বাংলাদেশে সিভিল সোসাইটির প্রচলিত বাংলা অনুবাদ হল সুশীল সমাজ – আমি সাম্প্রতিক কালে সিভিল সোসাইটি বলতে ‘জনসমাজ’ শব্দটি ব্যবহার করি। কেননা সুশীল কথাটার মধ্যে এক ধরনের পদসোপান (হাইয়ারার্কি) আছে বলে আমার মনে হয়। এর খানিকটা অবশ্য তৈরি হয়েছে কেননা যারা এই ‘সুশীল সমাজের’ সদস্য বলে নিজেদের মনে করেন তাঁরা নিজেদের হাজির করছেন অভিজাত শ্রেনী বা গোষ্ঠী হিসেবে। আমার ধারণা আমরা যদি একে জনসমাজ বলে অভিহিত করি তবে এই দুর্বলতা থেকে খানিকটা দূরে থাকা যায়। কেউ কেউ একে ‘সচেতন নাগরিক সমাজ’ বলার পক্ষপাতী।
বাংলাদেশে এই জনসমাজের ধারণা এবং তার কার্যকারিতা নিয়ে এক ধরনের ভুল ধারণা রয়েছে এবং প্রবল একটা সমালোচনাও রয়েছে। এই সমালোচনা গত কয়েক বছরে বেশ জোরদার হয়েছে। আমি লক্ষ করেছি যে প্রায়শই গোটা জনসমাজের বিরুদ্ধে এক ধরনের বিষোদ্গার করা হয়ে থাকে। সেটার অন্যতম কারণ হল বাংলাদেশে সিভিল সোসাইটি বলতে একটা নির্দিষ্ট ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গেছে; আর তা হল জনসমাজ মানে হল দেশের বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলো। তা ছাড়া সিভিল সোসাইটি বলতে একগুচ্ছ পরিচিত মানুষ যারা সাংবাদিকতা, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে পরিচিতি (এবং জনপ্রিয়তা) অর্জন করেছেন। এর সঙ্গে যুক্ত করা হয় কোনো কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে যারা বিভিন্ন বিষয়ে তাঁদের মন্তব্য প্রকাশ করেন। সংবাদপত্রে লেখালেখি কিংবা টেলিভিশনে টক শো’তে অংশগ্রহণকারী বুদ্ধিজীবীদের এই জনসমাজের প্রতীক, প্রতিনিধি এবং প্রতিভূ বলেও মনে করা হয়। এনজিও, বেসরকারি গবেষণা সংস্থা, মানবাধিকার সংগঠন, সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কর্মী – এদের সবাইকে এক কাতারে দাঁড় করিয়ে অনেকেই গোটা জনসমাজের ধারনারই বিরোধিতা করে থাকেন। ধরে নেন যে সুশীল সমাজ হল একটি সমশ্রেনীভুক্ত সমাজ এবং আমার সবাইকে একভাবে বিচার করতে পারি; আর এর যে কোনো অংশের বা ব্যক্তির সীমাবদ্ধতা আসলে পুরো ধারনাটিরই অকার্যকরতার প্রমাণ বহন করে। এই কাজটি ক্ষমতাসীনরা তো হরহামেশাই করেন এমনকি বিরোধী রাজনীতিবিদরাও তা থেকে পিছপা হন না। এখন সাধারণ মানুষেরাও প্রায়শ এমন ভাবেই বলে থাকেন।
আমার মনে হয় এখন এই বিষয়ে একটু খোলামেলা আলোচনার সময় এসেছে। আমাদের জনসমাজের ধারণা বিষয়ে আলোচনা করা দরকার; কেননা জনসমাজ বলে যাদের চিহ্নিত করা হয় তাঁদের কোনো কোনো অংশের, বলা যায় এক বড় অংশের, আচরণের কারণে আমরা সম্ভবত জনসমাজের ধারণাকে এমনভাবে সমালোচনা করছি যা দীর্ঘমেয়াদে স্বাধীন (স্বায়ত্তশাসিত অর্থে) তৃণমূল পর্যায় থেকে, দলীয় বিবেচনার বাইরে সামাজিক আন্দোলন গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে