গত মাসের শুরুতে গাজীপুরে মনির’কে রাজনীতির আগুনে দগ্ধ হতে দেখে আমরা শিহরে উঠেছিলাম। আমরা সেকথা বলেছি বিভিন্নভাবে। ভেবেছি সেটাই শেষ পুড়িয়ে মারার ঘটনা হবে। কিন্তু, যতদিন যায়, এই তালিকা দীর্ঘ হতে থাকে। আমাদের ভাগ্যের নির্ধারকরা আমাদের স্বার্থের জন্য একের পর এক পুড়িয়ে মারতে থাকেন আমাদেরই শ্রেণীর আরও মানুষ। আমরা চুপচাপ থাকি এইভেবে যে, এসবই তো আমাদের ভালোর জন্য। ভোট দিয়ে, আমাদের আপন ভেবে, যাদের শাসন করতে পাঠিয়েছি তারাতো আমাদের ভালো ছাড়া মন্দ চাইবেন না। আমাদের বলা হয়েছে, আমাদের সব ভালোর জন্য, সংবিধান নামে একটি বই আছে তাতে আমদের জন্য খুব ভালো ভালো কথা লেখা আছে। আমাদের বলা হয়েছে, সেই বই অপরিবর্তনীয়। অর্থাৎ আমাদের জন্য যা কিছু ভাল, তা কেউ পরিবর্তন করতে পারবেনা। শুনেছি সেই বইয়ে লেখা নিয়ম মতে, যারা নির্বাচনে বেশী ভোট পেয়েছে তারা “সরকার” গঠন করেছে আর অপেক্ষাকৃত কম ভোট যারা পেয়েছে তারা “ছায়া সরকার” গঠন করেছে। আমাদের কি আনন্দ, আমাদের দুটি সমান্তরাল সরকার আছে যারা আমাদের ভাল-মন্দ দেখে। ভোটের দিনটিকে আমাদের দেশে যারা “বুদ্ধি দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন” তারা বলেন “ভীষণ আনন্দমুখর” দিন। সত্যিই তাই। আমরা অনেক যুগ কিছুই পাইনি। এখন আমরা নিজেরা নিজেদের শাসন করছি, তাই আনন্দতো হবেই। কত সহজে আমরা বলতে পারি, “আমার ভোট আমি দিব, যাকে খুশি তাকে দিব।” আমাদের নিজেদের লোক বলে কথা। কেউ আমাদের আর জোর করে ইংরেজি কিংবা উর্দু ভাষায় কথা বলতে বাধ্য করতে পারবে না। জোর করে কোন সিদ্ধান্ত আমাদের উপর চাপিয়ে দিতে পারবে না। তাই যা কিছু হয় সব আমাদের ভালোর জন্যই। এছাড়া আর কি? কেউ যদি এর বাইরে কিছু ভাবেন তবে তিনি নিশ্চিত দেশদ্রোহী। নিজের ভালো পাগলও বোঝে।
আমাদের প্রধানমন্ত্রী বা তার সরকারের সকল কাজ তাই কেবলই জনগণের স্বার্থে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো যা করেন “ছায়া সরকার” হিসেবে তা-ও কেবল আমাদেরই স্বার্থে। গর্বে আমাদের বুক ফুলে ওঠে। কে কবে ভেবেছিল, এমন বড় বড় মানুষগুলো, আমাদের মত না খেতে পাওয়া, অর্ধমৃত মানুষগুলোর কথা বলবে! তাও আবার এমনভাবে বলবে যে, তারা আমাদের নির্দেশে আমাদের ভালোর জন্য সব কাজ করছে। আমাদের পেটে ভাত না থাকলেও তাই আমরা সম্মানিত বোধ করেছি। আমাদের বোমা আর পেট্রোল দিয়ে পুড়িয়ে মারলেও আমরা ভেবেছি এ-ও আমাদের ভালোর জন্যই। সবার ভালোর জন্য কারো কারো মৃত্যুরও নিশ্চয় প্রয়োজন আছে। আমাদের মাঝে কেউ কেউ কখনো সখনো বিভেদ তৈরি করার চেষ্টা করেছে- বলেছে, আমাদের ঠকানো হচ্ছে। আমরা বিশ্বাস করিনি। আমাদের মনে হয়েছে- ওরাই আমাদের ভালো চায় না। তাদেরই কোন না কোন দুরভিসন্ধি আছে। কেউ কেউ আবার ইসলামের নাম করে দেশ শাসন ও পরিচালনার অনুমতি চেয়েছে। আমরা পাকিস্তানের সাথে ২৪ বছর থাকার অভিজ্ঞতা থাকে জেনেছি, ওরা ধর্মের কথা বললেও অধর্ম করে বেশী। তাই তাদের কখনোই অনুমতি দেইনি। এই দেশের মালিক যখন আমরা, তখন আমরাই সিদ্ধান্ত নিব কাকে দিয়ে কোন কাজটি করাব।
