জামায়াতে ইসলামীর অভ্যন্তরে সাংগঠনিক বিতর্ক এবং সেই সূত্র ধরে দলের একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাকের পদত্যাগ, দলের নির্বাহী পরিষদের সদস্য মুজিবুর রহমান মঞ্জুর বহিষ্কার, ইতিমধ্যে দলের সংস্কারের ব্যাপারে কমিটি গঠন এবং নতুন দল গঠনের ব্যাপারে জামায়াতের উদ্যোগ এখন বিভিন্নভাবে আলোচিত হচ্ছে।
জামায়াতবিষয়ক চলমান আলোচনার দুটি দিক আছে। প্রথমটি মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াতের ভূমিকার জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে দলের সংস্কার করা। প্রথমটি নিয়ে আলোচনার বা বিতর্কের অবকাশ নেই। বাংলাদেশের রাজনীতিতে অংশগ্রহণের আগেই এই ক্ষমা প্রার্থনা করা দরকার ছিল। সেই ক্ষমাপ্রার্থনা ছাড়াই ১৯৭১ সালে নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়া জামায়াতে ইসলামীসহ চারটি দল জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলামী, মুসলিম লীগ এবং পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি (পিডিপি) চার দশক ধরে রাজনীতিতে অংশ নিয়েছে। কিন্তু এখন যদি জামায়াত ক্ষমা প্রার্থনাও করে, তবু এই নাম বহাল রেখে রাজনীতিতে আগের মতো অংশগ্রহণের সুযোগ থাকবে, এমন মনে করার কোনো কারণ নেই। ফলে দ্বিতীয় বিষয়, অর্থাৎ দলের সংস্কার অবধারিত হয়ে পড়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে সংস্কারের ব্যাপারে যেসব কথাবার্তা হচ্ছে তার লক্ষ্য সাংগঠনিক সংস্কার, না আদর্শিক সংস্কার?
জামায়াতের ইতিহাস যাঁরা জানেন তাঁরা সহজেই স্মরণ করতে পারবেন যে এখন যে দুই প্রশ্ন এসেছে তা একেবারে নতুন কিছু নয়। দলগতভাবে জামায়াতে ইসলামী নামে প্রকাশ্যে দল করা না–করার ব্যাপারে ১৯৭৯ সালে যখন আলোচনার সূত্রপাত হয়, তখনই ১৯৭১ সালের ভূমিকা এবং এই নামে সংগঠন না করার বিষয় এসেছিল। ১৯৭৬ সালে জামায়াত নেতারা নেজামে ইসলামীর সঙ্গে একত্রে ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ (আইডিএল) করেন, কেননা ১৯৭৬ সালের জুলাই মাসে রাজনৈতিক দল বিধির (পিপিআর) আওতায় আবেদন করেও তাঁরা অনুমোদন পাননি। কিন্তু ১৯৭৮ সালে জামায়াত নেতা গোলাম আযম বাংলাদেশে আসার পরে তিন বছর আগে করা অঙ্গীকার ভঙ্গ করে ১৯৭৯ সালে জামায়াতের উত্থান ঘটানো হয়েছিল। ১৯৮২ সালে মাওলানা আবদুল জাব্বার এবং ছাত্রশিবির নেতা আহমদ আবদুল কাদের বাচ্চুর নেতৃত্বে দলের একাংশের আলাদা করে জামায়াতে ইসলামী প্রতিষ্ঠা করার পেছনে জামায়াতের ১৯৭১ সালের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলার বিষয়ও ছিল। তার পরে ২০০১ সালে যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত জামায়াত নেতারা সংস্কার নিয়ে সুস্পষ্টভাবে প্রস্তাব পাঠান। ২০১০ সালের মাঝামাঝি দলের একাংশ কামারুজ্জামান ও মীর কাসেম আলীর নেতৃত্বে সংস্কারের উদ্যোগ নেয়, এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে ছাত্রশিবিরের তৎকালীন সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল্লাহ আল মামুনসহ সংশ্লিষ্ট নেতারা পদত্যাগ করেন। কারাগার থেকে ২০১০ সালের নভেম্বরে কামারুজ্জামানের লেখা চিঠি এবং তার পরে দলের প্রতিক্রিয়া বিষয়ে এখন সবাই জ্ঞাত।
২০০১ সালের আগে পর্যন্ত সংস্কারের আলোচনায় সংস্কার করে জামায়াতকে কীভাবে দাঁড় করানো হবে, তা নিয়ে কোনো ধারণা দেওয়া হয়নি। কিন্তু তারপর থেকে আলোচনায় প্রত্যক্ষভাবেই তুরস্কের একে পার্টি, মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুডের কথা উল্লিখিত হয়, পরে ২০১২ সালে থেকে এর সঙ্গে তিউনিসিয়ায় এন্নেহাদা দলের কথাও বলা হচ্ছে। পদত্যাগী জামায়াত নেতা ব্যারিস্টার রাজ্জাক ২০১২ সালে তাঁর লেখায় এবং সম্প্রতি প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এসব উদাহরণ টেনেছেন।
ইসলামপন্থী রাজনীতির সফল দলের উদাহরণ হিসেবে একত্রে এসব দলের কথা বলা হচ্ছে, এই তিন দলের সংস্কারের পথ ও পদ্ধতি এক রকমের নয়। মুসলিম ব্রাদারহুড ২০১১ সালে আরব বসন্তের আগে মিসরে কর্তৃত্ববাদী শাসনের আমলে সংগঠনকে অরাজনৈতিক সামাজিক সংগঠন হিসেবে পরিচালনা করেছে, বিভিন্ন ধরনের সামাজিক এবং দাতব্য কার্যক্রমের মাধ্যমে তাদের প্রভাব বিস্তার করেছে, অন্যদিকে তাদের রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টির নামে। তুরস্কে এরদোয়ানের নেতৃত্বাধীন একেপি বা জাস্টিস অ্যান্ড ফ্রিডম পার্টির আবির্ভাব ঘটেছে ২০০১ সালে, একাধিকবার বিভিন্ন নামে রাজনৈতিক দল হিসেবে সংগঠিত হওয়া এবং নিষিদ্ধ হওয়ার ঘটনার পরে। বরাবরই তাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল রাজনৈতিক। সমাজকল্যাণ এবং দাতব্য কার্যক্রমে তাদের সংশ্লিষ্টতা তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আড়াল করার জন্য নয়। তিউনিসিয়ার এন্নেহাদার সূচনা হয়েছিল ১৯৮১ সালে সামাজিক আন্দোলন হিসেবে এবং ক্রমান্বয়ে তা রাজনৈতিক সংগঠনে রূপ নিয়েছে, সরকারি নিপীড়ন মোকাবিলা করেছে এবং ২০১১ সালে একটি প্রতিষ্ঠিত দলের আকার নিয়েছে। এই তিন অভিজ্ঞতার বাইরে মরক্কোর পার্টি অব জাস্টিস অ্যান্ড ফ্রিডম (পিজেডি) বড় ধরনের সংস্কারের মধ্য দিয়ে গেছে এবং ২০১১ সাল থেকে দুই দফা নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় আছে।
লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে এই চার দলের মধ্যে মুসলিম ব্রাদারহুড একমাত্র দল, যা একই সঙ্গে রাজনৈতিক এবং সামাজিক শাখা বজায় রেখেছে। ২০১৩ সালে মিসরের সেনাবাহিনীর অভ্যুত্থান যা গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত মোহাম্মদ মুরসি সরকারের পতন ঘটিয়েছে তার তীব্র বিরোধিতা করেও বলা যায় যে ক্ষমতায় থাকাকালে তাদের আচরণ খুব ইতিবাচক ছিল না, যে কারণে মুরসি সরকারের পতনের পরে অন্যান্য দেশের ইসলামপন্থী দলগুলোও তার পাশে এসে দাঁড়ায়নি। এখন পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে সংস্কারের যে ধরনের কথা শোনা গেছে, তাতে এটাই মনে হচ্ছে যে তারা ইসলামিক ব্রাদারহুডের
সাংগঠনিক কাঠামো অনুসরণে উৎসাহী। এটা ঠিক যে প্রায় একই ধরনের মডেল অনুসরণ করে ফিলিস্তিনি সংগঠন হামাস এবং লেবাননের হিজবুল্লাহ। কিন্তু তাদের রাজনৈতিক এবং সামাজিক শাখার মধ্যে নামের ফারাক বা আদর্শিক ফারাক রাখেনি। ব্রাদারহুডের এই মডেলের সবচেয়ে বড় দিক হচ্ছে তাদের রাজনৈতিক আদর্শিক অবস্থানের দিক থেকে তাদের দুই শাখা অভিন্ন।
জামায়াতের যে চারটি কর্মসূচির কথা বলা হয় তা হলো ১. দাওয়াত ও তাবলিগ (চিন্তার পরিশুদ্ধি ও পুনর্গঠন), ২. সংগঠন ও প্রশিক্ষণ, ৩. সমাজসংস্কার ও সমাজসেবা, ৪. রাষ্ট্রীয় সংস্কার ও সংশোধন। এখন পর্যন্ত যা বোঝা যাচ্ছে তাতে দেখা যায় যে ৪ নম্বর দফার কর্মসূচিই জামায়াতের রাজনৈতিক রূপ এবং সেটা তারা আলাদা করে নতুন দলের হাতে অর্পণ করতে উৎসাহী। ২০১৬ সালে যখন জামায়াত নেতারা আশঙ্কা করছিলেন যে দল নিষিদ্ধ হতে চলেছে, সেই সময়ে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি (বিডিপি) নামে দল গঠনের সিদ্ধান্তের কথা শোনা গিয়েছিল এবং তার হাতেই ওই দায়িত্ব দেওয়ার কথা বলা হচ্ছিল (সেলিম জাহিদ, ‘নতুন নামে জামায়াত?’ প্রথম আলো, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৬)। এই ধরনের ব্যবস্থার মানে হচ্ছে যে আদর্শিকভাবে জামায়াতে ইসলামীর কোনো রকম বদল ঘটল না।
ইসলামপন্থী রাজনীতির ক্ষেত্রে তিউনিসিয়া, তুরস্ক এবং মরক্কোর দলগুলোর অভিজ্ঞতার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে যে তারা ইসলামপন্থী রাজনীতির প্রচলিত গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক নেতাদের দেওয়া পথ ও পদ্ধতি থেকে সরে এসে নিজেদের মতো করে আদর্শিক অবস্থান এবং পথ তৈরি করেছে। এ প্রসঙ্গে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে যে তিউনিসিয়ার এন্নেহাদার নেতা রাশিদ ঘানুশি নতুন তত্ত্বের কথা বলেছেন। ফলে প্রশ্ন হচ্ছে জামায়াতের সংস্কারের প্রসঙ্গে যখন আবদুর রাজ্জাক এন্নেহাদার কথা বলেন তখন তিনি কি দলের একেবারে মৌলিক আদর্শিক অবস্থানের পরিবর্তনের কথা বলছেন? জামায়াতের নেতারা এখন চাপের মুখে কিংবা বা কৌশল হিসেবেই নতুন দলের কথা বলছেন, সংস্কারের কথা বলছেন; তাঁরা কি আসলে সাংগঠনিকভাবে আরেকটি সংগঠনের আড়ালে জামায়াতকে নিয়ে যাওয়ার কথা বলছেন?
