনচিন্তক এমনভাবে জরুরি শাসনের সমস্যাকে বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনার কেন্দ্রে আনেননি যেমন স্মিট এনেছিলেন, এবং তিনি তা এমনভাবে করেছেন যাতে আমাদের মতো উদার ও গণতান্ত্রিক আইনি আদর্শে বিশ্বাসীদের অস্বস্তিতে ফেলে দেন। অন্তত তাঁর জরুরি শাসন সংক্রান্ত ধারণাগুলো আইনের শাসন রক্ষা করতে আগ্রহী ব্যক্তিদের কাছ থেকে একটি জবাব দাবি করে।’ ২০০৬ সালে, Preserving Constitutional Norms in Times of Permanent Emergencies শিরোনামের এক প্রবন্ধে আইনতাত্ত্বিক স্যানফোর্ড লেভিনসন মন্তব্য করেন যে, বুশ প্রশাসনের আইনি জবাবদিহিতার প্রতি সার্বভৌম উপেক্ষার প্রেক্ষিতে, আমেরিকা তখন এক ‘স্মিটীয় মুহূর্ত’-এর মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। লেভিনসনের ভাষায়,’বুশ প্রশাসনের আইনতত্ত্ব বোঝার জন্য যে একক আইনদার্শনিক সর্বাধিক কার্যকর, তিনি কার্ল স্মিট — ভাইমার যুগের এক প্রতিভাবান জার্মান চিন্তক, যিনি পরবর্তীতে (যা মোটেও আকস্মিক নয়) হিটলারের ক্ষমতাদখলের প্রধান আইনগত সমর্থকে পরিণত হন; কারণ স্মিট মনে করতেন জার্মান রাষ্ট্রব্যবস্থা তখন সম্পূর্ণভাবে অকার্যকর’। আরও এক স্থানে লেভিনসন স্মিটকে অভিহিত করেছেন ‘৯/১১-পরবর্তী বিশ্বের আইনদার্শনিক গুরু হিসেবে; এমন এক বিশ্বে যেখানে ‘ব্যতিক্রম অবস্থা’ (state of exception) নিজেই নতুন স্বাভাবিকতা হয়ে উঠেছে; অন্যভাবে বললে, অনেক বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষকের মতে, এটি ছিল এক স্থায়ী ব্যতিক্রমের অবস্থা।”

স্মিটের দর্শন আসলেই ছিল এক বিরাট উপহার তাঁদের জন্য, যারা হোয়াইট হাউসের লিগ্যাল কাউন্সিল অফিসের এর উপসহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল ও আইনবিদ জন ইউ-র ভাষায় “Unitary Executive” ধারণার প্রবক্তা ছিলেন। এই ধারণাটি বুশ প্রশাসনের সময় ব্যাপক রাজনৈতিক সমর্থন পেয়েছিল। স্মিট লিখেছিলেন: ‘সব আইনই ‘পরিস্থিতিনির্ভর আইন।’ সার্বভৌম (sovereign) ব্যক্তি সমগ্র পরিস্থিতিকে তার পূর্ণতায় সৃষ্টি ও নিশ্চয়তা প্রদান করেন। তিনিই এই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের একমাত্র অধিকারী’। অর্থাৎ সার্বভৌম শাসক নিজের ইচ্ছামতো পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিতে প্রতিক্রিয়া জানাতে পারেন, আগের কোনো সাংবিধানিক নিয়ম দ্বারা বাঁধা নন। অবশ্য হোয়াইট হাউসের “স্মিটীয়্রা” হয় স্মিটকে ভুল বুঝেছিলেন, নয়তো ইচ্ছাকৃতভাবে বিকৃতভাবে ব্যবহার করেছিলেন। স্মিট কোনোভাবেই সংবিধানিক স্থিতাবস্থা রক্ষা করার পক্ষে ছিলেন না—যেমন তাঁর সমর্থকেরা দাবি করে গিয়েছিলেন, যদিও এর বিপরীতে অনেক প্রমাণাদি ছিল। তিনি ‘রাজনৈতিক শ্রেষ্ঠত্বের’ গড়নরূপে ‘পরমতন্ত্রের যুগ’কে (Age of Absolutism) মহিমান্বিত করার সাথে সঙ্গতি রেখে একটি ‘সার্বভৌম স্বৈরতন্ত্রের’ (sovereign dictatorship) দিকে রূপান্তরকে সহায়তা করছিলেন। তাহলে স্মিটের ভূতটা আসলে হোয়াইট হাউসে কী করছিল?

