April 19, 2024

সূত্র: http://welcomeqatar.com/en/us-bloggers-killing-exposes-level/

রাজধানীতে প্রকাশ্য দিবালোকে ওয়াশিকুর রহমান নামের একজন তরুণ ব্লগার ও অনলাইন লেখককে হত্যা করা হয়েছে। যারা হত্যা করেছে, তারা তাঁকে চিনত না। আততায়ীরা তাঁর বা তাঁর লেখার সঙ্গে পরিচিত ছিল, তা নয়। তাদের চিনিয়ে দেওয়া হয়েছে, বলা হয়েছে যে ধর্মের অবমাননা হয়েছে তাঁর লেখায়। এইটুকুই যথেষ্ট বলে বিবেচনা করে ওয়াশিকুর রহমানের ওপর নৃশংস হামলা চালিয়েছে, তাঁকে খুন করেছে জিকরুল্লাহ ও আরিফুল ইসলাম নামের দুই তরুণ। এই খবরে জন ডানের কবিতার পঙ্ক্তি মনে পড়ছে, ‘যেকোনো মানুষের মৃত্যু আমাকে ছোট করে, কেননা আমি মানবতার অংশ;/ আর তাই জিজ্ঞাসা করো না কার জন্যে বাজছে ঐ ঘণ্টাধ্বনি, সে বাজছে তোমার জন্যে’।
যেকোনো মৃত্যুর মধ্যে আমি তাই আমার মৃত্যুর বার্তা শুনতে পাই। বারবার স্বদেশের মাটি থেকে যখন অপঘাতের মৃত্যুর খবর পাই, তার মধ্যে চার্চের ঘণ্টাধ্বনির মতো শুনতে পাই কেবল ব্যক্তির মৃত্যুর নয়, তার চেয়েও বেশি কিছুর মৃত্যুর সংবাদ।
হত্যা মাত্রই অমানবিক, মানবতাবিরোধী। যে হত্যা চিন্তার স্বাধীনতার বিরুদ্ধে, সে কেবল ব্যক্তির বিনাশ নয়। যে হত্যা ভিন্নমতের কারণে, তাকে কেবল ব্যক্তির হত্যা বলে বিবেচনা করা যাবে না। যে হত্যা, যে নিপীড়ন ব্যক্তির কণ্ঠরোধ করতে চায়—ধর্মের নামেই হোক কিংবা রাজনৈতিক আদর্শের নামেই হোক—তা সমাজে বহুত্ববাদিতার অবসান ঘটানোর লক্ষ্যে পরিচালিত। এটির আশু লক্ষ্য ব্যক্তি হলেও এর প্রধান লক্ষ্য ব্যক্তির চেয়েও বড়, তেমনি যে ব্যক্তি এই হত্যাকাণ্ড সংঘটন করল, তার চেয়েও বড় হলো কীভাবে তাকে প্ররোচিত করা হয়েছে, কে তাকে প্রণোদনা জুগিয়েছে, কারা তাকে সংগঠিত করেছে, কী পরিবেশ তাকে এই ধরনের ঘৃণ্য কাজের সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। ব্যক্তিকে আইনের মুখোমুখি করার পাশাপাশি এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে।
সমাজে হত্যা, হত্যার প্ররোচনা এবং তাকে স্বাভাবিকতায় রূপ দেওয়ার ঘটনা অসহিষ্ণুতার সাক্ষ্য। অসহিষ্ণুতা আরও অসহিষ্ণুতার জন্ম দেয়, এটাই অবশ্যম্ভাবী। আমি অসহিষ্ণু হলে আমার প্রতিপক্ষ সহিষ্ণু হবে, এই আশা বাতুলতা মাত্র। সহিষ্ণুতা চর্চার দায়িত্ব প্রথমেই আমার। আমার অসহিষ্ণুতা ধর্মের নামে, রাষ্ট্রের নামে, জাতীয়তার নামে হলে, সংখ্যাগরিষ্ঠতার যুক্তিতে হলে আমার প্রতিপক্ষ তার যুক্তি তৈরি করবে। কোনোটাই ‘যুক্তির কষ্ঠিপাথরে’ টিকল কি না, কে তার হিসাব করবে? রক্তের দাগ যুক্তির বিকল্প নয়; চাপাতি যুক্তির বিকল্প নয়; বুলেট যুক্তির বিকল্প নয়। অন্যের মত প্রকাশের অধিকার সীমিত করলে আমার মত প্রকাশের অধিকার সীমিত হবে। আমি একভাবে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করলে, হত্যার বৈধতা প্রদান করলে—আমার প্রতিপক্ষ অন্যভাবে ভয়ের সংস্কৃতি চাপিয়ে দেবে, সে আমাকে হত্যা করবে। আমাদের পারস্পরিক আক্রমণের সুযোগে অন্যরা তাদের অস্ত্র শাণাবে, ভয় দেখাবে, হত্যা করবে।
