December 30, 2024

ঘটনা ঘটার মাত্র পাঁচ বছরের মাথাতেই , ইচ্ছেয় হোক আর অনিচ্ছায় হোক, অনেক তথ্য গুলিয়ে ফেলেছে এদেশীয় শিক্ষিত জনগোষ্ঠী। ২০১২ সনের ২৯শে সেপ্টেম্বরে রামুতে ঘটে যাওয়া সহিংসতার কথা বলছি। বিদ্বানরা এখন নির্দ্বিধায় বলতে শুরু করেছেন- এই হামলার পেছনে রোহিঙ্গারা জড়িত ছিল! কলাম লেখক রেহনূমা আহমেদসহ সকল বন্ধু যারা “রামু সাম্প্রদায়িক সহিংসতা সংকলন” বের করার কাজে যুক্ত ছিলেন তাদেরকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। ভাগ্যিস বইটা করেছিলাম, নয়ত দিনকে রাত বানিয়ে হাজির করত এই “ভুলে যাওয়া” রোগে আক্রান্ত বিদ্বান ব্যক্তিবর্গ।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে (ফেসবুক) অন্য এক লেখায় দেখলাম- গত বছরের নভেম্বরে গোবিন্দগঞ্জে আদিবাসী-বাঙালী প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উপর ঘটে যাওয়া ভয়াবহ হামলার বিষয়েও অনেক তথ্য গুলিয়ে ফেলেছেন লেখক। সরকার দলীয় এক নেতাকে একটি বেসরকারি টেলিভশনে বলতে শুনেছি- আদালতের নির্দেশে পুলিশ সাঁওতাল পল্লী উচ্ছেদ করেছে!! সেই অনুষ্ঠানে হাজির থাকার সুযোগ হয়েছিল বিধায় এরকম ডাহা মিথ্যার প্রতিবাদ করা সম্ভব হয়েছিল। নাজানি কত মিথ্যা ভেতরে ভেতরে ডালপালা মেলছে! তবে এ এক অভাবনীয় ক্ষমতা- ভুলে যাওয়া। ভুলে যেতে পারা। এনিয়ে বৌদ্ধ “জাতক” এ বেশ মজার কিছু উপদেশমূলক গল্প আছে। সেসব নিয়ে পরে একসময় লিখবো।

বার্মার সাম্প্রতিক গণহত্যা অন্য অনেক বিষয়ের সাথে কিছুটা হলেও ধর্ম পরিচয়কে সামনে নিয়ে এসেছে। ধর্ম চিন্তা একদিকে মানুষকে যেমন বিভাজিত করে তেমনি অন্যদিকে যুক্তও করে। বর্তমান আলোচনায় একটি বিষয় সুস্পষ্টভাবে অনুপস্থিত-  কোন একটি নির্দিষ্ট ধর্ম বিশ্বাস নিজে বিভাজনের চরিত্র ধারণ করে কিনা?  নিজের বিশ্বাসের বাইরে গিয়ে পড়াশোনা যারা করেন, তাদের সীমাবদ্ধতাও চোখে পড়ার মত। যে যার অবস্থান থেকে মতামত দিতে থাকেন- ফলাফল হিসেবে বিভেদ বাড়তে থাকে এবং নতুন নতুন বিদ্বেষের উৎপত্তি ঘটে। যার বিশ্বাস প্রবল, তার কাছে যুক্তি নিয়ে যাওয়া এবং যুক্তি বিচারে আচরণ করতে বলা মানে, তার বিশ্বাসের উপরই আঘাত করা। কিন্তু যারা বিশ্বাসের উপর ভর করে জীবনযাপন করেননা এবং যারা “মডারেট” বলে দাবী করেন- তাদের বোঝাতে গিয়েও যে হিমশিম খেতে হয়- এটা নতুন অভিজ্ঞতা।

