November 23, 2024

ভারতের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ সফরের প্রাক্কালে এ দেশের সবাই আশায় বুক বেঁধেছিলো। সবাই ভেবেছিল এবার বুঝি আমাদের তিস্তার পানি নিয়ে দুঃখ মিটলো! ভারত সরকার ও বাংলাদেশ সরকারের তিস্তা চুক্তি সংক্রান্ত প্রস্তুতিসহ যৌথ নদী কমিশনের তৎপর ভূমিকায় চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়টিকে সবাই শুধুমাত্র সময়ের ব্যাপার মনে করেছিল। গণমাধ্যমও বিষয়টিকে নিয়ে অন্যরকম একটি উচ্চাশা তৈরি করেছিলো দেশের অভ্যন্তরে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিস্তা পানি বন্টন নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে কোন চুক্তি সম্পাদিত হলোনা। এরপর থেকে কারণ হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর নেতিবাচক অবস্থানকেই সবাই চিহ্নিত করে আসছে। ক্ষমতাসীন কংগ্রেসের রাজনৈতিক জোটের (ইউনাইটেড প্রোগ্রেসিভ অ্যালায়েন্স) টিকে থাকার জন্য পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেসের সমর্থন অপরিহার্য, তাই মনমোহন সিং ও মমতা বন্দোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক দড়ি টানাটানিতে শেষ পর্যন্ত বলির পাঁঠা হয়েছিলো, এই তিস্তা চুক্তি। তবে তাদের রাজনৈতিক দড়ি টানাটানিতে একটা বিষয় খুব অস্পষ্ট থেকে গেলো। আর তা হলো এ ধরণের আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্পাদনের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের এখতিয়ার। প্রাসঙ্গিকভাবে প্রশ্ন এলো, এক্ষেত্রে ভারতে রাজ্য সরকারের ক্ষমতাই বা কী।

এই লেখাটিতে মূলতঃ ঐ প্রশ্নগুলোর উত্তরগুলোই খোঁজার চেষ্টা করা হবে, ভারতের সংবিধানের আলোকে। উত্তরগুলো খোঁজার সাথে সাথে বহুপাক্ষিক কূটনৈতিক কিছু বিষয় প্রাসঙ্গিকভাবে আলোচিত হবে। তবে ভারতের সংবিধান সংক্রান্ত আলোচনায় দেখা যাবে তিস্তার পানি বন্টন চুক্তির মতো একটি আন্তর্জাতিক দলিল সম্পাদন করার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের সদিচ্ছাই সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।

এছাড়া, লেখাটিতে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সদিচ্ছার বাস্তবায়নের সম্ভাবনাকে শক্তিশালী করার জন্য আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বহুপাক্ষিক স্তরের কুটনৈতিক তৎপরতা ও বিরাজমান আইনী কাঠামোর উপরও আলোকপাত করা প্রয়োজন। এদিক থেকে বাংলাদেশ একটা সুবিধাজনক অবস্থায় আছে। কেননা ২০১১ সালের ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সফরকে কেন্দ্র করে ইতোমধ্যে ঐ চুক্তিটির একটি খসড়া প্রস্তুত হয়েছে, যেখানে ভারত অন্ততঃ বাংলাদেশের জন্য এপ্রিল-অক্টোবরের শুষ্ক মৌসুমে পানির সমবন্টন নিশ্চিত করেছে। যদিও  ভারত তাদের অংশে সমস্ত তিস্তা জুড়ে বেশ কয়েকটি বাঁধ নির্মাণ করে ইতোমধ্যে অনেক পরিমাণ পানি প্রত্যাহার করে নিয়েছে।

লেখাটি মূলতঃ দুই ভাগে বিভক্ত। প্রথমভাগে ভারতের সংবিধানের আলোকে আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্পাদনের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের এখতিয়ার পর্যালোচনা করা হবে। কেন্দ্রীয় সরকারের এখতিয়ার সংক্রান্ত কিছু ঐতিহাসিক ঘটনাও আলোচিত হবে এই ভাগে। দ্বিতীয় ভাগে প্রথমভাগের আলোচনার ভিত্তিতে অন্যান্য কিছু প্রাসঙ্গিক বিষয় আলোচিত হবে। বিশেষ করে, বহুপাক্ষিক কূটনৈতিক তৎপরতার উপর আলোকপাত করা হবে।

