এরপর কী হবে?
প্রতিটি দিন যখন আগের দিনের চেয়ে উদ্বেগজনক হয়ে ওঠে, অনিশ্চয়তা যখন গতকালের চেয়েও গভীর হয়, আশঙ্কা যখন সম্ভাবনাকে পরাজিত করে তখন মানুষের মনে এই প্রশ্নই বড় হয়ে ওঠে – এরপর কী হবে? বাংলাদেশের এখনকার অবস্থা এর থেকে ভিন্ন কিছু নয়, কোনো বিবেচনায়ই ব্যতিক্রম নয়। সরকার, সরকারী দল এবং সরকার সমর্থকরা যতটা উচ্চস্বরেই বলুন না কেন যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক, দেশের গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ এবং একেবারে সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বললেই বোঝা যায় যে একে স্বাভাবিক মনে করার মতো কারণ নেই। প্রতিদিন যে মানুষগুলোর প্রাণহানি ঘটছে তাঁদের পরিবার পরিজনকে জিজ্ঞেস করলে নিশ্চয় তাঁরা বিরাজমান অবস্থাকে স্বাভাবিক বলে বর্ণনা করবেন না। সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ধরে যে জননী আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছেন, পিকেটারের হামলায় যে মানুষটি মারা গেছেন কিংবা যারা নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে নিহত হয়েছেন তাঁদের পরিবার নিশ্চয় এই অবস্থাকে সরকারের ভাষ্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ মনে করবেন না। নিরাপত্তা বাহিনীর পাহারায় আন্তঃজেলা যানবাহণ চলাচলের ছবি স্বাভাবিকতার দাবিকে সমর্থন করেনা; ২২ জেলায় স্থানীয় প্রশাসনের অনুরোধে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্য মোতায়েন করার নির্দেশ নিশ্চয় প্রতিদিন ঘটেনা। সরকারের সমর্থক এবং মন্ত্রীসভার অংশীদার একটি দলের একজন শীর্ষনেতা এবং ‘আইন প্রণেতা’ যখন একটি প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের কর্মিদের গুলি করে হত্যা করার জন্যে ‘আইন-শৃঙ্খলা’ বাহিনীর প্রতি আহবান জানান (বা নির্দেশ দেন) তখন একথা বলার অপেক্ষা রাখেনা যে দেশে একটি সংকট তৈরি হয়েছে। তাঁকে অস্বীকার করার মধ্যে আত্মম্ভরিতা থাকতে পারে, আত্মতৃপ্তিও থাকতে পারে কিন্ত এগুলো সমাধানের পথ তৈরি করেনা। এই অনিশ্চয়তার কারনেই সাধারণের মনে প্রশ্ন ওঠে এরপর কী হবে? ৩ জানুয়ারি রাত থেকেই দেশে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তা প্রতিদিন উন্নতির বদলে অবনতির দিকেই যাচ্ছে। এর জন্যে সরকার ও বিরোধী দল এবং তাঁদের সমর্থকরা পরস্পরের দিকে আঙ্গুল তুলতে পারেন। কিন্ত বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াকে অবরুদ্ধ করা, দলের কার্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে দেয়া, নেতাদের আটক করা এবং দলটিকে সভা সমাবেশ করতে না দেয়ার কারণেই যে সাম্প্রতিক এই পরিস্থিতির সূচনা হয়েছে তা অস্বীকার করলেই অবস্থার বদল ঘটবে না। আমরা এও জানি যে, এগুলো সাম্প্রতিক ঘটনা প্রবাহের আশু উৎস; কিন্ত মূল উৎস কোথায় তা কারো অজানা থাকার কথা নয়।