বড় ধরনের বাধা হয়ে উঠতে পারে। সেকারনে আমাদের আলোচনা করা দরকার যে আমরা জনসমাজ বলতে কি বুঝি, গণতান্ত্রিক সমাজে তার দরকার কেন, এবং কেন এখন বাংলাদেশে দলীয় বিবেচনায় বিভক্ত কিংবা আর্থিক বিবেচনা দ্বারা চালিত জনসমাজ প্রকৃতপক্ষে জনসমাজের ধারণার সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ। আমাকে আমার পাঠকরা সাহস যোগালে বলবো – এখন সময় এসেছে জনসমাজের ধারণাকে তার অপব্যবহারকারীদের হাত থেকে উদ্ধার করে তার প্রকৃত জনসমাজের কাছে ফিরিয়ে আনা।
জনসমাজের দুটো ধারণার সঙ্গে আমরা পরিচিত। একটা আমরা পাই আন্তনিও গ্রামসির লেখালেখি থেকে। গ্রামসি বলছেন যে পুঁজিবাদী রাষ্ট্র আসলে দুটো পরস্পর-সংযুক্ত (ওভারলেপিং) এলাকা বা স্ফেয়ার – একটা হল ‘রাজনৈতিক সমাজ’ (‘পলিটিক্যাল সোসাইটি‘), আরেকটা হল ‘জনসমাজ’ (‘সিভিল সোসাইটি’)। গ্রামসি বলছেন যে রাজনৈতিক সমাজ বল প্রয়োগের মাধ্যমে শাসন করে আর সিভিল সোসাইটি সম্মতি (কনসেন্ট)-এর মাধ্যমে শাসন ব্যবস্থা বহাল রাখে। তিনি পরিবার, শিক্ষা ব্যবস্থা, অর্থনীতি, ট্রেড ইউনিয়ন ইত্যাদিকে সিভিল সোসাইটির অংশ বলে মনে করেন। আমরা এই ধারণা থেকে এগিয়ে গিয়ে বলতে পারি যে তা হলে যে কোনো পুঁজিবাদী সমাজে সিভিল সোসাইটি ঐ ব্যবস্থাকে বহাল রাখার বাইরে কিছু করবে না। আবার আপনি বলতে পারেন যে, যদি আপনি পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করতে চান তবে আপনাকে তা করতে হবে এই সম্মতির জায়গাতে আঘাত হানার মধ্য দিয়েই। প্রকৃতপক্ষে গ্রামসি তাই-ই বলেছেন যখন তিনি সমাজ বদলের কথা বলছেন। তিনি বলছেন যে, বিপ্লবী দল শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে জৈব বুদ্ধিজীবী বা অরগ্যানিক ইন্টেলেকচুয়াল তৈরির পরিস্থিতি তৈরি করবে এবং সিভিল সোসাইটির মধ্যে বিকল্প আধিপত্য বা হেজিমনি তৈরির পথ উন্মুক্ত করবে। তারাই তাঁদের রাজনৈতিক সক্রিয়তার মাধ্যমে, সর্বহারা মানুষের সংস্কৃতিকে প্রসারিত করবে। একে গ্রামসি বলছেন অবস্থানের লড়াই (‘ওয়ার অফ পজিশন’)। এই ধারণার আলোকে বর্তমান পরিস্থিতিতে (ধরা যাক বাংলাদেশের ক্ষেত্রে) আমরা বলতে পারি যে, যারা প্রচলিত ব্যবস্থার ধারণাগুলোকে চ্যালেঞ্জ করছেন, রাষ্ট্র এবং আধিপত্যশীল আদর্শের বিরুদ্ধে সাধারন মানুষের নিত্যদিনের সংগ্রামের পাশে দাঁড়িয়ে বিকল্প ভাবাদর্শকে তুলে ধরছেন তারাই হচ্ছেন জনসমাজের বা সিভিল সোসাইটির অংশ।