লেভিনসন ও শয়ুরম্যানের মতো সংবিধানবাদীরা মার্কিন শাসনে ‘স্মিটীয় মুহূর্তের’ আবির্ভাবে হতাশা ও উদ্বেগের সাথে প্রতিক্রিয়া জানালেও, সব পর্যবেক্ষক সমানভাবে বিচলিত ছিলেন না। ২০০৬ সালে প্রকাশিত Terror in the Balance: Security, Liberty, and the Courts গ্রন্থে এরিক পজনার ও অ্যাড্রিয়ান ভারমিউল দাবি করেন যে, সংসদীয় তদারকি ও বিচারিক পর্যালোচনা ছাড়া অনিয়ন্ত্রিত জরুরী ক্ষমতার পক্ষে স্মিটের যুক্তিগুলোই আসলে ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ’-এর জন্য ঠিক যা প্রয়োজন। পজনার ও ভারমিউল নির্যাতনের বিরোধিতাকারীদের ‘আত্মতুষ্ট নৈতিক আত্মমুগ্ধতা’ বলে উপহাস করেন। তাঁরা Terror in the Balance -এ তাঁদের লক্ষ্য হিসেবে লেখেন, ‘স্মিট থেকে মজ্জা বের করে নিয়ে তারপর হাড় ফেলে দেওয়া’। উপমাটি খুব বেমানান ছিল।  তারা তৎকালীন লিবারেল আইনবিদদের নৈতিক ক্ষোভকেও মোকাবিলা করার চেষ্টা করছিলেন। যেমন, সাত শতাধিক আইন অধ্যাপক ২০০১ সালের ডিসেম্বর মাসে একটি পিটিশনে স্বাক্ষর করে গুয়ানতানামো বে বন্দিদের সামরিক ট্রাইব্যুনালে বিচার করার বুশ প্রশাসনের পরিকল্পনার সমালোচনা করেছিলেন। বিচার বিভাগ গুয়ানতানামো বন্দিদের ‘অবৈধ শত্রু যোদ্ধা’ হিসেবে বানোয়াট বর্গীকরণ করার মাধ্যমে জেনেভা চুক্তি অনুযায়ী যুদ্ধবন্দি হিসেবে তাঁদের প্রাপ্য আইনি সুরক্ষা কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল।

