ডিসেম্বর 30, 2025
maxresdefault

This post has already been read 32 times!

‘গ্যাস্ট্র’ কথাটার অর্থ উদর আর ‘গ্রাস’ কথাটার অর্থ উদরস্থ করা- এই দুটি কথার ইন্দো-ইউরোয়োপিয় শেকড় একই। আবার বাংলা ইংরেজির ‘ইক’ প্রত্যয়ের ইন্দো-ইউরোয়োপিয় শেকড়ও এক এবং দুই ভাষাতেই তা বিশেষণ তৈরিতে ভূমিকা রাখে।যেমন গ্যাস্ট্রিক গ্যাস্ট্র+ইক মানে অন্ত্র+ইক। তবে কথার প্রয়োগ এবং অর্থ কথার প্রকৌশলকে বরাবরই পেরিয়ে যায়। যেমন, বাঙালি গ্যাস্ট্রিক আছে বলতে বোঝায় গ্যাস্ট্রিক পেইন কিংবা আলসার আছে। অর্থাৎ এখানে আন্ত্রিক বলতেই আন্ত্রিক পীড়া বোঝানো হয়। তেমনি, সাম্প্রদায়িক বলতে একই সঙ্গে নিজ সম্প্রদায়-প্রেমী এবং অন্য সম্প্রদায়-বিদ্বেষী ব্যক্তি, ব্যক্তি বর্গ বা বিষয়কে বোঝানো হয়, যদিও সাম্প্রদায়িকের ‘সম্প্রদায়গত’ অর্থটিও বর্তমান, যেমন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। অথচ সামাজিক কথাটির ক্ষেত্রে ফল ভিন্ন। তাই প্রশ্ন, কী আছে এই সম্প্রদায়ে?
সমাজ এবং সম্প্রদায় অনেক সময় প্রতিস্থাপনযোগ্য পদ হিসেবে ব্যবহার হয়, যেমন হিন্দু সম্প্রদায়, হিন্দু সমাজ আবার মুসলমান সম্প্রদায় মুসলমান সমাজ ইত্যাদি। কিন্তু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, সমাজ এবং সম্প্রদায়ের আভ্যন্তরীণ গঠন এক নয়। সমাজ সম অজ এখানে ব্যক্তি-স্বত্বসমূহের সাম্যের ভিত্তিতে তাত্ত্বিকভাবে হলেও সহ-বাসের ব্যাপার আছে, কিন্তু সম্প্রদায়ের একজন তার ব্যক্তি-স্বত্ব তুলে দেন বা সম্প্রদান করেন সম্প্রদায়ের কাছে। অন্য কথায়, সমাজ ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি স্বত্ব হরণ করে নিজেই ব্যক্তি বা একক সত্তা হয়ে ওঠে না, ফলে সামাজিক সমস্যা বলতে বোঝায় সমাজের ভেতরের সমস্যা। অন্যদিকে সম্প্রদায় ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি স্বত্ব হরণ করে নিজেই ব্যক্তি বা একক হয়ে ওঠে, তাই সাম্প্রদায়িক সমস্যার বললে দুটি সম্প্রদায়ের মধ্যকার সমস্যায় বোঝায়, সম্প্রদায়ের ভেতরের কিছু বোঝায় না।
আবার যেমন, যে লোকটা সামাজিক সে ভালো আর যে সাম্প্রদায়িক সে খারাপ। এক্ষেত্রে অর্থ উৎপাদনে সমাজ এবং সম্প্রদায়ের সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্ক বিশেষ ভূমিকা রাখে। ব্যক্তি মানুষ মূলত মানুষ। ব্যক্তি-স্বত্ব নিছক স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বই নয়, সেই সঙ্গে এটা মানুষত্ব এবং মনুষত্বের মালিকানাও। তো এই মানুষত্ব-মনুষত্ব-ব্যক্তিত্বের অধিকার কোনো একটি পরিচয়ের কাছে সম্প্রদান করা বা সমর্পণ করা ভীতিপ্রদ। ভয় এই কারণে যে, মানুষটাকে তখন সেই পরিচয় পরিচালিত করে, যেন মানুষটা একটা রোবট আর পরিচয়টা একটা প্রোগ্রাম। এই পরিচয় যে পরিচয়ই হোক, হোক ধর্ম কিংবা জাতি। ব্যক্তির স্বত্ব ধর্মের কাছে সম্প্রদান করলে যেমন ধর্ম একটি সম্প্রদায়ে পর্যবসিত হয় তেমনি জাতির কাছে সম্প্রদান করলে সে জাতিও একটি সম্প্রদায়ে পর্যবসিত হয়।
জাতীয়তাবাদের একটি পরিনতি হচ্ছে জাতিগত সম্প্রদায়, অর্থাৎ একটি সম্প্রদায়। সে বিবেচনায়, যে জাতীয়তাবাদ একটি জাতিকে একটি সম্প্রদায়ে পর্যবসিত করে তাকে বলব সাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদ। আমার সন্দেহ, বাঙালি জাতীয়তাবাদের একটি প্রখ্যাত ধারা আজ সেই খাতে প্রবাহিত হচ্ছে। এই জাতীয়তাবাদের ছায়াতলে দেশপ্রেম অপর দেশকে হিংসার নামান্তরই নয় কেবল বরং সম্প্রদায়ে পর্যবসিত জাতির কাছে ব্যক্তি স্বত্ব সম্প্রদান করে রাখার চাপও বটে। এভাবে চলতে থাকলে, ব্যক্তির নিজস্ব আর কোন কণ্ঠস্বর থাকবে না, পতাকা, শপথ, জাতীয় সঙ্গীত, সংসদ, সংবিধান ইত্যাদি ধর্মীয় পবিত্র অনুষঙ্গগুলোকে প্রতিস্থাপিত করে নিজেই ধর্মের অনুষঙ্গ হয়ে বসবে। নাগরিককে তা নীরবে নিয়তি জ্ঞানে মেনে নিতে হবে একদা ধর্মকে যেমন নিয়েছিল।
মানুষ পরিচয় চায় পরিজন চায়, ফলে ধর্মের কাছে যায় জাতির কাছে যায়। কিন্তু ধর্ম কিংবা জাতি সেই মানুষের ব্যক্তি-স্বত্ব যাতে না খায় বা না গ্রাস করে সেদিকে সদা সতর্ক থাকা দরকার। তা না হলে, ধর্ম বা জাতির নামে সম্প্রদায়ের গ্রাস্ট্রে গেলে বা উদরস্থ হলে, ব্যক্তির মাথায় গ্যাস্ট্রিক হয়, তার চিন্তাভাবনা সাম্প্রদায়িক হয়। ধর্মগত সাম্প্রদায়িক চিন্তাভাবনা যেমন ধর্মের জন্য বিধ্বংসী তেমনি জাতিগত সাম্প্রদায়িক চিন্তাভাবনা জাতির জন্য বিধ্বংসী। আবার ধর্মের সাম্প্রদায়িকতা এবং জাতির সাম্প্রদায়িকতা যেখানে পরস্পরকে ছেদ করে সেখানে ব্যক্তির চিন্তাশক্তি সম্প্রদান করা মানে আত্মহনন। এসকল আত্মঘাতী পথে পিছলে না পড়ার জন্য একটা মন্ত্র মনে রাখা দরকার, চিন্তাশক্তি সম্প্রদানের বিষয় নয়, ব্যক্তির চিন্তাশক্তি ও চিন্তার অধিকার ব্যক্তির কাছে রাখতে হয়।

This post has already been read 32 times!

মন্তব্য করুন