Share the post "করোনাভাইরাস মোকাবিলায় চীনের সফলতা, সান জু’র প্রাসঙ্গিকতা ও রাষ্ট্রপর্যায়ে আমাদের সমন্বয়হীনতা"
করোনাভাইরাস সংক্রমণ মোকাবিলায় সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা খাতের সময়োপযোগী সঠিক ব্যবস্থাপনা এবং অন্যান্য খাত যেমন- অর্থ, খাদ্য, পরিবহণের সাথে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার যথাপোযুক্ত সমন্বয়। অনেক মনে করে থাকেন, করোনাভাইরাস মোকাবিলায় চীন তুলনামুলক সফল (অন্তত কম মৃত্যু্র প্রেক্ষাপটে, আক্রান্ত মানুষের বিবেচনায়) হওয়ার পেছনে রয়েছে তাদের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা খাতের সাথে অন্যান্য খাতের সঠিক সমন্বয় ও সার্বিক ব্যবস্থাপনা।
চীন কেন এমনটা পারলো তার কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে অনেকেই প্রাচীন চীনা দার্শনিক ও রণকৌশলবিদ সান জুকে প্রাসঙ্গিক মনে করছেন। সান জু’র জন্ম খ্রিষ্টপূর্ব ৫৪৪ সালে। তারা মনে করছেন, জগদ্বিখ্যাত আর্ট অব ওয়ার-এর রচয়িতা সান জু’র ব্যবস্থাপনা কৌশল চীনের নেতৃত্বকে সাহায্য করেছে অপেক্ষাকৃত সফলভাবে করোনাভাইরাস মোকাবিলায়।
চীনের অনেক বিশ্লেষক বলছেন, চীনের ব্যবস্থাপনা ও সমন্বয় কৌশল বুঝবার জন্যে আর্ট অব ওয়ার বইটির একাদশ অধ্যায়ে চোখ বুলানো যেতে পারে। এই অধ্যায়ে বর্ণিত যুদ্ধ বা শত্রুর সাথে লড়াইয়ের নয়টি অবস্থার একটি অবস্থার সাথে তারা করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঘটনাকে তুলনা করছেন।
যুদ্ধকালীন এই অবস্থাটির নাম ‘মরিয়া-ক্ষেত্র’ (ডেসপারেট গ্রাউন্ড)। এই ক্ষেত্রের বৈশিষ্ট্য আলোচনা করতে গিয়ে সান জু বলেন যে, এটা এমন একটা অবস্থা যা বড় নদীতে ফুটো হয়ে যাওয়া নৌকা বা আগুনে পুড়তে থাকা বাড়িতে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকার মত। এই অবস্থা থেকে পালানোর কোনো পথ থাকে না। হয় মরো, অথবা বাঁচার চেষ্টা করো যে কোন উপায়ে – এরকম একটা অবস্থা । সান জু’র পরামর্শ ছিলো, এই রকম মরিয়াক্ষেত্র উপস্থিত হলে কোনো সময়ক্ষেপণ না করে ঐ অবস্থাটাকে খুব দ্রুত মোকাবিলা করা এবং অবস্থাউপযোগী তৎক্ষণাৎ সৃষ্টিশীল সিদ্ধান্ত নেয়া। এই অবস্থায় সেনানায়কের কাজ হলো – সেই সময় যারা ভালো কাজ করবে, অন্যকিছু না ভেবে তাদের পুরস্কৃত করা। তার সাথে সাথে সময়োপযোগী তাৎক্ষণিক নির্দেশ দেয়া প্রচলিত ব্যবস্থাকে তোয়াক্কা না করে।
বিশ্লেষকেরা দাবি করছেন, চীনে চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী থেকে শুরু করে নিরাপত্তারক্ষী, পিয়ন, পরিবহণ শ্রমিক মৃত্যুকে পরোয়া না করে যুদ্ধে নেমে পড়েছিল। সান জু আরো অভিমত দেন যে, একজন দক্ষ এবং অভিজ্ঞ নেতার কাজ হলো যুদ্ধক্ষেত্রের সামনের কাতারে লড়াকু সৈনিকদের মাধ্যমে পেছনের কাতারে যারা আছে তাদের নিরাপদ রাখা। চীন লকডাউন ব্যবস্থা নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে সংক্রমণের গতির রাশ টেনে এই কাজটি অনেক সফলভাবে করেছে আর লড়াইয়ের সামনে থেকেছে চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী এবং অন্যান্যরা। এরা সবাই সমন্বিতভাবে মৃত্যুঝুঁকিকে পেছনে ফেলে অনন্য সাহসিকতার সাথে কাজ করেই মোকাবিলা করেছে এই মহামারি।
এখন প্রশ্ন হলো আমাদের রাষ্ট্রের নেতৃত্ব কি ওভাবে ভাবছেন, বা সার্বিক মহাপরিকল্পনা নিচ্ছেন আর যথাপোযুক্তভাবে সবকিছুর সমন্বয় করছেন? অবস্থাদৃষ্টে এরকম ভালো কিছু মনে হওয়ার কোনো যৌক্তিক কারণ আমাদের সামনে এখন পর্যন্ত অনুপস্থিত। উদ্ভুত পরিস্থিতিতে তো দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় দৃশ্যপটেই নেই! অথচ রাষ্ট্রপর্যায়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সাথে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের থাকা উচিত ছিলো একটা সমন্বিত ভুমিকা। কিন্তু ‘মরার ওপর খাড়ার ঘা’-এর মত সমন্বয়হীনতার উদাহরণই তো দৃশ্যপটে উপস্থিত হচ্ছে একের পর এক!
