ছবিঃ জেনারেল পিনোশের সাথে বৈঠকে মার্কিন অর্থনীতিবিদ ফ্রিডম্যান (চশমা পরিহিত সর্ব ডানে)
সিআইএ’র প্ররোচনায় চিলির রাষ্ট্রপতি সালভাদোর আয়েন্দের হত্যাকান্ডের পরে মার্কিন সমর্থনপুষ্ট স্বৈরশাসক জেনারেল অগাষ্টো পিনোশে (সেপ্টেম্বর ১৯৭৩-ডিসেম্বর ১৯৮৯) যে বাজারমুখী অর্থনৈতিক সংস্কারের সূচনা করে সেটাকে নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ মিল্টন ফ্রিডম্যান অতিশয় প্রশংসা ক’রে নাম দিয়েছিলো ‘দি মিরাকেল অব চিলি’! সর্বোপরি সেই সময় “অর্থনৈতিক উন্নয়নের” জন্য আন্তর্জাতিক পরিসরে চিলি বহুল আলোচিত ছিলো, যদিও ১৯৮২ সাল নাগাদ দেশটি গভীর ঋণ সংকটে নিপতিত হয়েছিলো। বৈদেশিক ঋণ দাঁড়িয়েছিলো ১৭.২ বিলিয়ন ডলার। চিলির অর্ধেকেরও বেশি বেসরকারি ব্যাংক কর্তৃক প্রদত্ত ঋণ অপরিশোধিত ছিলো। প্রায় ৮০০ বেসরকারি ফার্ম তখন নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করেছিলো! তারপরও বিশ্বব্যাংক তাদের ২০০৪ সালের প্রতিবেদনে চিলির দারিদ্র বিমোচনের জন্য ক্রমবর্ধ্মান “অর্থনৈতিক প্রবৃ্দ্ধি”-কে সবচাইতে বেশি প্রশংসা করেছিলো। অনেকে বলে থাকে – চিলি এটা অর্জন করতে পেরেছিলো, মূলত পিনোশের আমলে গৃহীত তথাকথিত অর্থনৈতিক সংস্কারের কারণে। ১৯৮০ এর দশক থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত চিলির জিডিপির গড় প্রবৃদ্ধি ছিলো ৫.৯%।
তবে চিলির সাধারণ জনগণকে সহজে প্রদর্শনমুখী এই “অর্থনৈতিক প্রবৃ্দ্ধি” নির্ভর উন্নয়নের অপূরণীয় রাজনৈতিক এবং সামাজিক খেসারত দিতে হয়েছিলো। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক আর জে রুমেল এক হিসেবে নিশ্চিত করেছেন যে পিনোশের “উন্নয়নের আমলে” কমপক্ষে ১০,০০০ নাগরিককে হত্যা করা হয়েছিলো। সরকার কর্তৃক এই হত্যাযজ্ঞকে অধ্যাপক রুমেল চিহ্নিত করেছিলেন “ডেমোসাইড” (জেনোসাইড+ম্যাস মার্ডার) হিসেবে। পিনোশের আমলে গুমের শিকার হয়েছিলো হাজারের উপরে! কেউ কেউ বলে এ সংখ্যা তিন হাজার। ১৯৮৯ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচনের মাধ্যমে প্যাট্রশিও আয়ালউইনের নেতৃত্বে নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পরবর্তীকালে যে ভ্যালেক রিপোর্ট (Valech Report) প্রকাশিত হয় সেখানেও পিনোশে কর্তৃক মানবাধিকার লংঘনের বিপুল প্রমান পাওয়া যায়।
শুধু তাই নয়, ২০১৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা আর্কাইভ থেকে উন্মুক্ত করা এক গোপন দলিল থেকে জানা যায় জেনারেল পিনোশের সেনাবাহিনী কর্তৃক রডরিগো রোজাস ও কারমেন কুইন্টানা নামের গণতন্ত্রকামী দুই তরুন রাজনৈতিক কর্মীকে জ্যান্ত পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টার বিষয়টি। সরকারিভাবে তাদেরকে “সন্ত্রাসী” বলে আখ্যা দেয়া হয়েছিলো। সেই সময় সরকারের তরফ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বলা হয়েছিলো যে, ঐ দুই তরুন-তরুনী সম্ভবত নিজেরা ককটেল ফাটাতে গিয়ে “দূর্ঘটনাক্রমে অগ্নিকাণ্ডের শিকার” হয়েছিলেন! ঐ দুজনের মধ্যে রোজাস অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা গিয়েছিলেন। কুইন্টানার শরীরের ৬৩% পুড়ে গিয়েছিলো। এই জ্যান্ত পুড়িয়ে হত্যার প্রচেষ্টাটি জনপরিসরে প্রকাশিত হওয়ার পর কুইন্টানা এতদিন পর কোনো আইনী ব্যবস্থা নিবেন কি না তা আলোচিত হলে জেনারেল পিনোশের স্ত্রী লুসিয়া ব্যাঙ্গ করে বলেছিলেন, “ঐ মেয়ের এত অভিযোগ করার কী আছে? সে তো বলতে গেলে পুড়েইনি!”
শুধু “ডেমোসাইড” নয়, সেই সময় চিলির “উন্নয়ন মডেলের” আরেক অনুসংগ ছিলো তার পরিবার, আত্নীয়-স্বজন এবং বন্ধু-বান্ধব কর্তৃক দেশের সম্পদ লুন্ঠন আর দুর্নীতি! পিনোশেসহ তাদের বিরুদ্ধে ২১-২৭ মিলিয়ন ডলার আত্নসাৎ করার অভিযোগ উঠেছিলো!
১৯৯০ সাল নাগাদ অগাষ্টো পিনোশে ক্ষমতাচ্যুত হলেও সাংবিধানিক বাধ্যবাধ্যকতার কারণে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত চিলির সামরিক বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে বহাল ছিলেন। সেই বছর লণ্ডনে চিকিৎসাকালীন তার বিরুদ্ধে স্পেনের ম্যাজিস্ট্রেট বালতাসার গার্যন স্প্যানিশ নাগরিকদের হত্যা ও নিপীড়নের অভিযোগে গ্রেফতার-পরোয়ানা জারি করেন এবং বিচারের জন্য স্পেনে ফেরত পাঠানোর অনুরোধ করেন । এরপর অনেক আইনী লড়াইয়ের ধারাবাহিকতায় পিনোশে লণ্ডন থেকে মুক্ত হয়ে ২০০০ সালে আবার চিলিতে ফিরে যান। নিজ দেশেও অনেক আইনী এবং রাজনৈতিক নাটকীয়তার পর ২০০৬ সালে স্বৈরশাসক জেনারেল পিনোশে আবারো হাউজ এ্যারেস্ট হন এবং শেষ পর্যন্ত ঐ বছরের ডিসেম্বর মাসে সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৯১ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।