April 19, 2024

ইরাকের পর সিরিয়াতেও ইসলামিক স্টেটের পতন ঘনিয়ে আসছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের কি অবসান ঘটতে চলেছে? অন্য সন্ত্রাসবাদী সংগঠন আল-কায়েদার অবস্থাই বা কী? আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের ভবিষ্যতের সম্ভাব্য গতি–প্রকৃতি বোঝার জন্যে এর নিকট ইতিহাস এবং বর্তমান অবস্থা বিষয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা জরুরি। এই নিবন্ধের লক্ষ্য হচ্ছে সে বিষয়ে আলোকপাত করা।

১. আইএস কীভাবে রাষ্ট্র ঘোষণা করল
আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ ও বিশ্বরাজনীতির দিকে যাঁরা ঘনিষ্ঠভাবে নজর রাখেন, জুন মাসের শেষ দিকে তাঁদের মনোযোগ প্রধানত ছিল কথিত ইসলামিক স্টেটের (আইএস) কার্যকলাপের ওপর। ইরাকের মসুল শহরে ইরাকের সরকারি বাহিনীর সঙ্গে আইএস জঙ্গিদের শেষ লড়াই, সিরিয়ার রাকায় যুদ্ধে আইএসের বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির আশা, আবু বকর আল বাগদাদি রাশিয়ার হামলায় নিহত হয়েছেন কি না সেই বিষয়ের সত্যতা নিরূপণ; ফিলিপাইনের মিন্দানাওয়ের মারাউই শহরে আইএসের সশস্ত্র সমর্থকদের বিরুদ্ধে ফিলিপাইনের সেনাবাহিনীর অভিযান ছিল আলোচনার কেন্দ্রে। এর বাইরে উল্লেখযোগ্য সন্ত্রাসী হামলার ঘটনাও ছিল, যেমন লন্ডনে গাড়ি নিয়ে হামলা, আফগানিস্তানের কাবুলে ব্যাংকে বোমা হামলা ও পাকিস্তানের পারাচিনার বাজারে বোমা বিস্ফোরণে নিহত হন যথাক্রমে ৩৫ এবং ৭০ জনের বেশি। আইএসের বিরুদ্ধে বিভিন্ন জায়গায় যেসব অভিযান চলছিল, সেগুলোই সবচেয়ে বেশি মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল। কেননা, দৃশ্যত এই সব লড়াই থেকে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে বিশেষত একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবিদার হিসেবে, আইএসের ভবিষ্যৎ বোঝা যাবে বলেই ধারণা করা হচ্ছিল। ইরাক ও সিরিয়ায় আইএসের পরাজয় যে অত্যাসন্ন, সে বিষয়ে গত কয়েক মাসের ঘটনাপ্রবাহ সুস্পষ্ট ইঙ্গিত বহন করলেও এই ধারণা আরও সুদৃঢ় হয় এই সময়েই।

কিন্তু সেই সময়ে অর্থাৎ জুন মাসের তৃতীয় সপ্তাহে, আল-কায়েদা ইন ইন্ডিয়ান সাব-কন্টিনেন্ট (একিউআইএস, ভারতীয় উপমহাদেশে আল-কায়েদা) একটি দলিল প্রকাশ করেছে, যা সবার মনোযোগ দাবি করে। কুড়ি পৃষ্ঠার এই দলিলের শিরোনাম হচ্ছে ‘কোড অব কন্ডাক্ট ফর মুজাহিদীন ইন দ্য সাব-কন্টিনেন্ট’ বা ‘উপমহাদেশের মুজাহিদদের আচরণবিধি’। এই দলিলের তাৎপর্য রয়েছে সারা বিশ্বের সন্ত্রাসী তৎপরতার জন্য এবং দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে আল-কায়েদার নতুন কৌশলের ইঙ্গিতের বিবেচনায়। বাংলাদেশে যাঁরা জঙ্গিবাদবিষয়ক গবেষণা এবং কাউন্টার টেররিজমের সঙ্গে যুক্ত, এ বিষয় তাঁদের মনোযোগ দাবি করে। তবে এই দলিলের বিষয়বস্তু এবং এই দলিল কিসের ইঙ্গিত দেয়, সে সম্পর্কে আলোচনার আগে সারা পৃথিবীতে সাংগঠনিকভাবে আল-কায়েদার অবস্থা এবং দক্ষিণ এশিয়ায় তার শক্তি ও কৌশলের বিষয়ে আমাদের বিস্তারিত ধারণা থাকা দরকার।

আইএস ও আল-কায়েদার বাইরে অবশ্যই আরও সন্ত্রাসী সংগঠন আছে, যেমন সোমালিয়ায় আল শাবাব, নাইজেরিয়ার বোকো হারাম, ফিলিপাইনের আবু সায়াফ, পাকিস্তানের হরকাতুল মুজাহিদীন, যারা ইসলামপন্থী উগ্রবাদে বিশ্বাসী; ২০১০ সালের পর এদের কোনো কোনো সংগঠন, যথাক্রমে আল-কায়েদা বা আইএসের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছে। আন্তর্জাতিকভাবে সক্রিয় রাষ্ট্রবহির্ভূত বা নন-স্টেট সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে এখন পর্যন্ত প্রধান সংগঠন হচ্ছে আইএস ও আল-কায়েদা।

গত কয়েক বছরে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে আল-কায়েদা খুব বেশি আলোচিত হয়নি, তার অন্যতম কারণ হচ্ছে আইএসের উত্থান, ইরাক ও সিরিয়ার এক বড় অঞ্চলে কর্তৃত্ব স্থাপন, তাদের অভূতপূর্ব নৃশংসতা, বিশ্বের অন্যত্র তার উপস্থিতি ও হামলা এবং সর্বোপরি মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে আইএসের কারণে রাশিয়ার প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতাসহ বিভিন্ন ধরনের মেরুকরণ। ২০১৩ সালে আইএসের সঙ্গে আল-কায়েদার সম্পর্কচ্ছেদও এর একটি কারণ। গত কয়েক বছরে আল-কায়েদার প্রতি দৃষ্টি না থাকার অর্থ কি এই যে আল-কায়েদার মৃত্যু ঘটেছে বা আল-কায়েদার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সন্ত্রাসীরা নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে?

