ভাবমূর্তি (সূত্রঃ http://www.livemint.com/Opinion/LsypEdxwEB1ZPG6IPEOaNJ/In-defence-of-sweat-shops.html) চিত্রনঃ Jayachandran/Mint
This post has already been read 14 times!
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি মো. আতিকুল ইসলাম সাভারের ভবনধসের সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ করার ব্যাপারে গণমাধ্যমকে কার্যত সাবধানতা অবলম্বনেরই পরামর্শ দিয়েছেন। তাঁর প্রশ্নটা খুব সহজ – কেন আমরা বারবার এসব দেখাচ্ছি? বলার অপেক্ষা রাখেনা যে তিনি এ সব ছবি ‘বারবার’ না দেখানোরই পক্ষে। ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের এই সব ছবি ও সচিত্র প্রতিবেদন কেন দেখানো যাবেনা সেটাও মোটেই অস্পষ্ট নয় তাঁর কাছে – ‘এতে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে’। এই বক্তব্যে যে ইতিমধ্যেই নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হয়েছে সেটা নিশ্চয় বিজিএমইএ এবং তার নেতৃবৃন্দ জেনেছেন। আমি অবাক হবো না যদি অচিরেই এমন কথাও আমরা শুনতে পাই যে তাঁর কথা সঠিক ভাবে গণমাধ্যমে আসেনি। তাঁর নিজের কন্ঠের এবং সচিত্র প্রমাণ থাকলেই যে তিনি এমন কথা থেকে বিরত থাকবেন এমন আশা করারও কোন কারণ নেই। বাংলাদেশে যারা বিভিন্নভাবে ক্ষমতাশালী –সরকারে থাকা, বিরোধী দলের নেতৃত্বে আসীন হওয়া কিংবা বিত্তের জোর – যে কারনেই হোক তাঁদের কথা প্রায়শই যে মিডিয়া ভালোভাবে ‘বুঝতে’ পারেনা সেটা আমরা জানি। পরে তাঁরা আমাদের সবিস্তারে ‘বোঝানো’র চেষ্টা করেন। নির্বোধদের বোধ শক্তি দেবার জন্যে তাঁদের এই চেষ্টা নিশ্চয়ই প্রশংসার যোগ্য। ভবন ধ্বসের কারণ হিসেবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর বক্তব্য নিয়েও এই ধরণের কথা বার্তা আমরা শুনেছি। কিন্ত যতক্ষন না পর্যন্ত বিজিএমইএ সভাপতি মো. আতিকুল ইসলাম বলছেন যে আমরা তাঁর কথা ভুল বুঝেছি আমরা ধরে নিতে পারি এটাই তাঁর কথা যে দেশের ভাব মূর্তির সার্থে বারবার এসব ছবি দেখানো উচিৎ নয়।
দেশের ভাবমূর্তি নিয়ে উদ্বেগের বিষয়টা একবারে নতুন কিছু নয়। প্রায়শই আমরা সরকারের কাছ থেকে এই কথা শুনতে পাই যে বিরোধীরা দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করছে। ২০০১ সালে থেকে ২০০৬ সালের কথা অনেকের হয়তো মনে হবে। দেশে জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর উত্থানের সময়টাতেও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া দেশে ও দেশের বাইরে অত্যন্ত জোর দিয়ে বলছিলেন যে, দেশে কোনো জঙ্গি গোষ্ঠি নেই, দেশের ভাবমূর্তি নষ্টের জন্যে এক ধরণের ষড়যন্ত্র চলছে। জামায়াতে ইসলামীর নেতা মতিউর রহমান নিজামী বাংলা ভাইকে গণমাধ্যমের কল্পিত চরিত্র বলেই বর্ননা করেছিলেন। জঙ্গিদের তৎপরতার মুখে বিদেশী সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরকে এই বলে উড়িয়ে দেয়া হয়েছিল যে এগুলো বানানো। কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছিলো যে এমনকি এসব খবর পড়াও ভাবমূর্তি নষ্ট করার কাজে নিয়োজিত হবার মতোই। যতদূর মনে পড়ে প্রধানমন্ত্রী সাবেক কূটনীতিকদের নিয়ে সভা করে তাঁদের দায়িত্ব দিয়েছিলেন যেন তাঁরা ভাবমূর্তি নষ্টের এই চেষ্টা মোকাবেলায় সক্রিয় হন।
