March 29, 2024
http://i.telegraph.co.uk/multimedia/archive/02460/europe-flag_2460727b.jpg

ব্রিটেনের গণভোটে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ত্যাগের পক্ষের বিজয়ের প্রতিক্রিয়া ইতিমধ্যেই দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে, বিশ্ব বাজারে তার আরো প্রতিক্রিয়া দেখা যাবে আগামী কয়েক দিনে।

এই ভোটের ফলাফলের কারনে আগামীকালই ব্রিটেন ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের বাইরে চলে যাচ্ছে এমন নয়। এই প্রক্রিয়া শুরু হবার পরে দুই বছর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। কিন্ত এর ফলে যে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার সূচনা হল সেটি কি পথে অগ্রসর হবে তা আসলে কেউই জানেন না। জানেন না তার কারন যারা ইউনিয়ন ত্যাগের পক্ষে প্রচার করেছেন তাঁরা সুস্পষ্ট কোনো রকম পরিকল্পনা তুলে ধরেননি; আর এর কোন অতীত উদাহরণ নেই যা থেকে অনুমান করা যেতে পারে। এই অনিশ্চয়তার প্রথম ধাক্কাটি অবশ্যই আমরা দেখবো ব্রিটেনের অর্থনীতিতে। কিন্ত সেটা কেবল ব্রিটেনেই সীমিত থাকবেনা। ইতিমধ্যেই পাউন্ডের মুল্য পতন একটি উদাহরণ। নিউইয়র্কের স্টক মার্কেট সূচকেও পতন ঘটেছে।

ব্রিটেনের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে এই ভোট কনজারভেটিভ দলের নেতা ও প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের রাজনৈতিক জীবনাবসান ঘটিয়েছে। সামনের কঠোর ও অনিশ্চিত দিনগুলোতে সামান্য হলেও স্থিতিশীলতার স্বার্থে তিনি অক্টোবর পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করবেন। লেবার পার্টির নেতা জেরেমি করবিনের জন্যেও এই ফল সুখকর নয়। কিন্ত ক্যামেরনের জায়গায় দায়িত্ব নিতে কে এগিয়ে আসবেন কিনা সেটাও দেখার বিষয়। সেক্ষেত্রে লন্ডনের সাবেক মেয়র বরিস জনসন হচ্ছেন সম্ভাব্য বিকল্প। কিন্ত মনে রাখা দরকার যে এই ফলাফল অত্যন্ত সামান্য ব্যবধানের, ফলে যিনিই দায়িত্ব নিন বা থাকুন তাঁকে এটা মনে রাখতে হবে।

গণভোটের এই ফলাফলে দেখা যাচ্ছে যে উত্তর আয়ারল্যান্ড এবং স্কটল্যান্ডের অধিকাংশ মানুষ ছিলেন ইউনিয়নে থাকার পক্ষে। এখন ব্রিটেনের এই সিদ্ধান্তের পরে তাঁরা কি আলাদা হবার দাবি আবার তুলতে পারেন? সেই রকমটা মনে করা ভুল হবে না। ইতিমধ্যেই স্কটিশ নেতারা তাঁদের ব্রিটেনে থাকা না থাকা নিয়ে আবারও গণভোটের কথা বলেছেন। উত্তর আয়ারল্যান্ডের ডেপুটি ফার্স্ট মিনিস্টার সিন ফেন নেতা মার্টিন ম্যাকগিনিস আয়ারল্যান্ডের সঙ্গে ঐক্যের প্রশ্নে একটি গণভোটের দাবি তুলেছেন। তাঁর মানে কী এই যে এই গণভোট ঐক্যবদ্ধ ব্রিটেনের অবসানের প্রথম পদক্ষেপ?

