November 20, 2024

সূত্রঃ http://goo.gl/H6aTBT

গত দুদিন ধরে দেশের বিভিন্ন জায়গায়, বিশেষত ঢাকায়, যে ঘটনাবলি ঘটেছে এবং ঘটছে তা একেবারে অভূতপূর্ব এমন বলা যাবে না; নৈতিক বিবেচনায় অনাকাঙ্খিত ও অপ্রত্যাশিত বলে মন্তব্য করা গেলেও একে অভাবনীয় বলার কোনো সুযোগ নেই। যারা এমন হবে না বলে ভাবছিলেন তাঁদের পৃথিবী বাস্তবের বাংলাদেশ থেকে দূরে বলেই মনে করতে হবে। এর সুস্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিলো ৩১ ডিসেম্বরে ঢাকায় অনুষ্ঠিত তিনটি সংবাদ সম্মেলনেই। বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার ৭ দফা প্রস্তাব উপস্থাপনার পরপরই ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে চটজলদি তা প্রত্যাখান করা থেকেই এটা বোধগম্য ছিলো বিএনপি যাই বলুক না কেন তাঁদের কোনো রকম সমাবেশ করতে দেয়া হবে না। এর পাশাপাশি মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সংবাদ সম্মেলনে ২০১৪ সালের মানবাধিকার পরিস্থিতির যে চিত্র আমরা দেখতে পাই তা কমবেশি সকলের জানা থাকলেও পুরো চিত্র একত্রে আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় দেশে বিরাজমান ‘রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা’র মূল্য কে দিয়েছেন, কীভাবে দিয়েছেন। একার্থে এ ছিলো ২০১৫ সালে কি ঘটতে পারে তাঁর রেখাচিত্র। সেখানে অবশ্যই সরকার বিরোধীদের অধিকার রক্ষা ও প্রয়োগের কোনো নিশ্চয়তা নেই, থাকবার কথাও নয়। থাকবার কথাও নয় এই কারণে যে এই অবস্থার সূত্রপাত গত কয়েক দিনে হয়নি। এক বছর আগে এক-তরফা নির্বাচনের মধ্য দিয়েই নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিলো। নির্বাচনের পরপরই প্রথম সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানিয়ে দিয়েছিলেন যে ‘সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা’র নির্বাচন মানে অচিরেই আবার নির্বাচন নয়। ফলে এখন যা ঘটছে তাকে ‘স্বাভাবিক’ বলেই ধরে নিতে হবে, যদিও তার জন্যে অপূরনীয় ক্ষতি স্বীকার করতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।
গত এক বছরে এই কথা বহুবার এ কথা বলা হয়েছে যে নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার আত্মঘাতী সিদ্ধান্তের ফলে বিএনপি সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে। তাঁদের এই বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমতের অবকাশ নেই যে গত এক বছরে সাংগঠনিকভাবে বিএনপি ভয়াবহভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। এই ক্ষতির সূচনা হয়েছিলো দলটি ক্ষমতায় থাকার সময়েই, কিন্ত তা দিনে দিনে বৃদ্ধি পেয়েছে পরের বছরগুলোতে। আন্দোলনের সহযোগী নির্ধারন কিংবা কৌশল নির্বাচন কোনো বিষয়েই বিএনপি এবং তাঁর নেত্রী খালেদা জিয়া প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন বলে কেউ দাবি করতে পারবেন না। বিএনপি গত কয়েক বছরে জনগণের সামনে এমন কোনো কর্মসূচি উপস্থিত করেনি যাতে করে দল হিশেবে জনসম্পৃক্ততা বাড়বে, খালেদা জিয়ার ঘোষিত ৭ দফা প্রস্তাবেও তাঁর কোনো ইঙ্গিত নেই। উপরন্ত তাঁর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে লন্ডন প্রবাসী তারেক রহমানের ক্ষেত্রবিশেষে অসময়োচিত, ক্ষেত্রবিশেষে অজ্ঞতাপ্রসূত, কিন্ত সামগ্রিকভাবে ঔদ্ধত্যপূর্ণ এবং অশোভন কিছু বক্তব্য। শেখ মুজিব প্রসঙ্গে তাঁর সাম্প্রতিক বক্তব্যসমূহ এই ধারার সবচেয়ে বড় উদাহরণ। এগুলো বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে দলের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি করেছে এই দাবি করতে পারেন কারা সেটা পাঠকেরা জানেন, এ বিষয়ে বাক্য ব্যয়ের দরকার নেই। এ কথা বলা বাহুল্য যে, অনুপস্থিত শেখ মুজিবকে নেতৃত্বের আসনে রেখেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিলো।
গত এক বছরে দল হিশেবে বিএনপি তার ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পারেনি। সরকারি দলের নেতা-নেত্রীরা বারংবার তা মনেও করিয়ে দিয়েছেন। কিন্ত গত দু’দিনে তাঁরা নিজেদের বক্তব্যকেই অসার প্রমাণ করলেন কী না সেটা তাঁরা ভেবে দেখতে পারেন। যাকে তাঁরা এতদিন ধরে ‘সাংগঠনিকভাবে দুর্বল’ এবং ‘দিকভ্রান্ত’ একটি ‘ক্ষুদ্র’ দল বলে বর্ননা করেছেন তাকে মোকাবেলা করতে ক্ষমতাসীন দলকে এইভাবে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করতে হলো কেন সেটা নিশ্চয় তাঁরা ভেবে দেখবেন। নৈতিক শক্তির অভাব সব সময়ই ক্ষমতাসীনদের বল প্রয়োগের ওপরে নির্ভরশীল করে তোলে। একতরফা নির্বাচনের পর থেকে সরকার-বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি জোরদার না হলেও ক্ষমতাসীনরা বারবারই শক্তি প্রয়োগের পথ বেছে নিয়ে তাঁদের দুর্বল অবস্থানেরই জানান দিচ্ছেন। তাঁদের আচরণের ফলে সাধারণ নাগরিকদের মনে এই ধারনা আরো জোরদার হবে যে, রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলার ব্যর্থতার কারণেই সরকার ও ক্ষমতাসীন দলকে বড় বড় আকারের ট্রাকের মতো জিনিশের আশ্রয় নিতে হয়েছে।
