April 16, 2024

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার চিরচেনা উত্তেজনা এখন প্রত্যক্ষ সামরিক সংঘাতের আকার নিয়েছে। এটা পরিপূর্ণ যুদ্ধে রূপান্তরিত হতে পারে—এই আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এখনো এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণযোগ্য, কিন্তু তাতে স্বস্তিবোধের কারণ নেই, কেননা এই পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে পারে। উদ্বেগের কারণ এই যে ঘটনার ধারাবাহিকতায় পরিস্থিতি যদি এমনকি সীমিত যুদ্ধেও পরিণত হয়, তা হবে এই অঞ্চলের জন্য ভয়াবহ, তার মানবিক ক্ষয়ক্ষতি (বা হিউম্যান কস্ট) হবে অকল্পনীয়।

পাকিস্তান-ভারতের মধ্যকার এই নতুন সংঘাতের আশু প্রেক্ষাপট হচ্ছে ১৪ ফেব্রুয়ারি ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পুলওয়ামা জেলায় এক আত্মঘাতী হামলায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৪০ জন সৈন্যের নিহত হওয়ার ঘটনা। পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন জইশ-ই-মুহাম্মদ এই হামলার দায়িত্ব স্বীকার করেছে এবং এই ধরনের আরও হামলার হুমকি দিয়েছে। জইশ-ই-মুহাম্মদ ২০০০ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর, বিশেষত গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে থাকে বলে অভিযোগ আছে। এই সংগঠনের নেতা মাসুদ আজহার পাকিস্তানে বসবাস করেন এবং অভিযোগ সত্ত্বেও তাঁকে কখনোই পাকিস্তানের সরকার বিচারের মুখোমুখি করেনি। ২০০১ সাল থেকে ভারতে একাধিক জঙ্গি হামলার জন্য জইশ-ই-মুহাম্মদ ও পাকিস্তানভিত্তিক আরেকটি জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তাইয়েবাকে ভারত দায়ী করে। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে ১৯৯০-এর দশক থেকেই পাকিস্তান এসব জঙ্গিগোষ্ঠীকে স্ট্র্যাটেজিক অ্যাসেট হিসেবে ব্যবহার করে ভারত ও আফগানিস্তানে কাজ করতে দিয়েছে এবং তা থেকে সুবিধা লাভ করেছে। ফলে এই ধরনের জঙ্গি সংগঠন যখন ভারতে হামলা চালায়, তখন তার দায়িত্ব ভারত সংগত কারণেই পাকিস্তানের ওপরে চাপায়।

বারবার এই ধরনের হামলা, ভারতের অভ্যন্তরে সন্ত্রাসী তৎপরতা এবং ভারতশাসিত কাশ্মীরে সাম্প্রতিক কালে পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গিদের উপস্থিতির চেষ্টা ভারতকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। কিন্তু এই দফা ভারতের এ হামলা এবং হঠাৎ করে যুদ্ধংদেহী হয়ে ওঠার পেছনে সেটাই একমাত্র কারণ কি না তা প্রশ্নসাপেক্ষ। কেননা, পুলওয়ামার ঘটনার পরে পরিস্থিতিকে একধরনের যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। পাকিস্তান ও ভারত উভয় দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি যে পুলওয়ামা ও তার পরের ঘটনাবলির অন্যতম এবং সম্ভবত প্রধান উপাদান, তা গত কয়েক দিনের ঘটনার দিকে তাকালেই বোঝা যায়।

