কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবীতে এক পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষার স্বপ্নবুনে শাহবাগ আন্দোলনের যাত্রা শুরু হয়েছিলো ২০১৩ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারী, অন্যরকমের এক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের মধ্য দিয়ে। এই পরিবর্তনের আকাংখা মূলত উৎসারিত হয়েছিলো রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ন্যায়-বিচারের মূল্যবোধ চর্চা নিশ্চিতকরনের একান্ত মধ্যবিত্তীয় চেষ্টা থেকে। যুদ্ধপরাধীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর ব্যর্থতা সেই ন্যায়-বিচারের মূল্যবোধ চর্চার প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তির অনুপস্থিতির কারণেই ঘটেছে। এই ন্যায়-বিচারের মূল্যবোধই ছিলো আমাদের মুক্তিযুদ্ধের, আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশের প্রকৃত চেতনা, যার বাস্তবায়ন কিংবা এর ন্যুনতম চর্চা এই রাষ্ট্র গত ৪৩ বছরেও করেনি।
বরঞ্চ রাজনৈতিক কৌশলের নামে সময়ে সময়ে সব ক্ষমতাসীন দল মিলে এই বাংলাদেশ রাষ্ট্রটিকে মূল্যবোধহীন এক সার্বিক জনকল্যান-বিমুখী রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে পরিনত করেছে। বিএনপির যেমন আদর্শগত দায়বদ্ধতা না থাকার কারণে অসাম্প্রদায়িক-বাংলাদেশ-বিরোধী জামায়াত ইসলামের সাথে ক্ষমতার ভাগাভাগিতে আপত্তি নেই, তেমনি আওয়ামীলীগেরও ক্ষমতায় টিকে থাকা কিংবা ক্ষমতায় যাওয়ার প্রশ্নে জামায়াত ইসলামের সাথে যৌথ আন্দোলনে অথবা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগানো স্বৈরাচারী এরশাদকে কাছে টানার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় কোনো চিন্তা নেই! তাই নির্বাচন এলে ভোটাররাও বেমালুম ভুলে যায় আগের সময়ে ক্ষমতায় থাকা দলের অপকর্মের কথা অথবা তাদের মধ্যে আপাত বিরাজমান আদর্শগত পার্থক্যের কথা। আর এটা ঘটে মূলতঃ মূল্যবোধহীন অপকৌশলী রাজনীতি চর্চার দাপটে, অথবা পূর্বে ক্ষমতায় থাকা বর্তমানের বিরোধী জোটের সব অপকর্ম ঢাকা পড়ে যায়, বর্তমানের ক্ষমতাসীন জোটের অপশাসনে! অন্ততঃ ১৯৯০ পরবর্তীকালে ২০১৪ সালের “বিতর্কিত” জাতীয় নির্বাচনের আগ পর্যন্ত এটাই ছিলো আমাদের দেশের নির্বাচনী রাজনীতির একটি স্বাভাবিক ধারা।
তাদের এই মূল্যবোধহীন রাজনৈতিক কৌশলের সবচাইতে বেশি ফলপ্রসু ব্যবহার ঘটছে মূলতঃ রাষ্ট্রের সম্পদ লুটপাট, দুর্ণীতি, স্বার্থান্বেষী ব্যবসায়ীগোষ্ঠীর লালন, অপকর্ম পরায়ন অসৎ বিত্তশালীদের মাঝে রাজনৈতিক ক্ষমতার বণ্টণ, স্থানীয় ও সকল ধরণের প্রতিষ্ঠানিক পর্যায়ে মাস্তানবৃত্তি শক্তিশালীকরণ এবং দেশব্যাপী অপশাসন বিস্তারে। আর রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকাকালীন এই দুই রাজনৈতিক গোষ্ঠীর সময়ে সময়ে বিতরনকৃত রাষ্ট্রীয়, প্রশাসনিক, ব্যবসায়িক এবং আর্থিক সুবিধা পাওয়া অথবা সুবিধা পাওয়ার আকাংখাকে কেন্দ্র ক’রে আমাদের সমাজে বিকাশ ঘটেছে এক চাটুকার শ্রেণি, যার অন্তর্ভূক্ত হয়েছে এক ধরণের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, সাংবাদিক, লেখক-সাহিত্যিক থেকে শুরু ক’রে এনজিও মালিক পর্যন্ত। তাদের স্বাধীন সত্ত্বা এখন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে রাষ্ট্র ক্ষমতা, মুনাফার বাজার আর অপরাজনীতির মাঝে! এমনকি স্বাধীনতার সপক্ষ শক্তি বলে দাবী করা মানুষগুলোও মূল্যবোধের আর সার্বিক জনকল্যান নিশ্চিত করার তাগিদে তাদের চোখে প্রগতিবিরোধী অন্য মানুষগুলোর সাথে মোটা দাগে মৌলিক কোনো পার্থক্য তৈরি করতে এখন পর্যন্ত সমর্থ হয়নি।
অবশ্য ঐসব মূলবোধহীন অপকৌশলী রাজনীতির চর্চাকে আড়াল করা এবং সম্ভাব্য রাজনৈতিক সমর্থণহীনতা ও বৈধতার সংকট এড়ানোর জন্য, এই দুই রাজনৈতিক গোষ্ঠী সময়ে সময়ে দুটি হাতিয়ার মোক্ষমভাবে ব্যবহার করে থাকে। এজন্য এক গোষ্ঠীর কাছে আছে “মুক্তিযুদ্ধের চেতনা” আর অপরটির “ইসলামী চেতনা”। কেননা এই দুই চেতনার ‘রাজনৈতিক বাজার মূল্য’ অনেক বেশি, এই মূল্যবোধহীন সার্বিক জনকল্যাণবিচ্ছিন্ন সংখ্যাগরিষ্ঠতার আবেগ নির্ভর বর্তমান রাজনীতিতে। রাষ্ট্রও এখন অতীতের ধারাবাহিকতায় একটা জগাখিচুরী রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিকশিত হয়েছে। একদিকে নিজেকে বলছে ধর্ম নিরপেক্ষ, আবার ধর্মের পরিচয়ে “ইসলামী”!
তাই মানুষকে ধারণ করা, তার কাছাকাছি থাকা এবং জনকল্যান নিশ্চিত করার জন্য মূল্যবোধসম্পন্ন অন্য সব উপায়ই যখন অবলুপ্ত হয়েছে, তখন অপরাজনীতিই তাদের একমাত্র ভরসা। অপরাজনীতির এই কাঠামো সমাজের একটা দূর্বৃত্ত চক্রকে গত ৪৩ বছরে রাষ্ট্রশক্তি অর্জনের একটা পথ তৈরি করে দিয়েছে। তাই এই দুই রাজনৈতিক গোষ্ঠীর কাছে দূর্বৃত্ত-নেতাদের রাজনৈতিক মূল্য এবং কদর – এই দুই-ই অনেক বেশি – একজন সাধারণ মানুষের চাইতে! তাই যে কোনো নির্বাচনে মনোনয়ন পাওয়ার ক্ষেত্রে এদের দাপটটাই বেশি থাকে। সাগর-রুনি, বিশ্বজিতদের কিংবা ত্বকীদের মতো মায়াবী শিশুদের কোনো মূল্য নেই এদের কাছে। গ্রেনেড দিয়ে অথবা অন্য কোনো উপায়ে নিজেদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হত্যা করতে এদের বাঁধেনা। কোনো নিরাপরাধ মানুষকে “জজ মিয়া”, “লিমন” বানাতে এদের অন্য কোনো চিন্তার প্রয়োজন পড়েনা। এদের কাছে সবাই আমরা “আল্লাহর মাল”! তাই স্বাভাবিক মৃত্যুর পরিবর্তে তারা নিজেরাই দায়িত্ব নিয়ে নেয়, মানুষজনকে আসল গন্তব্যে পাঠানোর! এদের কারো মুখ থেকেই অবলীলায় উচ্চারিত হয়, “ক্রেষ্ট চাইনা, ক্যাশ চাই”!