সাভারের ভবন ধ্বসে পড়ার সঙ্গে জঙ্গি গোষ্ঠির উত্থানের তুলনা হয়না। কোনো অবস্থাতেই এদের এক কাতারে দাঁড় করার ইচ্ছে আমার নেই। তদুপরি ভাবমূর্তি নিয়ে সরকারী উদ্বেগের সেটাই যে একমাত্র উদাহরণ তাও নয়। কিন্ত প্রসঙ্গটির অবতারণা করলাম এই কারণে যে, বাংলাদেশে বিত্তশালী ও ক্ষমতাশালীদের মধ্যে দেশের ভাবমূর্তি নিয়ে যে একটা বায়বীয় ধারণা রয়েছে তাঁর প্রতি মনোযোগ আকর্ষনের জন্যে। দেশের ভাবমূর্তি একটা বায়বীয় বিষয় নয়। কোনো দেশের ক্ষমতাশালীরা যে ভাবে চাইবেন সেভাবেই ঐ দেশের ভাবমূর্তি গড়ে উঠবে বলে যারা মনে করেন তাঁরা আর যাই হোক রাজনৈতিক-অর্থনীতি বিষয়ে ধারণার অধিকারী নন। যে কোনো দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক বাস্তবতাই ঐ দেশের ভাবমূর্তি তৈরি করে।
গত প্রায় এক দশকে সারা পৃথিবী জুড়ে একটি সম্ভাবনাময় দেশ হিসেবে বাংলাদেশের যে পরিচিতি তৈরি হয়েছে, যে ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছে তাঁর পেছনে পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের ভূমিকা অসামান্য। গত প্রায় পঁচিশ বছরে ধরে একাধিক দেশে জীবন যাপন ও কাজ করার এবং বাংলাদেশ বিষয়ে যৎকিঞ্চিত পঠনপাঠনের অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভর করেই কথাটি বলতে পারি। এই শিল্পের এবং অন্যান্য শিল্পের উদ্যোক্তাদের ভুমিকাকে ছোট না করেই একথা বলা যায় যে এই শ্রমিক গোষ্ঠীর (এবং প্রবাসে কর্মরত স্বল্প মেয়াদী শ্রমিকদের) কারনেই বাংলাদেশ এক মধ্য আয়ের দেশ হবার স্বপ্ন দেখতে পারছে। ‘বাংলাদেশ প্যারাডক্স’ বলে যে ধারণার উদ্ভব হয়েছে তাঁর মূল কথাই হল যে দেশে সুশাসনের অভাব সত্ত্বেও মানুষের অপরিমেয় শক্তির কারনেই বাংলাদেশ সম্ভাবনার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে, সেই অপরিমেয় শক্তির একটি হল তাঁর শ্রমিকরা। পোশাক শিল্পের অধিকাংশ নারী শ্রমিকের শ্রম এবং ঘাম কেবল বাংলাদেশের অর্থনীতি নয়, সমাজকেও বদলে দিয়েছে। এ বিষয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে বলে বেশি কথা বলার প্রয়োজন নেই। এর নেতিবাচক দিক নেই এমন বলাও আমার উদ্দেশ্য নয়। কিন্ত এই প্রপঞ্চকে বাদ দিয়ে, এই শ্রমিকদের জীবনের কথা বাদ দিয়ে যে বাংলাদেশের ভাবমূর্তির কাল্পনিক গল্প ফাঁদার চেষ্টা হচ্ছে তা দেখে শুধু ক্ষোভ জাগে তা নয়, এই প্রশ্নও জাগে যে তা হলে কি অতীতের মত এই মর্মান্তিক ঘটনা থেকে কি আমরা কিছুই শিখবোনা? এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনাকে ধুয়েমুছে বা সেনিটাইজ করে দেখানোর পরামর্শ সাংবাদিকতার মানদণ্ডে হলে সে নিয়েও আমরা আলোচনা করতে পারতাম, সে বিষয়েও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বিজিএমইএ একমত হত বলে মনে হয়না। (কোনো কোনো ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের, বিশেষত ইলেকট্রনিক মিডিয়ার, যে ব্যত্যয় হয়নি আমি তাও অস্বীকার করবো না।)