ভারতের আসন্ন নির্বাচনে ক্ষমতাসীন বিজেপি যখন বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে, সেই সময়ে পুলওয়ামার ঘটনার পর নরেন্দ্র মোদি ও বিজেপি উগ্র জাতীয়তাবাদের ধুয়ো তুলতে চেষ্টা করেছে। পুলওয়ামার পরে সারা ভারতেই যে কাশ্মীরবিরোধী মনোভাব ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, অন্যান্য রাজ্যে কাশ্মীরিদের ওপরে হামলা হয়েছে, তা স্বতঃস্ফূর্ত বলে মনে হয় না। পাঁচ বছর ধরে ভিন্নমতাবলম্বী, ভিন্নধর্মাবলম্বীদের বিরুদ্ধে হামলা-মামলার সঙ্গে সরকার ও সরকারি দলের সংশ্লিষ্টতা থেকে বোঝাই যায়, একধরনের অসহিষ্ণুতার সংস্কৃতি ও রাজনীতিকে উসকে দেওয়া, তাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া ও স্থায়ী করা হচ্ছে বিজেপির উদ্দেশ্য। পুলওয়ামার হামলা সেই সুযোগ তৈরি করেছে। ফলে মোদি ও বিজেপি যে পুলওয়ামার দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাকে রাজনৈতিক পুঁজিতে রূপান্তরিত করেছে, একে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের দামামায় পরিণত করতে পেরেছে, তা বিস্ময়কর নয়। এই ঘটনার জবাব দেওয়ার নামে বিমান অভিযান চালানোর মধ্য দিয়ে মোদি দেখাতে চাইছেন যে তিনিই একমাত্র জাতীয়তাবাদী, ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা তাঁর হাতেই সুরক্ষিত।

Eprothom Aloদুঃখজনক হচ্ছে এই দামামা বাজানো এবং উগ্র জাতীয়তাবাদী চিন্তাকে ‘দেশপ্রেম’ বলে হাজির করার কাজে ভারতের একশ্রেণির গণমাধ্যম ও সেলিব্রেটি সহযোগীর ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁদের এই ভূমিকা না ছিল কাঙ্ক্ষিত, না ছিল প্রয়োজনীয়। বালাকোট অভিযানের পরে ভারতের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো বিমানবাহিনীকে অভিনন্দন এবং এই অভিযানকে সমর্থন দিলেও বুধবার সরকারবিরোধী ২১ দলের নেতারা অভিযোগ করেছেন, সশস্ত্র বাহিনীর আত্মত্যাগকে দলীয়করণ করেছে ক্ষমতাসীন দল বিজেপি।

অবস্থাদৃষ্টে এটাও মনে হয় যে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও ক্ষমতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এই ধরনের যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরির উপাদান হিসেবে কাজ করেছে। পাকিস্তানের নতুন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান দেখাতে চাইছেন যে তিনি রাজনীতিতে অনভিজ্ঞ বলে মনে হলেও তাঁর দেশপ্রেম প্রশ্নাতীত, দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে যেকোনো ধরনের সামরিক পদক্ষেপে তিনি মোটেই পিছপা হবেন না। তাঁর এই অবস্থান তাঁকে যেমন পাকিস্তানের সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে জনপ্রিয়তা দেবে, তেমনি পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ও ডিপ স্টেটের কাছে গ্রহণযোগ্য করে রাখবে।

পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর দরকার তাদের গুরুত্ব রক্ষার জন্য এবং দেশের ভেতরে যে ধরনের কার্যকলাপ চালাচ্ছে, বিশেষত পশতুন তাহফুজ মুভমেন্টের উত্থান তাদের যেভাবে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে, তা মোকাবিলার জন্য দেশের বাইরে একটা আক্রমণোদ্যত শত্রু তৈরি করা। তারাও চায়, ভারতের আসন্ন নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদিই বিজয়ী হোক। কেননা তিনি ক্ষমতায় থাকলে ভারতকে পাকিস্তানের অস্তিত্বের জন্য হুমকি বলে দেখানো সহজ। এতে করে দেশের রাজনীতির ওপরে তাদের নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত রাখা সম্ভব। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী বা গোয়েন্দা সংস্থার অজ্ঞাতেই জইশ-ই-মুহাম্মদ পুলওয়ামায় হামলা চালিয়েছে, তা বিশ্বাস করা দুরূহ।

