December 30, 2024

ষোড়শ সংশোধনী বাতিলসংক্রান্ত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের দেওয়া রায়ের বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে এটা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে ১৯৭৫ সালের চতুর্থ সংশোধনী ছিল সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর পরিপন্থী। এই পর্যবেক্ষণ পাঠ করে এটা অনুমেয় যে এই আদালতে এই বিষয় আলাদা করে উপস্থিত হলে তা সর্বসম্মতভাবেই বাতিল করা হতো এবং অগণতান্ত্রিক বলেই বিবেচনা করা হতো। ফলে ১ আগস্ট সুপ্রিম কোর্টের রায়ে কেবল ষোড়শ সংশোধনীই বাতিল হয়নি, মর্মবস্তুর দিক থেকে চতুর্থ সংশোধনীও বাতিল করা হয়েছে। আদালতের এই পর্যবেক্ষণের পর আমরা দেখতে পাই যে গত ৪৭ বছরে বাংলাদেশের সংবিধানের যে ষোলোটি সংশোধনী হয়েছে, তার মধ্যে পাঁচটি সংশোধনীই সংবিধানের মৌলিক কাঠামো পরিপন্থী, অগণতান্ত্রিক ও অসাংবিধানিক বিবেচনায় দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে বাতিল হলো। এগুলো হচ্ছে চতুর্থ, পঞ্চম, সপ্তম, ত্রয়োদশ ও ষোড়শ। এর বাইরে অষ্টম সংশোধনীর একটি অংশ—ঢাকার বাইরে ছয়টি জেলায় হাইকোর্টের স্থায়ী বেঞ্চ স্থাপনসংক্রান্ত অংশটি—আগেই বাতিল হয়েছে। এই বাতিল হওয়া সংশোধনীগুলোর মধ্যে বিভিন্ন পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও কোনো ধরনের মিল কি রয়েছে, যা বাংলাদেশের সংসদীয় ব্যবস্থা এবং রাজনীতি অনুধাবনে আমাদের সাহায্য করতে পারে?

বাংলাদেশের সংবিধানের ষোলোটি সংশোধনীকে আমরা চার ভাগে ভাগ করতে পারি—মৌলিক কাঠামোগত, ব্যক্তিকেন্দ্রিক, পদ্ধতিগত ও ইতিহাস-নির্ধারিত। বাতিল করা পাঁচটি সংশোধনী যে মৌলিক কাঠামোগত, তা এসব সংশোধনী বাতিল করে দেওয়া আদালতের রায়েই বলা হয়েছে। এর বাইরেও মৌলিক কাঠামোগত সংশোধনী আছে, এই বিষয়ে আমরা কিছু পরেই আলোচনা করব। তার আগে দেখা যাক অন্যান্য সংশোধনীর মূল প্রতিপাদ্য কী।

ইতিহাস-নির্ধারিত সংশোধনী বলে চিহ্নিত করা যায় সংবিধানের প্রথম সংশোধনীকে, যাতে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের বিধান তৈরি করা হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং পরবর্তী পরিস্থিতি, বিশেষত যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত আটক পাকিস্তানি সৈন্যদের বিচারের সাংবিধানিক ভিত্তি তৈরি করার তাগিদ থেকেই এই সংশোধনী করা আবশ্যক ছিল (যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত পাকিস্তানি সৈন্যদের বিচারকে কেন্দ্র করে পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশের আলাপ-আলোচনার জন্য দেখুন, গ্যারি বাস, ‘বারগেনিং জাস্টিস অ্যাওয়ে: ইন্ডিয়া, পাকিস্তান অ্যান্ড দ্য ইন্টারন্যাশনাল পলিটিকস অব ইম্পিউনিটি ফর দ্য বাংলাদেশ জেনোসাইড,’ ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটি, বর্ষ ৪১, সংখ্যা ২, ফল ২০১৬, পৃষ্ঠা ১৪০-১৮৭)। বাংলাদেশ সরকার অপরাধীদের বিচারের কার্যকর প্রস্তুতির অংশ হিসেবেই এই সংশোধনী করেছিল।