কথা সেটাই- দেশের মালিক আমরা। এই আমরাই তো না খেয়ে, নিজের সুখের কথা চিন্তা না করে, দিনরাত পরিশ্রম করে যাই আমার দেশের রাজারা যেন দুধে ভাতে থাকে। আমাদের পাঁজর ভেঙ্গে হলেও তাদের পাজেরো যেন চলতে পারে। আমাদের ঘরে আলো না জ্বললেও রাজবাড়ীগুলোতে আলোর ঝলকানি তাই আমাদের মনে প্রশ্ন তোলে না। আমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকি তাঁরা যেন নিমেষে চলে যেতে পারে। কেননা, ওরা যে আমাদেরই লোক, আমাদেরই জন্য কাজ করছে। ওরা কাজ করলে একদিন আমরাও……।
আমরা আশায় বুক বাঁধি। দেশ এগোবে। আমরা এগোবো। কিন্তু, ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিটে যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকা মানুষগুলো চোখের সামনে মরতে দেখে আমাদের স্বপ্নের ঘোর ভাঙ্গে। ২৮ নভেম্বর শাহবাগে একটি যাত্রীবাহী বাসে পেট্রোল বোমা ছুঁড়ে মারলে ১৯ জন বাসযাত্রী পেট্রোল বোমায় অগ্নিদগ্ধ। ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিটে নাহিদ, রবিন আর বাবু আমাদের বুড়ো আঙুল দেখিয়ে চলে গেছে এরই মধ্যে। দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে দেখা যায়, চলতি বছরের ২৬ অক্টোবর থেকে ২৯ নভেম্বর পর্যন্ত শুধু যানবাহনে দেওয়া আগুন ও পেট্রল হামলায় পুড়েছে ৫৫ জন, মারা গেছেন ১০ জন আর ৫২ জন এখনো চিকিৎসাধীন আছেন। তাদের মধ্যে অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক। ৩০ নভেম্বর রাতে মালিবাগে একটি বাসে আগুন দিলে বাসটি চাপা দেয় গার্মেন্টস ব্যবসায়ী হাবিবকে। তিনি মাত্র এক মাস সাত দিন আগে বিয়ে করেছেন। তার আত্মীয়দের কান্না আর বিলাপ আমাদের গায়ের মধ্যেও যেন আগুন ধরিয়ে দেয়। হাবিবের ভাই চোখের জল ফেলে বলছিলেন, এই দুনিয়ার আদালতে এই হত্যার বিচার না হলেও আল্লাহর আদালতে একদিন নিশ্চয়ই বিচার হবে। সত্যি তাই, এতগুলো হত্যা অথচ এখন কোন হত্যা মামলা হয়নি। মৃত ব্যক্তিদের পরিবারের কারোরই দেশের বিচার ব্যবস্থার উপর আস্থা নাই। কোন পথে যাচ্ছি আমরা? রাজনৈতিক দলগুলো যখন একে অপরের প্রতি দোষ চাপানোর চিরচেনা রাজনৈতিক অশিস্টাচারে ব্যস্ত থাকেন তখন হত্যাকারীরা এক ধরণের ইম্পিউনিটি পেয়ে যান। এরই ফল- বিচারব্যাবস্থার প্রতি অনাস্থা।
