April 17, 2024

রাজনৈতিক অর্থনীতিকে অনেকভাবে সংজ্ঞায়িত করা হলেও একে খুব সহজভাবেও অনেকে ব্যাখ্যা করেন আঠারো শতকের নৈতিক দর্শন শাস্ত্রের প্রেক্ষাপটে। নৈতিক দর্শন শাস্ত্রের প্রেক্ষাপটে তারা মনে করেন – রাজনৈতিক অর্থনীতি হলো সম্পদ/অর্থ/প্রাচুর্যের সাথে ক্ষমতা/প্রভাব/রাজনীতির সম্পর্কের পাঠ, বিশ্লেষন বা অনুসন্ধান। অথবা উল্টোটা অর্থাৎ, ক্ষমতা/প্রভাব/রাজনীতির সাথে সম্পদ/অর্থ/প্রাচুর্যের সম্পর্কের বিশ্লেষন বা অনুসন্ধান।

এই সম্পর্কের বিশ্লেষন বা অনুসন্ধান মূলত রাষ্ট্রকেন্দ্রিক হলেও অরাষ্ট্রীয় কোনো ইস্যুর ক্ষেত্রেও এটা প্রাসঙ্গিক হতে পারে। বিশেষ করে যখন সেই ইস্যু অথবা বিষয়বস্তু মোটা দাগে ক্ষমতা এবং অর্থের সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট হয় অথবা অর্থের সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রাজনীতি বা ক্ষমতার সংশ্লিষ্টতা থাকে। রাজনৈতিক অর্থনীতির যারা চর্চা করেন, তারা সেজন্য অর্থনীতি থেকে রাজনীতিকে আলাদা করে দেখেন না এবং সংগত কারণেই তারা সব সময় প্রশ্নের মুখে রাখতে চান ক্ষমতাশালীদের – হোক সে কোন রাষ্ট্র, সরকার, অথবা ব্যবসায়ী।

এই দৃষ্টিকোণ থেকে করোনাভাইরাসজনিত অতিমারির এই সময় বাংলাদেশের ছয়টি বেসরকারি ঔষধ কোম্পানী যেমনঃ বেক্সিমকো ফার্মা, ইনসেপ্টা, স্কয়ার, হেলথকেয়ার, বীকন, এসকায়েফ দ্বারা রেমডেসিভির এত দ্রুত বাণিজ্যিক উৎপাদনের সিদ্ধান্ত এবং ঔষধ কোম্পানীগুলোর নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করে উৎপাদন প্রক্রিয়ায় চলে যাওয়া অনেক কৌতুহল উদ্দীপক প্রশ্নের জন্ম দেয় এবং রাজনৈতিক অর্থনীতিভিত্তিক বিশ্লেষণকে প্রাসঙ্গিক করে তোলে। কেননা অতিমারি মোকাবেলায় রাষ্ট্রের অন্য সিদ্ধান্তগুলোতে অব্যবস্থাপনা সমন্বয়হীনতার অনেক উদাহরণ ইতোমধ্যে তৈরি হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে “সরকার-বিরোধী” গণস্বাস্থ্যের র‍্যাপিড কিটের ট্রায়াল নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গড়িমসি এবং মিডিয়া ট্রায়াল এক্ষেত্রে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ।

সবচাইতে মজার বিষয় হলো – আন্তর্জাতিক বাজারে রেমডিসিভির দামও এখনো নির্ধারণ করা হয়নি। অনেকে অনুমান করে বলছে, ১০ দিনের রেমডিসিভির তৈরিতে আমেরিকান কোম্পানি গিলিড সাইন্সের এর খরচ হবে সর্বমোট দশ ডলার। অথচ গণমাধ্যম মারফত জানা যায়, বাংলাদেশে উৎপাদিত প্রতি ডোজ ওষুধের দাম পড়বে ৫-৬ হাজার টাকা। গুরুতর অসুস্থ রোগীর ৫ থেকে ১১ ডোজ ওষুধ প্রয়োজন হতে পারে। সেই হিসেবে, ২৫-৬৫ হাজার টাকা বা তার চাইতে বেশি ব্যয় হতে পারে একজন রোগীর যা নিশ্চিতভাবে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে।