নাইন-ইলেভেনের হামলার পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলির সম্মুখীন হয়েছিল, তা নিঃসন্দেহে ব্যতিক্রমী ছিল। তবে, আইনের শাসনের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্য, এই ব্যতিক্রমের মোকাবিলা করার মূল চাবিকাঠি হলো এটা নিশ্চিত করা যে সাংবিধানিক দৃষ্টিকোণ থেকে সেই প্রতিক্রিয়া যেন জরুরি অবস্থার অনুপাতে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। অন্য কথায়, প্রতিক্রিয়াটি এমনভাবে পরিমাপ করতে হবে যাতে আইনি-সাংবিধানিক স্থিতাবস্থায় (status quo ante) ফিরে আসা যায়। ১৮৬১ সালে, এপ্রিল মাসে ফোর্ট সামটার আক্রমণের এবং জুলাই মাসে কংগ্রেসের প্রত্যাবর্তনের মধ্যবর্তী সময়ে, লিঙ্কন—শ্মিটের পরিভাষা ব্যবহার করলে—একজন “কমিসারিয়াল” (বা সীমিত) স্বৈরশাসক হিসেবে কাজ করেছিলেন। কিন্তু লিঙ্কন প্রজাতন্ত্রকে সুরক্ষিত করার জন্য জরুরি ক্ষমতা ব্যবহার করেছিলেন; তাঁর কর্মগুলি সর্বদা সাংবিধানিক স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসার পূর্বশর্ত বহন করত; এবং তাই তাঁর এই ‘ব্যতিক্রমী’ আচরণ কার্যনির্বাহী কর্তৃপক্ষের দায়িত্বশীল ব্যবহারের একটি উদাহরণ। তাছাড়া, স্মিটের ‘দোস্ত/দুশমন’ভেদাভেদের মাধ্যমে ‘রাজনীতিকে’ সংজ্ঞায়িত করার প্রচেষ্টা, অর্থাৎ রাজনীতিকে যুদ্ধ হিসেবে দেখার ধারণা, পশ্চিমা রাজনৈতিক ঐতিহ্যের কেন্দ্রীয় দিকগুলির সাথে মৌলিকভাবে বিরোধপূর্ণ। এই ঐতিহ্য অনুসারে ‘ন্যায়বিচার’ ও ‘সদ্গুণ’ হলো রাজনীতির অস্তিত্বের কারণ, শত্রুতা নয়। আমেরিকান পরিভাষায়, স্মিটের ‘রাজনৈতিকতার ধারণা’ আসলে রাজনীতি-বিরোধী ধারণা, বা রাজনীতির বিপর্যয়ের ধারণা, যেমনটি ১৮৬১ সালে ঘটেছিল। আমাদের শাসন ব্যবস্থা সংঘাতের জন্য ডিজাইন করা হয়েছিল, ম্যাডিসন যাকে মানব জীবনের একটি স্থায়ী বৈশিষ্ট্য হিসাবে গণ্য করতেন, কিন্তু এর মধ্যে ডারউইনবাদী বা স্মিটীয় কোনো কিছুই নেই।

এদিকে, বাম স্মিটপন্থীরা বুশ প্রশাসনের নির্বাহী কর্তৃত্বের আদি-স্মিটীয় মহিমান্বিতকরণকে তাদের নিজেদের দীর্ঘদিনের লিবারেলবিরোধী পূর্বানুমানগুলোর পূর্বধারণার এক স্বাগত নিশ্চয়তা হিসেবে দেখেছিল। ১৯৯০-এর দশকেই তাঁরা রাজনৈতিক লিবারেলবাদের দেউলিয়াত্ব নিয়ে স্মিটের যুক্তিগুলোকে একপ্রকার প্রতিষ্ঠিত সত্য হিসেবে মেনে নিয়েছিলেন। ফরাসি তত্ত্বের প্রভাবাধীন হয়ে বাম স্মিটিয়ানরা স্মিটের এই দাবিকে আগ্রহভরে গ্রহণ করেন যে, লিবারেল নর্মস আসলে এক ধরনের প্রতারণা মাত্র। তাঁদের মতে, যেহেতু মানদণ্ডগুলো নির্দেশমূলক (prescriptive), অর্থাৎ সমাজে কী আচরণ গ্রহণযোগ্য তা আগে থেকেই নির্ধারণ করে দেয়, তাই এগুলোই সামাজিক ‘স্বাভাবিকতা’র সীমানা তৈরি করে। এর ফলে বিচ্যুতি ও ভিন্নতাকে “অসুস্থ” বা “অস্বাভাবিক” হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়—ফলে মানদণ্ডগুলো হয়ে ওঠে শাস্তিমূলক সমাজের এক অনমনীয় নিয়ন্ত্রণব্যবস্থার অপরিহার্য অংশ। জ্ঞান-ক্ষমতার কারণে আমাদের মধ্যে ‘স্বায়ত্বশাসন/স্বাধীনতা’র একটি বিভ্রম তৈরি হয়, যাতে আমরা বিশ্বাস করি যে আমরা মুক্ত। ফুকো যখন স্মিটের সঙ্গে যুক্ত হন, তখন এ-ই ঘটে। ফুকো লিখেছিলেন: “[the] will to knowledge reveals that all knowledge rest upon injustice, that there is no right … to truth or foundation for truth … The instinct for knowledge is malicious, something murderous, opposed to the happiness of mankind.” স্মিট ও ফুকোর দৃষ্টিতে আলোকায়নের ডায়ালেক্ট মুক্তির দিকে নয়, বিপর্যয়ের দিকে গিয়ে শেষ হয়।