১ ডিসেম্বর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অগ্নিদগ্ধদের দেখতে গেলে অবরোধের সময় বাসে পেট্রলবোমা হামলায় দগ্ধ গৃহবধূ গীতা সরকার তাঁকে বলেন “আমরা আপনাদের তৈরি করছি, আপনারা আমাদের তৈরি করেন নাই। আমরা আমাদের স্বামীরটা খাই। আপনারা আমাদের নিয়ে ছিনিমিনি খেলছেন।… আমরা ভালো সরকার চাই…আমরা অসুস্থ সরকার চাই না।’
চলমান রাজনৈতিক সহিংসতার বিরুদ্ধে এটিই শেষ কথা। মাননীয় বিরোধী দলীয় নেত্রী এখনো এসব মৃত মানুষ আর প্রায় মৃত মানুষদের জন্য শোক আর সমবেদনা জানানোর প্রয়োজনও বোধ করেননি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর সহযোদ্ধারা আমাদের বুঝিয়ে যাচ্ছেন, বিএনপি-জমায়াত চক্র দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্যে মানুষ পুড়িয়ে মারছে। একথায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে চেয়েছেন। কিন্তু তিনি গীতা সরকারের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি। পারবেনও না। আমাদের রক্ষার দায়িত্ব দিয়ে যদি আপনাদের ক্ষমতায় বসিয়ে থাকি তবে সেটা করতে না পারার ব্যর্থতার পাশাপাশি ক্ষমতার লড়াইয়ে আমাদের তুচ্ছ জ্ঞ্যান করে, আমাদের দোহাই দিয়ে দেশকে অশান্ত, অস্থিতিশীল করার জন্যে আপনারা দুই দলই সমানভাবে দায়ী। আমরা যাদের “ছায়া সরকার” বলে জেনেছি তারাও আমাদের ভালোর জন্যে সব করছেন বলে দাবী করছেন। আমাদের জ্বালিয়ে, বোমার আঘাতে হত্যা করে আমাদের কোন ভালো করছেন তা আমরা সত্যিই বুঝতে পারছি না। স্বৈরাচারী সরকার উৎখাতের নামে রাষ্ট্রীয় সম্পদ নষ্ট করে, সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ মেরে কোন সরকার উৎখাত হবে- তা আমরা মোটেই বুঝতে পারছি না।
স্বাধীনতার পর থেকে আমাদের রেল লাইনের সংকোচন ছাড়া বৃদ্ধি হয়নি। রাজনীতিতে যুক্ত থাকা “বাস মালিকদের” স্বার্থের পরিপন্থী বিধায় কোন রেলমন্ত্রীই কম খরচের এই সেবা খাতকে মূল যাতায়তের মাধ্যম হিসেবে গড়ে তুলতে পারেননি। গত দু’সপ্তাহের অবরোধে রেলের যে পরিমাণ ক্ষতি করা হল তা কার স্বার্থে এটা বোঝা দরকার।
সড়ক ও রেলপথ অবরোধ না করে, বিরোধী দল যদি দেশের নির্বাচন কমিশন ও তার আঞ্চলিক অফিসগুলো অবরোধ করতেন, যদি বলতেন সচিবালয়সহ অন্যান্য সরকারী অফিস ঘেরাও করবেন তাতেও আমরা বুঝতাম যুদ্ধটা আমাদের বিরুদ্ধে নয়।
প্রধান বিরোধী দলের পাশাপাশি এই সহিংসতার অন্যতম শরিক দল জামায়াতে ইসলামী। তাদের দল আগামী নির্বাচনে আদালত কর্তৃক অযোগ্য ঘোষণার পর নির্বাচন নিয়ে তাদের উদ্দেশ্য আর বিএনপির উদ্দেশ্য এক হওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু, আমরা দেখছি এই দলটি আমাদের পুড়িয়ে মারার পেছনে অগ্রণী ভুমিকা রাখছে। তারা অবশ্য কখনো বলেনি তারা আমাদের প্রয়োজনে রাজনীতি করছেন। তাই তাদের কাজের পেছনে যুক্তি আমরা বুঝতে পারি। কিন্তু, বিএনপির মত একটি দল তাদের এজেন্ডার সাথে কিভাবে খাপ খায় সেটা আমরা বুঝি না।
