কী পেল আওয়ামী লীগ?
পাঁচ পর্বে দেশের উপজেলা পরিষদের নির্বাচনের পরিসমাপ্তি হয়েছে। সাকল্যে ৪০ দিনের ব্যবধানে সম্পন্ন এই নির্বাচনের প্রায় পুরো ফলই এখন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদের ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে কোনো কোনো গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এই নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছে। অঙ্কের হিসাবে এই শিরোনাম নির্ভুল। কিন্তু আওয়ামী লীগের এই বিজয় কীভাবে অর্জিত হলো এবং এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে লাভের চেয়ে ক্ষতির পাল্লাই ভারী হলো কি না, সেটা বিবেচনার দাবি রাখে। উপরন্তু বিএনপির ওপর এর কী প্রভাব পড়তে পারে, সেটাও দেখার বিষয়। নির্বাচন কমিশনের ভবিষ্যতের জন্যই বা এই নির্বাচন কতটা ইতিবাচক হবে?
কাগজে-কলমে উপজেলা নির্বাচন দলভিত্তিক নয়, কিন্তু আমরা এও জানি যে বাস্তবে এই নির্বাচনের প্রার্থীরা দল-সমর্থিত হন, প্রচার কার্যত হয় দলভিত্তিক এবং এই বিষয়ে দলগুলো কোনো রকম রাখঢাক করে না। সাধারণভাবে বিবেচনা করলে উপজেলা নির্বাচন নিয়ে উৎসাহের কারণ নেই। কেননা প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই উপজেলা পরিষদের ক্ষমতা সীমিত, তদুপরি দফায় দফায় এর কাঠামো ও ক্ষমতা সংশোধনের পর পরিষদগুলো নামেমাত্র স্থানীয় সরকারের বিষয়, কার্যত তা স্থানীয় সংসদ সদস্যের নিয়ন্ত্রণাধীন। তদুপরি রয়েছে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কর্তৃত্বের প্রশ্ন। মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানের পদ সৃষ্টি যতটা ইতিবাচক, ঠিক ততটাই নেতিবাচক যে তাঁদের কার্যপরিধি এবং ক্ষমতার প্রশ্নটি অমীমাংসিত রাখা।
সেনাশাসনের আমলে জেনারেল এরশাদের হাতে উপজেলা ব্যবস্থার উৎপত্তি। উদ্দেশ্য হিসেবে প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণের কথা বলা হলেও অনেকেই এর মধ্যে সেনাশাসকের ক্ষমতা সংহত করার অসদুদ্দেশ্য দেখতে পেয়েছিলেন। উপজেলা ব্যবস্থার মধ্যে পাকিস্তান আমলে জেনারেল আইয়ুব খানের তৈরি করা বনিয়াদি গণতন্ত্রের ছায়া দেখতে পাওয়ার জন্য খুব কষ্ট করতে হয়নি। তাই সে সময় অনেকেই একে ‘উপজ্বালা’ বলেও বর্ণনা করেছিলেন। সামরিক শাসনের বিরোধীরা এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন এবং আন্দোলনের সময় এর বিলোপের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ১৯৯১ সালে ক্ষমতায় এসে খালেদা জিয়া তা অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়ন করেন। কিন্তু একটি নির্বাচিত প্রশাসনিক কাঠামো, ইতিমধ্যে যার দুই দফা নির্বাচন হয়েছে এবং যেখানে দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে পরিবর্তনের হাওয়া বইতে শুরু করেছে, সেখানে এই কাঠামোর একটা উপযোগিতা তৈরি হয়ে গিয়েছিল। এই ব্যবস্থার বিলোপের সময় তা যে ভাবা হয়নি, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো, এর কোনো বিকল্প কাঠামো বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেনি। পালাক্রমে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ক্ষমতায় এলেও প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণের কোনো উদ্যোগই নেওয়া হয়নি। ক্ষমতার এককেন্দ্রীকরণের ব্যাপারে যাঁদের আগ্রহ বেশি, তাঁদের হাতে উপজেলাই বলি, কি অন্য স্থানীয় প্রতিষ্ঠানই বলি, তার বিকাশ সম্ভব নয়।