সংসদে পাস করা দুটি সংশোধনী ছিল কার্যত ব্যক্তিকেন্দ্রিক—১৯৮১ সালে ষষ্ঠ সংশোধনীর লক্ষ্য ছিল তৎকালীন উপরাষ্ট্রপতি পদে আসীন বিচারপতি আবদুস সাত্তারের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশগ্রহণে যোগ্য করে তোলা আর একাদশ সংশোধনী করা হয়েছিল ১৯৯১ সালের আগস্ট মাসে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের প্রধান বিচারপতি পদে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করার জন্য। এসব সংশোধনী এই দুই ব্যক্তির বাইরে কাউকে কোনো ধরনের সুবিধা দেয়নি, যদিও শাসনব্যবস্থার বিবেচনায় সেগুলোর প্রতিক্রিয়া আছে।
সংবিধানের তিনটি সংশোধনীকে আমরা পদ্ধতিগত বিষয় বলেই বিবেচনা করতে পারি; এগুলো হচ্ছে তৃতীয়, নবম এবং দশম সংশোধনী। ১৯৭৪ সালের নভেম্বরে পাস করা তৃতীয় সংশোধনীর মূল বিষয় ছিল ভারতের সঙ্গে সীমান্ত নির্ধারণ চুক্তির আলোকে সাংবিধানিকভাবে দেশের সীমান্ত নির্ধারণ, নবম সংশোধনী রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সময় একই সঙ্গে উপরাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচনের বিধান এবং রাষ্ট্রপতি পদের কোনো ব্যক্তির মেয়াদ পরপর দুবারে সীমিত করে। দশম সংশোধনী পাস হয়েছিল ১৯৯০ সালের জুন মাসে সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনের মেয়াদ আরও ১০ বছর বৃদ্ধির জন্য।

২০০৪ সালে পাস হওয়া চতুর্দশ সংশোধনী একাদিক্রমে ব্যক্তিগত সুবিধা প্রদানের লক্ষ্যে এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এর অন্তর্ভুক্ত বিষয়গুলোর মধ্যে ছিল বিচারপতিসহ কয়েকটি সাংবিধানিক পদের চাকরির মেয়াদ বৃদ্ধি এবং নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনের সংখ্যা বৃদ্ধি। এই সংশোধনী প্রশাসনিক এবং সংসদের কাঠামোগত বলেই বিবেচিত হতো, যদি না বিচারপতিদের চাকরির মেয়াদ বৃদ্ধির পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য, অর্থাৎ পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান কে হবেন তা নির্ধারণের বিবেচনা না থাকত। প্রাসঙ্গিকভাবে আমরা স্মরণ করতে পারি যে ২০০৪ সালের ৮ মার্চ মন্ত্রিসভা যে বিল অনুমোদন করেছিল এবং আইনমন্ত্রী ১৭ মার্চ সংসদে যে বিল উত্থাপন করেছিলেন, সেখানে এসব সাংবিধানিক পদের (অর্থাৎ বিচারপতি, কম্পট্রোলার ও অডিটর জেনারেল, পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের) অবসরের বয়স বৃদ্ধির বিতর্কিত বিধান ছিল না। এই ধারাগুলো যুক্ত করা হয়েছিল বিলটি পার্লামেন্টারি স্ট্যান্ডিং কমিটির কাছে পাঠানোরও পর—২০ এপ্রিল। পরে এই সব বিধানসংবলিত সংশোধিত বিল মন্ত্রিসভায় পাস করিয়ে স্ট্যান্ডিং কমিটিতে আবার পাঠানো হয় এবং ১৬ মে ২০০৪ সালে তা পাস হয়। যদিও এই সংশোধনীর বিষয় দৃশ্যত মৌলিক কাঠামোগত নয়, তথাপি এর প্রতিক্রিয়া শেষ পর্যন্ত সংবিধান, নির্বাচন এবং শাসনব্যবস্থার ওপরেই পড়েছে।