এসব কথা বলার বিপদ হল- আমাদের আক্ষেপের অধিকাংশ বক্তব্য কোন না কোনভাবে ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে যায় আর তারা ভাবতে শুরু করেন কিভাবে একে আরও তাদের পক্ষে ব্যবহার করা যায়। শাহবাগের আন্দোলন সে অভিজ্ঞতাই বয়ান করে। চলমান রাজনৈতিক সহিংসতা প্রতিরোধে সরকার ব্যর্থ, রাষ্ট্র তার নাগরিকদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ। এই ব্যর্থতার কারণে ফুসে উঠছে সাধারণ মানুষ। কিন্তু, তারা সত্যিকারের প্রতিরোধে রাস্তায় নামতে দ্বিধাগ্রস্ত। প্রধান দুই দলই রাজনৈতিক বিভাজনের শুরু থেকে চাইছিলেন যেন সাধারণ মানুষ রাস্তায় নামেন। কিন্তু, সাধারণ মানুষ হালুয়া রুটির ভাগাভাগির অংশ হতে চাননি। ক্ষমতার রাজনীতিতে সাধারণ মানুষ কোন ভুমিকা রাখেন না বলে প্রধান দুই দল এখনো তাদের অরাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে পারছেন।
শুরু থেকে আমাদের বোঝানো হচ্ছে- নির্বাচন হলেই আমাদের দেশে গণতন্ত্র সুসংহত হবে। দেশ সুখ আর সমৃদ্ধিতে ভরে উঠবে। তাই যদি হত- এদেশ ১৯৯০ সনের পর থেকে গণতন্ত্রের পথে হাঁটছে। এই ২৩ বছর পরও আমাদের নির্বাচন কিভাবে হবে তা নিয়ে এত সংকট তৈরি হত না। কথায় কথায় প্রধান দুই দল, নিজেদেরকে গণতান্ত্রিক দল হিসেবে দাবী করেন। অথচ, আমরা তাদের আচার-আচরণে এই গণতান্ত্রিক চর্চার কোন প্রতিফলন দেখিনা। গণতন্ত্র আমাদের মত দেশের জন্য আদৌ সঠিক শাসন ব্যবস্থা কিনা, এনিয়েই আমাদের সন্দেহ দানা বাঁধছে। গণতন্ত্রের ফাঁকা বুলি আমাদের আর আশ্বস্ত করে না।
নির্বাচনী অভিধানে কিছু চালু শব্দ আছে যেমন- রাজনৈতিক সমস্যা রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিদেরই সমাধান করতে হবে। কোনভাবেই অরাজনৈতিক ব্যক্তির হস্তক্ষেপ কাম্য নয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের তাঁবেদার বুদ্ধিজীবীরা এনিয়ে ভীষণ উচ্চকন্ঠ টেলিভিশনের টকশোগুলোতে। আমরাও বিশ্বাস করতে চাই আপনাদের এই বুলি। বাতাসে গুজব ভেসে আসে- যেকোন মুহূর্তে সেনা বাহিনী ক্ষমতা গ্রহণ করতে পারে। আমরা কোন অবস্থাতেই দেশে “সেনা শাসন” চাই না। আমরা ধারণা করি, বর্তমান অবস্থা তৈরির পেছনে, প্রধান দুই দলেরই সুপ্ত ইচ্ছা সেনা শাসন। প্রধান দুই দল, যে “পয়েন্ট অফ নো রিটার্নে” চলে গেছেন তাতে তারা আশা করবেন সেনা বাহিনী এসে তাদের এই পঙ্কিল অবস্থা থেকে টেনে তুলবেন। কিন্তু, সেনাবাহিনীর কি দায়? তারা দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকতে পারেন না, তাহলে রাজনৈতিক দলের ময়লা পরিস্কার করার কাজে কেন সেনাবাহিনী আগ্রহী হবেন?