২০১৩ সালের শেষ দিকে সংঘাত এবং সহিংসতার কারণে নাভিশ্বাস ওঠা সাধারণ মানুষ যে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের অব্যবহিত পরে আর রাজনৈতিক অস্থিরতা চান নি, সংখ্যাগরিষ্ঠের অংশগ্রহণ ব্যতিরকে অনুষ্ঠিত নির্বাচন মেনে নিয়েছিলেন তার একটা কারণ এই যে তাঁরা একে সাময়িক ব্যবস্থা বলেই বিবেচনা করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেয়া ১৯ ডিসেম্বর ২০১৩ সালের এই বক্তব্যকে সমাধানের ইঙ্গিত বলে বিবেচনা করেছিলেন যে, ‘সমঝোতায় আসলে দশম সংসদ ভেঙ্গে দিয়ে সংবিধান অনুযায়ী একাদশ সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হবে’; প্রধানমন্ত্রী এও বলেছিলেন যে, ‘আলোচনা চলতে থাকবে।’ ক্ষমতাসীন দল ও প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের পর অবস্থান বদলেছেন। কিন্ত সাধারন মানুষের মনে এই আশা ছিলো যে এক/দেড় বছরের মধ্যেই এই বিষয়ে ‘আলোচনা’ হবে এবং অগ্রগতির লক্ষণ দেখা যাবে। বিরোধী দল হিশেবে বিএনপি সম্ভবত সেই প্রত্যাশা থেকেই ২০১৪ সালে কোনো রকম উত্তেজনা সৃষ্টির পথে এগুতে চায়নি। দলগতভাবে তাঁদের সাংগঠনিক অবস্থাও সরকার বিরোধী আন্দোলন তৈরির অনুকূলে ছিলো না। জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সম্পর্কের প্রশ্ন থেকে শুরু করে, দলের নেতাদের বক্তব্য এবং কিছু নেতার ভূমিকা পর্যন্ত অনেক বিষয়েই দলটিকে প্রতিকূল জনমতের মুখোমুখি হতে হয়েছে। দলগতভাবে বিএনপি পরবর্তি নির্বাচন অনুষ্ঠানের উপায় বিষয়েও তার অবস্থান স্পষ্ট করতে পারেনি। এই সময়ে সাধারণ মানুষের দাবি দাওয়া বা সংকটে যে নেতৃত্ব দিতে পেরেছে বা তাঁদের আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটিয়েছে সে দাবিও তাঁর করতে পারবেনা। অন্যদিকে ‘আন্দোলনের সময়সুচি’ নিয়ে বিএনপি নেতাদের দেয়া বক্তব্যকে ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করতে সরকারী দলের নেতারা যেমন তেমনি সাধারণ মানুষও পিছপা হননি। কিন্ত তারপরেও ঢাকায় বিএনপিকে সমাবেশ করতে না দেয়ার কারণ কি থাকতে পারে তা বোধগম্য নয়। সেই থেকে অবস্থার অবণতি ঘটতে শুরু করে। বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের প্রস্ততি নিয়ে এই সমাবেশের আয়োজন করেছিলো এমন মনে করার পক্ষে সমর্থন মেলেনা যখন দেখা যায় যে অপরিকল্পিতভাবেই খালেদা জিয়া অবরোধ কর্মসূচি ঘোষনা করেন এবং এর পরবর্তি পদক্ষেপ কী হবে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো ইঙ্গিত তিনি বা তাঁর দল দিতে পারছেনা। কিন্ত এই অবরোধকে কেন্দ্র করেই এখন সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। ফলে ঘটমান সহিংসতার দায় বিএনপির ওপরেই এসে পড়ছে। বিএনপি না চাইলেও যেমন এর দায় অস্বীকার করতে পারবেনা, তেমনি এই পরিস্থিতি অবসানে রাজনৈতিক পদক্ষেপ না নেয়ার এবং নাগরিকদের নিরাপত্তা বিধানে ব্যর্থতার দায় সরকারের। কেবল উচ্চকন্ঠে বিরোধী দলকে দায়ি করে সরকার পার পেতে পারে না। শক্তি প্রয়োগের হুমকি এবং শক্তি প্রয়োগের ফলে পরিস্থিতি ক্ষমতাসীনদের অনুকূলে আসবে বলে যারা ধারণা করছেন তাঁরা নাগরিকদের নিরাপত্তার বিষয় বিবেচনায় নিচ্ছেন বলে মনে হয়না। এটি গণতান্ত্রিক আচরণ বলে গণ্য হতে পারেনা।