২০০১ সালে আফগানিস্তানে মার্কিন সামরিক অভিযান এবং ক্ষমতা থেকে তালেবানের অপসারণের পর আল-কায়েদা সেন্ট্রাল বা আল-কায়েদার কেন্দ্রীয় কমান্ড ও প্রধান নেতারা হয় মারা যায় অথবা পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। আল-কায়েদার বিরুদ্ধে অব্যাহত সামরিক অভিযানের প্রেক্ষাপটে সংগঠনের দুর্বলতা প্রকাশিত হলেও সাংগঠনিকভাবে আল-কায়েদা সম্পূর্ণভাবে পরাস্ত হয়নি। বরং সংগঠনটি সারা পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে বিভক্ত হয়ে তাদের কার্যক্রম বিস্তারের কৌশল গ্রহণ করে। ২০১৪ সাল নাগাদ আমরা আল-কায়েদার অন্তত তিনটি শক্তিশালী আঞ্চলিক শাখার উপস্থিতি ও সক্রিয়তা চিহ্নিত করতে পারি। সেগুলো হচ্ছে আল-কায়েদা ইন মাগরেব, আল-কায়েদা ইন আরব পেনিনসুলা এবং আল-কায়েদা ইন ইন্ডিয়ান সাব-কন্টিনেন্ট। এর বাইরে আছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আল-কায়েদার সাংগঠনিক উপস্থিতি। এসব আঞ্চলিক সাংগঠনিক কাঠামোর উপস্থিতির অর্থ এই নয় যে বিভিন্ন দেশে আলাদা করে আল-কায়েদার দেশীয় শাখা নেই। অনেকের ধারণা যে এই দেশভিত্তিক শাখাগুলো গুরুত্বপূর্ণ। নিরাপত্তা বিশ্লেষক বারাক মেন্ডেলসন বলেন যে আল-কায়েদা এখন পর্যন্ত সাতটি শক্তিশালী শাখা প্রতিষ্ঠা করেছে। এগুলো হচ্ছে সৌদি আরব (২০০৩), ইরাক (২০০৪), আলজেরিয়া (২০০৬), ইয়েমেন (২০০৯), সোমালিয়া (২০১০), সিরিয়া (২০১২) এবং ভারতীয় উপমহাদেশ (২০১৪) (দেখুন, দ্য আল-কায়েদা ফ্র্যাঞ্চাইজ: দ্য এক্সপানশন অব আল-কায়েদা অ্যান্ড ইটস কনসিকিউয়েন্সেস, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০১৬)।

আল-কায়েদা পুনর্গঠনে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছে ২০০৩ সালে ইরাকে মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপ এবং পরবর্তী নৈরাজ্যকর রাজনৈতিক পরিস্থিতি। ইরাক আক্রমণ আল-কায়েদাকে নতুনভাবে সংগঠিত হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। একদিকে ডি-বাথিফিকেশনের নামে সুসংগঠিত সেনাবাহিনীকে নিষ্ক্রিয় করে হাজার হাজার প্রশিক্ষিত সেনাসদস্য ও অফিসারের চাকরিচ্যুতি, অন্যদিকে দখলদার বাহিনী কর্তৃক একেবারে মৌলিক সেবাব্যবস্থা, যেমন বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহ পুনঃপ্রতিষ্ঠায় ব্যর্থতা, সাধারণ নিরাপত্তাব্যবস্থা ভেঙে পড়া একধরনের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে। প্রাথমিকভাবে সাদ্দাম হোসেনের সমর্থকেরা যে প্রতিরোধ তৈরি করেছিল, তা সামরিকভাবে মোকাবিলা করার সময় মার্কিন বাহিনীর আচরণ, বিশেষ করে আবু গারাইবের মতো বিভিন্ন কারাগারে অত্যাচারের ঘটনা, ইরাকিদের এই বিদ্রোহীদের প্রতিই সহানুভূতিশীল করে তোলে।

এই পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি ঘটে ২০০৫ সালে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া শুরু করার পর। প্রথমত ২০০৫ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সুন্নি জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ না করা এবং ডিসেম্বরের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত নুর-ই-আল মালিকি সরকারের নীতিসমূহ, যা সংখ্যালঘু সুন্নিদের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে অংশগ্রহণের পথ সীমিত করে দেয়। মুক্তাদা আল-সদরের নেতৃত্বাধীন উগ্রপন্থী সদর বাহিনীর উত্থান, তার ব্যাপক প্রভাব এবং একটি অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থা তৈরিতে সরকারের সম্পূর্ণ ব্যর্থতা ও অর্থনৈতিক অনুন্নয়ন এমন অবস্থা তৈরি করে, যে কারণে আল-কায়েদার পক্ষে সেখানে শক্তি সঞ্চয় সম্ভব হয়।

আবু মুসাব আল জারকাবি ১৯৯৯ সাল থেকে ‘জামাত আল তাওহিদ ওয়াল জিহাদ’ নামে যে সংগঠনটি গড়ে তুলেছিলেন, তা-ই ২০০৪ সালের অক্টোবরে আল-কায়েদায় যোগ দেয় এবং আল-কায়েদা ইন ইরাক (একিউআই) হিসেবে প্রকাশিত হয়। ইরাকে মার্কিনিদের বিরুদ্ধে সাদ্দাম সমর্থক প্রতিরোধ বাহিনীর সঙ্গে তাঁর সখ্য থাকলেও জারকাবির লক্ষ্য হয়ে ওঠে শিয়া-সুন্নি বিভেদকে সহিংস সংঘাতে পরিণত করা। তাতে তিনি সাফল্যও লাভ করেন। কিন্তু এই কৌশল নিয়ে আল-কায়েদার নেতাদের সঙ্গে, বিশেষ করে আয়মান আল জাওয়াহিরির সঙ্গে তাঁর বিরোধের সূচনা হয়। ২০০৬ সালের গোড়ায় জারকাবি অন্য কিছু জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে একত্রে গড়ে তোলেন ‘মুজাহিদীন শুরা কাউন্সিল’, উদ্দেশ্য তাঁদের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি করা। জুন মাসে জারকাবি এবং তাঁর দীক্ষাগুরু শেখ আবদেল রহমান মার্কিনদের হামলায় মারা গেলে এর নেতৃত্বে আসেন আবু আইয়ুব আল মাসরি, ১৫ অক্টোবর ‘ইসলামিক স্টেট ইন ইরাক’ বলে নতুন রাষ্ট্রের ঘোষণা দেওয়া হয় এবং আমির-উল-মোমিনিন হিসেবে ঘোষণা করা হয় আবু উমর আল বাগদাদির নাম (আসল নাম হামিদ দাউদ খালিল আল-জাউই, মৃত্যু ২০১০)। আল-কায়েদার কেন্দ্রীয় নেতারা, এমনকি ওসামা বিন লাদেন, এই রাষ্ট্র এবং কথিত আমির-উল-মোমিনিনের প্রতি সমর্থন জানান।