আমরা সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমাদের চাওয়া একটাই- শান্তি। সেটি কিভাবে আনবেন সেটি ভাবার দায়িত্ব রাজনীতিবিদদের। আমরা অনেক সয়েছি। আমরা অনেক জীবন অপচয় করেছি গণতন্ত্রের নামে। আমাদের মেরেই যদি বারবার গণতন্ত্রের ভিত শক্ত করতে হয়, তাহলে আমরা আর চাইনা সেই গণতন্ত্র। অন্য কোন তন্ত্রের কথা বলুন। আমরা কান পেতে রই।
লেখাটি ভালো তবে একধরনের অস্থিরতা প্রকাশ পেয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে মনে হয়েছে। লেখক বলেছেন “আমাদের মেরেই যদি বারবার গণতন্ত্রের ভিত শক্ত করতে হয়, তাহলে আমরা আর চাইনা সেই গণতন্ত্র।” সমস্যা হলো এধরনের বক্তব্য অগনতান্ত্রিক শক্তিগুলোর প্রিয় বিষয়। আমি বুঝতে পারছি লেখক একধরনের হতাশার জায়গা থেকে হয়তো বলেছেন। তবে, বর্তমানের যে তন্ত্রকে আমরা গনতন্ত্র বলি সেটা আদৌ গনতন্ত্র কিনা সেই বিষয়ে আমাদের প্রশ্ন করে যেতে হবে বলে মনে করি। বর্তমানের সমস্যাটা অগনতান্ত্রিক আচরণের। এর বিপরীতে গনতন্ত্রের উত্থান দেখতে চাই আমরা নিশ্চয়।
একটুও মিথ্যে নয়। তবে সাধারণ মানুষের সমস্যাটাও বোঝা দরকার মনে হয়! সাধারণ মানুষের দেয়ালে পিঠ থেকে গেছে। তারা আর গণতন্ত্র একদমই চাইছে না। ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে সুশাসক নির্বাচনের ইচ্ছে মনে হয় তারা বিসর্জন দিয়েছে !
অতীতে ছিল না গণতন্ত্র, নিজের খেয়ালখুশিমত দেশ চালিয়েছেন রাজারানীগন। প্রজারা হয়ত পেট-পুরে খেতে পারত না, গায়ে চাপাতে পারত না ভাল কোন পোশাক। তবু তারা বেঁচে তো থাকত। অথচ আজ? গণতন্ত্রের আগুনে পুড়ে মরছে সবাই।
সাধারণ মানুষ তাই আজ গণতন্ত্রের মায়ায় আর ভুলতে চাইছে না। তারা জেনে গেছে, “গণতন্ত্র” নামক ফাঁদ দিয়েই তাদের একের পর এক বড়শিতে গেঁথে ফেলা হয়। আর তারপর গনতান্ত্রিক রাজনীতিবিদদের প্লেটে সুন্দর করে সাজিয়ে-গুছিয়ে পরিবেশন করা হয়!
দারুণ বলেছেন। আশ্চর্য হল, এদেশে এমনটা ভাবার মত লোকের কিন্তু অভাব নেই। আজকেও একজন সিএনজি ড্রাইভারকে বলতে শুনলাম, “এমন ঘটনা আরও ঘটব। হাসিনা গদি ছাড়লেই সব ঠাণ্ডা হইয়া যাইব। দেশে শান্তি ফিরা আইব” অবাক করা বিষয় হল, ঐ সিএনজি ড্রাইভারই কিন্তু হতে পারে অবরোধকারীদের পরবর্তী টার্গেট!
