ডিসেম্বর 7, 2025
1

This post has already been read 14 times!

বাংলাদেশ প্রতিদিনে “নিজের ভাষাকে বাঙালিরা কি সত্যি ভালোবাসে?” নামে বাংলাদেশের নারীবাদী আন্দোলনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব তসলিমা নাসরিন একটি নিবন্ধ ছেপেছেন এই ফাল্গুনে। তার কথার একটি গুরুত্ব আছে, কেননা তিনি বাংলাদেশে নারীর সমান অধিকার আন্দোলনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একজন কর্মী এবং সেই কারণবশত একজন নির্বাসিত লেখক। বহু বিষয়েই তিনি আমাদের মান্য কিন্তু আলোচ্য নিবন্ধে তিনি বাংলাদেশের বাংলাভাষীদের নিয়ে অন্যায্য আপত্তি তুলেছেন, যা বিপত্তি ও বিব্রত-কর। তাকে লক্ষ্য করে এই আমার এই লেখায় সসম্মানে কিছু ভুল ভাঙাতে চাই তার। তার নিবন্ধে তিনি বলেছেন,

“বাংলাদেশের অধিকাংশ বাঙালির বাংলা উচ্চারণে ত্রুটি থাকেই। শুদ্ধ বাংলা বলার অভ্যেস নেই বলেই সম্ভবত কবিতায় শুদ্ধ উচ্চারণে ভুল হয়ে যায়। বাংলাদেশের মানুষ শব্দে চন্দ্রবিন্দুর উচ্চারণ করেই না, দাঁড়ানোকে দাড়ানো বলে, অবশ্য দাড়ানোও বলে না, বলে দারানো। র আর ড়’ র উচ্চারণে কোনও পার্থক্য থাকে না।”

বাংলাদেশের বাঙালিরা নিজের ভাষাকে সত্যি সত্যি ভালোবাসে তার প্রমাণতো আপনিই দিলেন নাসরিন! যাদের ভাষায় চন্দ্রবিন্দু আর জিভ উল্টানো ড়’র উচ্চারণ নেই তারা কেনইবা তা উচ্চারণ করতে যাবে? পশ্চিমের পাতে ওঠার জন্য? “বাংলাদেশের অধিকাংশ বাঙালির বাংলা” বাংলাদেশের বাংলা। পশ্চিমবঙ্গের প্রমিত বাংলার সাপেক্ষে এর ত্রুটি ধরা এবং একে অশুদ্ধ বলার মাধ্যমে পুরো বিষয়টি সম্পর্কে আপনার আধাসিদ্ধ জ্ঞান প্রকাশ পাচ্ছে। আপনাকে জ্ঞান দেয়া আমার সাজে না, শুধু বলব, আপনি সমান অধিকার আন্দোলনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একজন কর্মী, ভাষা বিষয়ে বৈষম্যবাদী বক্তব্য রাখার আগে ভেবে দেখতে পারতেন। আপনি আরও বলেছেন,

“বাংলাদেশে ভাষা টিকে থাকা মানে ভাষা নয়, উপভাষা টিকে থাকা , অপভ্রংশ টিকে থাকা। আমরা যে ভাষায় বই পত্র লিখি, সে ভাষায় কথা বলি না। কিন্তু চেষ্টা করলেই কিন্তু শুদ্ধ বাংলা বলার অভ্যেসটা আমরা করতে পারি।আবৃত্তি শেখার জন্য সারা পশ্চিমবঙ্গে বিদ্যালয় খোলা হয়েছে।”

দুটি কথা। এক, ভাষা এবং উপভাষা আলাদা কিছু নয়। আপনি একটি প্রমিত উপভাষাকে ভাষা বলছেন, অন্যগুলোকে বলছেন উপভাষা। এই প্রমিতকরণ একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এটা গণতান্ত্রিক হওয়াই ভালো, চাপিয়ে দিলে তা নানান বিপত্তির তৈরি করে। সে যাক, বিষয়টি আসলে উলটা, বাংলাদেশের উপভাষাগুলোর টিকে থাকা বা অপভ্রংশগুলোর (!) টিকে থাকা মানে বাংলা ভাষার টিকে থাকা। কেননা বাংলা ভাষা মানে এর একটি উপভাষা নয় ( হোক তা পশ্চিমের প্রমিত কিংবা বাংলাদেশের প্রমিত), বাংলা ভাষা মানে অনেকগুলো উপভাষার একটা সাধারণ নাম। ঐ উপভাষাগুলোর বাইরে বাংলা ভাষা বলে কিছুর অস্তিত্ব নেই। উপভাষা হচ্ছে বাস্তব, ভাষা হচ্ছে ভেবে নেয়া একটি বাস্তব- এসব অবশ্য সূক্ষ্ম কথা। বরং দ্বিতীয় কথায় যাই।