কাদের মোল্লার ফাঁসীর দাবীতে সূচিত শাহবাগ আন্দোলনের অন্ততঃ প্রথম কয়েকদিন, এই দুই “চেতনা” ব্যবসা কেন্দ্রিক রাজনীতি চর্চার বিপরীতে মূল্যবোধকামী শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণির আকাংখার স্রোত তৈরিতে সমর্থ হয়েছিলো। সেই আকাংখার প্রকাশও ঘটে যথারীতি নতুন নতুন শ্লোগানের প্রচলনের মধ্য দিয়েই। এর মধ্যে দুটি শ্লোগান ছিলো খুব গুরুত্বপূর্ণ। তার একটি হলো “ধর্ম যার যার, দেশ সবার” এবং অপরটি “জয় বাংলা, জয় জনতা”। দুটি শ্লোগানই উৎসারিত হয়েছে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ এবং জনমানুষের সাথে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিচ্ছিন্নতার যে সম্পর্ক এবং সংকীর্ণ দলীয় আধিপত্য তৈরি হয়েছে, তা দূর করার আকাঙ্ক্ষা থেকেই। তবে এই আকাংখা, দুই প্রধান রাজনৈতিক জোটের প্রচলিত অপরাজনীতির বিপরীত এবং শক্তিশালী স্রোত ছিলো বলেই, এদের দ্বারাই শাহবাগ আন্দোলন শেষ পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছে।
এক পক্ষ এই আন্দোলনকে রাজীবকে হত্যার মধ্য দিয়ে নাস্তিকদের আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত করে এই আকাংখার স্রোতকে দূর্বল করেছে। আর অন্যপক্ষ নিজেদের সমর্থিত এবং সমমনা তরুণদের দ্বারা শাহবাগ আন্দোলনের উপর আধিপত্য তৈরি ও শাহবাগ আন্দোলনের নেতৃবৃন্দকে নিরাপত্তার নামে গানম্যানসহ রাষ্ট্রের অন্যান্য সু্যোগ-সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে এই আন্দোলনের সনাতনী রাষ্ট্র বিরোধী প্রতিবাদী চরিত্র পাল্টাতে এবং তার নৈতিক ভিত্তি বিনষ্ট করে দিতে সক্ষম হয়েছে বহুলাংশে। ক্ষমতাসীন জোট এটাও নিশ্চিত করতে সমর্থ হয়েছে যে, এই আন্দোলন কোনোভাবেই আর সরকার বিরোধী হবেনা। ফলে অন্তত: শহুরে মধ্যবিত্তের যে অংশটি কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবীকে ঘিরে দুই মিথ্যা চেতনার বিপরীতে সত্যিকারের ন্যায়-বিচার আর সামষ্টিক কল্যান ভিত্তিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিলো, তারা ফিরে গেলো নিজ গৃহে!
অন্যদিকে কাদের মোল্লার রায়কে ঘিরে শাহবাগ কর্মীদের শুধুমাত্র ফাঁসির দাবীতে জোর দেওয়ার কারণে এই আন্দোলনের দার্শনিক চরিত্রটিও স্পষ্ট হয়ে উঠেনি। কোনো দার্শনিক ভিত্তি দেওয়ার পরিবর্তে মূলতঃ “বাংলা পরীক্ষার দিন বাংলা পরীক্ষা দিবো”- এই চিন্তাটির কারণে আমাদের রাজনীতিতে ন্যায়-বিচারের মূল্যবোধের চর্চাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টাটি সার্বিকতা পায়নি। ঠিক একইভাবে রানা প্লাজার দূর্ঘটনায় আহতদের উদ্ধার, রক্ত প্রদানসহ ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের জন্য অনেকধরণের সহযোগিতামূলক কার্যক্রম নিলেও শাহবাগ কর্মীরা ন্যায়-বিচারের মূল্যবোধের তাগিদ থেকে ঐ দূর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের গ্রেফতার ও শাস্তির দাবীতে খুব স্পষ্ট ও জোরালো কোনো অবস্থান নেয়নি। উপরন্তু রানা প্লাজার মালিকের রাজনৈতিক পরিচিতি একটা নতুন প্রশ্ন সামনে নিয়ে এলো। আর তা হলো, এই ভবনটির মালিক যদি জামায়াত অথবা বিএনপি’র কোনো নেতা হতো, তাহলে শাহবাগ কর্মীদের অবস্থান কী হতো? আবার শ্রমিক অধ্যুষিত ঢাকার কিছু এলাকাগুলোতে (যেমন: আশুলিয়া, গাজীপুর) সমাবেশ অনুষ্ঠিত হলেও এই শাহবাগ আন্দোলন যে বঞ্চিতদের পক্ষে, শ্রমিকদের ন্যায় বিচারের পক্ষে, সেই ব্যাপারে কোন শক্তিশালী শব্দ উচ্চারিত হয়নি। তাই এই মধ্যবিত্তীয় আন্দোলনটি সমাজের বিরাজমান শ্রেণিগুলোর মধ্যে পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে কোনো যোগসূত্র স্থাপণও ক’রতে পারলোনা শেষ পর্যন্ত, বিশেষ ক’রে এই সমাজের প্রান্তিক মানুষগুলোর সাথে। আর ন্যায়-বিচারের ধারণাটি সর্বজনের না হয়ে শুধুমাত্র ফাঁসির আনুষ্ঠানিকতাকে ঘিরেই বিচ্ছিন্নভাবে আবর্তিত হলো শাহবাগ আন্দোলনে। ফলে এই ন্যায়-বিচারের মূল্যবোধটি যথারীতি আবারো নির্বাসিত হলো সনাতনী রাজনীতির ঘেরাটোপে এবং সংকীর্নতায়! শাহবাগের গণ্ডীর বাইরে এই স্রোত আর পৌছাতে পারলোনা দুই অপরাজনীতির স্রোতের শক্তিকে দূর্বল ক’রে দিয়ে, রাষ্ট্রের অপশক্তি ব্যবহারের বিপরীতে!
সার্বিকভাবে যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসি নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে শাহবাগ আন্দোলনের সাফল্য জন-মানুষের আকাঙ্ক্ষার একটা নতুন জমিন প্রদান করতে পারলেও অন্য আরেকটি বিপদ তৈরি হলো ভবিষ্যতের জন্যে। আর তা হলো আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন বিক্রি হয়ে যাওয়ার আশংকা, ভয় ইত্যাদি বরাবরের মতো আবার ফিরে আসা। এই আশংকা দূরে ঠেলে মধ্যবিত্ত আবার কোনো পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে আবার স্বতঃস্ফুর্তভাবে শাহবাগে ফিরে আসবে কিনা সেই সম্পর্কে কোনো ধনাত্বক উত্তর দেওয়া এই মুহূর্তে সম্ভব নয়। এরকম আন্দোলনে প্রান্তিক মানুষের অংশগ্রহণ তো আরো অনেক অনেক দূরের পথ! তবে অনেক দূর্বলতার পরও কাদের মোল্লার ফাঁসি অন্ততঃ এটা নিশ্চিত করেছে যে, শাহবাগ আন্দোলনের টিকে থাকা জরুরি যতক্ষণ পর্যন্ত সকল যুদ্ধপরাধীর বিচার কার্যক্রম সমাপ্ত না হয়, যদিও ন্যায়-বিচারের মূল্যবোধকেন্দ্রিক অন্য আকাংখাগুলো ধারণ করার ক্ষমতা হারিয়েছে শাহবাগ আন্দোলন তথা গণজাগরণ মঞ্চ বহু আগেই। তবে গত ৪৩ বছরের গ্লানি কিছুটা হলেও দূর হলো কাদের মোল্লার ফাঁসীর মধ্য দিয়ে। তাই সব কিছু মিলিয়ে শাহবাগ এখনো ন্যুনতম ভরসার জায়গা, আকাঙ্ক্ষার জায়গা, অনেক সমালোচনার পরেও। আর সার্বিক মূল্যবোধের দর্শন নির্ভর আরেকটা সার্বজনীন শাহবাগ ছাড়া আমাদের মুক্তির আর অন্য কোনো উপায় নেই, এটাও অন্তত বলা যায় আমাদের দেশের জনকল্যাণ বিমুখ মূলধারার রাজনীতি এবং আমাদের রাষ্ট্র চরিত্রের চলমান প্রেক্ষাপটে।