এই হিসেবে সংবিধানের নয়টি সংশোধনীকে আমরা মৌলিক কাঠামোগত বলে বিবেচনা করতে পারি। এগুলো হচ্ছে দ্বিতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম, সপ্তম, অষ্টম, দ্বাদশ, ত্রয়োদশ, পঞ্চদশ ও ষোড়শ। এর মধ্যে দ্বিতীয় সংশোধনী, যা দেশে জরুরি অবস্থা জারির বিধান যুক্ত করেছে, সেটিতে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে—দ্বিতীয় সংশোধনী এই ক্ষমতা দিয়েছিল রাষ্ট্রপতির হাতে, যা দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে কার্যত প্রধানমন্ত্রীর হাতেই সমর্পণ করা হয়েছে। অন্যদিকে অষ্টম সংশোধনীর যে অংশটুকু এখন বহাল আছে তা হলো রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে সংবিধানে সংযুক্তি। সেটিও পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমেই এখন সংবিধানে যুক্ত। আদালত কর্তৃক পাঁচটি সংশোধনী বাতিলের পর কার্যত মৌলিক কাঠামোগত সংশোধনীর দুটি টিকে আছে; দ্বাদশ সংশোধনী (রাষ্ট্রপতিশাসিত ব্যবস্থার বিলোপ ঘটিয়ে সংসদীয় ব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তন) এবং পঞ্চদশ সংশোধনী (তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থার বিলোপ)। এই দুইয়ের মধ্যে পঞ্চদশ সংশোধনী যে বিতর্কিত তা ২০১৪ সালের একপক্ষীয় নির্বাচন যেমন তার প্রমাণ, তেমনি আগামী নির্বাচনও সবার অংশগ্রহণমূলক, গ্রহণযোগ্য ও সুষ্ঠু হবে কি না, সে বিষয়ে সংশয়ও তার উদাহরণ; তদুপরি ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায়ে আর দুটি নির্বাচন এই ব্যবস্থায় করার যে পর্যবেক্ষণ ছিল তা ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ে উল্লেখ লক্ষণীয়। এই রায়ে প্রতিষ্ঠানের অনুপস্থিতির উদাহরণ হিসেবে নির্বাচন কমিশনের কথাও আমাদের নজর এড়ায় না।

সংবিধানের যে সংশোধনীটি প্রশ্নাতীতভাবে বিতর্কের ঊর্ধ্বে আছে তা হচ্ছে দ্বাদশ সংশোধনী, যা পাস হয়েছিল পঞ্চম সংসদে, সরকার এবং বিরোধী দলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়। শুধু তা-ই নয়, বাংলাদেশের এযাবৎকালের দশটি সংসদের মধ্যে যে দুটি সংসদে বিরোধী দলের আসন ছিল উল্লেখযোগ্য এবং বিরোধী দল শক্তিশালীভাবে আচরণ করতে পেরেছে, এটি তার একটি। লক্ষ করলে এ–ও দেখা যাবে যে এই সংসদ নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের দিক থেকে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের ফারাক ছিল সামান্যই (যথাক্রমে ৩০ দশমিক ৮১ শতাংশ এবং ৩০ দশমিক ০৮ শতাংশ)। বিরোধী দলের উপস্থিতি ও অংশগ্রহণের মধ্য দিয়েই দ্বাদশ সংশোধনী পাস করা হয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, এই সংশোধনী পরে এক গণভোটের মাধ্যমে নাগরিকদের সম্মতি লাভের পরই তা কার্যকর হয়। একইভাবে স্মরণ করা দরকার যে সপ্তম সংসদ যেখানে বাংলাদেশের সংসদীয় ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বিরোধী দল ছিল, সেই সংসদ সংবিধানের কোনো ধরনের মৌলিক পরিবর্তনের চেষ্টাই করেনি।

সংবিধানের মৌলিক কাঠামোগত পরিবর্তনসংবলিত সংশোধনী পাসের অধিকাংশ ঘটনাই ঘটেছে এমন ধরনের সংসদে, যেখানে সরকারি দলের একচ্ছত্র আধিপত্য বহাল ছিল; চতুর্থ, পঞ্চম, সপ্তম, অষ্টম, ত্রয়োদশ, পঞ্চদশ ও ষোড়শ সংশোধনী পাস হয়েছে এমন সব সংসদে যেখানে ক্ষমতাসীন দল (বা তার জোটসঙ্গীদের) দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসন ছিল। এখন দেশের সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক ষোড়শ সংশোধনীকে মৌলিক কাঠামোগত বলে বর্ণনা করে তা বাতিলের সিদ্ধান্তে এটা প্রমাণিত বলেই বিবেচনা করা দরকার যে একক দলের নিরঙ্কুশ সুপার মেজরিটি যেকোনো রাজনৈতিক দলকে যে শক্তি প্রদান করে তার অপব্যবহারের ফলে সংবিধানের মৌলিক ভিত্তিই আক্রান্ত হয়। অতীতে বিভিন্ন সংশোধনী বাতিলের রায়ের মধ্যেই এই বার্তা ছিল, কিন্তু ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ে বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতির যে চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, তার পাশাপাশি আমাদের এই বিষয়টিও বিবেচনায় নেওয়া দরকার।

প্রথম আলো’তে প্রকাশিত ৫ আগস্ট ২০১৭

Leave a Reply