সিভিল সোসাইটির দ্বিতীয় ধারনাটি অনেক পুরনো, তবে মার্ক্সের আবির্ভাবের পর এ নিয়ে (গ্রামসি ছাড়া) অন্যরা খুব একটা আলোচনা করেননি। গত তিন দশকে অবশ্য এ নিয়ে নতুন করে আলোচনা লক্ষ করা যাচ্ছে। এই ধারনাটি হল পরিবার, রাষ্ট্র, এবং বাজারের বাইরে সাধারন মানুষেরা তাঁদের অভিন্ন স্বার্থকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য যে জায়গায় (কেবল ভৌত জায়গা বা ফিজিক্যাল স্পেস নয়, ‘এরেনা’ অর্থে) একত্রিত হন সেটাই হল সিভিল সোসাইটি। আরেকভাবে বললে আমরা বলতে পারি যে, যারা নাগরিকদের স্বার্থ এবং ইচ্ছাকে প্রতিনিধিত্ব করে এবং রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠীর প্রভাবের বাইরে থাকে সেই সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্মিলিত রূপই হল সিভিল সোসাইটি।
লক্ষ করলে দেখবেন যে বাংলাদেশে জনসমাজের যে ধারণা প্রতিষ্ঠা পেয়েছে তা হল এটা উন্নয়ন কর্মকান্ডের সঙ্গে যুক্ত বা কয়েকজন মধ্যবিত্ত/উচ্চবিত্ত মানুষ তাঁদের পরিচিতির কারনে আলাদা ভাবে ‘সিভিল সোসাইটি’ বলে পরিচিত হবেন; কিন্ত এ ধারণা আসলে জনসমাজের মূল ধারণার সঙ্গে একেবারেই সংগতিপূর্ন নয়। যারা রাজনৈতিক সমাজের অংশ, যারা দলীয় বিবেচনায় তাঁদের বক্তব্য ও কর্মকান্ড পরিচালনা করেন, যারা আর্থিক বিবেচনায় তাঁদের এজেন্ডা নির্ধারন করেন তারা তো একেবারে মৌলিক বিবেচনায়ই নিজেদের সিভিল সোসাইটি বলে দাবি করতে পারেন না। এইরকম যে শ্রেণীটি বাংলাদেশে গড়ে উঠেছে তারা নিজেরাও কিন্ত দাবি করেন না যে তাঁরাই সিভিল সোসাইটি। অন্যপক্ষে তাঁদের এই ধরনের কার্যকলাপের সমালোচনা করতে গিয়ে তাঁদেরকে সমালোচকরা এমন জায়গায় স্থাপন করেন যেখানে তাঁদের থাকার কোনো যোগ্যতাই নেই। এটা রাজনৈতিক শ্রেণীর সদস্যরা খুব আনন্দের সঙ্গে উপভোগ করেন কেননা তাঁরা দেখতে পান যে এই সমালোচনা কার্যত সিভিল সোসাইটি বা জনসমাজের ধারনাকেই নাকচ করে দিচ্ছে। এটা বলা প্রয়োজন যে, জনসমাজের ধারণা কোনো একদল ব্যক্তি, গোষ্ঠি, বা সংগঠনের কাছে ইজারা দেয়া হয়নি। জনসমাজ কেবল তাঁদের কাজের মধ্য দিয়েই জনসমাজ হয়ে ওঠে, টিকে থাকে।
এই জায়গায় এসেই গণতন্ত্রে জনসমাজের প্রয়োজনটা আমাদের মনে করতে হবে। জনসমাজের সবচেয়ে বড় ভূমিকাটি হল জবাবদিহিতার সংস্কৃতি তৈরি করা। জবাবদিহিতা বলতে রাজনৈতিক শ্রেণী সবসময়ই নির্বাচনকে বোঝেন এবং তারা সেটাই বোঝাতে চান। তারা এটাও বলেন জবাবদিহিতার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাই যথেষ্ট – ‘আপনার যদি বক্তব্য থাকে তাহলে সংসদে আসুন’ বলে সবসময়ই উচ্চস্বরে যে সরকারি দল (এখন এবং অতীতে) বলে থাকে তা থেকে প্রমাণিত যে তারা রাজনৈতিক দলের বাইরে আর কোনো স্বাধীন সত্তার ব্যাপারে মোটেই উৎসাহী নয়। তাহলে যারা দলের বাইরে থাকবেন তাঁদের কণ্ঠস্বর আমরা কি ভাবে শুনতে পাবো ? আমরা যদি দেখতে পাই যে নির্বাচিত সরকারের করণীয় কাজে ব্যত্যয় ঘটছে তাহলে আমাদেরকে কি কেবল বিরোধী রাজনীতিবিদদের ওপর নির্ভর করতে হবে? গণতন্ত্রে সকলের কণ্ঠস্বর শোনার উপায়ই হচ্ছে জনসমাজের উপস্থিতি ও শক্তি। এখন আমরা যদি ক্রমাগতভাবে জনসমাজের ধারণাকেই অগ্রহণযোগ্য করে তুলি তবে তা কার অনুকূলে যাবে?
বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাস হল এই যে যারাই ক্ষমতায় যান তাঁদের মধ্যেই কর্তৃত্ববাদী প্রবণতা তৈরি হয়। বাংলাদেশের সাংবিধানিক কাঠামো, রাজনৈতিক সংস্কৃতি, দলীয় ব্যবস্থা, নেতৃত্বের ধরণ – সবই এই ধরণের কর্তৃত্ববাদী শাসনের কারণ ও ফলাফল। সেই পটভূমিকায় ক্রমাগতভাবে জনসমাজ বলে পরিচিত একটা বড় অংশ– যেমন সাংবাদিক ও পেশার সংগঠনগুলো – দলীয় মুখপাত্রে পরিণত হয়েছে। ব্যক্তিদের ভূমিকা উল্লেখ করলাম না – কেননা এ বিষয়ে সবাই ভালোভাবে অবগত। এই রকম পরিস্থিতিতে কিছু লোকের অপব্যবহারের কারনে স্বাধীন জনসমাজের ধারনাকেই যদি আমরা বাতিল করে দেই তবে তার পরিণতি ভাল হবে না।
তাহলে করণীয় কি? দেশে সিভিল সোসাইটি বা জনসমাজ বলে পরিচিতদের একটা বড় অংশের এই ধরণের দেউলিয়াপনা এখন সকলের কাছেই স্পষ্ট। তারা যে এখন আর নাগরিকদের স্বার্থ এবং ইচ্ছাকে প্রতিনিধিত্ব করেন না সেটা সত্য, কিন্ত তার অর্থ কিন্ত এই নয় যে সাধারনের প্রয়োজনে ইস্যুর ভিত্তিতে তৃণমূল পর্যায় থেকে চাপ দেবার জন্য আন্দোলন তৈরি হয়না বা তৈরি হওয়া সম্ভব নয়। বিভিন্ন প্রয়োজনে (যেমন ধরুন প্রবল শৈত্য প্রবাহের সময় সামাজিক উদযোগে সাধারনের জন্য বস্ত্র বিতরণ) আমরা জনসমাজের উদযোগ দেখেছি। ২০১১ সালে সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে এ ধরণের একটা আন্দোলনের উদ্ভব হয়েছিল সেটাও অনেকের মনে থাকবে। প্রচলিত রাজনৈতিক শক্তি বা দলের বাইরে সচেতনভাবে যারাই এগিয়ে আসছেন তাঁর শ্রেনী বা পেশার সম্মিলিত স্বার্থের কথা বলতে তাকেই আমরা জনসমাজ বলে চিহ্নিত করবো। যেমনঃ নারী সমাজ তাঁদের অধিকার নিয়ে কথা বললে তাকে জনসমাজের অংশ হিসেবে গণ্য করতে হবে। কৃষক তার উৎপাদন খরচ ও তার উৎপাদনের পণ্যের উপযুক্ত দাম নিয়ে কথা তুললে সে জনসমাজের অংশ হয়ে ওঠে। তেল-গ্যাস-বিদ্যুত নিয়ে আন্দোলন করতে গিয়ে নাগরিক স্বার্থের কথা যারা তুলছে তাদেরকে জনসমাজ বা সচেতন নাগরিক সমাজ বলা হবে না কেন ? যারা গার্মেণ্টসের অনিয়ম-অনাচার-বঞ্চনা নিয়ে কথা তুলছে তাদের জনসমাজ না বলার পক্ষে যুক্তি কোথায়? এই যে শিক্ষক সমাজ রাস্তায় নেমেছেন তাদের পেশাগত দাবির জন্য লড়ছেন তাঁরাই কি জনসমাজ নয়?