২০১০ সালে কথিত ‘ইসলামিক স্টেট ইন ইরাক’-এর প্রধান বা আমির-উল-মোমিনিনের দায়িত্ব নেন আবু বাকার আল বাগদাদি (আসল নাম ইবরাহিম ইবনে আওয়াদ ইবনে ইবরাহিম ইবনে আলী ইবনে মুহাম্মদ আল-বাদরি); ২০১৩ সালের ৯ এপ্রিল ইসলামিক স্টেটকে সিরিয়ায় সম্প্রসারিত করার ঘোষণা দেওয়া হয়। সিরিয়ায় এর অংশ বলে বিবেচিত হয় ২০১১ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘জাবাত আল নুসরা’। সিরিয়ায় ইসলামিক স্টেটের সম্প্রসারণের ঘোষণা নিয়ে আল-কায়েদাপ্রধান জাওয়াহিরির সঙ্গে আবু বকর বাগদাদির প্রকাশ্য বিরোধের প্রেক্ষাপটে ২০১৪ সালের ২ ফেব্রুয়ারি আল-কায়েদা ইসলামিক স্টেটের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ ঘটায়। স্মরণ করা দরকার যে ইতিমধ্যে দৃশ্যপট থেকে অপসৃত হয়েছেন আল-কায়েদার প্রতিষ্ঠাতা ওসামা বিন লাদেন—২০১১ সালের ২ মে পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে মার্কিন বাহিনী অভিযান চালিয়ে তাঁকে হত্যা করে। তার তিন বছরের মাথায়, ২০১৪ সালের মে-জুন মাসে ইরাকের মসুলসহ বেশ কিছু এলাকা এবং সিরিয়ার একটি অঞ্চলে কর্তৃত্ব স্থাপনের পর ২৯ জুন ‘খেলাফত’ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয় ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড সিরিয়া, দিনটি ছিল ১৪৩৫ হিজরি সনের রমজান মাসের প্রথম দিন। খলিফা হিসেবে ঘোষিত আবু বকর আল বাগদাদি ৪ জুলাই শুক্রবার মসুলের গ্র্যান্ড মসজিদে উপস্থিত হয়ে বক্তব্য দেন।

২. আইএসএর সমান্তরালে আল–কায়েদার শক্তি সঞ্চয়
আবু বকর আল বাগদাদির নেতৃত্বে ২০১৪ সালের জুন মাসে ইসলামিক স্টেটের আবির্ভাবের পর আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের আলোচনায় আইএসের প্রাধান্য থাকলেও আরেক সন্ত্রাসী সংগঠন, ১৯৮৮ সালে প্রতিষ্ঠিত, আল-কায়েদা তখনো সক্রিয় এবং খানিকটা অগোচরেই শক্তি সঞ্চয় করছে। ইতিমধ্যে আল-কায়েদা ২০১০-১১ সালের ‘আরব বসন্ত’-এর ধাক্কা সামলে উঠেছে, পাকিস্তান ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে তাদের বিরুদ্ধে চালানো অব্যাহত ড্রোন হামলা মোকাবিলা করেছে; শীর্ষস্থানীয় নেতা ওসামা বিন লাদেন, আনোয়ার আল আওলাকিসহ একাধিক নেতার মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। আয়মান আল জাওয়াহিরির নেতৃত্বে আল-কায়েদার আঞ্চলিক শাখা আল-কায়েদা ইন মাগরেব (একিউআইএম) এবং আল-কায়েদা ইন আরব পেনিনসুলা (একিউএপি)—প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছে আল-কায়েদা ইন ইন্ডিয়ান সাব-কন্টিনেট (একিউআইএস)। ফলে একদিকে আল-কায়েদার ঘটেছে শক্তিক্ষয়, অন্যদিকে নতুন কাঠামো নিয়ে আল-কায়েদা সংগঠিত হয়েছে।

একিউআইএম প্রতিষ্ঠিত হয় ২০০৭ সালে, আলজেরিয়ার সন্ত্রাসী সংগঠন জিএসপিসি আল-কায়েদার সঙ্গে একীভূত হওয়ার পর। তবে একিউআইএম প্রধানত মালিকে ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। সোমালিয়া, নাইজেরিয়া, আলজেরিয়া, লিবিয়া, মালি, বুরকিনা ফাসো, মৌরিতানিয়া, মরক্কো ও তিউনিসিয়ায় তাদের সহযোগী ও শাখা সংগঠনগুলোর কাজের সমন্বয় এই আঞ্চলিক কাঠামোর উদ্দেশ্য; যেখানে এ ধরনের সাংগঠনিক উপস্থিতি নেই, সেখানে এ ধরনের সংগঠন তৈরি করাও ছিল তাদের প্রচেষ্টার অন্তর্গত। ২০১১ সালে তিউনিসিয়া ও লিবিয়ায় আনসার আল-শারিয়া, ২০১২ সালে তিউনিসিয়ায় কাতিবাত আকবা ইবনে নাফির প্রতিষ্ঠা থেকেই তা প্রতিভাত হয়। এর বাইরে ওই সব দেশে যেসব জঙ্গি সংগঠন আছে, তাদের সঙ্গে আল-কায়েদা সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে তোলে, যেমন সোমালিয়ায় আল শাবাব, নাইজেরিয়ায় বোকো হারাম।

একিউআইএমের বিস্তৃতি, শক্তি সঞ্চয় ও ভয়াবহতা বোঝার জন্য ২০১২-১৩ সালে মালির উত্তরাংশে এক বড় এলাকাজুড়ে তাদের দখল প্রতিষ্ঠার কথা স্মরণই যথেষ্ট। ফ্রান্সের সামরিক অভিযানের মধ্য দিয়েই এই এলাকায় মালি সরকারের কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়; কিন্তু এরপর একিউআইএম ফ্রান্সে তাদের তৎপরতা বৃদ্ধি করেছে এবং কয়েকটি হামলা চালানোর চেষ্টা করেছে। এই গোষ্ঠীর আক্রমণের আরও উদাহরণ রয়েছে আলজেরিয়া থেকে বুরকিনা ফাসো পর্যন্ত। লিবিয়ায় গাদ্দাফি সরকারের পতনের পর সৃষ্ট পরিস্থিতির সুযোগে লিবিয়ার কালোবাজার থেকে একিউআইএমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জঙ্গিরা অস্ত্র সংগ্রহ করেছে বলেই জানা যায়। তাদের অর্থের এক প্রধান উৎস হচ্ছে পশ্চিমাদের পণবন্দী হিসেবে নেওয়া। এ বছরের জুন মাসের শেষ দিকে এ রকম একজন পণবন্দী সুইডেনের নাগরিক ছয় বছর আটক থাকার পর মুক্তি লাভ করেছেন।

