November 23, 2024

বাংলাদেশে ৫ জানুয়ারি ২০১৪-এ যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, তার ফল আমরা এখনই জানি। ইতিমধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনের ফল কার্যত প্রকাশিত হয়েছে এবং বাদবাকি আসনগুলোর ফলাফলের অনুমানও আমরা সহজেই করতে পারি। আওয়ামী লীগ এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনেই কেবল বিজয়ী হবে তা নয়, এককভাবে দুই-তৃতীয়াংশ আসনও পাবে। সংসদ হবে আওয়ামী লীগের শরিকদের প্রতিনিধিদের নিয়ে। একটি ভোট প্রদানের আগে, এমনকি নির্বাচনের ব্যালট ছাপারও আগে কী করে আমরা ফলাফল জানতে পারলাম, তার ব্যাখ্যা নির্বাচন কমিশন দেয়নি।

তবে প্রধানমন্ত্রী সেই প্রশ্নের উত্তর না চাইতেই দিয়েছেন; সে জন্য অবশ্যই আন্তরিক ধন্যবাদ তাঁর পাওনা। তিনি বলেছেন, ‘সর্বদলীয় সরকারে যাঁরা যোগ দিয়েছেন, তাঁদের সঙ্গে সমঝোতা করে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেছি।’ সমঝোতার সূত্র এবং অন্যান্য আসনের ফলাফলের ইঙ্গিত প্রধানমন্ত্রীর এই কথায়ই রয়েছে, ‘যেখানে যেখানে প্রার্থী আছে, সেখানে একটা পার্সেন্টেজ ধরেছি যে এখানে এত পার্সেন্ট সমঝোতা করে ছেড়ে দেব।’ শুধু তা-ই নয়, প্রধান বিরোধী দলের ব্যাপারেও তাঁর বক্তব্য স্পষ্ট, ‘যদি বিএনপি আমাদের সঙ্গে সর্বদলীয় সরকারে আসত, তাদের সঙ্গেও আমরা একই প্রক্রিয়া করতাম’ (আওয়ামী লীগের আলোচনা সভায় প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৩)।

অনুমান করতে অসুবিধা হয় না যে প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবিত এই ধরনের ‘প্রক্রিয়া’য় বিএনপিকে নিশ্চয় সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন বা দুই-তৃতীয়াংশ আসন দেওয়া হতো না। বিতর্কের খাতিরে যদি আমরা ধরেও নিই যে প্রধানমন্ত্রী এই প্রক্রিয়ায় বিএনপিকে সব কটি আসনই দিয়ে দিতেন, তাহলে নির্বাচনের প্রয়োজন কি অবসিত হয় না? প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে ঐকমত্যের মাধ্যমে বিএনপি যদি একটি আসনও লাভ করত, প্রধানমন্ত্রী যদি তাদের একটি আসনও দিয়ে দেন, সেই আসনের ভোটারদের নাগরিক অধিকারের প্রশ্নটি সেখানে কোথায় থাকছে?

এ বক্তব্য থেকে এই উপসংহারে পৌঁছালে কি ভুল হবে যে ভোটাধিকারের প্রশ্নটি, জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হওয়ার প্রশ্নটি এখন আর মূল্য বহন করে না? ইতিমধ্যে জানা ফলাফলের মাধ্যমে বাংলাদেশের ভোটাররা যেহেতু জানেন, তাঁদের ভোটের মূল্য নেই, সে ক্ষেত্রে নির্বাচনের দিনে ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার জন্য বিরোধী দল নয়, সরকারই আসলে ভোটারদের অনুৎসাহী করতে সক্ষম হয়েছে। তাতে করে বিরোধীদের ডাকা ‘বর্জন’ বা ‘প্রতিরোধের’ চেয়ে আরও বেশি কারণ তৈরি হয়েছে ভোটারদের ভোট না দেওয়ার।