জর্জিও আগামবেনের State of Exception ২০০৪ সালে প্রকাশিত হয়; এটি ছিল আবু গারিব ও গুয়ানতানামো ঘটনার প্রতিক্রিয়া এবং স্মিট ও পোস্টস্ট্রাকচারালিজমের এক পরিপূর্ণ সংশ্লেষ। এই দুই ধারাকে একত্র করে আগামবেন আলোকায়ন-বিরোধী নৈরাশ্যবাদকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যান। আগামবেন যুক্তি দেন যে, বুশ প্রশাসন ৯/১১-পরবর্তী সময়ে যে “ব্যতিক্রমের অবস্থা” ঘোষণা করেছিল, তাতে আদতে কোনো “ব্যতিক্রম” ছিল না; বরং এটি লিবারেল গণতান্ত্রিক “লিগ্যালিজমের” শান্তিপূর্ণ মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে থাকা সহিংসতার গোপন ক্ষমতাকেই প্রকাশ করেছিল। আগামবেনের মতে, ‘ব্যতিক্রমের অবস্থা’ ইতিমধ্যেই সমসাময়িক রাজনীতিতে শাসনের প্রভাবশালী রূপে প্রতিষ্ঠিত। তিনি স্মিটকে প্রশংসায় ভরিয়ে বলেন: ‘স্মিটের তত্ত্বের বিশেষ অবদান হলো, তিনি ব্যতিক্রমের অবস্থা ও আইনি শৃঙ্খলার মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন সম্ভবপর করে তুলেছেন। এটি একটি স্ব-বিরোধী অবস্থান, কারণ যা আইনের কাঠামোর মধ্যে লিপিবদ্ধ হতে হবে, তা হলো মূলত সেই কাঠামোর বহির্ভূত  একটি বিষয়: এটি অন্য কিছু নয়, বিচারিক ব্যবস্থার স্থগিতাদেশ নিজেই’। আগামবেনের মতে, ব্যতিক্রমী অবস্থার সংশোধনের উপায় আইনের শাসনে ফিরে আসা বা আইনকে প্রকৃতপক্ষে কার্যকর করা নয়। কারণ আগামবেন স্মিটকে অনুসরণ করে মনে করতেন যে, ব্যতিক্রমী অবস্থা—যদিও এটি স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করা হয়নি—আইনের শাসনের মধ্যেই লিপিবদ্ধ আছে। এই সমস্ত ধারণার অস্পষ্টতা ছিল রাজনৈতিক অক্ষমতার একটি সূত্র। বাম স্মিটপন্থীদের ডিরেক্ট একশন, এগোনিস্টিক স্ট্রাগলের মতো বিমূর্ত পপুলিজমের একটি অস্পষ্ট তত্ত্ব ছাড়া আর কিছুই দেওয়ার নেই। কিন্তু জনগণ কি আগামবেনের সঙ্গে রাস্তায় নামবে? এই ধারণাটি কিছুটা কৌতুককর—যদিও আগামবেনের এই দাবির মুখে কৌতুকটি অদৃশ্য হয়ে যায় যে, গুয়ানতানামো বে এবং আউশউইৎজ-এর মধ্যে কোনো মৌলিক ঐতিহাসিক পার্থক্য নেই। তিনি মনে করেন, উভয়ই ‘আধুনিকতার’ লুকানো উদ্দেশ্য প্রকাশ করে।