 ১.     ভারতের সংবিধান ও আন্তর্জাতিক তিস্তা চুক্তি

তিস্তা নদী আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিতে একটি আন্তর্জাতিক নদী। কেননা এটি শুধু সিকিম রাজ্যে উৎসারিত হয়ে ভারতে সীমাবদ্ধ থাকেনি, বাংলাদেশের উপর দিয়েও প্রাকৃতিকভাবে প্রবাহিত হয়েছে। এ ধরণের আন্তর্জাতিক নদীতে কোনো দেশের একচ্ছত্র আইনগত আধিপত্য নেই। এ নদীগুলোর পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে উজান ও ভাটির দেশগুলোর একইরকম অধিকার।

১৯৬৬ সালের হেলসিংকি নিয়মাবলী অনুযায়ী ইচ্ছা করলেই উজানের দেশ, এ ধরণের নদীর উপর ভাটির দেশের জন্য ক্ষতিকর এরকম কোন কিছু নির্মাণ করতে পারেনা। তবে ভারতের সংবিধান আন্তর্জাতিক নদীকে আলাদাভাবে সংজ্ঞায়িত করেনি। সংবিধানে নদী বলতে আন্তঃরাজ্য নদী”-কেই (Inter-State Rivers) বুঝিয়েছে। এক্ষেত্রে এই নদীগুলো  আন্তর্জাতিক না আন্তঃরাজ্য কেন্দ্রিক অভ্যন্তরীন নদী, সেই ব্যাপারে ভারতের সংবিধান কোন দিক নির্দেশনা দেয়নি। ভারতের সংবিধানের ক্ষমতা তালিকার ৫৬নং সন্নিবেশকে নদীসমূহের (Inter-State Rivers) ব্যবস্থাপণা ও উন্নয়নের দায়িত্ব শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় সরকারের উপর ন্যস্ত করা হয়েছে।

অন্যদিকে, নদীকে ঘিরে রাজ্য সরকার দায়িত্ব বন্টনের ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারের এখতিয়ার হিসেবে অন্তর্ভূক্ত হয়েছে পানি সরবরাহ, সেচ, খাল খনন, হ্রদ, নালা ও বাঁধ নির্মাণ, সংরক্ষণ এবং জলশক্তি ব্যবহার। সংবিধানানুযায়ী এগুলো নিশ্চিত করা হয়েছে রাজ্য সরকারের ক্ষমতা তালিকার ১৭নং সন্নিবেশকে। অবশ্য এই দায়িত্বগুলো কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা তালিকার ৫৬নং সন্নিবেশের সাথে যেন সাংঘর্ষিক না হয়।

ভারতের সংবিধানের রাজ্য ক্ষমতার তালিকার ১৭নং সন্নিবেশকের ক্ষমতা বলেই ভারতীয় রাজ্য সরকার এ পর্যন্ত প্রায় পাঁচ হাজার বড় বড় বাঁধ নির্মাণ করেছে পানি সরবরাহ এবং সেচ ব্যবস্থা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে। এতে এখন পর্যন্ত প্রায় পাঁচ কোটি লোক সমগ্র ভারতে বাস্তুচ্যুত হয়েছে। এমনকি তিস্তা ব্যারেজ নির্মাণের কারণেও পশ্চিমবঙ্গে উত্তরের বেশ কিছু জেলাতে বাস্তুচ্যুতি ঘটেছে। সেখানকার স্থানীয় জনগণ বাস্তুচ্যুতিতে ক্ষুব্ধ হয়ে ২০১১ সাল নাগাদ এ ব্যারেজের বিরুদ্ধে ১৫০টি মামলাও দায়ের করেছে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক আইনকে বিবেচনায় না নিয়ে রাজ্য সরকার কর্তৃক নদীটির উৎস সিকিম থেকে গজলডোবা পর্যন্ত বেশ কয়েকটি বাঁধ নির্মাণের কারণে বাংলাদেশের রংপুর-রাজশাহী অঞ্চল মরুকরণের শিকার হচ্ছে। অথচ এই অঞ্চল বাংলাদেশের সবচাইতে দারিদ্রপীড়িত অঞ্চল।

তবে ভারতের সংবিধানে আন্তর্জাতিক নদীর সংজ্ঞা সংক্রান্ত কোনো সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা না থাকলেও, আন্তর্জাতিক চুক্তি রাজ্য সরকারের এখতিয়ার নাকি কেন্দ্রীয় সরকারের এখতিয়ার, সেই বিষয়ে স্পষ্ট ব্যাখ্যা দেওয়া আছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাথে তিস্তা নদীর পানি বন্টন সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্পাদন করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, এটা নিশ্চিত।