সামগ্রিকভাবে যে সরলীকরণ দাঁড় করানো হয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে- “অহিংসার পথ যারা বেছে নিয়েছেন জীবনযাপনের জন্যে তারাও আসলে সহিংস। অন্য যেকোন ধর্মের অনুসারীদের সাথে কোন পার্থক্য নেই।” যারা বৌদ্ধধর্মের অনুসারী তাদের বিশ্বাসের জায়গা থেকে এই সরলীকরণ ভাল লাগার কথা নয়। কিন্তু একটু ভাবলেই দেখা যাবে এর সমাধান বৌদ্ধ দর্শনেই আছে। সে ভাবনার বিস্তার খুব বেশী ঘটেনি এদেশীয় বৌদ্ধ দর্শনের অনুসারীদের মাঝে। চিন্তায় যারা কট্টর তারা বিরোধিতার জবাব যে ভাষায় দিচ্ছেন তা-ও বৌদ্ধ দর্শনের সাথে সাংঘর্ষিক। দেখা যাচ্ছে মূল বিষয়কে ছাড়িয়ে ধরমাস্ত্র প্রয়োগ করেই একটি বিশাল জনগোষ্ঠীকে ব্যস্ত রাখা গেছে। খুব সহজেই দুটো পক্ষ দাঁড় করানো গেছে- যারা একে অন্যের প্রাণ সংহার করার জন্যেও প্রস্তুত। ধর্মকে রাজনৈতিক প্রয়োজনে ব্যবহারের ক্ষেত্রে পূর্ব আর পশ্চিমের মাঝে কোন ফারাক নেই। ধর্মের ব্যবহার সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে তার চেহারা পাল্টেছে মাত্র। তার মানে যেটা দাঁড়াচ্ছে তা হল- ধর্ম দর্শনে যাই লেখা থাকুক না কেন, চাইলেই একে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক কিংবা সামাজিক প্রয়োজনে স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী ভিন্নভাবে ব্যবহার করছে, করা যায়, যাচ্ছে, অতীতেও করা গেছে। তুলনামূলক ধর্ম দর্শন নিয়ে যাদের পড়াশোনা তারা হয়ত ভাল বলতে পারবেন- ধর্মের এই দুর্বল দিকগুলোর কারণে, সঠিক জীবন দর্শন না থাকার কারণে অবিশ্বাসীদের সংখ্যা বাড়ছে কিনা। আমার নিজের কাছে অনেকগুলো বিষয় নতুন করে বেশ গোলমেলে ঠেকছে।

সাম্প্রতিক রোহিঙ্গা সমস্যা শুরু হওয়ার পর থেকে  প্রয়াত গজল শিল্পী জগজিৎ সিং এর একটি গান বেশ মনে পড়ছে- “না মে হিন্দু, না মুসলমান, মুঝে জি নে দো।” (আমি না হিন্দু, না মুসলমান, আমাকে বাঁচতে দাও।) এই আকুতি এখন অনেকের মাঝেই। পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়া রোহিঙ্গা বংশোদ্ভূত শিশুর লাশ দেখে, বর্মী সেনাবাহিনীর নির্মমতা দেখে- শুধু এই গানটির কথাই কেন যেন বারবার মনে পড়ছিল। নৃশংসতার যেসব ভিডিও বা ছবি প্রকাশ পেয়েছে তার অধিকাংশ দেখা যায়না। প্রযুক্তির কল্যাণে বিভিন্ন সূত্র থেকে ছবি ও ভিডিও চলে আসছে সারা দুনিয়ার কাছে। এরই মধ্যে বিভিন্ন মিথ্যা ছবি ও ভিডিও দিয়ে সাম্প্রদায়িক উস্কানি দেয়ার অভিযোগও উঠেছে। আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমের কেউ কেউ বর্মী সেনাবাহিনীর ভূয়া ভিডিও বানিয়ে ছেড়ে দেয়ার তথ্যও হাজির করছেন। কোন কোন সূত্রে আরএসও এবং অন্য রোহিঙ্গা যোদ্ধাদের সশস্ত্র ভিডিও ও আসছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসব নিয়ে যে খিচুড়ি পাকানো হচ্ছে তা কেকা ফেরদৌসিকেও হার মানিয়েছে। ফেসবুকও ঠিক শিক্ষিত প্রজন্মের হাতে আর সীমাবদ্ধ নেই, ফলে এখানেও কট্টর পন্থার চাষ বেশ ভালভাবেই হচ্ছে। এসব নিয়ে ট্রল করা যায়, সমালোচনা করা যায় কিন্তু সমাধান বের করা যায়না। কোন কোন ক্ষেত্রে দেখা গেছে- কারো কারো অন্তর্জালিক কর্মকাণ্ড সুস্পষ্ট ফৌজদারি অপরাধে পড়ছে- কিন্তু সেটি বোঝার মত বিদ্যাটুকুও তাদের নেই। এসবের ফাঁকে যে আলোচনা সবার সামনে থাকার কথা ছিল তা হারিয়ে যাচ্ছে। যেসব প্রশ্ন তোলা এখন সবচেয়ে বেশী জরুরী সেসব প্রশ্ন, আবেগের ঠেলায় অনেক দূরে সরে গেছে। কিছু প্রশ্ন অগোছালোভাবে পাঠকের সামনে রেখে যেতে চাই-

১। রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ সরকারের ঘোষিত অবস্থান কি? এই প্রশ্নের মূল কারণ হল- রোহিঙ্গাদের সরকারীভাবে এখনো “অবৈধ অনুপ্রবেশকারী” বলা হচ্ছে। সরকার কখনোই রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রবেশ করতে দেবে এব্যাপারে পরিস্কার করে কিছু বলে নাই। সরকারের নির্দেশে বিজিবি বর্ডার খুলে দিয়েছে এরকম দাবীও কোন পক্ষ থেকে করা হয়নি।

২। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি বলতে সংবিধানের ২৫নং অনুচ্ছেদে বর্ণিত মৌলিক ধারণা। এছাড়া, আর কোন ঘোষিত পররাষ্ট্র নীতি নেই। সংবিধানের ২৫নং অনুচ্ছেদে বলা আছে-

“The State shall base its international relations on the principles of respect for national sovereignty and equality, non-interference in the internal affairs of other countries, peaceful settlement of international disputes, and respect for international law and the principles enunciated in the United Nations Charter, and on the basis of those principles shall –

(a) strive for the renunciation of the use of force in international relations and for general and complete disarmament;

(b) uphold the right of every people freely to determine and build up its own social, economic and political system by ways and means of its own free choice; and

(c) support oppressed peoples throughout the world waging a just struggle against imperialism, colonialism or racialism.”

আমাদের পররাষ্ট্র নীতির যদি ভিত্তি এটা হয় তাহলে আমরা সকল ক্ষেত্রে একইরকম ভূমিকা রাখতে পারছি না? রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রে শুরু থেকে সেই ভূমিকা ছিল কিনা। রাষ্ট্রীয় অখন্ডতা, সমতা নিশ্চিত করার জন্যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে যথেষ্ট ভূমিকা রাখছে কিনা?

৩। রাখাইন প্রদেশে সহিংসতার পেছনে অন্য অনেক পুরনো কারণের সাথে অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে জায়গা খালি করানোর একটি তথ্যও বিভিন্ন সুত্র থেকে উঠে এসেছে। যদি তা-ই হয় তাহলে পুরো ব্যাপারটাকে বাংলাদেশের প্রেক্ষিতেও নতুন করে ভাবতে হবে। বাংলাদেশ যেখানে ক্রমাগত বৈদেশিক চাপের কারনে হোক আর নিজেদের আর্থিক লাভের  লোভে হোক- একের পর এক অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার নামে নিজ দেশের সম্পদ ধ্বংস করে চলেছে, তাতে করে ভবিষ্যতে আমাদের দেশেও একইরকম খেলা শুরু হবে কিনা এবং তার বিরুদ্ধে কি প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়া যায় তা এখনই আলোচনা করতে হবে। চট্টগ্রামের বাঁশখালী এবং খুলনার সুন্দরবন অঞ্চলে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপন, ফুলবাড়ির উন্মুক্ত কয়লা উত্তোলন চেষ্টা, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে প্রান্তিক আদিবাসী-বাঙালী জনগোষ্ঠীকে উচ্ছেদ করে রপ্তানী প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল প্রতিষ্ঠা কিংবা চাবাগানের ক্ষেতল্যান্ড ধ্বংস করে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করার পরিকল্পনা বৃহৎআঙ্গিকে এসব আন্তর্জাতিক/আঞ্চলিক রাজনীতির অংশ ছাড়া আর কিছুই নয়। এসব ভূরাজনৈতিক উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্যে এমন অনেক “চালু বিষয়”কে সামনে নিয়ে আসতে হয় যার ক্ষেত্র ইতিমধ্যেই প্রস্তুত হয়ে থাকে। ধর্মীয় সংঘাত, জাতিগত সংঘাত এমন সব বিষয় নিয়ে সারা বিশ্ব যেভাবে তাতিয়ে উঠেছে তাতে এসব অজুহাত তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাঁধানোরও ক্ষমতা রাখে। সবাই ভুলে যেতে পারে কিন্তু যাদের দায়িত্বই হলে অন্যদের জাগিয়ে রাখা- তাদের কাজ ভুলে গেলে চলবে কেন? তাই দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি হয়ে যাবার আগেই আমাদের ঘুরে দাঁড়াতে হবে। রোহিঙ্গা সমস্যা আভ্যন্তরীণ এমন অনেক রকমের সমস্যা তৈরি করবে যা হয়ে উঠবে ভূরাজনৈতিক চালের অন্যতম গুটি।