২০০৯ সালে এসে উদ্ভব ঘটে আল-কায়েদা ইন আরব পেনিনসুলার (একিউএপি); এই আঞ্চলিক কাঠামোর প্রধান এলাকা হচ্ছে ইয়েমেন ও সৌদি আরব। ইয়েমেনে ১৯৯০-এর দশক থেকেই আফগান যুদ্ধফেরত যোদ্ধারা সংগঠিত ছিল বিভিন্ন নামে, যেমন ইসলামিক জেহাদ ইন ইয়েমেন (১৯৯০-৯৪), আর্মি অব এডেন আবয়িয়ান (১৯৯৪-৯৮) এবং আল-কায়েদা ইন ইয়েমেন (১৯৯৮-২০০৩)। এরাই ২০০০ সালের অক্টোবরে এডেন বন্দরে মার্কিন যুদ্ধজাহাজ ইউএসএস কোলে বোমা হামলা চালিয়েছিল। ইয়েমেনে জঙ্গিদের বিকাশের পথ উন্মুক্ত হয়েছিল আলী আবদুল্লাহ সালেহ সরকারের প্রত্যক্ষ মদদেই, দক্ষিণের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মোকাবিলা করার কৌশল হিসেবে সালেহ আশির দশকে আফগানিস্তানে ইয়েমেনিদের পাঠিয়েছিলেন এবং তাদের পরে দক্ষিণে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়। সেই জঙ্গিরাই পরে আল-কায়েদার সঙ্গে যুক্ত হয়; ২০১১ সালে প্রতিষ্ঠা হয় আনসার আল শারিয়া। এরাই ২০১১ সালে আবয়ান প্রদেশের একটি এলাকা দখল করে নিয়ে সেখানে তাদের শাসনব্যবস্থা চালু রাখে প্রায় এক বছর। সালেহ সরকারের পতনের পর (২০১২) তার উত্তরসূরির বিরুদ্ধে শিয়া মতানুসারী হুতি জনগোষ্ঠী যে বিদ্রোহ চালাচ্ছে, তার বিপরীতে আল-কায়েদা সুন্নি মতাবলম্বীদের প্রতিনিধিত্বের দাবিদার হয়ে গৃহযুদ্ধে শরিক হয়েছে এবং ক্রমাগতভাবে শক্তি সঞ্চয় করে চলেছে। নতুন সরকারের প্রতি সমর্থনের নামে এই সংকটে সৌদি আরবের সংযুক্তি এবং রাজনৈতিক সমাধানের বদলে নির্বিচার হামলা ও যুদ্ধ এই পরিস্থিতির আরও অবনতিই ঘটিয়েছে। আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের ফেলো ক্যাথরিন জিমারম্যান গত ১৩ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের একটি সাব-কমিটির শুনানিতে ‘আল-কায়েদা ইজ স্ট্রেংদেনিং ইন দ্য শ্যাডোজ’ শিরোনামে দেওয়া বক্তব্যে বলেন যে ইয়েমেন আল-কায়েদার বৈশ্বিক অপারেশন এবং জ্যেষ্ঠ নেতাদের একটি ‘নিরাপদ স্বর্গে’ পরিণত হয়েছে।

একিউএপির দ্বিতীয় প্রধান ক্ষেত্র হচ্ছে সৌদি আরব। আল-কায়েদার সঙ্গে সৌদি যোগাযোগের একটি দিক হচ্ছে আদর্শিক, অন্যটি ঐতিহাসিক। ওসামা বিন লাদেন সৌদি নাগরিক ছিলেন এবং ১৯৯১ সাল পর্যন্ত সৌদি ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে তাঁর কোনো বিরোধই ছিল না। তদুপরি ৯/১১-এর ১৯ জন হামলাকারীর ১৫ জন ছিল সৌদি নাগরিক এবং এই হামলার পরিকল্পনাকারীদের বড় অংশই এসেছিল সৌদি আরব থেকে। এই অভিযোগও আছে যে সৌদি আরবের ক্ষমতাসীন ও প্রভাবশালীরা জ্ঞাতসারেই আল-কায়েদার এই অভিযানে অর্থের সংস্থান করেছিল। এসব তথ্যের পাশাপাশি এটাও আমরা জানি যে ২০০৩ সাল থেকে সৌদি আরবের ভেতরেই আল-কায়েদার সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধি পেয়েছে এবং আল-কায়েদার জঙ্গিরা বেশ কিছু হামলা চালাতে সক্ষম হয়েছে।

ক্যাথরিন জিমারম্যানের মতে, সাম্প্রতিক কালে আল-কায়েদার শক্তি সঞ্চয়ে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে এবং এখনো রেখে চলেছে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ। জাওয়াহিরি যে ইরাক, সিরিয়া ও লেবাননকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন, সেটা তাঁর একাধিক বক্তব্যেই স্পষ্ট।

এসব সুনির্দিষ্ট আঞ্চলিক শাখার বাইরেও আল-কায়েদার সঙ্গে যুক্ত সন্ত্রাসী সংগঠন আছে এবং তার অনেকগুলো যথেষ্ট শক্তিশালী বলেই বিবেচিত। আল-কায়েদার একটা বড় উপস্থিতি আমরা দেখতে পাই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়, যেখানে আঞ্চলিক শাখা না থাকলেও সাংগঠনিকভাবে যুক্ত সংগঠন ছিল বা রয়েছে; যেমন ইন্দোনেশিয়ার লস্কর-এ-জুনাদুল্লাহা, জামিয়া ইসলামিয়া, মালয়েশিয়ায় কুম্পুলান মুজাহিদিন, থাইল্যান্ডের জামিয়া সালাফিয়া। আবু সায়েফ এবং মরো ইসলামিক ফ্রন্ট ইসলামিক স্টেটের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের আগ পর্যন্ত আল-কায়েদার সঙ্গেই যুক্ত ছিল। এ ধরনের যোগাযোগ ১৯৯০-এর গোড়া থেকেই উপস্থিত। যে কারণে ১৯৯৪ সালে রামজি ইউসুফ এবং ৯/১১-এর অন্যতম পরিকল্পনাকারী খালিদ শেখ মুহাম্মদ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বসেই ১২টি মার্কিন বিমান ছিনতাই করার পরিকল্পনা করেছিলেন; কুয়েতি জঙ্গি ওমর আল ফারুক দক্ষিণ এশীয় গোষ্ঠীর সদস্যদের প্রশিক্ষণের জন্য ক্যাম্প তৈরি করেছিলেন। এসব জঙ্গিই এই অঞ্চলের বিভিন্ন দেশে সন্ত্রাসী হামলা চালায়, যার মধ্যে আছে ২০০২ সালে বালিতে, ২০০৩ সালে জাকার্তায় হোটেলে এবং ২০০৪ সালে অস্ট্রেলিয়ার দূতাবাসে বোমা হামলা। তাদের এসব কার্যক্রমের প্রভাব কেবল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় নয়, বরং দক্ষিণ এশিয়াতেও আছে।

বাংলাদেশের পাঠক, নিরাপত্তা বিশ্লেষক এবং সন্ত্রাসবাদ–বিরোধী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের জন্য আল-কায়েদার যে আঞ্চলিক শাখার কার্যক্রম বিশেষ মনোযোগ দাবি করে, তা হচ্ছে আল-কায়েদা ইন ইন্ডিয়ান সাব-কন্টিনেন্ট (একিউআইএস)। আর এই শাখার পক্ষ থকেই জুন মাসে প্রকাশিত হয়েছে নতুন দলিল ‘কোড অব কনডাক্ট ফর মুজাহিদিন ইন দ্য সাব-কন্টিনেন্ট’ বা ‘উপমহাদেশের মুজাহিদদের আচরণবিধি’।