ফলে শেষ পর্যন্ত অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাত ধরেই উপজেলার প্রত্যাবর্তন ঘটে ২০০৮ সালে। সে সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আগ্রহ ছিল জাতীয় নির্বাচনের আগেই উপজেলা পরিষদের নির্বাচন। যে আশঙ্কায় প্রতিষ্ঠালগ্নে রাজনীতিবিদেরা এই ব্যবস্থার বিরোধিতা করেছিলেন, একই যুক্তিতে জাতীয় নির্বাচনের আগে উপজেলার নির্বাচনে তাঁদের সায় ছিল না। এই টানাপোড়েনে শেষাবধি রাজনীতিবিদেরা জয়ী হয়েছিলেন। ২০০৯ সালের গোড়াতে, জাতীয় নির্বাচনের অব্যবহিত পরই, তৃতীয় উপজেলা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। জাতীয় নির্বাচনে আশাতীত ভোটারের উপস্থিতি ঘটলেও উপজেলা নির্বাচনে ভোটারদের উৎসাহ ছিল খুবই কম। সেই নির্বাচনে সদ্য ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগের সমর্থিত প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছিলেন। সহিংসতা হয়েছিল লক্ষণীয়ভাবে কম এবং নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের জন্য নির্বাচন কমিশন প্রশংসিতও হয়েছিল।
এই ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দেওয়ার কারণ দুটো: প্রথমত, যদিও উপজেলা পরিষদের হাতে ক্ষমতা সীমিত এবং স্থানীয় উন্নয়নের ক্ষেত্রে তাদের করণীয় কম, আওয়ামী লীগ সরকারের হাতে এই ক্ষমতার আরও সংকোচন ঘটেছে, তবু একার্থে এই পরিষদই হয়ে উঠেছিল সাধারণ মানুষের কাছে স্থানীয় প্রশাসনের অংশগ্রহণের একধরনের প্রতীক। যেকোনো অংশগ্রহণমূলক প্রতিষ্ঠানের যে একটা প্রতীকী মূল্য আছে, তা অনস্বীকার্য। দ্বিতীয়ত, ১৯৯০ ও ২০০৯ সালের নির্বাচনে মানুষের ভোটদানের বিবেচনায় জাতীয় রাজনীতি ছিল গৌণ। কেন্দ্রীয়ভাবে প্রার্থী বাছাই করে দেওয়ার যে পদ্ধতি সংসদ নির্বাচনে ব্যবহূত হয়, তা থেকে উপজেলা নির্বাচন সম্পূর্ণ না হলেও মোটা দাগে মুক্ত ছিল। সেদিক থেকে রাজনীতিবিদেরা না চাইলেও উপজেলা পরিষদ তৃণমূল পর্যায়ে স্বায়ত্তশাসিত একটা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার সামান্য সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছিল।
কিন্তু ২০১৪ সালের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল এবং বিরোধীরা উপজেলা নির্বাচনকে যেভাবে জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ফেলল, তাতে করে ভবিষ্যতে এই ব্যবস্থার সম্ভাবনার মূলে কুঠারাঘাতই করা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে স্থানীয় নির্বাচনকে এতটা জড়িয়ে ফেলার কারণে এই নির্বাচন কার্যত দুই দলের, বিশেষত ক্ষমতাসীনদের, জন্য মর্যাদার লড়াইয়ে পরিণত হয়। প্রথম দুই দফা নির্বাচনে ভালো ফল না করার পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কর্মীদের কাছে তৃতীয় দফা থেকেই যেনতেন প্রকারে নির্বাচনের চেষ্টাই মুখ্য হয়ে ওঠে। কীভাবে বিজয় হলো, তার চেয়ে সংখ্যা এবং ফলাফল মুখ্য হয়ে ওঠে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী, নির্বাচনের ধারা ও প্রকৃতিতে বদল ঘটে। এই প্রক্রিয়ায় শেষ বা পঞ্চম দফায় এসে ভোট দেওয়ার দায়িত্ব থেকে ভোটারদের নিষ্কৃতি দিতে দ্বিধান্বিত হননি সরকারি দলের কর্মীরা। এতে করে বিজয় নিশ্চিত হয়েছে। কিন্তু নির্বাচনী প্রক্রিয়ার ওপর শেষ আস্থাও তিরোহিত হয়েছে। ৫ জানুয়ারির জাতীয় সংসদের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচনের ভরসা রাখার জায়গা ছিল না, কিন্তু বাংলাদেশের নাগরিকেরা সম্ভবত আশা করেছিলেন যে ৫ জানুয়ারি ব্যতিক্রম হবে, যেমনটি ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচন হয়েছিল।