ভারতের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭৩ (১) (খ)-এ এটা বলা হয়েছে যে, ভারত সরকার কর্তৃক সম্পাদিত কোন চুক্তি বা সমঝোতা থেকে উৎসারিত কোন অধিকার, কর্তৃত্ব এবং এখতিয়ারের চর্চা শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় সরকারের নির্বাহী ক্ষমতার অন্তর্ভূক্ত। ঠিকই একই সাথে ভারতের সংবিধানে কেন্দ্রীয় সরকারের যে ক্ষমতা তালিকা দেওয়া আছে, তার ১০ ও ১৪ নং সন্নিবেশকে পররাষ্ট্রনীতি সংক্রান্ত বিষয়াবলীসহ বিদেশী রাষ্ট্রের সাথে চুক্তি, সমঝোতা আর কনভেনশন সম্পাদনের ক্ষমতা কেবলমাত্র কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্বেরই অন্তর্ভূক্ত।

কেন্দ্রীয় সরকারের আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্পাদনের এই একচ্ছত্র ক্ষমতা নিয়ে ১৯৫০ সালে ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া বনাম মনমুল জৈন নামের একটি মামলা হয়েছিল। ভারতে হাইকোর্ট তার রায়ে এটা নিশ্চিত করে যে, ভারত সরকারের চুক্তি সম্পাদন একটি নির্বাহী কাজ, কোন আইন প্রণয়নমূলক কাজ নয়। রাষ্ট্রপতি তার নিজস্ব নির্বাহী ক্ষমতাবলে বিদেশী রাষ্ট্রের সাথে চুক্তি সম্পাদন করতে পারেন।

পাকিস্তানের সাথে ১৯৬০ সালে ইনডাস পানি চুক্তি সম্পাদনের কারণে কিছু অর্থনৈতিক দায়বদ্ধতা ভারতের উপর বর্তায় । ভারতের লোকসভায় এই বির্তকটি আসে যে, সাংসদদের সাথে ঐ চুক্তিটি নিয়ে সলাপরামর্শ করা উচিত ছিলো। সাংসদেরা আরো দাবী করে, চুক্তিটি অনুস্বাক্ষর করার ক্ষমতা সংসদের এবং রাষ্ট্রের নির্বাহী সদস্যরা এটি করবেন না। লোকসভার স্পীকার তাদের দাবীগুলো নাচক করে বলেন যে, চুক্তি সম্পাদন এবং অনুস্বাক্ষরের একচ্ছত্র এখতিয়ার সরকারের। তবে অনুস্বাক্ষরের সময় তারা চুক্তি সংক্রান্ত অনুযোগগুলো উত্থাপন করতে পারেন। এক্ষেত্রে স্পীকার ভারতীয় সংবিধানের ২৫৩ নং অনুচ্ছেদের কথা উল্লেখ করেন। এই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কোন চুক্তি, সমঝোতা, কনভেনশন অথবা আন্তর্জাতিক সম্মেলন, সংগঠন অথবা প্রতিষ্ঠানে গৃহীত সিদ্ধান্তকে শুধুমাত্র আইনে পরিণত করা অথবা বাস্তবায়ন সংসদের  উপর নির্ভর করে ।

ভারতের সংবিধান পর্যালোচনায় এটা স্পষ্ট যে, বাংলাদেশের সাথে তিস্তা পানি চুক্তি স্বাক্ষরের দায়িত্বটা কেন্দ্রীয় সরকারের উপরই বর্তায়। সেই কারণে ভারতের ক্ষমতাসীন সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছাটি সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, তিস্তা পানি বন্টনের মতো আন্তর্জাতিক চুক্তিটি স্বাক্ষর করার ব্যাপারে। শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের উপর দোষ চাপিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের সদিচ্ছার বিষয়টিকে আড়ালে রাখলে ভারতের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং আমলাতন্ত্রের উপর কোন চাপ তৈরি করা যাবেনা।