প্রথম দফায় ১৫১টি আসনের প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন বলে যে খবর প্রকাশিত হয়েছিল, তার ভিত্তিতে সেসব আসনের ভোটারদের সংখ্যা এবং মোট ভোটারের শতাংশের হিসাবের দিকে তাকালে যে চিত্রটি উঠে আসে, তা এই নির্বাচনকে ইতিমধ্যেই বৈধতার সংকটে ফেলে দিয়েছে। ২০০৮ সালের ভোটারসংখ্যাকে ভিত্তি ধরলে চটজলদি হিসাবে দেখা যায় যে সারা দেশের প্রায় ৫১ শতাংশ ভোটারকে ভোটকেন্দ্রে যেতে হবে না। এখন পর্যন্ত ৪৯ শতাংশ ভোটারের ভোট দেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। কোনো কোনো বিভাগে এই হার এতটাই বেশি যে সেটা যেকোনো বিবেচনায় অগ্রহণযোগ্য।

যেমন ধরা যাক রাজশাহী বিভাগের কথা। সেখানে ৬৮ শতাংশ ভোটারের ভোট দেওয়ার প্রয়োজন হবে না; ঢাকা বিভাগের ক্ষেত্রে তা ৫৮ শতাংশের বেশি। চট্টগ্রাম বিভাগের ৫৪ শতাংশ ভোটারের পছন্দের বিষয়টি এখন ধর্তব্যের বিষয় নয়। রংপুরের ভোটাররা এই ভেবে আনন্দিত হতে পারেন যে তাঁদের প্রায় ৭৩ শতাংশের ভোটের মূল্য রয়েছে। তবে যাঁদের ভোটের মূল্য আছে, তাও যে সীমিত, সেটি আমরা আগেই দেখিয়েছি। কেননা, তাঁরা সরকার গঠনের ক্ষেত্রে কোনো রকম বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারবেন না। এই হিসাবের পরে আমরা দেখেছি, আরও কমপক্ষে তিনটি আসনকে এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সেই হিসাবকে এর সঙ্গে যুক্ত করলে চিত্রটি আরও বেশি অগ্রহণযোগ্য হবে। ক্ষমতাসীনদের মধ্যে যাঁরা ভাবছেন, এসব হিসাব-নিকাশ কোনোভাবেই দেশের বাইরে বিবেচ্য বিষয় হবে না, তাঁদের জন্য দুঃসংবাদ হলো, ইতিমধ্যেই এসব অঙ্কের হিসাব শুরু হয়ে গেছে।

বাংলাদেশের গণমাধ্যমের সূত্রে ওয়াশিংটন সময় ১৩ ডিসেম্বর শুক্রবার বিকেলে যখন এই খবর জানা যায় যে এক-তৃতীয়াংশ আসনে বিনা নির্বাচনেই বিজয়ী নির্ধারিত হচ্ছে, সে সময় নির্বাচনবিষয়ক গবেষণায় যুক্ত আন্তর্জাতিক একটি ফাউন্ডেশনের একজন প্রতিনিধির কাছে দেশের নাম উল্লেখ না করে আমি জানতে চেয়েছিলাম, এই ধরনের অবস্থার কোনো উদাহরণ তাঁরা জানেন কি না। তিনি পাল্টা আমার কাছে জানতে চেয়েছিলেন, আমি প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক গণতান্ত্রিক দেশের কথা বলছি কি না। হাস্যচ্ছলে তিনি এ-ও জানতে চেয়েছিলেন, এই ধরনের একটা অসম্ভব দশ্যপটের কথা আমার মাথায় কেন এল।

আমি তখন তাঁকে জানাই যে এটা কোনো কল্পনাপ্রসূত বিষয় নয়। তিনি দ্রুত খোঁজখবর নিয়ে আমাকে জানান যে আপাতদৃষ্টে তিনি এমন দ্বিতীয় উদাহরণ খুঁজে পাননি। আমাদের মনে রাখা দরকার যে বাংলাদেশে অতীতে যেসব একতরফা নির্বাচন হয়েছে, সেগুলো আন্তর্জাতিক মহলে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গঠিত সরকার এতটাই স্বল্প সময় ছিল যে দেশ শাসনের প্রশ্নটি উত্থাপিত হয়নি। সে ধরনের চেষ্টা যে বাতুলতা হতো, সেটা বর্তমান বিরোধী দল, বিএনপি ভালো করেই জানে।