গত কয়েক দিনে সংগঠিত ঘটনাবলি যার পরিণতিতে কমপক্ষে ২১ জন মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে এবং অবস্থা যে উত্তরোত্তর খারাপ হচ্ছে তা দেখেই এই প্রশ্ন ওঠে যে এরপরে কী হবে? আজকের ঘটনাই যে চূড়ান্ত নয়, আগামীকাল যে আরো দুঃসংবাদ বয়ে আনবে এ ভেবে কমবেশি সকলেই শংকিত। আমার এক বন্ধুর ফেসবুকে মন্তব্য এ প্রসঙ্গে যথাযথ – ‘নিজ দায়িত্বে নিরাপদে থাকুন।’ কিন্ত তাঁর চেয়েও বড় উদ্বেগের বিষয় হল এই যে সহিংস ঘটনা ঘটছে তার ওপরে আদৌ কারো নিয়ন্ত্রণ আছে কিনা। সরকার সমর্থকরা বলবেন যে যেহেতু খালেদা জিয়া অবরোধ ডাকার পর থেকেই এর সুচনা এটি তাঁর দায়িত্ব। কিন্ত খালেদা জিয়াকে অবরুদ্ধ করে রাখলে এবং তাঁর দলের মহাসচিবসহ নেতাদের আটক করে রাখলে ঘটনাপ্রবাহের ওপর বিএনপির নিয়ন্ত্রণ আদোই আছে কিনা এবং ভবিষ্যতে কতদিন থাকবে সেটা নিয়ে আমার মনে প্রশ্ন রয়েছে। ২০১৩ সালের শেষ দিকে অব্যাহত সহিংসতার প্রেক্ষাপটে আমি এই আশংকা প্রকাশ করেছিলাম এ সহিংসতা শেষ পর্যন্ত নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিশ্বাসীদের হাতে না-ও থাকতে পারে। কেননা, এ ধারা অব্যাহত থাকলে সহিংসতার মাত্রা বাড়বে এবং তা নতুন নতুন রূপ নেবে। এতে করে এর ওপর এমন শক্তির নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, যা নিয়মতান্ত্রিক সাংবিধানিক রাজনীতির জন্যই হুমকি হয়ে উঠতে পারে। নির্বাচনের পর বিএনপি নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির ধারায় তাঁদের দাবি আদায়ের পথ খোঁজার কারণে তা নিয়ন্ত্রিত হয়েছিলো। বিতর্কিত নির্বাচনের পর বিএনপি’র কর্মিদের একাংশের এবং সাধারণের মধ্যেও এই আশা ছিলো যে ‘নিয়ম রক্ষার নির্বাচনের’ পর আলোচনা শুরু হবে। ফলে অবস্থার অবসান ঘটানোর সঙ্গে একার্থে তাঁদের স্বার্থ জড়িত ছিলো, আগামিতে সেই সম্ভাবনা না থাকলে কেবল শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে সহিংসতা মোকাবেলা করা যাবে কিনা তা প্রশ্নসাপেক্ষ।
যদিও এটা কোনো নতুন কথা নয় তবুও বলা দরকার যে এই আশঙ্কার বিবেচনায় এই অবস্থা থেকে বেরুবার পথ খুজতে হবে জরুরি ভিত্তিতে। কিন্ত সেই পথ কী? আমার বিবেচনায় এই অবস্থার অবসান হবার সম্ভাব্য পথ তিনটি।
যেভাবে সংকটের সমাধান হতে পারে
দেশের বিরাজমান সংকট এবং সহিংসতার পটভূমি আমাদের সকলের জানা। ৩ জানুয়ারি রাত থেকেই গোটা দেশ এক অসহনীয় পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে। সরকার ও বিরোধীদের ক্ষমতার প্রতিযোগিতা ও শক্তি প্রদর্শনের শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। ইতিমধ্যে কমপক্ষে ২৪ জন নিহত হয়েছেন, দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষিপ্ত সহিংসতা ঘটছে এবং আতঙ্কজনক অবস্থার মধ্যে মানুষ দিন কাটাচ্ছে।
সরকার ও বিরোধী পক্ষ কেবল যে মুখোমুখি হয়ে পড়েছে তাই নয় তাঁরা নিজেদেরকে এমন এক অবস্থানে নিয়ে গেছেন যে তা থেকে বেরুবার পথ সংকীর্ণ হয়ে পড়েছে। যদিও বিএনপি বলেছে যে তারা আলোচনায় রাজি আছে এবং তাদের ঢাকায় সমাবেশ করতে দিলে তারা অবরোধ তুলে নেবে তথাপি এটাই যে বর্তমান সংকটের স্থায়ী সমাধান নয় সেটা কমবেশি সবাই বুঝতে পারেন। অন্যদিকে সরকার ও সরকারী দল বিএনপি বিষয়ে এমন অবস্থান দেখিয়েছে যে এখন তাঁদের পক্ষে বিএনপি’র সঙ্গে সরাসরি আলোচনার সুযোগ অত্যন্ত সীমিত। উভয় পক্ষই মনে করে যে এখন যে কোনো ধরণের ছাড় দিলেই সাংগঠনিকভাবে তাঁরা ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে। এই ধরণের বিবেচনা শান্তিপূর্ণভাবে সংকট সমাধানের অনুকূল নয়।