জঙ্গিদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া, তাদের দিয়ে কৌশলগত স্বার্থ উদ্ধার এবং এই অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা বহাল রাখার জন্য পাকিস্তান অবশ্যই দায়ী। এ জন্য পাকিস্তানের দীর্ঘদিনের সঙ্গী চীন বা যুক্তরাষ্ট্র এখন তার পাশে এসে দাঁড়াতে সংশয়ী। সাবেক পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত হুসেন হাক্কানি বলেছেন, পাকিস্তানের প্রতি পুরো বিশ্বের সহনশীলতা ক্রমশ কমে যাচ্ছে। কিন্তু এই ধরনের হামলার মতো পরিস্থিতি কেন কাশ্মীরে তৈরি হয়েছে, সেই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া থেকে ভারত কি বিরত থাকতে পারে? কাশ্মীরে কয়েক দশক ধরে যে নিপীড়ন–নির্যাতন হয়েছে, বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম ও আটকের ঘটনা ঘটেছে এবং কয়েক মাস ধরে যে বিক্ষোভ চলছিল—সেগুলো বাদ দিয়ে কি পুলওয়ামার ঘটনাকে বিবেচনা করা যাবে? গত বছরের মাঝামাঝি রাজ্যপালের শাসন এবং ডিসেম্বরে রাষ্ট্রপতির শাসন জারির আওতায় যে ধরনের সেনা অভিযান চালানো হয়েছে, তাতে করে সহিংস শক্তির বিকাশের পথ আরও উন্মুক্ত হয়েছে। সেটা ভারতের নীতিনির্ধারকেরা অস্বীকার করতে পারেন, কিন্তু বাস্তবতা তাতে বদলে যায় না।

পুলওয়ামার হামলা ও তারপরে গগনবিদারী যুদ্ধ দামামার শব্দে চাপা পড়ে গেছে কাশ্মীরের মানুষের মানবাধিকারের দাবি, কাশ্মীরিদের নির্বিচারে হত্যার ঘটনাবলি, কাশ্মীরিদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রশক্তির চালানো নির্যাতনের প্রতিবাদ।

ভারতের যে সৈন্যরা পুলওয়ামায় নিহত হয়েছেন, তাঁদের পরিবারকে শোকের ও বেদনার যে মর্মবিদারক ভার সইতে হচ্ছে, কাশ্মীরে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের শোক তেমনি মর্মবিদারক। এসব মৃত্যু কাশ্মীর প্রশ্নের সমাধান দেবে না। বিমান হামলা ও পাল্টা ব্যবস্থার খবরের কোথাও কি উল্লেখ হচ্ছে যে তার আগের মাসগুলোতে কাশ্মীরে আসলেই কী ঘটছিল? এতে করে ভারতের ক্ষমতাসীনেরা ছাড়া, যে রাজনীতিবিদেরা কাশ্মীরের মানুষের এই অবস্থাকে আড়ালে রাখতে চান, তাঁরা ছাড়া আর কারা লাভবান হচ্ছেন? কাশ্মীরিদের দাবিদাওয়া অগ্রাহ্য করে কোনোভাবেই যে কাশ্মীর প্রশ্নের মীমাংসা হবে না, তা সহজেই বোধগম্য; কিন্তু ভারত-পাকিস্তানের রাজনীতিবিদ ও সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তারা চাইবেন আমরা বরং এই দুই দেশের যুদ্ধ বিষয়েই মনোনিবেশ করি।

আশার বিষয় এই যে যুদ্ধের এই উগ্রতার বিরুদ্ধে ভারত ও পাকিস্তানের নাগরিকেরা সরব হয়েছেন। তাঁদের সেই কণ্ঠস্বর আরও জোরদার হয়ে যুদ্ধোন্মাদনার অবসান ঘটাক। আমরা যেন কাশ্মীরের মানুষের কণ্ঠস্বর শুনতে পাই, সেই অবস্থার সূচনা হোক।

প্রথম আলো’তে প্রকাশিত ১ মার্চ ২০১৯

Leave a Reply