অন্যদিকে, ১৯৮৮ সালের নির্বাচন একতরফাভাবে হলেও এই ধরনের পরিস্থিতির উদ্ভব হয়নি। তা সত্ত্বেও সেই সরকারের বৈধতার প্রশ্ন বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মহলে তখন জোরেশোরেই উঠেছিল। এই বিষয়ে ক্ষমতাসীনেরা তার শরিক জাতীয় পার্টির নেতাদের প্রশ্ন করলেই জানতে পারবেন।

দেশের বিরাজমান সহিংস পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে মাত্র ১৪৬টি আসনে ‘নির্বাচনের’ ব্যবস্থা করা সহজতর হবে বলে সরকারের কোনো কোনো মহলে ধারণা থাকতেও পারে। কিন্তু এসব এলাকায় ৫০ শতাংশ মানুষকে ভোটাকেন্দ্রে হাজির করা সম্ভব হলেও তাতে যে মোট ভোটারের এক-চতুর্থাংশ ভোটারের দেওয়া রায়ের ভিত্তিতে দেশ পরিচালনার চেষ্টা, সেই হিসাব করতে গণিতে পারদর্শী হতে হয় না। এই যুক্তি মোটেই ধোপে টিকবে না যে অনেক দেশেই ভোটারদের ২৫ শতাংশও ভোট দেন না, তাতে সরকারের বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ হয় না। কেননা, সেসব ক্ষেত্রে ভোটারদের সামনে পছন্দের জন্য বিকল্প থাকে এবং তাঁরা স্বেচ্ছায় সিদ্ধান্ত নেন যে ভোট দেবেন কি না। গণতন্ত্রের একেবারে গোড়ার কথাই হচ্ছে, কোনো কিছু পছন্দ করা বা না করার অধিকার নাগরিকের আছে কি না। একজন নাগরিক সেই অধিকার কীভাবে প্রয়োগ করবে, সেটা নাগরিকের বিষয়। যতক্ষণ না পর্যন্ত রাষ্ট্র আইনানুগভাবে তার প্রয়োগ বাধ্যতামূলক করছে, ততক্ষণ পর্যন্ত সে বিষয় নিশ্চিত করাই কেবল রাষ্ট্রের কাজ। অন্যদিকে, রাষ্ট্র যদি আইন করেও তা হরণ করে, তবে তাকে আর গণতন্ত্র বলে অভিহিত করা যাবে না।

একসময় নির্বাচন কমিশনের স্লোগান হিসেবে একটা বাক্য ব্যবহূত হতো—‘আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দেব’। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চারটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের পর জাতীয় সংসদে গত ১৬ জুন দেওয়া ভাষণে বিরোধী দলের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেছিলেন, ‘নির্বাচনী মেকানিজম তাঁরা ভালোই জানেন।’ তিনি এ-ও বলেছিলেন, ‘“আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দেব”—এটা আমারই স্লোগান ছিল। সেটা আমরা নিশ্চিত করতে পেরেছি।’

দেশের ৫০ শতাংশের বেশি ভোটার এখন এই প্রশ্ন করতেই পারেন, ‘সমঝোতার’ ভিত্তিতে যে সংসদ তৈরি হচ্ছে, সেখানে ‘যাকে খুশি’ ভোট দেওয়ার অধিকার কীভাবে নিশ্চিত করা হয়েছে? নির্বাচনী মেকানিজমের মাধ্যমে একসময় যা হরণ করা হতো বলে প্রধানমন্ত্রী যথাযথভাবেই বর্ণনা করেছিলেন, এখনকার অবস্থা তা থেকে কী অর্থে ভিন্ন?

(প্রথম আলো, ডিসেম্বর ১৭, ২০১৩)

Leave a Reply