মেডিকেল টেস্ট নিয়ে তৃতীয় এবং সর্বশেষ সমন্বয়হীনতার উদাহরণ সবচেয়ে বড় বিপদের ইঙ্গিত দেয়। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে দেখা যায়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ‘ভুলক্রমে’ প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক প্রতিটি উপজেলায় দুটি করে কোভিড-১৯ পরীক্ষার নমুনা সংগ্রহের নির্দেশনার কথা বলেছে। এজন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর আন্তরিকভাবে দুঃখিত বলে জানিয়েছে।
মেডিকেল টেস্টের মত এরকম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা করোনাভাইরাসে সংক্রমণ মোকাবিলার প্রথম ধাপ, তা নিয়ে এরকম পরিস্থিতি রাষ্ট্রপর্যায়ের সমন্বয়হীনতাকেই স্পষ্ট করে তোলে। সমন্বয়ে এরকম অব্যবস্থাপনা থাকলে টেস্ট কিট, ভেন্টিলেটর বা সুরক্ষা পোশাক পর্যাপ্ত থাকলেও তো সময় ও পরিস্থিতির বিবেচনায় কাজে আসবে না।
ঠিক একইভাবে এর আগে করোনাভাইরাসের ঝুঁকি মোকাবিলায় তথ্য মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় পরিকল্পনা আর সমন্বয়হীনতার আরো দুটি নজির রেখেছিলো । স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় কর্তৃক গৃহীত এক প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়েছিলো, ‘সব পর্যায়ের হাসপাতালসমূহে সাধারণ রোগীদের প্রাথমিক চিকিৎসা, জরুরি চিকিৎসা, নতুন আসা রোগীদের ভর্তি করাসহ সব রোগীদের সেবা নিশ্চিত করতে হবে। এ বিষয়ে সবাইকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’ এতে আরো বলা হয়, ‘কোনও হাসপাতাল এ নির্দেশ অমান্য করলে ভুক্তভোগীকে তাৎক্ষণিক স্থানীয় সেনাবাহিনীর টহলপোস্টে দায়িত্বরত কর্মকর্তা বা নিকটবর্তী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে অবহিত করার অনুরোধ করা হলো। এ আদেশ অমান্য করলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের রেজিস্ট্রেশন বাতিল, লাইসেন্স বাতিলসহ আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
একইভাবে তথ্য মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে নিশ্চিত করা হয়, বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলোতে সম্প্রচারিত কোভিড-১৯ বা করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বিষয়ে অপপ্রচার কিংবা গুজব প্রচার হচ্ছে কি না, তা মনিটরিং করছে সরকার ১৫ কর্মকর্তাকে দিয়ে। আবার সেগুলো বাতিলও করে দেয়া হলো। তবে তথ্য মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনটি, নতুন বোতলে পুরোনো মদের মত করে, আবার নতুন নামে জারি করা হল!
চীনের করোনাভাইরাস মোকাবিলা, সান জু’র ব্যবস্থাপনা কৌশলের নিরিখে আমাদের রাষ্ট্রপর্যায়ের এখন পর্যন্ত গণমাধ্যমে প্রকাশিত সমন্বয়হীনতা বিবেচনায় এই প্রশ্নটা করা কি তাহলে খুব অস্বাভাবিক হবে, করোনাভাইরাস মোকাবিলায় আমরা আসলে কোন পথে?
(গত ৩ এপ্রিল ২০২০ এ সমকাল অনলাইনে প্রকাশিত)