সরকার সমর্থকরা বলবেন যে বিএনপি’কে সমাবেশ করতে দিলে অরাজকতা ও নাশকতার বিষয়ে সরকার নিশ্চিত ছিলেন। সেটা যদি সত্য বলেই ধরে নেই তাহলে কি এটাই মেনে নিতে হবে যে জনগণকে এই বিষয়ে তাঁরা গত একবছরেও বোঝাতে পারেন নি? জনগণকে সম্পৃক্ত করে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে বিএনপি ব্যর্থ হয়েছে এই সত্য আর কারো চেয়ে ক্ষমতাসীনদেরই বোঝার কথা আগে। সেই সত্য জানাবোঝার পরও ক্ষমতাসীনরা কেন জনসাধারণকে বোঝাতে পারছেন না যে বিএনপি তাঁদের জন্যে কতটা ক্ষতিকর? বিপরীতক্রমে সরকারী দলের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধির বদলে রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপরে, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর ওপরে নির্ভর করেই দেশ পরিচালনা করতে হচ্ছে কেন?
প্রাসঙ্গিকভাবে অনেকেই জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে বিএনপি’র সখ্যের কথা এবং জামায়াতের ভূমিকার কথা বলবেন; তাঁদের বক্তব্য অনুযায়ী বিএনপিকে সমাবেশ করতে দেয়ার অর্থ জামায়তের কর্মিদের মাঠে নামার সুযোগ তৈরি করা। এই কথার অর্থ এই দাঁড়ায় কী যে বিএনপি ছাড়া জামাত তাঁর কার্যক্রম চালাতে পারছে না? যদিও জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় নি, কিন্ত তাঁদের কার্যক্রম পরিচালনা নিষিদ্ধ দলের আকার নিয়েছে। এবং এটাও বলা যেতে পারে যে, জামায়াত বিএনপিকে বাদ দিয়েই তাঁদের কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। কিন্ত জামায়াতের ডাকে যে মানুষ সাড়া দেয় না সেটা গত কয়েক দফা ব্যর্থ হরতাল থেকেই প্রমাণিত হয়েছে, সাধারণ মানুষ নিশ্চয় এটা বুঝতে পারেন যে কাদের কখন প্রত্যাখান করতে হবে। জামায়াতের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সংগ্রামে বিজয়ী হওয়ার পথ দেখানোর কাজ নেতৃত্বের, কিন্ত শেষ বিচারে তা করবেন সাধারণ জনগণ। বিএনপি যদি সেটা না বুঝতে পারে তবে তার জন্যে দল হিসেবে বিএনপিকে মাসুল গুনতে হবে, জনগণকে সেই সুযোগ দিলে তাঁরা যে এই রকম সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধা করেন না ইতিহাস সেই স্বাক্ষ্যই দেয়। একাত্তরের গণহত্যা এবং মানবতা বিরোধী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্তদের যে বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে সেটি সম্ভব হয়েছে জনগণের আকাঙ্খার কারণেই, তাঁদের দেয়া নির্বাচনী রায়ের কারণেই এর সূচনা সম্ভব হয়েছে; এর পেছনে অনেক দিনের প্রক্রিয়া কাজ করেছে। কোনো দল চাইলেই তা বন্ধ হয়ে যাবে বলার অর্থ হচ্ছে এমন মনে করা যে জনগণের মধ্যে সেই শক্তি গড়ে ওঠেনি যা দিয়ে একই প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখা যাবে। কিন্ত জনগণের ওপরে সেই আস্থা রাখার কোনো লক্ষন নেই, ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনের আগে থেকেই তা শুরু হয়েছে গত এক বছরে তা আরো জোরদার হয়েছে।
আগামী দিনগুলোতে এই প্রবণতা আরো বৃদ্ধি পাবে। ফলে ২০১৫ সালে আমরা এই ধরণের পরিস্থিতি আরো দেখতে পাবো বলেই অনুমান করতে পারি। পাঁচ জানুয়ারিকে কেন্দ্র করে দুইপক্ষ যে অবস্থান নিয়েছে তা দেখে যারা এটা মনে করেন যে এই দফায় এক পক্ষ অন্য পক্ষকে সম্পূর্ণ পরাস্ত করতে পারবে আমি তাঁদের সঙ্গে একমত হবার কারণ খুঁজে পাচ্ছিনা। তবে এটা ঠিক যে এই বছরে এই চেষ্টা আরো শক্তিশালী আকার ধারণ করবে। এই বৃত্তচক্র থেকে বেরুবার যে পথ নেই তা নয়, কিন্ত সে পথে অগ্রসর হতে হলে ক্ষমতাসীনদেরই আগে পদক্ষেপ নিতে হবে; কারণটা সহজ – তাঁরা এখন ক্ষমতাসীন, সে যেই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই হোক না কেন। সব পথ বন্ধ করে দিলে বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতি তৈরি হবে ইংরেজিতে যাকে ‘টিন্ডার বক্স’ বলে। দেশ সে পথে অগ্রসর হোক তা নিশ্চয় কারো কাঙ্খিত হতে পারেনা।
প্রথম আলো’তে ৬ জানুয়ারি ২০১৫ প্রকাশিত।

থাম্বনেইলের ছবির সূত্র: লিঙ্ক

Leave a Reply