
http://www.independent.co.uk/news/world/middle-east/hamas-leader-vows-to-continue-israel-jihad-8395861.html

যারা দুনিয়ার খবরাখবর রাখেন তাঁরা সবাই জানেন ইসরাইলের সঙ্গে হামাসের একটা যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে; গণমাধ্যমে সেই খবরের পাশাপাশি সাংবাদিক ও বিশ্লেষকদের প্রশ্ন হচ্ছে সর্বাত্মক যুদ্ধ আসন্ন কিনা। সহজ ভাষায় বললে, ইসরাইলের সেনাবাহিনী গাজা’য় প্রত্যক্ষ আগ্রাসন চালাবে কিনা সেটা নিয়েই আলোচনা। ফিলিস্তিনি এলাকা গাজার নিয়ন্ত্রণকারী সংগঠন হামাসের সঙ্গে ইসরাইলের সম্পর্ক সাপে নেউলের; ফলে সংঘাত হবে এতে অবাক হবার কিছু নেই। ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে ইসরাইলের যুদ্ধও নতুন কিছু নয়। ১৯৪৮ সাল থেকেই এই যুদ্ধ চলে আসছে। দফায় দফায় লড়াই হয়েছে, এই লড়াই আসলে কোনো দিনই থেমে থাকেনি – অসম এই লড়াইয়ে ইসরাইলের বিজয়ী হওয়া আসলে খবর নয়, দীর্ঘ মেয়াদে বিবেচনা করলে বলতে হয় যে ফিলিস্তিনিরা যে এখনও টিকে আছে সেটাই সম্ভবত বিস্ময়ের। সেটা দীর্ঘমেয়াদের প্রশ্ন, প্রশ্নটা ইতিহাসবিদদের জন্য বললে অত্যুক্তি হবে না। গণমাধ্যমের জন্য সাধারণত প্রশ্ন হল এখন কি হচ্ছে, কি ভাবে এই দফা শুরু হল, এর দায় কার, কত দূর যাবে এই দফার লড়াই। এসব প্রশ্ন নিয়েই এখন গণমাধ্যমের উৎসাহ। কিন্ত সে কাজেও যে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো খুব বেশি সাফল্য দাবি করতে পারে কিনা তা প্রশ্ন সাপেক্ষ।
বুধবার থেকে ইসরাইলের বিমানগুলোর বিরতিহীন হামলার পরিণতি হল গাজা’র নিরপরাধ মানুষদের মৃত্যু। ইতিমধ্যে, এই লেখার সময় পর্যন্ত, কম করে হলেও তিরিশ জন মারা গেছেন, তার মধ্যে রয়েছে বেশ কয়েকটি শিশু। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব শিশুদের নামধাম পর্যন্ত আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে জায়গা পায়না। এ সব গণমাধ্যমের খবরে সব সময়ই একটা ‘বড় চিত্র’ তুলে ধরার অজুহাত খাড়া করা হয় এই সব মানবিক দিক নিয়ে কথা না বলার জন্য। ইসরাইলের অভ্যন্তরে হামাসের রকেট হামলায় নিহতের সংখ্যা তিন জন। কিন্ত তাঁদের মৃত্যুও কোনো অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্য কোনো বিষয় নয়। যে কোনো দেশে যে কোনো শিশুর অপঘাতেই মৃত্যুই আমাদের বিবেককে নাড়া দেয়, আর এ ধরণের মৃত্যু যদি হয় প্রতিদিনের বিষয় তখন আমরা তাঁকে স্বাভাবিক বলে মনে করলেও তার গুরুত্ব কোনো অংশেই কম নয়। গণমাধ্যমের শ্রোতা-দর্শকরা এ নিয়ে কম সংবেদনশীল হন, তাতে নাটকীয় খবরের উপাদান থাকে কম; কিন্ত যে পিতামাতারা তাঁদের সন্তান হারান তাঁদের জন্য এর চেয়ে বড় কোনো ঘটনাই নেই। কে কার সঙ্গে যুদ্ধ গেলো, এই বিজয়ে কার কি লাভ হবে তা আর তাঁদের বিবেচনার বিষয় থাকেনা।