আবার রোগীর জন্য শেষ পর্যন্ত কতটুকু ওষুধ প্রয়োজন, সেই গবেষণা এখনো শেষ হয়নি। অথচ এই ঔষধটি বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন হবে এবং এখনো অপ্রমানিত ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে থাকা ঔষধটি অনেক বেশী দাম দিয়ে রোগীকে কিনতে হবে এবং আমাদের দেশের রোগীর উপর বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার হবে। এমন কি ঔষধ কোম্পানীগুলো এই দামী ঔষধ উৎপাদনের জন্য সরকার কাছ থেকে ভর্তুকিও আশা করছে।

ঠিক একইভাবে এই ঔষধটি নিয়ে বাঁধহীন উচ্ছাসের প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে কিছু গণ্যমাধ্যমেও। এই ঔষধটির উৎপাদন নিয়ে তাদের মাঝে এমন এক ধরনের গদগদ ভাব যেন এটা রোগীর হাতে পৌছালেই করোনা “যুদ্ধে” জয়! অথচ ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে রেমডিসিভির কার্যকারিতা দেখা গেছে প্রধানত সেরে উঠার সময় কমানোর ক্ষেত্রে। সেরে উঠতে গড়ে তিন দিন সময় কম নেয়। তবে মৃত্যুহার কমানোতে এটার তেমন কোন কার্যকারিতা নেই বললেই চলে । যদি কার্যকরী হতো তাহলে ইতালী, যুক্তরাষ্ট্র বা স্পেনের মত দেশ রেমডেসিভিরকে কভিড-১৯ রোগটি নিরাময়ে একমাত্র কার্যকরী ঔষধ হিসেবেই গ্রহণ করতো এবং তারা মৃত্যুহার কমাতে পারতো!

আরেকটি বিষয়ও খুব গুরুত্বপূ্র্ণ আর তা হলো করোনাভাইরাসের ঘন ঘন মিউটেশন বা রুপান্তর। এই ভাইরাসটি শেষ পর্যন্ত এই অঞ্চলে বা বাংলাদেশের এসে কীভাবে রুপান্তরিত হয়েছে সেই বিষয় নিয়ে কোনো গবেষনা না থাকায় এটাও নিশ্চিত না যে, আসলে আমাদের দেশের রোগীর উপর রেমডিসিভির প্রয়োগ কতটুকু ফলপ্রসু হবে সেরে উঠার সময় কমানোর ক্ষেত্রে।

তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায় রেমডেসিভির নিয়ে এত ‘যদি’ এবং ‘কিন্তু’ থাকা এবং অপ্রমানিত ট্রায়াল ড্রাগ হওয়ার পরও সরকার কেন এত দ্রুত ছয়টি কোম্পানীকে এটির বাণিজ্যিক উৎপাদনের অনুমতি দিলো কিংবা কতিপয় গণমাধ্যমই বা কেন এত উচ্ছসিত এই ঔষধটি নিয়ে যেন এটা কভিড-১৯ নিরাময়ের ‘মহৌষধ’?

তাই এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য রাজনীতি অর্থনীতির শরণাপন্ন হওয়া একটা ভালো উপায় হতে পারে। রাজনীতি অর্থনীতির প্রদত্ত সংজ্ঞাটিকে মাথায় নিলে আসলে আমাদের বুঝা দরকার রেমডেসিভির নিয়ে ব্যবসা করার সরকারি অনুমতি পাওয়া ছয়টি কোম্পানীর সাথে সরকার বা ক্ষমতার সম্পর্ক কী। অন্য কথায়, তাদের এই অনু্মতি পাওয়ার ক্ষেত্রে সরকার বা রাষ্ট্রের সাথে তাদের ঘনিষ্ট সম্পর্ক কোন প্রভাব ফেলেছে কি না।

