সংবাদমতে 1 ওভারব্রিজ ব্যবহার না করলে ঢাকায় পথচারীদের ওপর জেল এবং জরিমানার বিধান কঠোর ভাবে আরোপ করার ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। এ থেকে বোঝা যায় পথচারীদের মধ্যে অবস্থাপন্নদের হার কমছে আর সুযোগবঞ্চিতরা নগর ব্যবস্থাপকদের বিবেচনায় গুরুত্ব পাচ্ছেন না। অন্যদিকে নগর ব্যবস্থাপনার নির্বাহী সিদ্ধান্তু যারা নিচ্ছেন তাদের এই সিদ্ধান্তগুলো নেয়ার কথা নয়। নগর পরিকল্পনাবিদ হিসাবে তাই কিছু প্রশ্ন বিবেচনা করা দরকার মনে করছি। আর্থিক সক্ষমতার অভাবে জীবিকা ও জীবনের প্রয়োজনে ঢাকার রাস্তায় প্রতিদিন অনেকটা পথ হাঁটা ছাড়া যাদের কোন বিকল্প নেই তাদের মতামত কি নেয়া হয়েছে এই সিদ্ধান্ত নেবার সময়? মনে হয় না। এই সিদ্ধান্তে কারা কীভাবে উপকৃত হবে? প্রথমত মোটরযান যেন নির্বিঘ্নে চলতে পারে সে জন্যেই এই ব্যবস্থা। আর সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ক বিবেচনার সাথে এই সিদ্ধান্ত যে সাংঘর্ষিক সে বিষয়ে নীতি নির্ধারকরা সচেতন বলে মনে হচ্ছে না। সড়ক নিরাপত্তা এবং পরিবহণ ব্যবস্থার ভালমন্দের দায়দায়িত্ব পুলিশের উপরের ন্যস্ত থাকার সিদ্ধান্তই বা কতটা যৌক্তিক? ঢাকায় যদি একজন নির্বাচিত মেয়র থাকতেন তাহলেও কি পুলিশ বিভাগ এমন একটি সিদ্ধান্ত পথচারীদের উপর চাপাতেন? নির্বাচিত মেয়রকে যেহেতু জবাবদিহিতার কাঠামোর মধ্যে থাকতে হয় সেই সম্ভাবনা কম বলেই মনে করি।
একটি ভাল শহর গড়ে তোলার দর্শনকে দুই শব্দে সংক্ষেপে প্রকাশ করা যায়, “সকলের শহর”। আর একটি শহর তখনই “সকলের” হয় যখন সেই শহরের নির্মাণ, ব্যবস্থাপনা এবং নিয়মনীতি নির্ধারণে শহরের সব শ্রেণীর মানুষের অংশগ্রহনের ব্যবস্থা ও রীতি চালু থাকে। সেই অংশগ্রহনই নিশ্চিত করবে শহরটিকে এর মানুষজন কতটা আপন করে নিতে পারবে। ঠিক হবে শহরটির ভবিষ্যত কোন দিকে যাবে। ঢাকা শহরকে সবার শহরে পরিনত করার কোন কার্যকর ব্যবস্থা যে নেয়া হয়নি তা অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানি। নতুন করে জেল জরিমানা এবং সেটার প্রয়োগ করার বিধান এই সত্যটিকেই আবার নতুন করে প্রমান করল। প্রশ্ন আসতে পারে যেই বিধান দুর্ঘটনা কমাবে বলে দাবি করা হচ্ছে সেটাকে ক্ষতিকর মনে করছি কেন? সেটা জানতে গেলে আমাদের বুঝতে হবে পথচারীরা কেন ওভারব্রীজ ব্যবহার করে না? আর যদি ঠিক ভাবে ব্যবহার নাই হল তাহলে এসব ওভারব্রীজগুলো থাকার যৌক্তিকতাই বা কী? আরো গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে ওভারব্রীজ ব্যবহার না করা কি জেল জরিমানাযোগ্য অপরাধ? শুধুমাত্র রাস্তা “ঠিক ভাবে” পার হতে পারলেন না বলে একজন পথচারী ছয় মাসের কারাদণ্ড ভোগ করবেন এমন আইন নগরবাসি মেনে নিচ্ছে কি করে?