কার্ল স্মিটের কাল্ট আবার নতুন রূপে ফিরে এসেছে। সম্প্রতি ডানপন্থী মহলে একটি নতুন কর্তৃত্ববাদী নৈতিকতা দেখা দিয়েছে, যা প্রচার করে যে লিবারেল গণতন্ত্র চূড়ান্ত সংকটের মধ্যে প্রবেশ করেছে। এই মতবাদের প্রবক্তারা দাবি করেন, লিবারেল অসুস্থতার লক্ষণ সর্বত্র উপস্থিত এবং অনস্বীকার্য; শুধুমাত্র যারা সেকেলে চিন্তাভাবনায় ডুবে আছে, সেই বোকারাই এর স্পষ্টতা অস্বীকার করবে। লিবারেলবাদের এই সংকটের একমাত্র নিরাময় বা সর্বরোগহর ঔষধ হিসেবে যে স্লোগানটি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে—এবং যা স্বৈরশাসক ও তাদের সমর্থকদের দ্বারা উৎসাহের সঙ্গে গৃহীত হয়েছে—তা হলো ‘অনুদার গণতন্ত্র’ বা ‘ইলিবারেল ডেমোক্রেসি’। যে রাজনৈতিক দার্শনিকের মতবাদ লিবারেলদের অপরিবর্তনীয় পতনের কারণ ব্যাখ্যা করতে এবং এর দেউলিয়াত্ব থেকে আমাদের বাঁচাতে একটি নতুন কর্তৃত্ববাদী শাসনের দিকে পরিবর্তনের যৌক্তিকতা তুলে ধরতে বারবার উদ্ধৃত হয়েছে, তিনি হলেন কার্ল স্মিট।

ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং হাঙ্গেরির শক্তিশালী নেতা ভিক্টর অর্বানের রাজনৈতিক ‘সাফল্যে’ উৎসাহিত হওয়া ‘লিবারেলত্তোর’ রক্ষণশীলদের একটি নতুন প্রজন্ম স্মিটকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছে। স্মিটকে অনুসরণ করে, তারা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে নাগরিক স্বাধীনতা ও আইনি সমতার সাংবিধানিক নিশ্চয়তাগুলো অবশ্যই বর্জন করতে হবে, কারণ এগুলোই বিশৃঙ্খল কেন্দ্রাতিগ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের পৃষ্ঠপোষকতা করে, আর পশ্চিমা সভ্যতার দ্রুত পতনের জন্য মূলত এরাই দায়ী। গত গ্রীষ্মে টেক্সাসে CPAC সম্মেলনে অর্বান উৎসাহজনক অভ্যর্থনা পেয়েছিলেন। এর প্রতিক্রিয়ায়, ওয়াশিংটন পোস্টের একজন সাংবাদিক আমেরিকান রক্ষণশীলতার এই ‘অর্বানাইজেশন’ (Orbánization) এইভাবে বর্ণনা করেছেন: ‘লিবারেলরিরোধীতায় মগ্ন ডানপন্থীদের কাছে হাঙ্গেরি যুদ্ধে বিজয়ের একটি ঝলক এবং কাজের একটি ছাঁচ তুলে ধরে’।