এই অবস্থার অবসান ঘটতে পারে তিনভাবে।
প্রথম পথ হচ্ছে বিএনপির অবরোধ কর্মসূচী এবং তাকে কেন্দ্র করে যে ধরণের সহিংসতা ঘটছে সরকার তা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হবে। এখন পর্যন্ত সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ থেকে স্পষ্ট যে ক্ষমতাসীন দল সেটাকেই একমাত্র পথ বলে বিবেচনা করছেন। তাঁদের ধারণা ২০১৩ সালের শেষ দিকে এই ধরণের সংঘাতময় পরিস্থিতি যেহেতু নিয়ন্ত্রণ করা গেছে সেহেতু এই অবস্থা দীর্ঘদিন ধরে অব্যাহত রাখা বিএনপি’র পক্ষে সম্ভব হবে না। সাংগঠনিক শক্তি ক্ষয়, নেতা-কর্মিদের ওপরে আরো বেশি নিপীড়ন অব্যাহত রাখা এবং জনসাধারনের মধ্যে এর বিরুদ্ধে ক্ষোভ তৈরি করা গেলে এই অবস্থার অবসান হবে বলে সরকার সম্ভবত আশা করেন। শুধু তাই নয় এই সময়ে যদি বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া আদালতে তাঁর বিরুদ্ধে আনীত মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হন কিংবা তাঁকে আনুষ্ঠানিকভাবে আটক করা যায় তবে দলটি কার্যত নিঃশেষিত হয়ে যাবে বলে তাঁদের ধারণা। সরকার সমর্থকদের কথা থেকে এটা মনে হয় যে এই দফায় বিএনপিকে সম্পূর্ণভাবে পরাস্ত করাই তাঁদের লক্ষ। কিন্ত এই ধরণের সম্ভাবনা বাস্তবোচিত মনে হয় না। প্রথমত ২০১৩ সালের শক্তি প্রয়োগের একটা দৃশ্যত শেষ পর্যায় ছিলো; তা হল ৫ জানুয়ারির নির্বাচন। এখন সে ধরণের কোনো নির্দিষ্ট সময় নেই, ফলে এই ধরণের অবস্থা অনির্দিষ্ট সময়ের জন্যে জারি রাখতে হবে। এটি আন্তর্জাতিক সমাজের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না, যার প্রভাব অবশ্যই পড়বে। দ্বিতীয়ত অব্যাহতভাবে শক্তি প্রয়োগের ফলে সরকারের বিরুদ্ধে বিরাজমান ক্ষোভ বিরোধীদের পক্ষেই কাজ করতে পারে, সাধারণ মানুষ এটা চাইবেন না যে তাঁদেরকে অনির্দিষ্ট সময় এই ধরণের অবস্থার মধ্যে থাকতে হবে। তদুপরি এই অবস্থায় গোটা পরিস্থিতি সরকারের এবং বিরোধীদের নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যাবার আশঙ্কাও রয়েছে। একটি রাজনৈতিক দল কেবল চাপের মুখে সম্পূর্নভাবে পরাস্ত হবে এবং বিলুপ্ত হবে সেটা মনে করার পক্ষে কোন যুক্তি দেখিনা।
দ্বিতীয় পথ হচ্ছে বিএনপির এই আন্দোলনে সাফল্য লাভ করা। অর্থাৎ সরকারকে নতুন করে নির্বাচনের পথে অগ্রসর হতে বাধ্য করা। বাংলাদেশে এই ঘটনার উদাহরণ থাকলেও, এখন পর্যন্ত বিএনপি সে ধরণের শক্তি সমাবেশ ঘটাতে পারেনি যা সরকারকে সে পথে যেতে বাধ্য করবে।তাছাড়া এখন যদি সরকার একটি নতুন নির্বাচনের জন্যে রাজিও হয় তবে তা হবে বর্তমান সাংবিধানিক ব্যবস্থার অধীনে যা সমস্যার কোন সমাধান দেয় না। সরকারকে বাধ্য করার জন্যে যে ধরণের সাংগঠনিক শক্তি থাকা দরকার তার কোনো লক্ষণ আমরা এ যাবত বিএনপি’র আন্দোলনে দেখতে পাইনি। বিক্ষিপ্তভাবে হামলা চালিয়ে তারা ভীতি তৈরিতে সক্ষম হলেও তা মানুষের মধ্যে সক্রিয় সমর্থন তৈরি করবে না। একে গণতান্ত্রিক আচরণ বলেও দাবি করা যাবে না। প্রাণনাশ ও রক্তক্ষরণের মাধ্যমে সাফল্য অর্জনের চেয়ে মানুষের সঙ্গে দূরত্বই তৈরি হবে, জনদুর্ভোগ দিয়ে সাধারণের মন জয় করা যাবেনা। এটাও উদ্বেগের বিষয় যে, এই ধরণের সহিংসতার বিরুদ্ধে বিএনপি’র পক্ষ থেকে কোনো রকম নিন্দা বা তা বন্ধের জন্যে আহবান আমরা শুনতে পাইনি। যদি সরকারকে আলোচনার টেবিলে আনার উপায় হিশেবে বিএনপি অব্যাহত অবরোধকে বিবেচনা করে তবে তাঁকে আলোচনার এজেন্ডা বিষয়ে আরো সুস্পষ্ট বক্তব্য দিতে হবে।