২.    কেন্দ্রীয় সরকারের সদিচ্ছা ও অন্যান্য প্রাসঙ্গিকতা

কেন্দ্রীয় সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছাকে সক্রিয় করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য আন্তর্জাতিক সম্পর্কে দ্বিপাক্ষিক এবং বহুপাক্ষিক এই দুই স্তরে অগ্রণী ভূমিকা এবং আন্তর্জাতিক আইনের আশ্রয় নেওয়ার বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় নেওয়া জরুরী। বস্তুতঃ আন্তর্জাতিক নদীর পানির ব্যবহার সংক্রান্ত ১৯৬৬ সালে সম্পাদিত হেলসিংকি নিয়মাবলীতে বিবাদমান রাষ্ট্রগুলোর জন্যে দ্বি-পাক্ষিক এবং বহুপাক্ষিক – এই দুই স্তরেই আন্তর্জাতিক নদীর পানি ব্যবহার এবং তার সমবন্টন সংক্রান্ত সমস্যার সমাধানের আইনী পথ বাতলে দেয়া হয়েছে।

হেলসিংকি নিয়মাবলীর অনুচ্ছেদ ৩০-৩৫ পর্যন্ত, ধাপে ধাপে সমস্যা সমাধানের নির্দেশনা দেওয়া আছে। যেমনঃ  অনুচ্ছেদ ৩০ এ বিবদমান রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের কথা বলা হয়েছে। সেটা সম্ভব না হলে যৌথ প্রতিষ্ঠান তৈরির উপর জোর দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যৌথ নদী কমিশন বর্তমানে সক্রিয় আছে। এর মাধ্যমে সমাধানের সম্ভব না হলে অনুচ্ছেদ ৩২ অনুযায়ী তৃতীয়পক্ষের মধ্যস্থতার মাধ্যমে সমাধানের পথও খোলা রাখা হয়েছে। তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতায় কোন সমাধান না হলে অনুচ্ছেদ ৩৩ একটি অনুসন্ধান কমিশন গঠণের কথা বলেছে। অনুচ্ছেদ ৩৪ এ আন্তর্জাতিক বিচারালয়সহ অন্যান্য অনেক উপায়ে আন্তর্জাতিক সালিশীর সুযোগও তৈরি করা হয়েছে। এক্ষেত্রে হেলসিংকি নিয়মাবলীর ৩৫নং অনুচ্ছেদে আন্তর্জাতিক সালিশীর জন্য আন্তর্জাতিক আইন কমিশনে শরণাপন্ন হওয়ার বিষয়টিকেও অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে।

যেহেতু দ্বিপাক্ষিক আলোচনা এখন পর্যন্ত সত্যিকারের ফলপ্রসূ কিছু নিশ্চিত করতে পারেনি, তাই বহুপাক্ষিক স্তরে, বিশেষ করে আর্ন্তজাতিক আইনী কাঠামোর আশ্রয় নেওয়ার বিয়ষটি বাংলাদেশ সরকারের বিবেচনায় নেওয়া এই মুহুর্তে জরুরি। এক্ষেত্রে হেলসিংকি নিয়মাবলীর আশ্রয় নেওয়ার বিষয়টি আবার নির্ভর করছে আন্তর্জাতিক নদীর পানি ব্যবহার সংক্রান্ত অন্যান্য চুক্তিগুলোকেই নিজেদের আইনী কাঠামোতে অন্তর্ভূক্ত করার উপর। এতে ভারত সরকারের উপর চাপ প্রয়োগকরাসহ তাদের রাজনৈতিক সদিচ্ছা বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের অবস্থান আরো শক্তিশালী হবে। যেমনঃ বাংলাদেশ এখনো ১৯৯৭ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক সম্পাদিত আন্তর্জাতিক অ-নৌবাহ জলপ্রবাহের ব্যবহারের আইন সংক্রান্ত কনভেনশনটি  স্বাক্ষর  করেনি।

ঐ কনভেনশনটির সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যের ধারক হলো অনুচ্ছেদ ৭। এই অনুচ্ছেদটি আন্তর্জাতিক নদীর পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে, কোন রাষ্ট্র অন্য কোন রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর কিছু করবেনা, এই বিষয়টিকে আন্তর্জাতিক আইনী কাঠামোতে অন্তর্ভূক্ত করেছে। সেজন্য ভাঁটির দেশ হিসেবে ১৯৯৭ সালের এই কনভেনশনটি আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই কনভেনশনটি আন্তর্জাতিক আইনে পরিণত করার জন্য ৩৫টি দেশের অনুস্বাক্ষর প্রয়োজন। অথচ এখন পর্যন্ত ৩৪টি রাষ্ট্র অনুস্বাক্ষর করেছে। বাংলাদেশ হতে পারে ৩৫ তম অনুস্বাক্ষরকারী রাষ্ট্র।