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে কেবল নির্বাচনই গণতন্ত্র নয়। কিন্তু এরশাদবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যা অর্জিত হয়েছিল, তার মধ্যে টিকে ছিল নির্বাচন। বাংলাদেশের ইতিহাসে সেনাশাসনের আওতায় যেসব নির্বাচন হয়েছে সেগুলো যে সাজানো খেলার চেয়ে বেশি কিছু নয়, সে বিষয়ে সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে কোনো সংশয় ছিল না। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনও ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। কিন্তু ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ কার্যকর ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হলেও, অন্যান্য গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গড়ে না উঠলেও এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতি গণতন্ত্রের অনুকূল না হলেও অন্তত প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচনের প্রতি একটি আস্থা তৈরি হয়েছিল। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সেই আস্থায় বড় ধরনের ফাটলের তৈরি হয়েছে। এখন উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে, বিশেষত শেষ দুই দফার নির্বাচনের মধ্য দিয়ে, দেশ আবার নব্বই-পূর্ববর্তী অবস্থায় গিয়েই দাঁড়াল বলে মনে হয়।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপির তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিকে নাকচ করে দিতে প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ বারবার বলেছে যে ২০০৮ সালের পর তাঁদের শাসনে সব ধরনের স্থানীয় নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে। স্থানীয় নির্বাচন এবং জাতীয় নির্বাচনকে এক কাতারে বিবেচনা করা যাবে কি না, সেটা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও, এটা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সত্য ছিল যে ২০০৮ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত স্থানীয় নির্বাচনে সরকারি দলের তাণ্ডব দেখতে পাইনি, পূর্বনির্ধারিত ফলাফল ঘোষণার চেষ্টাও পরিলক্ষিত হয়নি। সরকারের এই দাবিকে ১৫ থেকে ৩১ মার্চের এই ১৬ দিনে ধূলিসাৎ করে দিয়ে ক্ষমতাহীন স্থানীয় পর্যায়ের একটি পরিষদের এই বিরাট বিজয় দিয়ে ক্ষমতাসীন দল কীভাবে লাভবান হবে, সেটা আমার কাছে বোধগম্য হয় না।
বিএনপি ও ইসির ওপর প্রভাব
১৯ ফেব্রুয়ারি উপজেলা নির্বাচনের প্রথম দফা শেষে প্রাপ্ত ফলাফল জানার পর থেকেই বিভিন্ন রকমের আলোচনা, বিশ্লেষণ আমরা দেখতে পেয়েছি। প্রথম দফার ফলাফলে বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থীদের তুলনামূলকভাবে বেশি চেয়ারম্যান পদে জেতার পর কেউ কেউ বিস্ময় প্রকাশ করেছেন যে গত বছরের শেষের দিকটাতে নির্বাচনের আগে বিএনপি সহিংসতার সঙ্গে জড়িত ছিল বলে জানার পরেও সাধারণ ভোটাররা কেন বিএনপির প্রার্থীদের বিজয়ী করছেন। জামায়াতের বিরুদ্ধে অভিযোগ এবং প্রচার সত্ত্বেও দলের প্রার্থীদের ফলাফল এই বিস্ময়ে আরেক মাত্রা যুক্ত করেছে। অন্যদিকে কেউ কেউ বলেছেন যে এটাই তাঁরা অনুমান করছিলেন। কেননা, গত বছরের বিভিন্ন জনমত জরিপে বিএনপি এগিয়ে ছিল। সরকার-সমর্থকদের মধ্যে সাময়িক হতাশাও লক্ষ করা গিয়েছিল। কিন্তু একটা স্বস্তি তৈরি হয়েছিল যে জাতীয় নির্বাচনের আগে সহিংসতা দেখা গেলেও এ ক্ষেত্রে তা ঘটেনি। নির্বাচন কমিশনের ব্যাপারে খানিকটা ইতিবাচক মনোভাবের ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু প্রথম দফা শান্তিপূর্ণ এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের পর তৃতীয় দফা নাগাদ সহিংসতা বৃদ্ধি পায়। পর্যায়ক্রমে বিএনপির প্রার্থীরা পিছিয়ে পড়েন এবং শেষ পর্যন্ত ক্ষমতাসীনরা বেশিসংখ্যক চেয়ারম্যান পদে বিজয়ী হয়েছেন।