এই গণভোটের প্রচারে এবং সম্ভবত বিজয়ের পেছনেও কাজ করেছে অভিবাসনের প্রশ্ন। তাঁর অর্থ হচ্ছে এখন ব্রিটেনে অভিবাসী বিরোধী মনোভাব আরো চাঙ্গা হবে। এটির একটি সুস্পষ্ট বর্ণবাদী রূপ তৈরি হওয়ায়ই স্বাভাবিক। এই আশঙ্কা সত্য হলে তার প্রথম শিকার হবেন অশ্বেতাঙ্গরা। অতীতে দক্ষিন এশীয়রাই এই ধরণের আক্রমণের সহজ লক্ষ্যবস্ত হয়েছেন (এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি আমার বই Islam and Identity Politics among British-Bangladeshis: A Leap of Faith, Manchester: Manchester University Press, 2013 – এ) । ব্রিটেনের এই ফল যে ইউরোপের অন্য দেশের রাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে তাও অনুমেয়। ফ্রান্স এবং নেদারল্যান্ডের উগ্র জাতীয়াতাবাদীরা একে পুঁজি করে ইউনিয়ন থেকে বেরুবার দাবি তুলেছেন যা আগেই অনুমান করা গিয়েছিল। আমার জানি যে গত প্রায় এক দশকে গোটা ইউরোপে উগ্র দক্ষিনপন্থী দলগুলো শক্তি সঞ্চয় করেছে (দেখুন নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন ২২ মে ২০১৬)। এই দলগুলো এখন আরো শক্তি সঞ্চয়ের চেষ্টা করবে।

এর প্রতিক্রিয়া কী আটলান্টিকের অপর পাড়ের দেশ যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে পড়তে পারে? ইতিমধ্যেই আমরা ডোনাল্ড ট্রাম্পের উত্থান দেখতে পেয়েছি যার বক্তব্য ‘ব্রেক্সিটের’ সমর্থকদের চেয়ে ভিন্ন নয়। অভিবাসী বিরোধী মনোভাবকে শক্তিশালী করার চেষ্টা ট্রাম্পের প্রচারণার প্রধান দিক। ফলে এই আশঙ্কাকে উড়িয়ে দেয়া যায়না যে এতে তিনি শক্তিশালী হবেন। তবে এই প্রচেষ্টার সাফল্য নির্ভর করছে ডেমোক্রেটিক পার্টির ওপরেও। হিলারী ক্লিনটন এবং ডেমোক্রেটিক পার্টি যদি দেখাতে পারে যে এই ধরণের ‘একলা চলো’ পদক্ষেপের পরিণতি ভালো হয় না যেমন ব্রিটেনের জন্যে হচ্ছে না তবে তাঁর ফল উল্টোও হতে পারে।

বাংলাদেশে যারা আছেন তাঁরা নিশ্চয় বুঝতে চাইবেন এর প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশে কী হবে। এর কোনো রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া বাংলদেশে পড়বে বলে মনে হয় না। তবে অবশ্যই এর অর্থনোতিক প্রতিক্রিয়া বাংলদেশের ওপরে হবে। কেননা বাংলদেশ ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে শুল্কমুক্ত যে সুবিধা পায় তাঁর আওতায় ব্রিটেনে রপ্তানী করে। ইউনিয়নে মোট রপ্তানীর পরিমাণ প্রায় ১৪ বিলিয়ণ ডলার। এর মধ্যে কমপক্ষে ২ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার রপ্তানী হয় ব্রিটেনে (২০১৩-১৪ সালের হিসেব এটি)। ব্রিটেন বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম রপ্তানী বাজার। আগামীতে সেখানে আলাদা করে আলোচনা করে রপ্তানির পথ তৈরি করতে হবে। পাউন্ডের মুল্যমান হ্রাস হলে আয়ের পরিমাণ কমবে। বাংলাদেশে যে সব বিদেশি বিনিয়োগ আসে তার মধ্যে ব্রিটেন হচ্ছে দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎস। তাঁর ওপরেও প্রভাব পড়বে বলেই ধারণা করা যায়।

ব্রিটেনের গণভোট কেবল ব্রিটেনকেই এক অনিশ্চিত যাত্রায় ঠেলে দিয়েছে তা নয়, তার সহযাত্রী সারা পৃথিবী।

Leave a Reply