এগুলো প্রমাণ করে বাংলাদেশ প্রকৃত বিচারে জনসমাজের উপস্থিতি আগেও ছিলো, এখনও রয়েছে। তাঁদের আরো বড় ধরণের সামাজিক আন্দোলনের কাজে যুক্ত করাটাই হচ্ছে এখনকার কাজ। আমাদের প্রয়োজন হল জনসমাজের এই ধারণাকে আরো বেশি করে সামনে নিয়ে আসা, জনসমাজের ধারণাকে বাতিল করে দেয়া নয়। এসব কার্যকলাপ একদিকে জনসমাজের ধারণাকে তার জায়গায় প্রতিষ্ঠিত করবে অন্যদিকে যারা সিভিল সোসাইটির ধারক বলে নিজেদের ভাবছেন তাদের দেউলিয়াপনা স্পষ্ট হবে। এই বিবেচনায়ই আমি সিভিল সোসাইটি বলতে ‘জনসমাজের’ কথা বলছি, এবং মনে করি যে যারা দলীয় উঞ্ছবৃত্তির বাইরে, ব্যবসায়িক বিবেচনার বাইরে স্বাধীন ভাবে জনস্বার্থে কথা বলছেন, সংগ্রাম করছেন তাঁদের এখন উচ্চকন্ঠে বলা দরকার ‘আমরাই জনসমাজ’ এবং জনসমাজের ধারণাকে যারা কলুষিত করছেন তাঁদের এবং যারা একে বাতিল করে দিতে চাইছেন তাঁদের বিরুদ্ধে একই ভাবে সোচ্চার হওয়া প্রয়োজন।
প্রথম প্রকাশঃ প্রথম আলো, ৩০-০১-২০১৩
সংসদিয় গনতন্ত্রের দুই দশক পার হয়ে গেলেও গনতন্ত্রের কার্যকর সুফল সুফল পাবার জন্য আমাদের যে আরো দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে এটা এখন স্পষ্ট হয়ে গেছে। “পথ পরিক্রমা” বলতে আসলে কি কি সুনির্দিষ্ট কার্যাবলি বোঝায়, সেগুলি কারা করবেন, আর কি ভাবে করবেন এগুলোও নির্ধারিত হওয়া দরকার আছে। সে বিচারে “সুশীল সমাজ” বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। লেখাটিতে গ্রামশির উল্লেখ থাকায় এ প্রসঙ্গে তাঁর চিন্তাভাবনার সাথে পরিচিত হবার চেষ্টা করলাম এবং দেখলাম তিনি সুশীল সমাজের ওপর কতটা গুরুত্ব দিয়েছেন। সেই বিচারে লেখাটিকে একটি দীর্ঘ আলোচনার সূত্রপাত হিসাবে দেখা যেতে পারে। আশা করি তেমনটাই হোক।
একজন কৌতুহলি নাগরিকের দৃষ্টিতে দেখলে সুশীল সমাজ এবং সমাজ পরিবর্তনের প্রক্রিয়াটিকে নিয়ে আলোচনার দুটি গুরুত্বপূর্ণ মাত্রা রয়েছে। একটি হচ্ছে বৈশ্বিক এবং কালিক মাত্রায় বিষয়টিকে স্থাপন করে কিছু ধারনা পরিষ্কার করে নেয়া। যার মধ্যে থাকবে বিভিন্ন সমাজে এবং সময়ে জনসমাজের ভূমিকার বিশ্লেষন। অন্যটি হচ্ছে সুনির্দিষ্টভাবে বাংলাদেশে সুশীল সমাজের ভূমিকার মূল্যায়ন। সাম্প্রতিক সময়ে সুশীল সমাজের সম্পর্কে একটা নেতিবাচক ধারনা তৈরি হয়েছে, যেটা আপনি আপনার লেখায় উল্লেখ করেছেন। আর এই ক্ষেত্রে