৩. উপমহাদেশে আল-কায়েদার নজর
আল-কায়েদার তৃতীয় আঞ্চলিক কাঠামোটি ঘোষণা করা হয় ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে—আল-কায়েদা ইন ইন্ডিয়ান সাব-কন্টিনেন্ট (একিউআইএস)। প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই আল-কায়েদার উপস্থিতি দক্ষিণ এশিয়ায়, বিশেষ করে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে রয়েছে এবং ১৯৯৬ সালে ওসামা বিন লাদেন এক ভিডিওতে ভারত, বিশেষ করে কাশ্মীরের কথা উল্লেখ করেছিলেন। ফলে এই অঞ্চলে আল-কায়েদা দীর্ঘদিন ধরেই উপস্থিত ছিল। আলাদা করে একটি আঞ্চলিক শাখা গঠনকে এই অঞ্চলের সহযোগী সংগঠনগুলোর সম্পর্ককে ‘আনুষ্ঠানিক রূপ প্রদান’ বলেই মনে করেন অনেক বিশ্লেষক, যেমন যুক্তরাষ্ট্রের মিলিটারি একাডেমির কমব্যাটিং টেররিজম সেন্টারের (সিটিসি) ডন রেসলার (দেখুন, হাউ আল-কায়েদা সারভাইভড ড্রোনস, আপ রাইজিংস অ্যান্ড ইসলামিক স্টেট, এরোন জেলিন সম্পাদিত গ্রন্থ, প্রকাশক: দ্য ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউট ফর নিয়ার ইস্ট পলিসি, জুন, ২০১৭)।

তা ছাড়া, আল-কায়েদার ম্যাগাজিন রিসারজেন্স-এর প্রথম সংখ্যায় বলা হয়েছিল, এই সংগঠন গড়ে তোলা হয়েছে এই অঞ্চলে কয়েক বছর ধরে ‘জিহাদে’ লিপ্ত বেশ কিছু সংগঠনের মধ্যে সমন্বয় বা মার্জারের মাধ্যমে। এই সাংগঠনিক রূপ এমন সময়ে প্রদান করা হয়, যখন ইসলামিক স্টেট দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে। আইএসের সঙ্গে প্রতিযোগিতার কথা আল-কায়েদা অবশ্য স্বীকার করে না। ২০১৫ সালে রিসারজেন্স-এর এক বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত আহমেদ ইয়াহিয়া গাদানের নিবন্ধের ভাষ্য হচ্ছে, এই শাখা গঠনের কাজ শুরু হয় ২০১৩ সালের মাঝামাঝি। কোনো কোনো নিরাপত্তা বিশ্লেষক দাবি করেন, এই ধরনের উদ্যোগ ২০১১ সালেও নেওয়া হয়েছিল।
অন্যদিকে আফগানিস্তান পরিস্থিতি যে এই আঞ্চলিক শাখা গঠনের সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে কাজ করেছে, সেটা সহজেই বোধগম্য। আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের নির্ধারিত সময়কে (২০১৪) বিবেচনায় রেখেই আল-কায়েদা এই পদক্ষেপ নিয়েছিল। রিসারজেন্স ম্যাগাজিনের প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত হাসান ইউসুফের নিবন্ধেও তা উল্লেখিত হয়েছে। ২০১২ সালে আফগানিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন বাহিনীর বিদায়ী কমান্ডার জেনারেল জন এলেন বলেছিলেন, আল-কায়েদা আফগানিস্তানে আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, তাঁর ভাষায় ‘রি-এমার্জড’; তাদের অর্থ ও লোকবল বেড়েছে এবং মার্কিন সৈন্যদের সঙ্গে তারা সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে।

আগের সাংগঠনিক যোগাযোগই যে এই নতুন কাঠামোর ভিত্তি, সেটা বোঝা যায় এর প্রধান হিসেবে শেখ অসিম উমরের নিয়োগ থেকে। শেখ অসিম উমর জন্মসূত্রে ভারতীয় নাগরিক কিন্তু পাকিস্তানভিত্তিক হরকাতুল জিহাদুল ইসলাম (হুজি) এবং হরকাতুল মুজাহিদিনের প্রচারক ছিলেন। একিউআইএসের ঘোষণার আরও যেসব উল্লেখযোগ্য দিক ছিল, যা বিশেষ করে বাংলাদেশের পাঠকদের জন্য গুরুত্ব বহন করে তা হলো, এই সংগঠনের কর্মক্ষেত্রের তালিকায় সুস্পষ্টভাবে বাংলাদেশের সংযুক্তি, বাংলাদেশে সেই সময়ে জঙ্গি তৎপরতা বৃদ্ধি এবং বাংলাদেশে জঙ্গি হামলার ক্ষেত্রে নতুন নতুন মাত্রা যোগ হওয়া। তদুপরি আহমেদ ইয়াহিয়া গাদানের ভাষ্য অনুযায়ী একিউআইএস প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টার শুরু এবং বাংলাদেশে জঙ্গি তৎপরতা বৃদ্ধির একটা যোগসূত্র পাওয়া যায়। সেই সময়ে একিউআইএস বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের জন্য আলাদা আলাদা প্রধানও নিয়োগ করে। জাওয়াহিরির ৫৫ মিনিটের ভিডিওতে বলা হয়েছিল, তাঁরা ভারতে ‘ইসলামের প্রত্যাবর্তন’ চান, যা ‘বার্মা (মিয়ানমার), কাশ্মীর, গুজরাট, বাংলাদেশ, আহমেদাবাদ ও আসামকে সাহায্য করবে।’

প্রতিষ্ঠার পরপরই একিউআইএস ২০১৪ সালের ৬ সেপ্টেম্বর করাচি বন্দর থেকে পাকিস্তানি একটি যুদ্ধজাহাজ ছিনতাইয়ের চেষ্টা করে; লক্ষ্য ছিল সেটা ব্যবহার করে ভারত মহাসাগরের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে টহলরত মার্কিন নৌযানগুলোর ওপর হামলা চালানো। তাতে সাফল্য না এলেও দেখা যায় যে সাংগঠনিকভাবে বড় ধরনের অভিযানের ব্যাপারে একিউআইএস উৎসাহী। পাকিস্তানে আল-কায়েদার শক্তির পেছনে রয়েছে আফগান তালেবানের সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। আফগান তালেবানের মূল নেতৃত্ব, যা কোয়েটা শ‌ুরা বলে পরিচিত ও আরও উগ্রপন্থী অংশ হাক্কানি নেটওয়ার্ক—দুই-ই পাকিস্তানভিত্তিক। পাকিস্তান যদিও সব সময়ই দাবি করে আসছে এবং ২০১৪ সালের পর জোর দিয়ে বলছে যে হাক্কানি নেটওয়ার্ককে তারা সমর্থন করে না, কিন্তু বিভিন্ন ঘটনা এই সম্পর্কের ইঙ্গিত দেয়।

তালেবানের সঙ্গে আল-কায়েদার যোগাযোগ কেবল ২০০১ সালের আগের ঘটনা নয়। আল-কায়েদার প্রধান জাওয়াহিরি সব সময়ই আফগানিস্তানের তালেবানপ্রধানকে ‘আমিরুল মোমিনিন’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে এসেছেন এবং তাঁর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছেন। ২০১৫ সালের জুলাই মাসে মোল্লা ওমরের মৃত্যুর পর মোল্লা আখতার মনসুরের প্রতি এবং মনসুর নিহত হওয়ার পর তাঁর উত্তরসূরি মোল্লা হায়বাতুল্লাহ আখুঞ্জাইয়ের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। পাকিস্তানে আল-কায়েদার আদর্শের অনুসারী এবং সাংগঠনিকভাবে ঘনিষ্ঠ জঙ্গি সংগঠনও রয়েছে, যেমন তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি), লস্কর-ই-তাইয়েবা, হুজি, হরকাতুল মুজাহিদিন, জইশ-ই-মুহাম্মদ।

আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সৈন্য হ্রাস, হামিদ কারজাই এবং ক্ষমতাসীন আশরাফ ঘানি সরকারের অপশাসন ও দুর্নীতি, পাকিস্তান-ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বিতা, সাধারণ মানুষের হতাশা, অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি, আন্তর্জাতিক সমাজের প্রতিশ্রুতি পালনে ব্যর্থতা এবং পরিস্থিতির রাজনৈতিক সমাধানের অনুপস্থিতির কারণে গত কয়েক বছরে তালেবান ক্রমাগতভাবে শক্তি সঞ্চয় করে চলেছে। এ বছরের মে মাসে স্পেশাল ইন্সপেক্টর জেনারেল ফর আফগানিস্তান রিকন্সট্রাকশনের (সিগার) দেওয়া হিসাব অনুযায়ী দেশের ৪০ শতাংশ এলাকা হয় তালেবানের নিয়ন্ত্রণে, তাদের প্রভাবের আওতায় বা সংঘাতের মধ্যে আছে; বাকি ৬০ শতাংশ আছে সরকারের নিয়ন্ত্রণে। তালেবান-নিয়ন্ত্রিত এলাকায় আল-কায়েদা প্রশিক্ষণ শিবির গড়ে তুলতে সক্ষম হচ্ছে বলেই জানা যায়।

২০১৫ সালের অক্টোবরে মার্কিন এবং আফগান সৈন্যরা পাকিস্তান সীমান্তের কাছে কান্দাহার প্রদেশে যে প্রশিক্ষণ শিবিরে অভিযান চালায়, তাতে দুই শ জঙ্গি মারা যায় এবং এই শিবিরটি ছিল প্রায় ৩০ বর্গমাইল এলাকাজুড়ে (নিউইয়র্ক টাইমস, ২৯ ডিসেম্বর ২০১৫)। ২০১৫ সাল থেকে আফগান এবং মার্কিন বাহিনী আফগানিস্তানে আল-কায়েদার বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়েছে, পাকিস্তানে ড্রোন হামলা করে একাধিক আল-কায়েদা নেতাকে হত্যা করেছে। কিন্তু পাকিস্তানে ড্রোন হামলায় বেসামরিক হতাহতের পরিমাণ থেকে এই ধরনের ব্যবস্থার দীর্ঘমেয়াদি ফলাফল খুব ইতিবাচক হয়েছে বলে মনে হয় না।

ভারতে আল-কায়েদা নিজের অবস্থান তৈরি করার চেষ্টা করে আসছে এবং সেখানে ইন্ডিয়ান মুজাহিদিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা সৃষ্টি হয়েছে। স্মরণ করা যেতে পারে, ২০১৫ সালে আল-কায়েদার যে তিন ব্যক্তি ভারতে আটক হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন মোহাম্মদ আসিফ; আসিফ একিউআইএসের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন এবং আল-কায়েদার শ‌ুরার যে বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তাতে অংশ নিয়েছিলেন (রয়টার্স, ১৭ ডিসেম্বর ২০১৫)। ফলে একিউআইএস গোড়া থেকেই ভারতে নিজেদের শক্তিশালী করার চেষ্টায় ব্যাপৃত।

এই সব চেষ্টা সত্ত্বেও গত তিন বছরে একিউআইএসের তালিকায় সাফল্য খুব বেশি নেই। যা আছে তার অন্যতম হচ্ছে বাংলাদেশে—২০১৪ ও ২০১৫ সালে ব্লগার, অধ্যাপক, প্রকাশক ও সমকামী অধিকারকর্মীকে তারা হত্যা করতে সক্ষম হয়। কিন্তু সামগ্রিকভাবে গত এক বছরে গোটা অঞ্চলে আল-কায়েদার কার্যক্রমের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে বলেই নিরাপত্তা বিশ্লেষক, বিশেষত যাঁরা আল-কায়েদার গতিবিধির ওপর নজর রাখেন, তাঁরা বলছেন। ২৭ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি সভার সন্ত্রাসবাদ, পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্তার রোধ ও বাণিজ্যসংক্রান্ত উপকমিটির এবং ১৩ জুলাই কাউন্টার টেররিজম ও ইন্টেলিজেন্স-বিষয়ক হোমল্যান্ড সিকিউরিটি উপকমিটির শুনানিতে বিশেষজ্ঞরা, যেমন সেথ জোন্স ও ক্যাথরিন জিমারম্যান সেই রকম মতই প্রকাশ করেছেন। জুলাই মাসের শুনানিতে জিমারম্যান বলেন, ‘একিউআইএসের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের প্রচার বৃদ্ধি পেয়েছে; যার মানে হতে পারে যে তারা সংগঠনটিকে পুনরুজ্জীবনের চেষ্টা করছে।’ জুন মাসের শেষ নাগাদ একিউআইএসের পক্ষ থেকে ঘোষিত ‘কোড অ্যান্ড কনডাক্ট ফর মুজাহিদিন ইন দ্য সাব-কন্টিনেন্ট’ বা ‘উপমহাদেশের মুজাহিদদের আচরণবিধি’ তার সুস্পষ্ট ইঙ্গিতই দেয়।

৪.বাংলাদেশ নিয়ে ভাবার যথেষ্ট কারণ রয়েছে
আল-কায়েদা ইন ইন্ডিয়ান সাব-কন্টিনেন্ট (একিউআইএস) জুন মাসের শেষ নাগাদ যে ‘কোড অব কনডাক্ট ফর মুজাহিদিন ইন দ্য সাব-কন্টিনেন্ট’ বা ‘উপমহাদেশের মুজাহিদদের আচরণবিধি’ ঘোষণা করেছে, তাতে কেবল সংগঠনের উদ্দেশ্য এবং সাংগঠনিক কাঠামোর ধারণাই দেওয়া হয়নি, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ভারত, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে তাদের লক্ষ্যবস্তু কী কী, তা-ও বর্ণনা করেছে। এগুলো থেকে সাংগঠনিকভাবে বিস্তারের চেষ্টা ও নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধির চেষ্টা দুর্নিরীক্ষ্য নয়।