একইভাবে গণমাধ্যমের অতিউচ্ছসিত হওয়ার কারণটাই বা কী? কেননা ব্যবসায়ী বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতা বা রাজনৈতিক প্রভাবের উৎস শুধু রাষ্ট্র বা সরকার নয়। গণমাধ্যমের সাথে সম্পর্কও তাদের ক্ষমতা বা রাজনৈতিক প্রভাবের উৎস হতে পারে। এমন কি সরকারও ক্ষমতা বা রাজনৈতিক প্রভাবের বাড়াতে গণমাধ্যমের উপর নির্ভর করে অনেক সময়। এটা ব্যবসায়ীদের সরকারের সাথে ক্ষমতার বন্ধনের একটা সুযোগ তৈরী হয়, যা ঐ ব্যবসায়ীদের প্রভাব বা আরো ক্ষমতাকে শক্তিশালী করে তাদের ব্যবসায়ী-সমাজে।

এখন তাহলে জরুরি হলো রেমডেসিভির বাণিজ্যিক উৎপাদনের সরকারের অনুমোদন পাওয়া এই ছয় কোম্পানীর সাথে সরকার এবং গণমাধ্যমের সম্পর্ক এক এক করে ব্যবচ্ছেদ করা।

প্রথমেই নজর বুলানো যাক বেক্সিমকো ফার্মার দিকে। এই কোম্পানীর চেয়ারম্যান হচ্ছেন আহমেদ সোহেল ফাসিউর রহমান। প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারী শিল্প প্রতিষ্ঠান এবং বিনিয়োগ সংক্রান্ত উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের ভাই । সালমান এফ রহমান নিজেই এই কোম্পানীর ভাইস চেয়ারম্যান। তাদের সাথে আছেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে প্রয়াত রাষ্ট্রপতির সন্তান ও সংসদ সদস্য নাজমুল হোসেন পাপন। তিনি আবার বিসিবি’রও প্রেসিডেন্ট। বেক্সিমকো গ্রুপের অন্তর্গত এই ঔষধ কোম্পানী ছাড়াও অন্য অনেক প্রতিষ্ঠানের বাইরেও তাদের রয়েছে ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশন।

স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যাপারে নতুন করে কিছু বলার নেই। এটার চেয়ারম্যান এবং ভাইস চেয়ারম্যান যথাক্রমে হলেন প্রথিতযশা স্যামসন চৌধুরীর দুই ছেলেমেয়ে – স্যামুয়েল এস চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম্যান রত্না পাত্র। তারা দুজনই আবার হলেন মাছরাঙ্গা টেলিভিশনের চেয়ারম্যান এবং পরিচালক। বাংলাদেশের ব্যবসায়ী মহলে স্কয়ারের প্রভাব এবং সুনাম দুটোই আছে ।

এসকায়েফ চেয়ারম্যান হলেন ট্রান্সকম গ্রুপের মালিক সর্বজন পরিচিত লতিফুর রহমান। ট্রান্সকম গ্রুপের মালিকানায় রয়েছে প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টারের মত দুটি জনপ্রিয় দৈনিক পত্রিকা ।

বীকনের চেয়ারম্যান হলেন নুরুন নাহার করিম এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবাদুল করিম। এই কোম্পানীর সাথে পরিচালক হিসেবে আরো রয়েছেন চক্ষু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডঃ সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী যিনি ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ এবং সমাজকল্যাণ বিষয়ক উপদেষ্টা ছিলেন। তার আগে সৈয়দ মোদাচ্ছের আলি আওয়ামী লীগ সভাপতির ব্যক্তিগত চক্ষু চিকিৎসক হিসেবেও কাজ করেছেন।

ইনসেপ্টার চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক হলেন আব্দুল মুকতাদির যিনি বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট। ইনসেপ্টা ইম্প্রেস গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান যাদের মালিকানায় রয়েছে চ্যানেল আই এবং ‘সাপ্তাহিক’ নামের একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা ।

হেলথকেয়ারের চেয়ারপারসন হলেন মিস সুরাইয়া বিলকিস এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলাউদ্দিন আহমেদ। মিস সুরাইয়া বিলকিসের মালিকানায় রয়েছে রাইজিং ট্রেডিং কর্পোরেশন, স্মরণিকা এন্টারপ্রাইজ, ডেইরী এন্ড ফুড প্রোডাক্ট লিমিটেড, হেলথকেয়ার ডায়াগনষ্টিক সলিউশন লিমিটেড ইত্যাদি। ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলাউদ্দিন আহমেদ ২০০০ সালে সমাজকল্যাণ অধিদপ্তরের ‘ম্যান অব দি ইয়ার-২০০০’ পুরস্কার লাভ করেন। কোম্পানীর ওয়েবসাইটে তাদের আর অন্য কোন পরিচয় জানা যায়নি।

