This post has already been read 15 times!
বাংলাদেশের তরুণদের জন্য কি রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছে বা হচ্ছে? তারা রাজনীতিতে অংশ না নিক, সেটাই কি কাঙ্ক্ষিত হয়ে উঠেছে? তাদের রাজনৈতিক সক্রিয়তা কি এখন অপরাধ বলে গণ্য করা হচ্ছে? এই প্রশ্নগুলো তোলার কারণ হচ্ছে, কোটা সংস্কার আন্দোলন ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় সংবাদমাধ্যমের কিছু খবর, রাজনৈতিক নেতাদের বক্তব্য ও আচরণ। শুধু তা–ই নয়, এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত শিক্ষার্থীদের পরিবারগুলো বিভিন্ন সংবাদ সম্মেলনে রাষ্ট্রীয় রোষ থেকে তাদের সন্তানদের রক্ষা করতে যে কথাগুলো বলেছে, তা শুনেও আমার মনে হয়েছে এই প্রশ্নগুলো তোলা দরকার।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের একপর্যায়ে সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকেরা যখন এই আন্দোলনের পেছনে ‘রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা’র ভিত্তিহীন প্রচারণা শুরু করেন, যখন প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম বিবিসির কাছে দাবি করেন ‘সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতেই’ তিনি বলছেন যে এই আন্দোলনের নেতাদের ‘অধিকাংশ ছাত্রশিবিরের’, তখন থেকেই এ বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু হয়। আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত শিক্ষার্থীরা গোড়া থেকেই বলেছেন যে তাঁদের কোনো দলের সঙ্গে যোগাযোগ নেই। তাঁদের ওপরে যখন সরকারি খড়্গ নেমে আসে এবং নেতারা আটক হন, তখন তাঁদের পরিবারগুলো বারবার এই কথা বলতে বাধ্য হয় যে তাদের সন্তানেরা রাজনীতি করেন না।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতা রাশেদ খানের মা ও স্ত্রী সংবাদ সম্মেলনে জোর দিয়ে বলেছেন যে ‘রাশেদ কোনো রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত না।’ একজন অসহায় মা তাঁর সন্তানের মুক্তির জন্য আবেদন জানাতে দুই হাত জোড় করে বলেন, ‘আমার মনি এমনকি আমরা কেউ কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত না’ (বাংলা ট্রিবিউন, ১১ জুলাই ২০১৮)। প্রায় একই সময়ে যখন কোটা আন্দোলনের আরেকজন নেতা তারেক রহমানকে পাওয়া যাচ্ছিল না, তখন তাঁর বাবা-মা আবদুল লতিফ ও শাহানা বেগম তাঁদের সন্তানের সন্ধান চেয়ে ১৬ জুলাই সংবাদ সম্মেলন করলে সেখানে তারেক রাজনীতি করতেন কি না, তা জানতে চাইলে আবদুল লতিফ সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা কেউই রাজনীতি করি না। তবে আমাদের ছেলে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিল বলে শুনেছি।’ (প্রথম আলো, ১৬ জুলাই, ২০১৮)।
এই মা-বাবারা যে সত্য কথাই বলেছেন সে বিষয়ে সংশয়ের কারণ নেই। যখন রাষ্ট্রের সব শক্তি তদন্তের কাজে নিয়োজিত এবং সরকার-সমর্থকেরা অহর্নিশ চেষ্টা চালাচ্ছেন যেনতেন প্রকারে এই আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত করতে, সেই সময় শিক্ষার্থীদের পরিবার ভুল বা মিথ্যা তথ্য দেওয়ার ঝুঁকি নেবে, এমন কথা কেবল নির্বোধেরাই মনে করতে পারেন। সেই সময় সংবাদপত্রের অনুসন্ধানেও বেরিয়ে আসে যে এর পেছনে কোনো দলের ইন্ধন নেই। পুলিশের সূত্র উদ্ধৃত করে ৭ জুলাই প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ‘এখন পর্যন্ত জোরালো কোনো রাজনৈতিক যোগসাজশের তথ্য তাদের হাতে আসেনি।’
নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল স্কুল-কলেজ শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে। ফলে প্রথম দিন দুই হয়তো এমন কথা বলার সুযোগ ছিল না, কিন্তু আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা যুক্ত হওয়ামাত্রই সরকারের পক্ষ থেকে কথিত রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ এল, তার সঙ্গে যুক্ত হলেন সরকার সমর্থকেরা। যেহেতু এই আন্দোলনের যৌক্তিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা যাবে না এবং এই আন্দোলনে নেতা বলে কাউকে চিহ্নিত করে তাঁকে অভিযোগের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যাবে না, সেহেতু আন্দোলনে ‘তৃতীয় পক্ষ’, ‘অনুপ্রবেশকারী’ বলে এক নতুন ব্যাখ্যা উপস্থিত করা হলো। তারপরে যখন রাজপথ থেকে নির্বিচারভাবে ‘উসকানি’র অভিযোগে আটক করা হলো, তখনো সেই একই কথা বলা হলো। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের জোর দিয়ে বললেন, ‘শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে অবশ্যই রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ছিল’ (যুগান্তর, ১০ আগস্ট ২০১৮)। কিন্তু সাংবাদিকেরা অনুসন্ধান করে জানালেন যে ‘শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি’ (প্রথম আলো, ১৮ আগস্ট ২০১৮)।
দুই আন্দোলনের ক্ষেত্রেই আত্মীয়স্বজনকে সাংবাদিকদের এই ধরনের প্রশ্ন করা এবং সংবাদমাধ্যমের অনুসন্ধানের চেষ্টা করার কারণ বোধগম্য। তাঁরা তাঁদের দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু আন্দোলনে যুক্ত শিক্ষার্থীরা যদি কোনো সংগঠনের সদস্য হতেন, তা যদি নিষিদ্ধ সংগঠন না হয়, তবে কি তা দোষের বিষয় হতো? অনেক ছাত্রসংগঠন তাদের নিজস্ব দলীয় পরিচয়েই কোটা সংস্কারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। তাদের সদস্যরা কি এই ধরনের আন্দোলনে যুক্ত হতে পারবেন না? শিক্ষার্থীদের দাবি যদি যৌক্তিক ও ন্যায়সংগত বলে বিবেচিত হয়, তবে কেন একজন শিক্ষার্থীকে এর সঙ্গে যুক্ত হতে তাঁর রাজনৈতিক পরিচয়কে বিসর্জন দিতে হবে? কোটা সংস্কার আন্দোলনের যাঁরা বিরোধিতা করেছেন, তাঁরা যদি তাঁদের রাজনৈতিক এবং সাংগঠনিক পরিচয় অক্ষুণ্ন রেখেই এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারেন, তবে রাজনৈতিকভাবে সক্রিয়দের ক্ষেত্রে ভিন্ন বিবেচনা থাকার উদ্দেশ্য কী, তা বোঝা দরকার।