স্মিটের মতবাদের ওপর আনক্রিটিক্যাল নির্ভরতা ঐতিহাসিক স্মৃতির বিচ্যুতির প্রমাণ দেয়। একইভাবে উদ্বেগজনক হলো, লিবারেলবাদের রাজনৈতিক উত্তরসূরি কে হবে—এই প্রশ্ন করা হলে, লিবারেলোত্তর প্রতিক্রিয়া শ্মিটের ‘নেতাকেন্দ্রিক গণতন্ত্র’ এর ভুল সমর্থনের পথ ধরে চলে। স্মিটের যুক্তি ছিল যে লিবারেলবাদ অসংলগ্ন এবং আত্ম-ধ্বংসকারী, কারণ এটি এক প্রকারের শাসন ব্যবস্থা যা সহজাতভাবে ‘কর্তৃত্ব’ (authority) এবং ‘শৃঙ্খলার’ (order) বিরোধী।  এসবের অভাবে ‘রাজনৈতিক শাসন’ নিজেই অর্থহীন হয়ে যায়।  এই যুক্তিটিই প্যাট্রিক ডিনিনের প্রভাবশালী লিবারেলবিরোধী গ্রন্থ Why Liberalism Failed – এ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে আছে। স্মিটকে অনুকরণ করে ডিনিন মন্তব্য করেছেন: ‘গণতন্ত্র, আসলে, লিবারেলবাদের অধীনে টিকে থাকতে পারে না’। এই সিলসিলা স্পষ্ট। রবার্ট কাটনার যেমনটি নি ইয়র্ক রিভিউ অফ বুকসে যথাযথভাবে উল্লেখ করেছেন: ‘ডিনিনের চিন্তা লিবারেল গণতন্ত্রের মূর্খতা ও বিকৃতির উপর প্রতিক্রিয়াশীল যুক্তির একটি পুরোনো ধারাকে প্রতিধ্বনিত করে, যা বিংশ শতাব্দীর লিবারেলবিরোধী বুদ্ধিজীবী যেমন লিও স্ট্রাউস, এবং ফ্যাসিবাদী তাত্ত্বিক কার্ল শ্মিট ও জিওভান্নি জেন্টিলে থেকে শুরু করে লিবারেলবাদের রাজতান্ত্রিক সমালোচক জোসেফ ডি মেইস্ত্রে পর্যন্ত বিস্তৃত’। Why Liberalism Failed গ্রন্থের মৌলিক ত্রুটি হলো, লিবারেলবাদের অযোগ্যতা সম্পর্কে এর যে ধারণা, তা এমন একজন চিন্তাবিদের বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গি থেকে নেওয়া যিনি লিবারেলবাদ ও এর সমর্থিত সবকিছুর ঘোর বিরোধী ছিলেন। ত্রুটিপূর্ণ ভিত্তি থেকে ত্রুটিপূর্ণ ফলাফল আসে। লিবারেলবাদের ঘাটতি সম্পর্কে স্মিটের বর্ণনায় কিছুটা সত্যতা থাকলেও, তিনিই প্রথম বা শেষ ব্যক্তি ছিলেন না যিনি লিবারেল শাসনের জটিল প্রবণতা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন; তবে লিবারেলবাদের প্রতি তাঁর চিত্রায়ণ ছিল একটি বিকৃত ব্যঙ্গচিত্র—যা ছিল খণ্ডিত, আত্ম-স্বার্থসিদ্ধিপূর্ণ, হিস্ট্রিয়াগ্রস্থ এবং অতিশয়োক্তিপূর্ণ, ঠিক যেমন ডিনিনেরটিও।

স্মিটের মতে আস্থাবান কেবল ডিনিন একা নয়। A World After Liberalism: Philosophers of the Radical Right নামক গ্রন্থে ‘ফার্স্ট থিংস’ লেখক ম্যাথিউ রোজ কেবল লিবারেলবাদই নয়, বরঞ্চ ঐতিহ্যবাহী রক্ষণশীলতারও মৃত্যুঘণ্টা বাজিয়েছেন। রোজের মতে, এর জায়গায় এখন ‘একটি নতুন রক্ষণশীলতা’ জন্ম নেবে, যা ‘সাম্প্রতিক যেকোনো রক্ষণশীলতা থেকে ভিন্ন… যে ধারণাগুলোকে একসময় নিষিদ্ধ ভাবা হতো, সেগুলোকে পুনরায় বিবেচনা করা হচ্ছে; যে লেখকদের একসময় নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, তাদের পুনরায় প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে’। এই ‘উগ্র ডানপন্থার’ অনুপ্রেরণাদায়ক মতবাদগুলোর ধারণাগুলিকে রোজ সমসাময়িক রাজনীতির জন্য উপযোগী করতে চাইছেন, সেগুলোর উত্থান হয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে জার্মানিতে। এগুলি ‘রক্ষণশীল বিপ্লব’ নামে পরিচিত ছিল এবং এর প্রধান ব্যক্তিত্বদের মধ্যে ছিলেন কার্ল স্মিট, আর্নস্ট ইয়ুঙ্গার, আর্থার মোয়েলার ভ্যান ডেন ব্রুক এবং ওসওয়াল্ড স্পেংলার। রোজ এই চিন্তাবিদদের প্রশংসা করেছেন কারণ তারা ‘সাংস্কৃতিক পার্থক্য, মানুষের অসমতা, ধর্মীয় কর্তৃত্ব এবং জাতিগত বায়োপলিটিক্স’-এর মতো বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা করতে ইচ্ছুক ছিলেন, যদিও তাদের এই দৃষ্টিভঙ্গিকে কেবল জেনোফোবিয়া ও সহিংসতার প্রতি উৎসাহপ্রদান হিসেবেই দেখা হয়েছিল’। এই দৃষ্টিভঙ্গি কেবল ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল না, তা সত্যও ছিল।