রেমডেসিভির বানিজ্যিক উৎপাদনের ছয়টি কোম্পানীর অনুমোদন পাওয়ার বিষয়টাকে উপরের রাজনৈতিক অর্থনীতিভিত্তিক বিশ্লেষণে আমরা চারটি অনুসিদ্ধান্ত নিতে পারিঃ
১। রেমডিসিভি উৎপাদনের অনুমোদন পাওয়া কোম্পানীগুলোর ঔষধশিল্পে মোটাদাগে কম-বেশী সুনাম থাকলেও রেমিডিসিভির মত অপ্রমানিত ট্রায়াল ঔষধের এত দ্রুত বানিজ্যিক উৎপাদনের অনুমতি পাওয়াটা সম্ভবত সরকারের সাথে কোন কোন কোম্পানী যেমনঃ বেক্সিমকো, বীকনের রাজনৈতিক সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে।

২। অনুমোদন পাওয়া ছয়টি কোম্পানীর চারটি যেমনঃ বেক্সিমকো, ইনসেপ্টা, এসকায়েফ, স্কয়ারের শিল্পগ্রুপে তাদের নিজস্ব টেলিভিশন চ্যানেল এবং এদের কারো কারো আবার দৈনিক এবং সাপ্তাহিক পত্রিকা রয়েছে। গণমাধ্যমের সাথে এই সম্পর্ক তাদেরকে হয়তোবা সরকারি পর্যায়ে প্রভাব তৈরি করতে সাহায্য করেছে। তেমনি একই কারণে তারা অপ্রমানিত ট্রায়াল ঔষধটিকে তাদের নিজস্ব টেলিভিশন চ্যানেল বা পত্রিকায় কভিড-১৯ নিরাময়ে একটা ‘মহৌষধ’ হিসেবে প্রচার করতে পেরেছে। এর মধ্য দিয়ে যে ঔষধটি জনপরিসরে বড় আকারের আরও ট্রায়ালের জন্য রোগী বিনা পয়সায় পেতে পারতো, সেটার বাংলাদেশে বাণিজ্যিক মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে যা সাধারণ মানুষের আর্থিক আয়ত্ত্বের বাইরে। অপ্রমানিত ট্রায়াল ঔষধ ‘ভিআইপি’ ঔষধ হিসেবে আসলো আমাদের ঔষধ বাজারে!

৩। আপাতভাবে হেলথকেয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের ওয়েবসাইটে যে সব তথ্য আছে তা থেকে তাদের সাথে সরকার বা গণমাধ্যমের সরাসরি সম্পর্ক জানা না গেলেও আরো গবেষণা করলে হয়তোবা দেখা যাবে অন্য পাঁচটি কোম্পানীর বৈশিষ্ট্যের সাধারণ ধারা থেকে তারা ভিন্ন কিছু নয়।

৪। বাংলাদেশে সহজ উপায়ে এবং বাঁধাহীনভাবে ব্যবসা করতে চাইলে এবং দ্রুত ব্যবসায়িক সিদ্ধান্ত পেতে চাইলে হয় সরকারের সাথে সরাসরি সম্পর্ক থাকতে হবে। অথবা গণমাধ্যমের মালিক হতে পারলে জনপরিসরে প্রভাব বা ক্ষমতা তৈরী হয় যা সরকারকেও বিবেচনায় নিতে হয় অথবা সরকারেরও তাদের উপর কখনো নির্ভর করতে হয় নিজেদের প্রচারের জন্য। আর এরকম পরিস্থিতি কোম্পানীগুলোর ব্যবসার একটা অনুকুল পরিবেশ তৈরী করে দেয় যার মধ্য দিয়ে সবাই সবার স্বার্থ পারস্পরিক সমঝোতায় নিশ্চিত করে। রাজনৈতিক অর্থনীতির ভাষায় এটাকে বলা যেতে পারে “ব্যবসা-সরকার-গণমাধ্যম বন্ধন” বা ইংরেজীতে “বিজনেস-গভর্মেন্ট-মিডিয়া নেক্সাস”।

Leave a Reply