যদি কোনো ছাত্রসংগঠন মনে করে যে দলীয়ভাবে কোনো দাবি বা আন্দোলন সমর্থন করবে না, তার অর্থ কি এই যে কোনো সদস্যই এই আন্দোলনকে যৌক্তিক মনে করতে পারবেন না? সংসদ সদস্যদের যেমন সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের বাধা আছে, সৌভাগ্যবশত ছাত্ররাজনীতিতে তেমন বিধান নেই। ফলে তরুণ এবং শিক্ষার্থীরা তাঁদের ইচ্ছেমতো বিষয়ে তাঁদের রাজনৈতিক অবস্থান নেবেন, সেটাই স্বাভাবিক। এর বিকল্প হচ্ছে দলের দাসত্ব করা। যাঁরা ছাত্রদের রাজনৈতিক-সংশ্লিষ্টতা বিষয়ে উদ্বিগ্ন, তাঁদের কথায় মনে হয়েছে যে তরুণেরা দলের দাসত্ব করুক, সেটাই বরং তাঁদের বেশি প্রত্যাশিত। নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের দাবি কেবল শিক্ষার্থীদের বিষয় ছিল না, ছিল সমাজের সর্বস্তরের মানুষের দাবি। নাগরিক হিসেবে একজন তরুণ যদি এই আন্দোলনে অংশ নেন, তবে তাঁর রাজনৈতিক বা দলীয় সংশ্লিষ্টতাকে আক্রমণ করা আসলে নাগরিকের অধিকার লঙ্ঘন। সেই অধিকার লঙ্ঘনের পক্ষে যাঁরা অব্যাহতভাবে কথা বলেছেন ও বলছেন, তাঁরা একটা রাজনৈতিক অবস্থান থেকেই কথা বলছেন, কিন্তু অন্যের জন্য তাঁরা সেই অধিকার রাখতে চান না। অথবা তাঁরা বলতে চান, ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে যুক্ত থেকে রাজনৈতিক সক্রিয়তা গ্রহণযোগ্য, কিন্তু তা না হলেই তা অপরাধমূলক।
সাম্প্রতিক দুই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে এমন প্রচারণার উদ্দেশ্য বিরাজনীতিকরণ এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে এমন ধারণা তৈরি করা যে রাজনীতি একধরনের অস্পৃশ্য বিষয়। রাজনৈতিক-সংশ্লিষ্টতা থাকলে তাঁদের হয়রানি ও নিপীড়নের শিকার হতে হবে—এমন ধরনের ভীতি তৈরিও একটি উদ্দেশ্য বলেই মনে হয়। রাজনীতি বাদ দিয়ে দেশ শাসনের চেষ্টা, কিংবা কেবল ক্ষমতাসীনদের রাজনীতিই সহনীয়, অন্যদের নয়—এই পদ্ধতিকে গণতন্ত্র বলে দাবি করার কোনো কারণ নেই। দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্র সংসদের নির্বাচন না হওয়া, ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের একচ্ছত্র আধিপত্য বহাল থাকা, ছাত্ররাজনীতির নামে বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কাজ এবং দেশের রাজনীতির সার্বিক পরিস্থিতির কারণে একধরনের বিরাজনীতিকরণের প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে দীর্ঘদিন ধরেই। তরুণদের একাংশের মধ্যে একসময় ‘আই হেট পলিটিকস’ বলার যে ফ্যাশন চালু করা হয়েছিল, তার বিপরীতে দাঁড়িয়েই তরুণেরা এইসব আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। তাঁরা বুঝতে পারছেন যে বিরাজমান অবস্থার বদল ঘটাতে হলে, তা নিরাপদ সড়ক কিংবা চাকরিক্ষেত্রে বৈষম্য—যা-ই হোক না কেন, পরিবর্তনের পক্ষে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের বিকল্প নেই।
যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সী জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কমপক্ষে পাঁচ কোটি ছয় লাখ। এরা কেবল দেশের প্রধান কর্মশক্তিই নয়, এরাই বাংলাদেশ। এই জনগোষ্ঠীর কাছে রাজনীতিকে অস্পৃশ্য করে তোলার যে চেষ্টা, তাতে সাময়িকভাবে ক্ষমতাসীনেরা হয়তো লাভবান হবেন, কিন্তু এর পরিণতি শুভ হওয়ার কোনো কারণ নেই। রাজনীতি-সচেতনতা এবং রাজনৈতিক দিক-নির্দেশনা ছাড়া দেশের অগ্রগতি সম্ভব নয়, বাংলাদেশের ইতিহাস তাই সাক্ষ্য দেয়।
প্রথম আলো, ০১ সেপ্টেম্বর ২০১৮
This post has already been read 15 times!