একটি শহরের পরিবহণ ও নিরাপত্তা বিষয়ক অবকাঠামোগুলোর নকশা যেমন মানুষের আচরণকে প্রভাবিত করে তেমনি এই সব অবকাঠামোগুলোর নকশা করার সময় ব্যবহারকারিদের জন্য কোনটা সহজ, সহনীয় এবং সর্বোপরি কার্যকর হবে সেটাও আমলে নিতে হয়। অন্যভাবে বলা যায় ভাল নকশা এবং ভাল পরিকল্পনা তখনই ‘ভাল’ বলে গণ্য হবে যখন তাতে মানুষের ব্যক্ত-অব্যক্ত চাওয়া না চাওয়ার সাথে কারিগরি জ্ঞানের সমন্বয় ঘটবে। ফুট ওভারব্রিজগুলোর ব্যবহারের দুইটি প্রধান দিক হল এগুলো ব্যবহার করতে গেলে একজন পথচারীকে মধাকর্ষের বিপরীতে যেতে হয়। সেটা হঠাৎ একদিন বা একবেলার জন্য যতটা সহজ, যে পথচারীকে অনেক স্থানে দিনে অনেকবার তা করতে হবে তার জন্য তা অনেক গুণ কঠিন। আর এটা তার জীবনকে এবং বেঁচে থাকার লড়াইকে অনেকটাই কঠিন করে দেবে 2। কাজেই যদি পথচারীদের মতামত দেবার সুযোগ থাকত তাহলে যে তাঁরা এই বিধান মেনে নিতেন না এটা মনে করাই স্বাভাবিক। আর মতামত নেয়া হলে নীতিনির্ধারকরাও জানতে পারতেন পথচারীরা কী চান। এমনকি যদি বাহ্যত পথচারীরা এর পক্ষেই মতামত প্রকাশ করতেন তবু প্রশ্ন আসত, এসব ব্যবস্থা ব্যবহার না করার মাধ্যমে তারা প্রমান করছেন এগুলো তাদের জন্য যতটা সুবিধাজনক তার চাইতে বেশি অসুবিধাজনক। যারা পরিবহণ ব্যবস্থা নিয়ে গবেষনা করেন তারা একে বলেন আচরণিক পছন্দ (revealed preference) যেটা মানুষ আচরণের মাধ্যমে স্পষ্ট করেন। যেটা তারা মুখে বলেন সেটাকে বলা হয় ব্যক্ত পছন্দ (stated preference)। পথচারীদের ব্যক্ত মতামত সম্পর্কে যেহেতু এই মুহূর্তে সুনির্দিষ্ট তথ্য আমাদের কাছে নেই, তাদের আচরণ যে বক্তব্য তুলে ধরছে সেটাকেই গুরুত্ব দিতে পারি। এরপর আমাদের কাজ হবে তাদের আচরণকে নিয়ন্ত্রনের চেষ্টা না করে অবকাঠামোকে তাদের উপযোগি করে তোলা যায় কিনা সেটা বিবেচনা করা।
এছাড়া স্বাভাবিক বিচার বুদ্ধি থেকেও আমরা বুঝতে পারি মধ্যাকর্ষের বিপরীতে চলা একজন পথচারীর জন্য কতটা কঠিন। আর মোটরযানের ভেতরে বসে পথচারীর বাস্তবতা বোঝা সম্ভব নয়। কিন্তু আমরা লক্ষ্য করছি না ওভারব্রিজ ব্যবহার না করে পথচারীরা এই সত্যটাকেই প্রমান করছেন এবং ব্যবস্থাটির বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান সম্পর্কে একটি মতামত প্রকাশ করছেন। ঠিক এ কারণে নগর পরিবহনের নকশা করার সময় ব্যবহারকারিদের আচরণ বিবেচনা করার একটা চল আছে। এখন প্রশ্ন আসতে পারে তাহলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কেন এই সিদ্ধান্ত নিচ্ছে? একটু ভাল করে লক্ষ্য করলেই দেখব গত কয়েক দশকে দেশের জ্বলানী নীতি, পরিবহন নীতি, অবকাঠামো নীতি, ভূমি উন্নয়ন