কিন্ত তথাকথিত ভাবমূর্তি’র দোহাই তুলে কয়েক শো মানুষের হত্যাকাণ্ডের ঘটনাকে ধুয়ে মুছে, বেছে বেছে প্রকাশের ফলে জেনেশুনে এই হত্যাকাণ্ডে যারা শরিক হয়েছে তাঁদের অপরাধের মাত্রা যে জনসাধারণের, নীতি নির্ধারকদের, এমনকি বিদেশী ক্রেতাদের চোখে হ্রাস পাবে তা না বোঝার কোন কারণ নেই। বিজিএমইএ’র নেতাদের আমাদের সে পরামর্শ দিচ্ছেন কিনা সেটাও ভেবে দেখার দাবি করে।
আমি অনুমান করি যে ভাবমূর্তি বিষয়ে সরকারের মধ্যেও এই ধরণের একটা প্রবণতা রয়েছে। অন্যথায় এ রকম একটা বিপর্যয়ের পর উদ্ধার অভিযানের জন্যে আন্তর্জাতিকভাবে সাহায্য না চাওয়ার পেছনে আর কী কারণ থাকতে পারে? পৃথিবীর সে কোন দেশই এই ধরণের পরিস্থিতিতে অন্যদের সাহায্য নিয়ে থাকে। একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। ২০১০ সালে চিলি’তে একটি খনিতে ৩৩ জন শ্রমিক আটকে পড়ার পর তাঁদের উদ্ধার অভিযানে চিলির সরকার কেবল যে অন্যান্য দেশের সরকারী পর্যায়ের অভিজ্ঞতা, বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ এবং সাহায্যই নিয়েছিল তা নয় তাঁরা যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা’র সাহায্যও নিয়েছিল। কিন্ত সাভার থেকে কয়েক শো মাইল দূরে কলকাতায় কংক্রিট কাটার যন্ত্র ও ধসে পড়া ভবনে কেউ জীবিত আছে কি না তা দূর থেকে নিরূপণ করার যন্ত্র থাকলেও তার জন্যে ভারতকে অনুরোধ করতে সরকারের দ্বিধার পেছনে কী কারণ কাজ করতে পারে তা বোধগম্য নয়। বিশিষ্ট প্রকৌশলী জামিলুর রেজা চৌধুরী জানিয়েছেন যে, ‘বাংলাদেশ জাতিসংঘ উদ্ধারকারী সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল সার্চ অ্যান্ড রেসকু অ্যাডভাইজরি গ্রুপ (আইএনএসএআরএজি) মাধ্যমে আমাদের পাশের দেশ থেকে উদ্ধারকাজ পরিচালনার জন্য সহায়তা চাইতে পারত। প্রসঙ্গত, ভারতে ন্যাশনাল ডিজাস্টার রেসপন্স ফোর্স (এনডিএফ) ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং তাদের একটি দল কলকাতায় রয়েছে’। দুর্যোগ মোকাবেলায় এশিয়ায় জাপানের এক ধরণের দক্ষতা রয়েছে বলেই বলা হয়ে থাকে। ভূমিকম্প প্রবণ বলে দেশের বড় বড় ভবন ধ্বস মোকাবেলার অভিজ্ঞতা জাপানের রয়েছে। কিন্ত জাপানের কাছে কোন রকম অনুরোধ করা হয়েছিলো বলে আমরা জানি না। এর কারণ হিসেবে সরকারের অনাগ্রহের পেছনে দেশের ভাবমূর্তির ফাপা গল্প যদি কাজ করে থাকে তবে আমি অন্তত অবাক হবোনা। ক্ষমতাশালীদের কাছে দেশের ভাবমূর্তি একটা বায়বীয় ব্যাপার, তাঁরা বুঝতে পারেন না যে নাগরিকদের অবদানই এই ভাবমূর্তির ভিত্তি।
প্রথম আলো’তে প্রকাশিত
This post has already been read 14 times!