এই আদর্শিক সংস্কারের প্রশ্নে আমাদের স্মরণ করা দরকার যে ১৯৪০-এর দশক থেকে ইসলামপন্থী রাজনীতির যেসব তাত্ত্বিক সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করেছেন, তাঁরা হচ্ছেন আবুল আলা মওদুদী (১৯০৩-১৯৭৯), সাঈয়িদ কুতুব (১৯০৬-১৯৬৬) ও হাসান আল বান্না (১৯০৬-১৯৪৯)। সাইয়িদ কুতুব এবং হাসান আল বান্না মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রতিষ্ঠা ও বিকাশের সঙ্গে যুক্ত। মুসলিম ব্রাদারহুড তাদের রাজনৈতিক কৌশলের বদল ঘটালেও আদর্শিকভাবে ওই তত্ত্বগত অবস্থান থেকে কতটা সরে এসেছে তা প্রশ্নসাপেক্ষ। বিপরীতক্রমে তিউনিসিয়ার রাশিদ ঘানুশি এসব নেতার বিপরীতে অবস্থান নিয়ে তাঁর তত্ত্ব উপস্থাপন করেছেন। তাঁর সঙ্গে মওদুদীর পার্থক্য একার্থে আকাশ-পাতাল।
কুতুব, বান্না ও মওদুদী এই অবস্থানের ওপরে তাঁদের রাজনৈতিক আদর্শ তৈরি করেন যে সার্বভৌমত্বে হচ্ছে ঐশ্বরিক (ডিভাইন সভেরনটি), ফলে তা ব্যক্তির নয়। সহজ ভাষায় বললে আইন প্রণয়নের অধিকার শুধু আল্লাহ তাআলার; মানুষ হচ্ছে তাঁর প্রতিনিধি (বা ভাইস-রিজেন্ট)। ফলে কোরআনে সুস্পষ্টভাবে নির্ধারিত বিধানের বাইরে আইন প্রণয়নের কোনো সুযোগ মানুষের নেই। এই বিষয়ে প্রচলিত ইসলামপন্থী তাত্ত্বিকদের ব্যাখ্যার সমর্থনে যেমন কথাবার্তা হয়েছে, তেমনি তার বিপরীতে কোরআন, সুন্নাহ এবং ইসলামের ইতিহাসের আলোকেও ভিন্ন ব্যাখ্যা হয়েছে। যাতে বলা হয়েছে যে ইজতিহাদের (যুক্তিসিদ্ধ আলোচনা) আলোকে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার ইসলাম মানুষের ওপরে অর্পণ করেছে। ফলে ডিভাইন সভেরনটির নামে রাষ্ট্র পরিচালনা ও আইনশাস্ত্রকে সীমিত করা এবং একটি নির্দিষ্ট ব্যাখ্যাকে অনুসরণের ধারণা সঠিক নয়। ইসলামপন্থী তাত্ত্বিক হিসেবে রাশিদ ঘানুশি ইজতেহাদের আলোকে বলেন যে আসলে মুসলিম সমাজের বা উম্মাহর সার্বভৌমত্ব আছে, ঐশ্বরিক সার্বভৌমত্বের ব্যাখ্যাকে তিনি নাকচ করে দেন।
যেখানে মওদুদী মনে করেন যে গণতন্ত্রকে হতে হবে ‘থিও-ডেমোক্রেসি’, সেখানে ঘানুশি বলেন অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের কথা। ঘানুশি সেক্যুলারিজমের পক্ষে অবস্থান নেন, শরিয়াহভিত্তিক ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থার বিপরীতে সিভিল রাষ্ট্রের কথা বলেন। একইভাবে তুরস্কের একে পার্টির ক্রমাগতভাবে কর্তৃত্ববাদী হওয়ার প্রবণতার দিকে নজর রেখেও বলা যায় যে প্রচলিত রাজনৈতিক ইসলামের তাত্ত্বিকদের বিচার ও বিশ্লেষণ থেকে দল অনেক আগেই সরে এসেছে। এগুলো হচ্ছে আদর্শিক সংস্কার। জামায়াতের জন্য এই ধরনের সংস্কারের অর্থ হচ্ছে দলের প্রতিষ্ঠাতা আবুল আলা মওদুদীর আদর্শ থেকে সরে আসা। সেই সংস্কার না করে কেবল জামায়াতে ইসলামীকে অন্য নামের আরেকটি রাজনৈতিক সংগঠনের আড়ালে নিলে তাকে সংস্কার বলা যাবে না। তদুপরি জামায়াতে ইসলামী বলে একটি সংগঠনের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ উপস্থিতি মনে করিয়ে দেবে যে জামায়াতের নেতারা ১৯৭১ সালের ভূমিকার দায় নেননি, সে জন্য ক্ষমা প্রার্থনা তো দূরের বিষয়। সে কারণেই জামায়াতে ইসলামীর বিলুপ্তির আর কোনো বিকল্প নেই।
প্রথম আলো, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