সুশীল সমাজকে সংকীর্ণ ভাবে সংজ্ঞায়িত করা একটা কারন অবশ্যই, তবে এটার আরো দিক রয়েছে। প্রথমত যখন কোন একটা গোষ্ঠীকে সুশীল সমাজ হিসাবে চিহ্নিত করা হচ্ছে তখন সেটা তাদের ক্রিয়াশীলতার একটা নির্দেশক বটে। যারা রাজনৈতিক প্রক্রিয়াতে কোন রকম ভূমিকা রাখেননা তাদের নিষ্ক্রিয়তার দরুনই সুশীল সমাজ হিসাবে পরিচিত হন না। যেসব গোষ্ঠী নিজেদের সুশীল হিসাবে সবার সামনে উপস্থাপন করতে পারতেন তারা যদি কুঠুরী থেকে বেরিয়ে না আসেন তাহলে তারা দৃশ্যমান হবেননা — ফলে সুশীল সমাজ পদবাচ্যও হবেননা। এই ভাবে ভাবা যায় হয়ত। তবে সুশীল সমাজের অনেকগুলো ভাগ থাকবে, সেখানে ভিন্ন ভিন্ন মত থাকবে। সেই ক্ষেত্রে দেখা দরকার কারা সুশীল সমাজের কোন ভাগটির সমালোচনা করছেন?
পদসোপান এবং জনসমাজ বনাম সুশীল সমাজ প্রসঙ্গে আসি। এই প্রেক্ষিতে গ্রামশী অবশ্য সরাসরি “সিভিল সোসাইটি” উল্লেখ করেছেন – এই শ্রেনীটিকে তিনি যেভাবে সংজ্ঞায়িত এবং চিত্রায়িত করেছেন সেই অনুসারে তার নামকরনটা যথার্থ মনে হচ্ছে আমার কাছে। সেখানে নিজেদের অধিকার সম্পর্কে, আধিপত্যবাদের কৌশল এবং শোষনের নানাদিক সম্পর্কে অসচেতন আরেকটি গোষ্ঠীকে আলাদা করা হয়েছে। এই শ্রেনী বা গোষ্ঠীকে বলা হচ্ছে “সাবলটার্ন”। আপনার ভাষায় যেটা জনসমাজ সেটা সম্ভবত গ্রামশীর সুশীল সমাজ এবং সাবল্টার্নের সমন্বয়ে তৈরি একটা গোষ্ঠী। তবু সামগ্রিক প্রক্রিয়াটিকে ধারন করার জন্য গ্রামশির তৈরি বিভাজন দরকারি মনে হচ্ছে, অন্তত তাঁর ধারনাকে ব্যখ্যা করার জন্যতো অবশ্যই। সেটার আলোকেই গায়ত্রী চক্রবর্তির প্রশ্ন “সাবলটার্নরা কি বলতে পারে? [Can The Subaltern Speak?]” – এই প্রশ্নটি প্রাসঙ্গিক হয়। গ্রামশির শব্দচয়নে যেই সুশীল সমাজকে আমরা পাই – তার কয়েক ধরনের ভূমিকা থাকতে পারে – আবার সেটা ভিন্ন ভিন্ন গোষ্ঠিকেও বোঝাতে পারে। গ্রামশির বাইরে গিয়ে কিছুটা সাধারনভাবে দেখা যায় – তার কখনো অধিপতিদের সাথে গলা মেলান, কখনো সাবলটার্নদের মধ্যে চেতনার সঞ্চার করার জন্য তাদের সাথে মেশেন ওঠা-বসা করেন, আবার কখনো সাবল্টার্নদের হয়ে আধিপত্যবাদিদের বিপরীতে নতুন হেজিমনি তৈরির চেষ্টা করেন। সেই কারনেই গ্রামশির বহুল আলোচিত হেজিমনির ধারনা আর সুশীল সমাজের ধারনা হাত ধরাধরি করে চলে। কেননা যেকোন মুহূর্তে একটা সুনির্দিষ্ট হেজিমনি প্রতিষ্ঠার জন্য সম্মতি আদায় করার দরকার পরে রাষ্ট্রের অধপতি গোষ্ঠীর। এখন দেখার বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে এই সম্মতি কিভাবে আদায় হচ্ছে? এখানে সাবল্টার্নের ধারনা এবং জনসমাজের এই অংশটিকে আলাদা করে দেখার কিছু তাৎপর্য রয়েছে।