কথাটা আমারও। বিরোধী দল নির্বাচন কমিশন বা সরকার-যন্ত্রের অন্যান্য আস্তানাগুলো ঘেরাও করলে পারে, হয়ত একাজে তাদের রক্ত ঝরবে, জীবনও যেতে পারে। কিন্তু সেক্ষেত্রে মানুষ অন্তত বুঝবে, না, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য বিরোধী দল নিজেদের জীবন পর্যন্ত বিলিয়ে দিচ্ছে। আশ্চর্য হল, এদেশে এখন নিজের জীবন নয়, সাধারণ মানুষের জীবন কেড়ে নিয়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলন করা হচ্ছে। এমন গণতান্ত্রিক আন্দোলন কি বিশ্ব আগে দেখেছে কখনো?
উপরে এই অবস্থানটি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। গনতন্ত্র একটি খুবই বিস্তৃত ধারণা। এই শব্দটি দিয়ে সব অবস্থায় সবাই একই কথা বোঝান বলা যায় না। কিন্তু আমি বর্তমান অবস্থা এবং উপরের নিবন্ধের আলোকে বাক্যটিকে একটু নিজের মত করে কনটেক্সটে স্থাপন করতে চাই। আমি বলব এইভাবে
কাজেই আমার দৃষ্টিতে সমস্যাটা হচ্ছে এই সমস্যাগুলো থাকার মানে হচ্ছে যেই ব্যবস্থাকে বাংলাদেশে গণতন্ত্র বলা হচ্ছে সেটা আদৌ গণতন্ত্র নয়। কেননা এখানে শাসন ক্ষমতায় পাঁচ বছরের জন্য দুইটি দলের একটিকে পাঠানো ছাড়া সাধারণ জনতার আর তেমন কিছু করার নেই। কাজেই মানুষের চাওয়ার প্রতিফলন কে যদি আমরা গনতন্ত্র বলি এটা গনতন্ত্র হতে পারে না। ফলে আমরা এখানে আমরা বিদ্যমান গনতন্ত্রে পরিবর্তন চাই এতে কোন সন্দেহ নেই। সেই ক্ষেত্রে পরিবর্তনটা কোন কোন ক্ষেত্রে হবে সেটা একটা বড় প্রশ্ন — এই প্রশ্নটির জন্য সুনির্দিষ্ট কিছু সমাধান ভেবে দেখা যেতে পারে। প্রয়োজনে পূর্নমাত্রার গবেষনণার মধ্য দিয়ে নির্বাচন ব্যবস্থায় পরিবর্তন (Electoral Reform) এনে জনগনের ক্ষমতায়নের রাস্তা উন্মুক্ত করতে হবে। অন্যদিকে দেশের নাগরিকদেরো আস্তে আস্তে বুঝতে হবে তারা যদি রাজনীতি থেকে দূরে থাকার প্রবনতা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারে তাহলে রাজনীতিও তাদেরকে ছাড়াই আগাবে, যেখানে তাদের স্বার্থে সংরক্ষিত হবার সম্ভাবনা না থাকাই স্বাভাবিক। কাজেই এভাবেও বলা যায় আমাদের দেশের বর্তমান অবস্থা আমাদের দেশ এবং সমাজের জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাস্তর (learning phase)।
যাক আপাতত এইটুকুই; বিষয়টি নিয়ে ভবিষ্যতে আরো আলোচনা হবে আশা রাখছি।
রেলের বগি পোড়ে আর বিটিআরসি’র বাস পোড়ে। হিসাব মেলানো খুব কঠিন নয়।সাধারণ মানুষ তো নিজের সম্পত্তির হিসাব নেবার মত সচেতনতাটুকুও দেখাচ্ছে না, গণতন্ত্রের এহেন বাহার দেখে গণতন্ত্রের সাধও মিটে যাচ্ছে প্রায়। কিন্তু প্রধান দুই দলের অরাজনৈতিক কর্মকান্ডের তুলনায় সেনাদলের অরাজনৈতিক কর্মকান্ড তুলনামূলকভাবে কম অকল্যাণকর হবে, এই বিশ্বাসের ভিত্তি কি? জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা তৈরি না হলে, নিজের হিসাব সংঘবদ্ধভাবে বুঝে নেবার মত রাজনৈতিক বুদ্ধি না হলে, কোন দলই ছাড়বে কেন?