আফগানিস্তানের তালেবানের প্রতি একিউআইএসের নিরঙ্কুশ আনুগত্য প্রকাশ করে একে ‘ইসলামিক আমিরাত’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে এবং দাবি করা হয়েছে যে তাদের সদস্যরা মার্কিন এবং আফগান সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অংশ নিচ্ছে। পাকিস্তানে আল-কায়েদার প্রধান অগ্রাধিকার লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে মার্কিন নাগরিকেরা। তারপর আছে অমুসলিম দেশের প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা। ‘অত্যাচারী ব্রিটিশ ব্যবস্থাকে’ তৃতীয় লক্ষ্য বলে তারা সেনাবাহিনীর অফিসার, সাধারণ সৈনিক, পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থার সদস্য, সরকারি কর্মচারীদেরই কেবল চিহ্নিত করেনি, একই সঙ্গে তারা ধর্মনিরপেক্ষতার প্রচারকদেরও তাতে অন্তর্ভুক্ত করেছে। সেনাবাহিনীর ব্যাপারে বলা হয়েছে যে সেনাবাহিনীর কর্মচারীরা যেখানেই থাকুক—যুদ্ধক্ষেত্রে বা ছাউনিতে—তারা লক্ষ্যবস্তু বলে বিবেচিত হবে।

ভারত, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের লক্ষ্যবস্তুগুলোকে একত্রে তালিকাবদ্ধ করা হয়েছে। ভারতের ক্ষেত্রে মার্কিন এবং ইসরায়েলের নাগরিকদের বলা হয়েছে প্রথম লক্ষ্যবস্তু এবং তারপর আছে ‘ভারতীয় রাষ্ট্র’। ভারতীয় রাষ্ট্রকে লক্ষ্যবস্তু বলে চিহ্নিত করার যেসব কারণ দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে আছে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও ইসরায়েলের সঙ্গে সহযোগিতা, কাশ্মীরে মুসলিমদের ওপর নিপীড়ন, দেশবিভাগের সময় থেকে ‘মুসলিমদের গণহত্যার নীতি অনুসরণ’ এবং বাংলাদেশের ‘ধর্মনিরপেক্ষ সরকার ও ধর্মনিরপেক্ষ আন্দোলনের রক্ষাকর্তা’র ভূমিকা পালন। ‘বাংলাদেশের মুসলিমদের’ কাছ থেকে ‘অন্যায়ভাবে পানি দখল করা’কেও একটি কারণ বলে দেখানো হয়েছে। ভারতের সেনাবাহিনী ও অন্যান্য বাহিনী, বিশেষত ‘যাদের হাতে কাশ্মীরিদের রক্ত লেগে আছে’, তাদের বলা হয়েছে লক্ষ্যবস্তু। বাংলাদেশ ও ভারতের ক্ষেত্রে ব্লাসফেমিতে যুক্তদের এই তালিকায় রাখা হয়েছে। মিয়ানমার, যাকে এই ডকুমেন্টে আরাকান বলে বলা হয়েছে, সেখানে সেনাবাহিনীর দখল থেকে ‘ইসলামিক আরাকান’কে মুক্ত করা তাদের লক্ষ্য।

এই প্রকাশনায় যদিও বলা হয়েছে যে একিউআইএস মনে করে যে শিয়া, আহমদিয়া ও ইসমাইলি সম্প্রদায় (যাদের রাফিদি, কাদিয়ানি ও ইসমাইলি বলে বর্ণনা করা হয়েছে) যদি ‘সুন্নি সম্প্রদায়ের সদস্যদের বিরুদ্ধে প্রকৃত যুদ্ধ ঘোষণা না করে’, তবে তাদের বিরুদ্ধে অভিযান অপ্রয়োজনীয়, কিন্তু তারা এ-ও বলেছে যে এই সম্প্রদায়ের সদস্যরা মুসলিমদের অংশ নয় (তাদের ভাষায় অবিশ্বাসী বা আনবিলিভার)। যদি কোনো খ্রিষ্টান মুসলিমদের ‘ইসলামের অবমাননা’ করে, তবে ‘খ্রিষ্টানদের হাত থেকে মুসলিমদের রক্ষার জন্য’ তারা আক্রমণ করবে।

এই সব সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ ও আচরণবিধির ঘোষণা এই ইঙ্গিত দেয় যে একিউআইএস তাদের প্রাথমিক সাংগঠনিক শক্তি সঞ্চয় করেছে; একই সঙ্গে এ থেকে ধারণা করা যায় যে আল-কায়েদা নেতারা অন্যান্য আঞ্চলিক শাখায় একধরনের স্থিতিশীলতা তৈরি করে এখন দক্ষিণ এশিয়ায় মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করছেন। আল-কায়েদার প্রতিষ্ঠা এবং পরবর্তী ইতিহাস আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে এই অঞ্চলেই তাদের সূচনা হয়েছিল, আল-কায়েদার কেন্দ্রীয় নেতারা এখনো পাকিস্তান ও আফগানিস্তানেই আছেন এবং তাঁদের কর্মকাণ্ড ওই দুই দেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।

একই সঙ্গে এই প্রকাশনা থেকে আমরা দেখতে পাই যে ইসলামিক স্টেটের নৃশংস আচরণের বিপরীতে আল-কায়েদা সাধারণের মধ্যে, বিশেষত সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীর কাছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা তৈরির চেষ্টা করছে এবং তাদের কৌশলের অংশ হিসেবে কিছু বিষয় উপস্থাপন করেছে। এগুলোও আমাদের বিবেচনায় রাখা দরকার, যাতে কেউ সহজেই এই ধরনের কৌশলের শিকার হয়ে না পড়ে। যেমন জিহাদের প্রসঙ্গ এবং তাদের দেওয়া আচরণবিধি মেনে চলা।

এই প্রকাশনায় বলা হয়েছে, জিহাদ একটি সামাজিক বিষয়; ফলে যেকোনো ব্যক্তি ও সংগঠনের আচার-আচরণই ‘গোটা মুসলিম উম্মাহর’ ওপর প্রভাব ফেলে। যে কারণে কেবল আল-কায়েদা সদস্য নয়, অন্য সংগঠনগুলোকেও এই সব বিধি মানতে আহ্বান জানিয়েছে। তারা বলেছে যে যারা অস্ত্র ধারণ করেনি, তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা বা তাদের পীড়িত করা থেকে বিরত হয়ে তারা তাদের মনোযোগ দেবে ‘শরিয়াহর শত্রু’ এবং ‘বিধর্মী (বা নাস্তিক) ব্যবস্থার রক্ষকদের’ বিরুদ্ধে।