ঢাকায় বিবিসি’র সংবাদদাতা অমিতাভ ভট্টশালির ফেইসবুকের সূত্রে ১৫ নভেম্বর যখন জানতে পারি বিবিসি’র আরবী বিভাগের ফটো এডিটর জেহাদ মাসওয়ারি’র ১১ মাসের শিশু সন্তান আলী বিমান হামলায় প্রাণ হারিয়েছে, প্রাণ হারিয়েছে জেহাদ মাসওয়ারি’র ভ্রাতৃবধূ, তাঁর ভাই লড়ছে মৃত্যুর সাথে তখন কেবল এটাই মনে হল যে জেহাদ এই শোকের ভার বইবেন কি করে। টেলিভিশনের পর্দায় এ রকম শিশুদের মৃত্যুর খবর বড় জোর কয়েক সেকেন্ডের ‘ফটো শুট’। বিবিসি’র সঙ্গে আমার চাকুরিসূত্রে যে যোগাযোগ তা শেষ হয়েছে এক যুগ আগে, ফলে এখন যারা কাজ করেন তাঁদের অনেকেও সঙ্গেই আমার পরিচয় নেই। জেহাদকেও আমি চিনিনা, কিন্ত অমিতাভ ভট্টশালীর খবরে অন্যান্যদের মন্তব্যগুলো দেখে মনে হল যে যেখানেই থাকুক না কেন – পরিচিত হোক অথবা না হোক এ রকম সংবাদ সবাইকেই নাড়া দেয়। তারপরেও যুদ্ধের খবর বলে যা প্রচার হয় তার মধ্যে মানুষের এই যে অবর্ননীয় কষ্ট তার কতটুকু থাকে? যে অপূরনীয় ক্ষতির শিকার হয় সাধারণ মানুষ তার কতটুকু আমরা জানতে পারি?
তারপরেও যুদ্ধের দামামা যখন বাজে তখন এই দামামা যারা বাজান তাঁরা বুঝতে চান না কত নিরপরাধ মানুষকে, কত শিশুকে এই ভাবে প্রাণ দিতে হবে। এখন গাজায় সেই দামামাই বেজে উঠতে শুরু করেছে। মধ্যপ্রাচের অনেক দেশেই চলছে সংঘাত, তার সঙ্গে আরো একটি ভয়াবহ অধ্যায় যুক্ত হতে যাচ্ছে বলে আশংকা অনেকেরই। এই যুদ্ধের ভয়াবহতার মাত্রা কত হবে তা অনুমান করা দুরূহ। আশংকা হচ্ছে যে এই দফায় যুদ্ধ বাধলে তার আগুন হয়তো কেবল ইসরাইলের এক সীমান্তে সীমিত থাকবেনা। এই যুদ্ধে লেবাননও জড়িয়ে পড়তে পারে বলেই অনেকের আশংকা। কেননা কোনো কোনো বিশ্লেষক মনে করেন যে হামাস যে গত কয়েক মাস ধরে ইসরাইলের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে, তাঁদের রকেট হামলার পরিমাণ বাড়িয়েছে তার কারণ হল তাঁরা চাইছে এই দফায় যুদ্ধকে সম্প্রসারিত করতে। আরব বসন্তের কারণে এই অঞ্চলে ইসরাইলের প্রতি অতীতে সহানুভূতিশীল রাষ্ট্র মিসরের অবস্থান যে হামাসের অনুকূলে হামাসের নেতৃবৃন্দ সেটা ভালো করেই জানেন। মিসরের প্রধানমন্ত্রী গাজায় উপস্থিত হয়ে যে মন্তব্য করেছেন তাতেও এই ধারণার পক্ষে যুক্তি মেলে। সিরিয়া পরিস্থিতির কারণে ইসরাইলকে গোলান উপত্যকায় কড়া নজর রাখতে হচ্ছে বলে হামাস মনেই করতে পারে এটাই চাপ সৃষ্টির জন্য ভালো সময়।
কিন্ত হামাস চাইছে বলেই কি ইসরাইল এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ছে? এই যুদ্ধের সূচনার জন্য কি তা হলে হামাসকেই দায়ি করতে হবে তা হলে? মোটেই তা মনে করার কারণ নেই। গাজায় হামাসের সামরিক নেতা আহমেদ জাবারিকে হত্যার পর এইবারের এই ঘটনা প্রবাহের সূচনা। যুদ্ধ বিরতির জন্য যখন দুপক্ষ আলোচনা করছিলো তখন ইসরাইলের এই অভিযানের কারণ কি অন্যত্র ? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছেন অনেকে।