একইভাবে ১৯৯২ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক সম্পাদিত ভাঁটির দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বহু-রাষ্ট্রসীমানা অতিক্রমকারী জলস্রোত ও আন্তর্জাতিক হ্রদের পানি ব্যবহার সংক্রান্ত কনভেনশনটি আমরা এখনো স্বাক্ষর করিনি। এই কনভেনশনটি অবশ্য ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক আইনে পরিণত হয়েছে।

ভারতের রাজনৈতিক সদিচ্ছা নিশ্চিত করার জন্য আন্তর্জাতিক কূটনীতিকে বহুপাক্ষিক স্তরেও বাংলাদেশের সক্রিয় অংশগ্রহণ জরুরি। তাই ভাঁটির রাষ্ট্রগুলোর পক্ষে যে সমস্ত বিরাজমান কনভেনশন এবং আন্তর্জাতিক আইন রয়েছে সেগুলোকে ভারত কিংবা অন্য কোন দেশের সাথে পানি বন্টন সংক্রান্ত কূটনৈতিক তৎপরতায় বাংলাদেশের বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন নিজেদের ভবিষ্যত অস্তিত্ব নিশ্চিত করার জন্য।

ভারত বাংলাদেশের তিস্তা চুক্তি সংক্রান্ত যে অনিশ্চয়তা রয়েছে তা মূলতঃ দুই দেশের জন্যই রাজনৈতিক সদিচ্ছাকে ঘিরে। ভারতীয় সংবিধানানুযায়ী আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্পাদনে কেন্দ্রীয় সরকারের একচ্ছত্র এখতিয়ার থাকা সত্ত্বেও, শুধুমাত্র রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব অথবা অনুপস্থিতির কারণে ২০১১ সালে চুক্তি স্বাক্ষরের কাছাকাছি গিয়েও শেষ পর্যন্ত চুক্তিটি আলোর মুখ দেখেনি, মমতা বন্দোপাধ্যায়ের একগুঁয়েমির অজুহাতে। একইভাবে ভারতের সাথে তিস্তা চুক্তি সম্পাদনে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা, বাংলাদেশের জন্য এখনো কোনো সুফল নিয়ে আসতে পারেনি। ভারতে ২০১৪ সালের নির্বাচনোত্তর নতুন সরকার ক্ষমতায় এলেও, কোন সমাধানে পৌছানো সম্ভব হবে, এরকম কোন লক্ষণও কূটনৈতিক পর্যায়ে দেখা যাচ্ছেনা। বরং বিজেপি ও তার রাজনৈতিক জোট ক্ষমতায় আসার কারণে তিস্তা চুক্তি সম্পাদনের সম্ভাবনা আরো সুদূর পরাহত এবং জটিল হয়ে উঠতে পারে। তবে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তার বাংলাদেশ-বিরোধী ভাবমূর্তি উন্নয়নে যদি বিন্দুমাত্র নরম হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি করে, সেটাকে কাজে লাগানো জরুরি। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বহুপাক্ষিক স্তরে সক্রিয় হওয়ার বিষয়টিকেও গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় নিতে হবে। তাই বাংলাদেশ সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছাও ভারতের উপর চাপ প্রয়োগ করার জন্য এই মুহুর্তে একমাত্র অনুঘটক। বহুপাক্ষিক স্তরে বিরাজমান বিকল্প কূটনৈতিক ব্যবস্থার শরণাপন্ন না হলে বাংলাদেশের সবচাইতে দারিদ্রপীড়িত রাজশাহী-রংপুর অঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত তো হবেই, পুরো বাংলাদেশের ভূ-খন্ডগত অবস্থান এবং পরিবেশগত অস্তিত্ব সংকটে নিপতিত হবে।

bdnews24.com এ প্রকাশিত হয়েছে এই লেখাটির আরেকটি সংস্করণ। পাওয়া যাবে- http://opinion.bdnews24.com/bangla/archives/17595

 

1 thought on “আন্তর্জাতিক তিস্তা চুক্তি, ভারতের সংবিধান এবং বহুপাক্ষিক কূটনীতি

Leave a Reply