কিন্তু ফলাফলের চেয়েও নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে আমরা যেটা দেখতে পেলাম তা হলো, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশন যে সংকটের মধ্যে নিপতিত হয়েছে, তাকে আরও বেশি সংকটের মধ্যে ঠেলে দেওয়া হলো। এ বিষয়ে আমরা গতকাল আলোচনা করেছি। আজ আমরা দেখব বিএনপির ওপর এই ফলাফলের, বিশেষত শেষ তিন দফায় সংঘটিত অনিয়মের কী ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে। এসব অনিয়মের ফলে কেবল যে নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে প্রশ্ন উঠছে তা নয়, পাশাপাশি নির্বাচন কমিশনও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ল।
বিএনপি গোড়াতে ভালো ফল করলেও শেষ পর্যন্ত মোট হিসাবে আওয়ামী লীগের চেয়ে পিছিয়েই থেকেছে। অনেকে বলতে পারেন যে এই ফলাফল স্বাভাবিক, কেননা বিরোধী দলের যতটা জনপ্রিয়তা আছে, তাতে তারা যতটা বিজয়ী হতে পারত, তা-ই তারা পেয়েছে এবং তা এসেছে প্রথম দুই দফায়। বিরোধী দল বিজয়ী হলো কি না, সুষ্ঠু নির্বাচনে তারা এর চেয়েও খারাপ করত কি না, আমার কাছে তা ধর্তব্যের বিষয় নয়। ২০০৯ সালের উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থীদের ফলাফল এর চেয়ে ভালো ছিল। তাঁরা যদি আবার ভালো করতেন তাতে অবাক হওয়ার কারণ ছিল না।
কিন্তু এবারের নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদের ফলাফলের যেসব পরিসংখ্যান আমরা দেখতে পাই, তাতে নিঃসন্দেহে মনে প্রশ্ন জাগে। প্রথম দফা নির্বাচনে প্রাপ্ত হিসাবে বিএনপি পেয়েছে ৪৩ শতাংশ পদ, দ্বিতীয় দফায় পেয়েছে ৪৪ শতাংশ; তৃতীয় দফায় পেয়েছে ৩৪ শতাংশ; চতুর্থ দফায় পেয়েছে ২৭ শতাংশ এবং শেষ দফায় পেয়েছে ১৬ শতাংশ চেয়ারম্যান পদ। যেকোনো দলই কয়েক দিনের নির্বাচনে কখনো খারাপ কখনো ভালো ফল করতেই পারে, কিন্তু নির্বাচনে সহিংসতা বৃদ্ধি, নির্বাচন কমিশনের নজরদারি হ্রাসের পাশাপাশি ক্ষমতাসীন দলের প্রাপ্ত পদের হার ৩৫ শতাংশ থেকে প্রায় ৭০ শতাংশ অর্থাৎ দ্বিগুণে পরিণত হওয়ার ঘটনা যেকোনো অবস্থায়ই প্রশ্নের জন্ম দেয়। এই রকম ফল যদি বিএনপির অনুকূলে যেত, তবে তাও প্রশ্নের ঊর্ধ্বে থাকত না।
এই নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে পরিকল্পনা করে এমন ঘটনা ঘটানো হয়েছে বলে বলার অভিপ্রায় আমার নেই। কিন্তু ৫ জানুয়ারির নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-নেত্রীরা যে বার্তা দিয়েছেন, সামান্য দেরিতে হলেও স্থানীয় কর্মীরা তা বুঝতে পেরেছেন। আর তা হলো কীভাবে জয় অর্জিত হলো সেটা বিবেচ্য বিষয় নয়, বিজয় নিশ্চিত করাটাই মুখ্য কাজ। শেষ দুই পর্বে আমরা তারই ফল প্রত্যক্ষ করেছি।
বিএনপি সংসদ নির্বাচন বর্জন করার পর, বিশেষত ৫ জানুয়ারির পর, অনেকেই বিএনপির সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছেন এই বলে যে বিএনপির নেতারা ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাঁদের একটা বড় যুক্তি ছিল যে এই রকম সময়ে বড় ধরনের কারচুপি করার ঘটনা ঘটতে পারত না। বিএনপির মধ্যেও অনেকেই এ রকম মনে করতে শুরু করেন। বিএনপি একটা চাপের মুখেই পড়েছিল। খানিকটা সেই চাপের কারণেও বিএনপিকে উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিতে হয়। প্রথম দুই দফায় ভালো ফলাফলের পরিপ্রেক্ষিতে যাঁরা বিএনপিকে ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত করেছিলেন, তাঁরা খানিকটা প্রভাবশালী হয়ে ওঠার পথে এগোচ্ছিলেন। আরেকটি বিষয় ছিল বিএনপি-জামায়াত সখ্য। বিএনপি যে জামায়াতের সঙ্গে একত্রে নির্বাচন না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, সেটা যে অংশত হলেও দলের বাইরের এবং ভেতরের চাপের কারণেই, তা সহজেই অনুমান করা যায়। কিন্তু এখন নির্বাচনের সময়কার ঘটনাপ্রবাহ এসব যুক্তিকে দুর্বল করে দিলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