বাস্তবে তাকালে আমারা দেখতে পাব সুশীল সমাজের বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন ভূমিকাতে রয়েছে। গ্রামশির ভাবনা অনুসরন করে বলা যায় এই সুশীল সমাজ কি ভূমিকা পালন করছে সেটার ওপর আমাদের সমাজের ভবিষ্যত পথ পরিক্রমা এবং পরিনতি নির্ভর করছে বহুলাংশে।
সিভিল সমাজ প্রসঙ্গে “হীরক রাজার দেশে” গল্পের উদয় পন্ডিতের কথা মনে আসে। রাজার শোষন করার হাতিয়ার হচ্ছে বিজ্ঞানী – যে যন্তর মন্তর ঘর আবিষ্কার করে। আর সেটা দিয়ে রাজ্যের সাধারন নাগরিকদের চিন্তা-ভাবনা পালটে দেয় সরকারের মুখপাত্র হিসাবে তার পছন্দ মাফিক হেজিমনি প্রতিষ্ঠার কাজ করে । আর যারা সভাসদ, যারা বিচার বিশ্লেষণ ছাড়াই রাজার কথার প্রতিধ্বনি করতে থাকে – তারা গ্রামশির ভাষায় “জ্যাকবিয়ান বানর” [La Scimmia Giacobina]। সমাজের মধ্যবিত্ত বা বুর্জোয়া শ্রেনীটি যখন নিজেদের সল্প মেয়েদি স্বার্থের বাইরে গিয়ে ভাবতে ব্যর্থ হয় তখন আধিপত্যবাদিদের সাথে আঁতাত করে। এরা তখন কেবল বাহ্যিক অঙ্গভঙ্গী বা বাচন ভঙ্গিতে অধিপতিদের অনুকরন করে থাকে, যা কার্যত হয় অন্তঃসারশুন্য, যার পেছনে নিজস্ব চিন্তাভাবনা বা আদর্শ থাকে না। গ্রামশির ভাষায় এই জ্যাকবিয়ান বানরের কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে পড়তে গিয়ে মনে পড়ল – হিস্ট্রি রিপিটস ইটসেলফ – তেমনটা হয়ত আমাদের এখানে এখনো যেন ইতালির সেই সময়কার বাস্তবতার চাইতেও বেশি প্রসাঙ্গিকঃ
আরেকটু ভাল করে সুশীল সমাজের ধারনাটি বোঝার চেষ্টা করছি। সুযোগ হলে আরো আলোচনার ইচ্ছা আছে।
যেসব রেফারেন্স দেখছিঃ
Buttigieg, Joseph A. (1995) “Gramsci on civil society.” boundary 2, 22(3): 1-32.
Spivak, G. C. (1988). “Can the subaltern speak?” in Nelson, C., & Grossberg, L. (Eds.).
Nelson, C., & Grossberg, L. (Eds.). (1987). Marxism and the Interpretation of Culture. University of Illinois Press.
Foley, M. W., & Edwards, B. (1996). The paradox of civil society. Journal of Democracy, 7(3), 38-52.