তৃতীয় পথ হচ্ছে আলোচনার সূচনা করা। যেহেতু ক্ষমতাসীন দল ইতিমধ্যেই কোন রকম আলোচনার সম্ভাবনাকে নাকচ করে দিয়েছে সেহেতু সরাসরি আলোচনার আশু সম্ভাবনা নেই। এটাও মনে রাখা দরকার যে ২০০৬ কিংবা ২০১৩ সালে দেশের বাইরে থেকে যে ধরণের উদযোগ ছিলো এখন সে ধরণের কোনো সম্ভাবনা কম বললেই চলে। ইতিমধ্যে এই ধরনের একটি উদযোগ ইউরোপীয় দেশগুলো নিতে শুরু করেছে, কিন্ত যদি সাফল্যের সম্ভাবনা না থাকে তবে তাঁরা যে পিছিয়ে যাবে সে বিষয়ে নিশ্চিত করেই বলা যায়। বিএনপির পক্ষ থেকে যারা মার্কিন কংগ্রেস সদস্যদের বিবৃতি জালিয়াতি করেছেন তাঁরা এই ধরনের উদযোগকে আরো বেশি দুরূহ করে তুলেছেন, তাঁরা যে দেশের সম্মানহানি ঘটিয়েছেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সরকারের পক্ষ থেকে মধ্যস্ততার অনুরোধ আসলে বা এই উদযোগের প্রতি সমর্থন থাকলেই কেবল এই ধরণের চেষ্টা জোরদার হবে। ক্ষমতাসীন দল চাইলে এই ধরণের উদযোগ নেয়ার মতো আন্তর্জাতিক সংস্থা রয়েছে।
কিন্ত অভ্যন্তরীনভাবেই সেই উদযোগ নেয়ার জায়গা এখনও অবশিষ্ট আছে বলেই আমার ধারণা। দেশের সংকটময় পরিস্থিতি বিবেচনায় রাষ্ট্রপতি গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করতে পারেন, এতে সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে সরকার ও বিরোধীরা তাঁদের অনমনীয় অবস্থান থেকে সরে আসার সুযোগ পাবে। দলীয় পরিচয়ের উর্ধে উঠে সংসদের স্পীকার একই ভূমিকা নেবার কথা বিবেচনা করতে পারেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন পেশার সদস্যরা দলীয়ভাবে বিভক্ত হয়ে পরার ফলে অতীতের মতো কোন পেশাজীবী সংগঠনের পক্ষে গ্রহণযোগ্য কোনো পদক্ষেপ নেয়ার সুযোগ নেই। তবে এর একমাত্র ব্যতিক্রম হতে পারেন দেশের বিশিষ্ট আইনজীবীরা, তাঁরা তাঁদের মতভেদ ভুলে সম্মিলিত পদক্ষেপ নেবার কথা বিবেচনা করে দেখতে পারেন। আমার বিশ্বাস যে তাঁরা এখনও সব রাজনৈতিক দলের কাছে আবেদন রাখতে পারবেন। আর প্রাতিষ্ঠনিকভাবে উদযোগ নিতে পারেন ব্যবসায়ীদের সংগঠন। সে প্রচেষ্টার সাফল্য নির্ভর করবে তাঁরা কতটা আন্তরিক তাঁর ওপরে।
এসব ক্ষেত্রে অতীতের অভিজ্ঞতা আমাদের জন্যে খবু বেশি আশাবাদ তৈরি করে না। কিন্ত এখন সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্বের অভাব বিবেচনা করলে সংকট সমাধানের আর কোন পথ খোলা আছে বলে মনে হয়না। রাজনীতিবিদরা আলোচনার পথ বেছে না নিলে সাধারণ মানুষের অব্যাহত প্রাণনাশ, কষ্ট ও ভোগান্তি অবসানের আর কোনো পথ খোলা নেই।
(প্রথম আলো’তে ১৬ ও ১৭ জানুয়ারি ২০১৫ প্রকাশিত)
থাম্বনেইলের ছবির সূত্র: পোমোনা কলেজে হোসে ক্লেমেন্তে ওরোজকো-এর তৈরি ম্যুরাল প্রমিথিউস এর ছবি [লিঙ্ক], আরো জানতে দেখুন এখানে