এই যুদ্ধের জন্য ইসরাইলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি যে কারণ হিসেবে কাজ করছে সেটা যারা ইসরাইলি রাজনীতির ইতিহাসের সঙ্গে পরিচিত তাঁরা বুঝতে পারবেন। ১৯৮১ সালের জুন মাসে দেশের আসন্ন নির্বাচনে পরাজয় যখন প্রায় নিশ্চিত তখন দেশের প্রধানমন্ত্রী মেনাচেম বেগিন সিদ্ধান্ত নিলেন ইরাকের পরমাণু স্থাপনায় হামলা চালানোর। পরমাণু স্থাপনা যেমন ধ্বংস হল তেমনি পরের নির্বাচনে বিজয়ী হলেন বেগিন। ১৫ বছরের পরের ঘটনা, ১৯৯৬ সালে নির্বাচনের ঠিক দু’মাস আগে অন্তর্বতী প্রধানমন্ত্রি সিমোন পেরেস লেবাননে হেজবল্লাহ’র বিরুদ্ধে বিমান অভিযানের নির্দেশ দিলেন। ব্যাপক এই বিমান হামলায় হেজবল্লাহ’র ক্ষতি হলেও জাতিসংঘের একটি অফিসে হামলার জন্য ইসরাইলকে মুখোমুখি হতে হয় আন্তর্জাতিক সমালোচনার। অভ্যন্তরীণভাবে পেরেসের জন্য তা ইতিবাচক হয় নি মোটেই। পেরেস সেই নির্বাচনে বিজয়ী হন নি। সর্বশেষ যেবার হামাসের সঙ্গে ইসরাইলের সংঘাত হয় সেটা চার বছর আগে। তখন প্রধানমন্ত্রী এহুদ ওলমার্ট হামাসের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেন কেননা তার প্রতিদ্বন্দ্বী বিনইয়ামিন নেতানিয়াহু জনমত জরিপে এগিয়ে ছিলেন। আশা ছিলো যে তাতে করে আসন্ন নির্বাচনে তার দলের পক্ষেই ভোটাররা রায় দেবেন কেননা জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে তাঁদের যে দুর্বলতার অভিযোগ তাঁরা মেটাতে পারবেন। কিন্ত ফলাফল তার পক্ষে যায় নি; ভোটাররা বেছে নিয়েছিলো তুলনামূলকভাবে কট্টরপন্থী দলকেই। আসন্ন নির্বাচনে কোনো বড় ধরণের প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হবেন না নেতানিয়াহুর এটা প্রায় নিশ্চিত; তারপরেও তিনি সম্ভবত কোনো ধরণের ঝুঁকি নিতে চান নি। নির্বাচনের সঙ্গে ইসরাইলি সামরিক অভিযানের যোগাযোগ হয়তো দেশের নেতারা মাইন্তে চাইবেন না। কিন্ত লক্ষণ দেখে অন্য কোনো রকম উপসংহারে পৌছুবার সুযোগ খুবই কম।
অন্য আরেকটি আশংকার কথাও কোনো বিশ্লেষক বলছেন যেটা চলমান যুদ্ধের চেয়েও ভয়াবহ। তাঁদের ধারণা যে এই যুদ্ধ হচ্ছে ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের পূর্ব প্রস্ততি। হামাসের সাথে ইরানের যোগাযোগের অজুহাতে ইসরাইল ইরানকে যুদ্ধে জড়িয়ে ফেলতে পারে। এই আশংকার পক্ষে এখনও জোরদার প্রমাণ মেলেনি বটে, তবে কিছুদিন আগে পর্যন্ত ইসরাইল যেভাবে কথাবার্তা বলছিল তাতে মনে হচ্ছিলো সে ইরানের সঙ্গে একটা যুদ্ধ বাধাতে চায়। যুক্তরাষ্ট্রকে সেই যুদ্ধে টেনে নিতে পারার কারণেই ইসরাইল এই পথ নিয়েছে বলে যারা মনে করেন তাঁদের সঙ্গে আমি এখনও একমত নই, কিন্ত তাই বলে এই বক্তব্যকে একেবারে নাকচ করে দেয়ার আগে ভেবে দরকার।
কারণ যাই হোক না কেন, আমার আশংকা ইসরাইল এবং হামাস দু’পক্ষ আগুন নিয়ে খেলতে শুরু করেছে। মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান পরিস্থিতিতে কোনো যুদ্ধের শুরু হলে তার নিয়ন্ত্রণ যারা যুদ্ধ শুরু করবেন তাঁদের হাতেই থাকবে এমন নাও হতে পারে। সেটাই এখন একটা বড় আশংকার বিষয়।
ইলিনয়; ১৬ নভেম্বর ২০১২