আপনার সঙ্গে একমত পোষণ করছি স্যার।
তবে ‘জনসমাজ’-এর প্রতীক হিসেবে কেন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ‘সুশীল সমাজ’-এর সদস্যদেরকেই বোঝানো হয়; সংস্কৃতিকর্মী, বুদ্ধিজীবী, কিংবা শিক্ষাবিদ, অর্থনীতিবিদদের প্রাধান্য দেয়া হয়- তার কিছু কারণও আছে। প্রথমতঃ আমাদের দেশে তৃণমূল পর্যায়ের মানুষরা কে কি ভাবছে, কিভাবে ভাবছে- সেটাকে বিধিবদ্ধ উপায়ে মিডিয়ার সামনে নিয়মতিভাবে উপস্থাপনের কোন পন্থা এখনো মিডিয়াকর্মীগণ বের করতে পারেন নি। একটা সাধারণ ধারণা আমাদের মধ্যে কাজ করছে তা হল, এ দেশের ‘জনসমাজ’-এর একটা বড় অংশ আধাশিক্ষিত এবং অশিক্ষিত। তাদের মতামতের গুরুত্ব কতখানি তা নিয়ে অনেকেই সন্দিহান। এজন্যই খুব বড় কোন বিষয়ে কিংবা রাজনৈতিক ক্রান্তিলগ্নে তাদের বক্তব্য কিংবা মতামত কতখানি দিকনির্দেশনাপূর্ণ হবে সেটি প্রশ্ন সাপেক্ষ। অন্যদিকে, সমাজের বড় কোন অবস্থানে আসীন শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীশ্রেণি, লেখক, অর্থনীতিবিদ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কিংবা সংস্কৃতিকর্মীদের মতামত অনেক বেশি insightful, তথ্যবহুল, এবং সুচিন্তিত হয়ে থাকে। যেমন ধরুন, আপনি এই যে কথাগুলো খুব গুছিয়ে যুক্তিপূর্ণভাবে উপস্থাপন করতে পেরেছেন, একজন পানের দোকানদার কিন্তু সেভাবে উপস্থাপন করার ক্ষমতা রাখে না। আরেকটি মজার ব্যাপার হল, একজন পানের দোকানদার কিংবা সাধারণ পেশাজীবি ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ কিন্তু কখনোই ভালোভাবে বুঝতে পারবে না যে প্রফেসর আলী রিয়াজ কি ভাবছেন, কেন ভাবছেন, এবং কিভাবে ভাবছেন। কিন্তু আপনি আপনার গবেষনাধর্মী মানসিকতা দিয়ে একজন সাধারণ মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্নবিত্ত মানুষের মানসিকতাগুলো আন্দাজ করে নিতে পারবেন, তারা কি দ্বারা প্রভাবিত, কেন প্রভাবিত- এসব কিছু তত্ত্ব দিয়ে বোঝার ক্ষমতা আপনার আছে। এ কারণেই, মিডিয়াকর্মীগন এত কষ্ট করে সমাজের বিশাল জনগোষ্ঠির কাছে যেতে পারে না… মতামতের জন্য তাদের বক্তব্যকে গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরতে পারে না। আবার তাদেরকে টকশোতেও আমন্ত্রণ জানানো সম্ভব না, সম্ভব না তাদের একটি দিকনির্দেশনাপূর্ণ কলাম পত্রিকায় ছাপা! তাই, ‘জনসমাজ’-এর প্রতিনিধিত্ব করার এবং তাদের বক্তব্যকেই সুচিন্তিত এবং যুক্তিপূর্ণভাবে উপস্থাপনের এবং সরকারকে বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ দেবার গুরুদায়িত্বটি নিয়ে থাকেন ‘সচেতন নাগরিক সমাজ।’ তবে হ্যা, এখন সমাজের সর্বস্তরের মানুষের বক্তব্যকে তুলে আনার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। ইতোমধ্যেই, অনেক পত্রিকা এবং চ্যানেলগুলো এ ধরনের উদ্যোগ নিয়ে ফেলেছেন। শুধু ‘সচেতন নাগরিক সমাজ’-ই নয়, পুরো ‘জনসমাজ’-এর দৃষ্টিভঙ্গিই এ দেশের সার্বিক উন্নয়নের পেছনে ভূমিকা রাখবে বলে আমি মনে করি। আপনার চমৎকার লেখাটির জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ স্যার।