একইভাবে, হার্ভার্ডের আইনি পণ্ডিত এবং ক্যাথলিক ‘ইন্টিগ্রালিস্ট’ অ্যাড্রিয়ান ভার্মিউল স্মিটের এই উক্তিটি ব্যবহার করেছেন যে ‘সমস্ত রাজনৈতিক ধারণাই ধর্মতাত্ত্বিক ধারণার সেকুলারকরণ’। তিনি লিবারেলবাদকে ধর্মতাত্ত্বিক উগ্রতায় অভিযুক্ত করেন, যার মাধ্যমে লিবারেলবাদ ঐতিহ্যবাহী সম্প্রদায়, বিশ্বাস ব্যবস্থা এবং জীবনধারাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে অবিরতভাবে তার এজেন্ডা এগিয়ে নিয়ে চলেছে। ডিনিনের মতো ভার্মিউলের যুক্তিগুলিতেও সূক্ষ্মতা ও নির্ভুলতার অভাব রয়েছে, তবে সেগুলো রেটোরিক্যাল জোর দিয়ে তা পুষিয়ে দেওয়া হয়। স্মিটের মতোই, ভার্মিউল যুক্তির চেয়ে ইচ্ছাশক্তিকে বেশি অগ্রাধিকার দেন। স্মিটের উক্তিটি ছিল আধুনিকতার মানসিকতার উপর তাঁর আরও সাধারণ আক্রমণের অংশ। এটা মনে রাখা দরকার যে, ধর্মতত্ত্বের বিপরীতে, আধুনিকতা তার বুদ্ধিবৃত্তিক পদ্ধতির জন্য এমন প্রমাণভিত্তিক মানদণ্ডের উপর নির্ভর করে যা ‘সর্বজনীন’ এবং ‘সাধারণীকরণযোগ্য’। এর প্রস্তাব এবং দাবিগুলো আলোচনা ও সমালোচনার জন্য উন্মুক্ত। ভার্মিউল যে ‘রাজনৈতিক ক্যাথলিকবাদের’ তার আধুনিকতার নীতিগুলো গোঁড়ামি-মুক্ত। ভার্মিউল কি সেমিনারের দরজায় তার বিশ্বাস রেখে আসেন, নাকি গির্জার দরজায় তার যুক্তি রেখে আসেন?

কার্ল স্মিটের চিন্তাধারার সঙ্গে যুক্ত থাকার চেয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক ও নৈতিক দেউলিয়াপনার আর কোনো নিশ্চিত লক্ষণ নেই। বর্তমান সময়ে তাঁর মতবাদের এই টিকে থাকা আমাদের সময়ের বহু দুর্ভাগ্যজনক অমঙ্গলের মধ্যে আরেকটি। কিন্তু যতদিন পর্যন্ত একটি স্বাধীন ও ন্যায্য সমাজের কঠিন কাজ তার কিছু বুদ্ধিজীবীর কাছে অত্যধিক বোঝা বলে মনে হবে, ততদিন পর্যন্ত স্মিট জিন্দা থাকবেন, আবার সক্রিয় হবেন, আবার খারিজ হবেন। 

This post has already been read 16 times!

মন্তব্য করুন