সেনা শাসন আমাদের বরাবরেই পিছিয়ে দিয়েছে। বিগত সেনা শাসিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথাই যদি ধরি- অন্য সব কিছু বাদ দিয়ে যদি শুধু “ভূমির মূল্য বৃদ্ধি” র দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাব, স্বাধীনতার পর এই সময়ে ভূমির মূল্য সবচেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের বর্তমান প্রধান বিচারপতি এবছরের মাঝামাঝি সময়ে বিচারকদের প্রশিক্ষণ শেষে সনদ প্রদান অনুষ্ঠানে একটি মুল্যবান কথা বলেছেন- এদেশে মামলার সংখ্যা (সব ধরণের) বৃদ্ধির পেছনে মূল কারণ ভূমির অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি। সেনাবাহিনী তাদের দুর্নীতির অংশ হিসেবে ভূমির মূল্য অস্বাভাবিক রকম বৃদ্ধি করেছিলেন। এর পেছনে অনেক গুরুতর কারচুপি লুকায়িত ছিল। এটি ভাবার কোন কারণ নেই তাদের বুদ্ধি হাঁটুতে- সেনাবাহিনীর ভেতরে দেশীয় রাজনীতির প্রভাব অন্য যেকোন সংস্থার চেয়ে বেশী। তারা নিজেরাই ত্রাসে থাকেন, কি জানি কি হয়? বাংলাদেশের ইতিহাসে আমি বোধ করি প্রথম আইনজীবী যিনি ফিল্ড কোর্ট মার্শালে অভিযুক্ত এক সিনিয়র সেনা কর্মকর্তার আইনজীবী হিসেবে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি এবং দেশের ইতিহাসে প্রথম বারের মত কেস জিতে অভিযুক্ত স্বীয় চাকরীতে বহাল হয়েছেন। এই প্রক্রিয়া ছিল দীর্ঘ, তাই আমার খুব কাছ থেকে অনেক কিছু দেখার সুযোগ হয়েছে। সেই ধারণা থেকেই বলছি- সেনাবাহিনী এমনিতেই যেসব সুযোগ সুবিধা ভোগ করেন, তারপর আর তাদের রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করার প্রয়োজন পড়েনা। আমাদের অথর্ব রাজনীতিবিদরাই তাদের নিজের স্বার্থে ব্যবহার করেন নানা ভাবে।
জনগণের সম্পত্তির হিসাব বুঝে নেয়ার যে কথাটি আপনি বলেছেন তার সাথে আমি শতভাগ একমত। এই জন সচেতনতা গঠন করার জন্য যেসব মেকানিজম থাকা দরকার তার মধ্যেই গলদ থাকায় মানুষ আজ দ্বিধাগ্রস্ত। রাজনৈতিক আলাপ আলোচনা চায়ের আড্ডা আর সভা সেমিনার পেরিয়ে এখন টেলিভিশনের টকশোতে গিয়ে ঠেকেছে। সেখানে কে বা কারা যাচ্ছে তা তো দেখতেই পাচ্ছেন।
অন্যের ভরসায় না থেকে কাজ আসলে আমাদেরই শুরু করতে হবে- সব কিছুর আগে চাই একটি গণতান্ত্রিক নতুন সংবিধান। এটি পেতে অনেক সময় লাগবে। দল কানা বুদ্ধি ব্যবসায়ীরা আমাদের দাবী নিয়ে এখনই হাস্যরস করছেন। কিন্তু আমরা এবার বুঝে নিতে চাই- অনেক কিছু।