যে ভাষা চেষ্টা করে অভ্যাস করতে হয় সেটা নিজের ভাষা না, আর সেটাকে ভালো না বাসলে বকা দিতে পারেন অবশ্য, কিন্তু “নিজের ভাষাকে বাঙালিরা কি সত্যি ভালোবাসে?” এই নামে না। আর, আপনি কবি, আমারও প্রিয়, কিন্তু আপনারতো জানার কথা ভাষার সাপেক্ষে কবিতার সঙ্গে পাঠের সম্পর্ক যত আন্তরিক আবৃত্তির সঙ্গে ততটা না। আবৃত্তি না ভাষার এবং না কবিতার অপরিহার্য অঙ্গ। তাহলে এই অঙ্গের শাসনে ভাষা বা কবিতা কাঁপবে কেন? আর লেখার ভাষা এবং বলার ভাষা আলাদা থাকাটা খামতি কেন হবে? ও আচ্ছা আপনি বানান ভুলের কথা বলছেন? কেননা আপনাকে এক সংস্কৃতবিশারদ বলেছেন,

“বাংলাদেশের মানুষ বাংলা বানান লিখতে ভুল করে, কারণ বাংলা ভাষার যে মূল উৎস, সংস্কৃত, এ নিয়ে তাদের চর্চা যথেষ্ট নয়, ফলে তৎসম শব্দের বানানের যে বিধিগুলো অনুসরণ করা হয়, সে সম্পর্কে তারা ওয়াকিবহাল নন। ফলতঃ বাংলা সাহিত্য পড়ে ভাষা এবং বানান তাদের আয়ত্ত করতে হয়েছে, কিন্তু সেই বানানগুলোর উৎস সম্পর্কে তাদের সম্যক ধারণা নেই।”

আচ্ছা আপনার কি মনে হয় না যে, একটা ভাষার বানান নির্ভুলভাবে লেখার জন্য আরেকটা ভাষা চর্চা করা আবশ্যক- এই যুক্তিটি অন্য আরেকটা সত্যকে সামনে আনে? সেই সত্যটি হল, সংস্কৃতের আদলে গড়া বানানরীতি বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাভাষীর জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঠিক আছে তাহলে ঠাকুরের মুখেই শুনুন:

“সংস্কৃত ভাষা ভালো করে জানা না থাকলে বাংলা ভাষা ব্যবহারের যোগ্যতা থাকবেই না, ভাষাকে এই অস্বাভাবিক অত্যাচারে বাধ্য করা পাণ্ডিত্যাভিমানী বাঙালির এক নূতন কীর্তি। যত শীঘ্র পারা যায় এই কঠোর বন্ধন শিথিল করে দেওয়া উচিত। বস্তুত একেই বলে ভূতের বোঝা বওয়া। এত কাল ধরে সংস্কৃত ব্যাকরণের সাহায্য না নিয়ে যে বহুকোটি বাঙালি প্রতিদিন মাতৃভাষা ব্যবহার করে এসেছে এতকাল পরে আজ তাদের সেই ভাষাই বাংলা সাহিত্যে প্রবেশের অধিকার পেয়েছে। এইজন্য তাদের সেই খাঁটি বাংলার প্রকৃত বানান নির্ণয়ের সময় উপস্থিত হয়েছে” (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বানান-বিধি)।

আপনি এও অবশ্যই জানেন, বানানরীতিও রাজনৈতিক, অর্থাৎ এখানেও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা জরুরি। এমন কোন বানানরীতি আপনি সাধারণের উপর চাপিয়ে দিতে পারেন না যা তাদের অংশগ্রহণকে থতমত করে তোলে। তাদের উপর বোঝা চাপিয়ে দিয়ে তাদের অসমর্থ প্রমাণ করা একটা পুরনো কৌশল, পুরুষেরা যুগ যুগ ধরে নারীদের উপর এই কৌশল প্রয়োগ করেছে আপনি তা আরও ভালো করে জানেন। কিন্তু ভাষার বিষয় আপনার বিচার এতো পালটে গেল কেন?

আরেক একটি কথা বলে শেষ করি, আপনি এবং অনেকেই প্রমিত বাংলায় শুদ্ধ করে বলা এবং লেখার কথা বলতে গিয়ে বাংলা ভাষার বিপন্নতার দোহাই তোলেন, এই ভাষার জন্য রক্তদানের কথা তোলেন, স্বাধীনতার সঙ্গে এর অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের কথা তোলেন, এইটা কেন করেন? আপনারা ঠিকই জানেন, ১৯৪৭-৮ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত বাংলা ভাষা নিয়ে আন্দোলন হয়েছে প্রমিত বাংলা নিয়ে নয়; মুখের ভাষা কাইড়া নেয়ার কথা বলা হয়েছে আবৃত্তির ভাষা নয়। আবার একটি জনগোষ্ঠীর মুক্তির আন্দলোন কোনো ভাষিক জাতিতে কুক্ষিগত করার জন্য ত্রিশ লাখ মানুষ শহিদ হয়নি; তাদের যুদ্ধ করার অনেক কারণ ছিল, একটি সাধারণ কারণ হল তারা বৈষম্যকে মেনে নিতে চাননি। ফলে বৈষম্যবাদী প্রস্তাবে তাদের দোহাই দিবেন না আশা করি। যখনই এসব বৈষম্যবাদী চিন্তা আসবে, তাকে এই যুক্তিতে প্রতিহত করুন, প্রমিত বাংলা অনেকগুলি উপভাষার একটা মাত্র। এটা মরলে বাংলা মরার প্রশ্ন আসে না, বাংলাভাষীরা তখন বাংলার আরেকটা উপভাষাকে প্রমিত করে নিবে।

This post has already been read 14 times!

মন্তব্য করুন