তারা মনে করে, যেসব জায়গায় সাধারণ নাগরিকেরা সমবেত হয় এবং যেখানে সাধারণ মুসলমানদের আহত হওয়ার আশঙ্কা আছে, যেমন মসজিদ, জানাজা, বাজার ও আদালত, সেখানে বিস্ফোরণ ঘটানো সম্পূর্ণ ভুল। তারা মাজার ও কবরে বোমা বিস্ফোরণকেও ভুল বলে বর্ণনা করেছে। এই প্রকাশনায় আরও বলা হয়েছে, তারা মনে করে, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে সেনাসদস্যদের স্ত্রী ও সন্তানদের হত্যা করা সঠিক নয়। তারা বলেছে, যেসব সামরিক অভিযান সাধারণ মুসলমানের কাছে বোধগম্য নয় এবং যা ‘মুজাহিদিনদের’ কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নেয়, সেগুলো ‘এড়িয়ে চলতে’ হবে। বিভিন্ন ধরনের সূক্ষ্ম বিষয়, যেমন কাউকে ‘কাফের’ বলে চিহ্নিত করা ও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে, সাধারণ সদস্যদের নিষেধ করা হয়েছে এবং সেই বিষয়ে জ্ঞানী উলেমার ওপর নির্ভরের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

আমি এই দীর্ঘ আলোচনার কোথাও কী ধরনের পরিবেশে এবং কী ধরনের রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থায় আল-কায়েদার সহযোগী সংগঠন বা তার আঞ্চলিক শাখাগুলো শক্তিশালী হয়েছে, সে বিষয়ে আলোচনা করিনি; এই বিষয়ে আলোচনার প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করা যায় না (আমি এই বিষয়ে অতীতে আলোকপাত করেছি আমার চার পর্বের ধারাবাহিক রচনায়, প্রথম আলো, ৯-১২ আগস্ট ২০১৬)। এখনকার আলোচনার লক্ষ্য হচ্ছে, গোটা বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে আল-কায়েদার সংগঠিত হওয়ার ধারণা দেওয়া এবং দক্ষিণ এশিয়ায় তাদের সম্ভাব্য কৌশলের দিকে মনোযোগ আকর্ষণ করা। এটি বিশেষভাবে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থায় জরুরি বলেই মনে হয়। কেননা, ইতিমধ্যেই বিশেষজ্ঞরা এ নিয়ে উদ্বেগের কথা বলেছেন।

এ বছরের ২৭ এপ্রিল মার্কিন কংগ্রেসে আফগানিস্তান এবং এই অঞ্চলবিষয়ক শুনানিতে নিরাপত্তাবিষয়ক বিশেষজ্ঞ সেথ জোন্স বাংলাদেশে আইএস ও আল-কায়েদার বিস্তৃতির বিষয়ে তাঁর লিখিত বক্তব্যে এবং প্রশ্নোত্তরে কিছু মন্তব্য করেন, যা প্রণিধানযোগ্য। প্রতিনিধি সভার একটি উপকমিটি আয়োজিত শুনানিতে জোন্স বলেন, ‘আমরা দেখেছি বাংলাদেশে জঙ্গি সংগঠন আইএস তাদের হামলাসহ বিভিন্ন কার্যক্রম জোরদার করেছে। ভারতীয় উপমহাদেশের পাশাপাশি আমরা বাংলাদেশে আল-কায়েদার উত্থানও লক্ষ করেছি।’ কংগ্রেসম্যান উইলিয়াম কিয়েটিংয়ের এক প্রশ্নের জবাবে সেথ জোন্স বলেন, ‘সন্ত্রাসবাদ প্রশ্নে আমরা প্রায়ই আফগানিস্তানকে অনেক বেশি গুরুত্ব দিই। তবে সমস্যাটি অঞ্চলগত। আমরা এই ইস্যুতে প্রায়ই পাকিস্তানকেও গুরুত্ব দিই। অথচ গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে জিহাদি কর্মকাণ্ড ব্যাপক হারে বেড়েছে।’ আরেক প্রশ্নের উত্তরে জোন্স বলেন, বাংলাদেশে আল-কায়েদার বিস্তারের কারণ একই সঙ্গে ভৌগোলিক ও কৌশলগত। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ নিয়ে ভাবার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।’ জোন্স তাঁর এই ধরনের বক্তব্যের ওপর আবারও জোর দেন ১৩ জুলাই মার্কিন প্রতিনিধি সভার কাউন্টার টেররিজম ও ইন্টেলিজেন্স-বিষয়ক হোমল্যান্ড সিকিউরিটি উপকমিটির সামনে দেওয়া লিখিত বক্তব্যে। জোন্স বলেন, বাংলাদেশে আল-কায়েদার তৎপরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

মার্কিন সেনা একাডেমির অধীন কমব্যাটিং টেররিজম সেন্টারের (সিটিসি) ম্যাগাজিন সিটিসিসেন্টিনেলকে ২২ ফেব্রুয়ারি দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আফগানিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন জেনারেল জন নিকোলসন বলেন, ‘বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল’ করার জন্য আল-কায়েদার দক্ষিণ এশীয় শাখাটি (একিউআইএস) সক্রিয় রয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশে আল-কায়েদার কর্মকাণ্ড লক্ষ করছি। ভারতের সঙ্গে আমাদের ক্রমবর্ধমান সুসম্পর্কের কারণে বাংলাদেশের অস্থিতিশীলতা নিয়ে আমরা বেশ উদ্বিগ্ন।’ নিকোলসন এ-ও দাবি করেন, বাংলাদেশে আল-কায়েদার কর্মকাণ্ডের কিছু তথ্য তাঁদের হাতে রয়েছে। এই সব তথ্য ২০১৫ সালে আফগানিস্তানে আল-কায়েদার প্রশিক্ষণ শিবিরে অভিযানের সময় পাওয়া গেছে বলেই তাঁর বক্তব্যে ইঙ্গিত রয়েছে।

তা ছাড়া, দেশে একাধিকবার নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও আনসার আল ইসলামের অস্তিত্ব আছে বলেই দেখা যাচ্ছে, তাদের অনলাইন উপস্থিতিও বেশ উল্লেখযোগ্য। এপ্রিলে একিউআইএসের বাংলাদেশ প্রধান আফগানিস্তানের কান্দাহারে আত্মঘাতী বোমা হামলায় নিহত হয়েছেন বলে সংগঠনের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে; সম্প্রতি আমরা জানতে পারি যে ২০১৫ সালে আফগানিস্তানে মার্কিন অভিযানে আরেকজন বাংলাদেশি সাইফুল ইসলাম হাসান নিহত হন।

জঙ্গি সংগঠনের কার্যকলাপ এবং সাংগঠনিক প্রস্তুতি বিষয়ে যত বেশি জানা যাবে, যত বেশি আলাপ-আলোচনার সুযোগ থাকবে, ততই এই ধরনের বিপদ মোকাবিলা করা সহজ হবে। অন্যথায় বিপদের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কাই বেশি।

প্রথম আলো’তে প্রকাশিত, ২৯ জুলাই ২০১৭ – ১ আগস্ট ২০১৭

Leave a Reply