৪।  রোহিঙ্গাদের উপর দীর্ঘ সময় ধরে যে গণহত্যা চালাচ্ছে বর্মী সেনাবাহিনী তার ফলে আভ্যন্তরীণ বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত হচ্ছে বাংলাদেশ। সেই ১৯৭৮ সাল থেকেই থেমে থেমে এই গণহত্যা চলছে। তাহলে এখন প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক- বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এই গণহত্যা বন্ধে কি পদক্ষেপ নিয়েছে? আন্তর্জাতিক বিচারালয়ে বিচার দেয়ার মত যথেষ্ট পরিস্থিতি কি ১৯৭৮ সন থেকে কখনোই সৃষ্টি হয়নি? এখানে মনে রাখা দরকার- আন্তর্জাতিক বিচারালয়ে অভিযোগ উত্থাপন করতে হলে রাষ্ট্রকেই করতে হয় অপর কোন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে বার্মার বিরুদ্ধে গণহত্যা বন্ধে এই অভিযোগ দায়ের করতে কোন আইনি বাধা নেই। তবে এই অভিযোগ দায়ের করার আগে আঞ্চলিক রাজনীতির অনেক কিছুই হয়ত বিবেচনায় নিতে হবে। সেসবই হয়ত বাধা হিসেবে কাজ করছে। সব বাধা পেরিয়ে মানবতার স্বার্থে হলেও বাংলাদেশকে কোন না কোন সময় এই পদক্ষেপ নিতেই হবে।

৫। রোহিঙ্গাদের জাতিসত্তা নির্ধারণে একটি কথা বর্মী সামরিক জান্তারা বরাবরেই বলে আসছেন যে, তারা বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত। যদি দীর্ঘ সময় ধরে এই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বার্মায় বসবাস করে থাকেন, সেদেশের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করে থাকেন, তাহলে তারা বাংলাদেশী হতে যাবেন কোন যুক্তিতে? হবিগঞ্জের চুনারুঘাট চা বাগানের ক্ষেতল্যান্ড রক্ষা আন্দোলনকারীদের সাথে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি- ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ব্রিটিশ শাসনামলে আসা অনেক জনগোষ্ঠীকে কেউ কেউ এখনো ভারতীয় বলে দাবী করার চেষ্টা করেন। তারমানে জাতিসত্তা নির্মাণ সবসময়ে নিজের ইচ্ছায়ও যে হয়না, তার ক্ল্যাসিক উদাহারণ এটি। আমাদের সংবিধান যেমন বলে দিয়েছে- পাহাড়ে বসবাসরত জাতি, গোষ্ঠীগুলো “ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী” কখনো বা “উপজাতি”। অনেকটা উনমানুষ বলে দেয়ার মত। রোহিঙ্গাদের প্রতিও একই চাপিয়ে দেয়া চলছে। রোহিঙ্গাদের প্রতি যে অযৌক্তিক পরিচয় চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে, সেখান থেকে আমরা নিজেদের জন্যে কি পাঠ নিচ্ছি সেই বোঝাপড়া তৈরি করা দরকার।

Leave a Reply