কিন্তু এখানে এসে অনেকে বলবেন যে তাহলে কি বিএনপিকে সব সময় জিততেই হবে? না জিতলেই কি আমরা ধরে নেব যে বিএনপির নেতারা সংসদ নির্বাচনের ব্যাপারে ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন? তাহলে কি ভোটাররা না চাইলেও বিএনপিকে জিতিয়ে দিতে হবে? এসব প্রশ্নের উত্তর একটাই, অবশ্যই নয়। বিএনপি এখন যে ফলাফল করেছে তার চেয়ে খারাপ করলেও বিএনপির যুক্তি খণ্ডন করা যেত যদি নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে হতো। বরং সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনে বিরোধীরা জয়ী হলে যেমন ক্ষমতাসীনদের লাভ হতো, তেমনি সুষ্ঠু নির্বাচনে বিরোধীরা পরাজিত হলে লাভ হতো দুই গুণ। কিন্তু সবচেয়ে বড় বিষয় প্রমাণিত হতো যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে অনড় থাকার ব্যাপারে বিএনপির যুক্তি দুর্বল। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের ঘটনা দেখিয়েছিল ক্ষমতাসীনদের তত্ত্বাবধানে নির্বাচনের বিপদটা কোথায়, সেই জায়গাটাকে একেবারে পাকাপোক্ত করে দিল শেষ তিন পর্বের নির্বাচন। নির্বাচনে সে কারণেই বিরোধীদের চেয়ে সরকারের ক্ষতি বেশি হলো বলেই মনে হয়।
এই সবকিছুর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নির্বাচন কমিশনের কার্যকলাপ। যতটা ক্ষমতা আছে তার প্রয়োগই তো হয়নি, অসার আস্ফাালন ছাড়া আর কিছুই কি দেখতে পাওয়া গেছে? উপরন্তু তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য। দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ আবদুল মোবারক বিএনপিকে সমালোচনা করার ক্ষেত্রে যে ভাষা ব্যবহার করেছেন, তাকে সরকারি দলের কথারই প্রতিধ্বনি বললে তা ভুল হবে না। সংসদ নির্বাচনের আগে অনেক বিশ্লেষক এমন মন্তব্য করেছিলেন যে আওয়ামী লীগ চায়নি বিএনপি নির্বাচনে আসুক। এবার মনে হচ্ছে নির্বাচন কমিশন এখন সেই ভূমিকা নিতে চলেছে। সেটা দুঃখজনক, কেননা প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশনের ওপর দেশের মানুষের আস্থা ছিল না অনেক দিন। ধীরে ধীরে তা তৈরি হচ্ছিল। বিশেষ করে গত কমিশন খানিকটা সময় হলেও রাজনৈতিক দলের শাসনামলে দায়িত্ব পালন করেছিল এবং সাধারণ মানুষের মনে এ রকম একটা ধারণা তৈরি হতে শুরু করেছিল যে দলীয় সরকার ক্ষমতায় থাকলেও ধীরে ধীরে একটা জোরদার নির্বাচন কমিশন হয়তো তৈরি করা যাবে। কিন্তু এই কমিশনের কার্যকলাপের কারণে সেই আস্থার জায়গাটা এখন আর প্রায় নেই। সম্ভবত এই মন্তব্যের পর সে আশাবাদের কফিনে পেরেক ঠুকে দেওয়া হলো।
এত কিছুর পর প্রশ্ন থাকে, তাহলে উপজেলা নির্বাচন থেকে ক্ষমতাসীনরা কী শিখবেন আর বিএনপিই বা ভবিষ্যতে কী করবে? আশা করি যে সরকারি দল দেরিতে হলেও বুঝতে পারবে নির্বাচন এবং নির্বাচন কমিশনের এই ভূমিকা দেশে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান তৈরির পথ নয়। যতটা ক্ষতি হয়েছে তা স্বীকার করে নিয়েই তা বদলাতে হবে। অন্য পক্ষে বিএনপির জন্য একটা বড় বিষয় হলো, সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হওয়া সত্ত্বেও সাধারণ মানুষের মধ্যে তার প্রতি সমর্থন আছে, সে জন্য জামায়াতের ওপর নির্ভর করার দরকার নেই। বাংলাদেশের সাধারণ নাগরিকদের ওপর ভরসা করেই বিএনপিকে দলের ভবিষ্যৎ রাজনীতির পদক্ষেপ ভাবতে হবে।
[ইতিপূর্বে প্রথম আলোয় দুই পর্বে প্রকাশিত]