নীতি, মোটরযান আমদানি বিষয়ক নীতিতে মোটরযানের প্রতি পক্ষপাত দেখা গেছে। যেমন পরিবহণ ব্যবস্থায় প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহার করার সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে এবং সেখানে লাগসই নীতি, যেমন বাড়তি কর আরোপের মাধ্যমে সামাজিক ভাবে উপযুক্ত মাত্রার ব্যবহার নিশ্চিত না করা ইত্যাদি প্রবর্তন করা দরকার ছিল। ভূমি ব্যবস্থাপনাও মোটরযান বান্ধব হয়েছে। ওভার ব্রীজ ব্যবহারের প্রসঙ্গে যদিও দৃশ্যত মনে হতে পারে পথচারীদের নিরাপত্তার জন্য এই ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে কিন্তু কার্যত এটা করা হচ্ছে মোটরযানের অবাধ চলাচলকে সহজ করে দেবার জন্য। অন্তত একজন পরিকল্পনাবিদ হিসাবে নীতিনির্ধারকদের এমন সিদ্ধান্ত নেবার পেছনে মূল প্রনোদনা সেখান থেকেই এসেছে বলে আমার ধারনা। এটা যদি পথচারীদের চাওয়ার প্রতিফলনই ঘটত তাহলে এতে জেল জরিমানার প্রয়োজন দেখা দিত না। এর মাধ্যমে একটি বার্তা আবার দেয়া হচ্ছে যে শহর এবং রাস্তা ঘাটের উপর মোটরযানের মালিকদের অধিকারই বেশি 3। ফলে যারা এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাবেন বা এর পক্ষে কথা বলবেন তারা সম্ভবত মোটরযানেই চলাফেরা করেন। আর তাদের অবাধ চলাচলে বাঁধা সৃষ্টি করে পথচারীরা নিঃসন্দেহে মোটরযান মালিকদের এবং একই সাথে নগর ব্যবস্থাপকদের বিরাগ ভাজন হচ্ছেন। এটা ভেবে দেখা দরকার।
এখন মোটরযান ব্যবহারকারিদের বিশেষ সুবিধা দেয়ার নীতিটি কতটা যৌক্তিক? সামাজিক ন্যায় বিচারের বিবেচনাতেও বা সেটা কেমন? একটি প্রাইভেট মোটরযান দুইজন যাত্রী বহন করতে সড়কের যেটুকু স্থান দখল করে সেখানে একজন পথচারী রাস্তার কতটুকু যায়গা দখল করে তাকি আমরা তুলনা করে দেখেছি? যদি দেখি তাহলে সিদ্ধান্তটির অযৌক্তিকতা এবং অন্যয্যতার কথা ভেবে এটা আমরা পুনর্বিবেচনা করব না? এতে করে আমরা এমন একটি শহর তৈরি করছি যেখানে এক সময় মোটরযান ছাড়া কেউ এক পাও আগাতে সক্ষম হবে না। আমরা এমন শহর চাই, নাকি একটু একটু করে এই আত্মহননমূলক প্রবনতা থেকে সরে আসতে চাই সেটা ভেবে দেখা প্রয়োজন। এর মধ্যেই উল্টোপথে আমরা অনেকদূর হেঁটেছি। সংশোধনের সময় তাই এখনই।
প্রশ্ন আসতে পারে, তাহলে এই পরিস্থিতিতে কী করণীয়? রাজধানী ঢাকা সহ দেশের অন্যান্য শহরের পরিবহণ পরিকল্পনার দৃষ্টভঙ্গিই বা কী হবে? আলোচনা সংক্ষিপ্ত রাখার স্বার্থে দু’টি কথা বলব, প্রথমেই যারা শহরের সাধারণ মানুষ, পথচারী, অল্পবেতনের শ্রমিক তাদের প্রয়োজনগুলো বিবেচনা করতে হবে। কেননা যেকোন পরিস্থিতিতে তাদের হাতে বিকল্প কম থাকে। একটি পথ বন্ধ হলে অন্য পথে যাবার সুযোগ তাদের কম। সে কারণে গণপরিবহন এবং পথচারীদের উপযোগী অবকাঠামো গুরুত্ব পাবে সবার আগে। হয়ত যাদের হাতে পরিবহণের অনেক বিকল্প থাকে তাদের জন্য এটা আপাত দৃষ্টিতে সমস্যাজনক মনে হবে। হয়ত পথচারীদের সুযোগ দিতে আরো কিছুটা দীর্ঘ সময় তাদের গাড়ীর ভেতর অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এটা সবার জন্যই সুফল বয়ে আনবে। কেননা যে রাস্তায় সহজে হাঁটা যায় সেখানে তখন ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবাই হাঁটতে পারবেন। আর যে রাস্তায় হাঁটা কঠিন সেটা কেবল নিরুপায় ব্যক্তির হাঁটার জন্যই বরাদ্দ হবে। আর এখন জেল জরিমানার বিধান ও তার প্রয়োগের ফলে আমরা বুঝতে পারছি আস্তে আস্তে পথচারীদের গুরুত্ব কীভাবে কমে আসছে নীতিনির্ধারকদের চোখে। শুধুমাত্র ওভারব্রীজ দিয়ে রাস্তা পার না হবার “অপরাধে” একজন পথচারীকে ছয় মাসের কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, কর্মজীবি ব্যক্তিদের চাওয়া-পাওয়াগুলো জানার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। গবেষনার পাশাপাশি সে রকম প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো এবং বিধান ও চালু করতে হবে। এর লক্ষ্য থাকবে ব্যবহারকারিদের চাওয়া পাওয়াগুলো জানা এবং সেগুলো পুরণের জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এবং সমাজে কী ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে সেগুলোর খোঁজ করা। আর স্থানীয় উদ্ভাবনের সুযোগও সেখানে বিবেচনা করা দরকার হবে। আমাদের সব সমস্যা অন্যদের মত নয়। সেখানে অনেক অভিনবত্ব আছে। আর সেগুলোর প্রয়োগের কৌশল উদ্ভাবনেও নাগরিকদের চাওয়া পাওয়াগুলোকে আমলে নেবার উপায় বিবেচনা করতে হবে। এভাবেই আমাদের শহরগুলো “সবার শহর” হতে পারবে। আর এই পুরো প্রক্রিয়াটিকে সফল করার জন্য আশু একজন নির্বাচিত নগর প্রতিনিধি বা অভিভাবক প্রয়োজন। নগরায়নের সাথে সাথে দেশের ভবিষ্যত নগরের উপযুক্ত ব্যবস্থাপনার উপর অনেক বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। ফলে নগর পরিচালনা ব্যবস্থার উপর আশু দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন।
থাম্বনেইলের ছবি: টোকিও শহরের পথচারীদের সুবিধা দেবার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা (pedestrian scramble) যাতে তাদের জন্য অনেকটা সময়ের জন্য সব যান বাহন বন্ধ করে তাদের পারাপারের সুযোগ দেয়া হয়। http://goo.gl/W9FfF0
সোমবার, ২৪ নভেম্বর, ২০১৪
I want to contact you. please send your email address.
musamiah@gamil.com