হত্যার বিচার যদি না হয়, আইনের শাসন যদি প্রতিষ্ঠা না পায়, তবে আরও হত্যার পথ উন্মুক্ত হয়। বিচারহীনতার ঐতিহ্য, ভয়ের সংস্কৃতি মানুষের শেষ পরিণতি হতে পারে না। অস্থির সময় কেবল অন্ধকারের শক্তিকেই সাহায্য করে। ধর্মের নামে যে উগ্রপন্থা, তা ধর্মের ও মানবিকতার আদর্শের বাহক নয়, হতে পারে না। ধর্মের নামে জারি করা উগ্রপন্থাকে মোকাবিলা করার পথ উদারনৈতিক আদর্শের চর্চা। উদারনীতি, সহিষ্ণুতা, আইনের শাসন ও মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আদর্শিক লড়াইয়ে নৈতিক শক্তি হচ্ছে সবচেয়ে বড় শক্তি, এই শক্তি ছাড়া আর সব শক্তি যে কেউ সংগ্রহ করতে পারে; আপনি-আমি পারি, আপনার-আমার প্রতিপক্ষও পারে। শক্তি দিয়ে, বল প্রয়োগ করে, ভয় দেখিয়ে, হত্যা করে কোনো রাজনৈতিক আদর্শ বিজয়ী হতে পারে না; কোনো ধর্ম টিকে থাকতে পারে না, থাকেনি; কোনো রাষ্ট্র পরিচালিত হতে পারে না।
কিন্তু এই সত্যগুলোকে আমাদের চারপাশে প্রতিদিন অবমানিত হতে দেখি। বাংলাদেশের রাজনীতি ও সমাজের দিকে তাকিয়ে এটা স্পষ্ট যে সমাজে সহনশীলতা অপসৃত হয়েছে। যেকোনো সমাজে সহনশীলতা নিজে নিজেই অপসৃত হয় না; প্রত্যেক নাগরিক, বিশেষ করে যাঁরা নিজের অবস্থানকে চূড়ান্ত বলে দাবি করেন, তাঁর এই পরিণতি তৈরির ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে বললে অত্যুক্তি হবে না। ধর্মের নামে যাঁরা চূড়ান্ত কথা বলার চেষ্টা করেছেন, তাঁরা চিন্তার স্বাধীনতাকে, মত প্রকাশের অধিকারকেই কেবল দমন করছেন তা নয়; ধর্মেরও অবমাননা করছেন। কোনো ধর্ম তার পক্ষে চূড়ান্ত কথা বলার, বিচারের দায়িত্ব মানুষের ওপরে অর্পণ করেনি। যাঁরা ধর্মের নামে নিজেদের অবস্থান ব্যাখ্যা করতে চান, তাঁদের ধর্মের এই শিক্ষার কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া আবশ্যক। আদর্শিক অন্ধত্বের কারণে যারা নিজেদের অবস্থানকে ঐশ্বরিক মর্যাদা প্রদান করেন, তাঁরা সমাজে এমন পরিস্থিতি তৈরি করেন, যেখানে ধর্মের নামে, জাতি-গোষ্ঠী-বর্ণের নামে বিভক্তিকরণ বৈধ রূপ লাভ করে। এই বিভক্তিকরণের পরিণতি বিষয়ে তাঁরা কি সচেতন?
বাংলাদেশের সমাজের দিকে তাকিয়ে বোধকরি এই প্রশ্ন তোলার সময় এসেছে যে তার মর্মমূলে কি এমন কোনো পরিবর্তন সংঘটিত হয়েছে যে দেশের নাগরিকেরা, বিশেষ করে তরুণেরা, এখন এই প্রশ্ন তুলতে অনীহ যে, কেন সে আরেকজনের স্বাধীন চিন্তার প্রতিবন্ধক হবে, কেন সে আরেকজন ভিন্নমতাবলম্বীকে নিপীড়ন করবে, কেন সে আরেকজনকে তার স্বাধীন চিন্তার জন্য হত্যা করবে? হত্যার দায় স্বীকার করেছে যে জিকরুল্লাহ ও আরিফুল ইসলাম, তাদের ভাষ্য অনুযায়ী তারা জানে না ওয়াশিকুর রহমান কে, তঁার বক্তব্য কী। কিন্তু তাদের জন্য এই বক্তব্য কেন যথেষ্ট যে ওয়াশিকুর ধর্মের অবমাননাকারী?
সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতি ও শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে স্বাধীন চিন্তার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ তৈরির, ভিন্নমতাবলম্বীর অধিকার সুরক্ষার উদাহরণ কি ক্রমান্বয়ে এতটাই অনুপস্থিত হয়ে যাচ্ছে যে দেশে মতভিন্নতা মানেই হত্যা, মতভিন্নতা মানেই নিপীড়ন সবার কাছে গ্রহণযোগ্য বলে মনে হচ্ছে?
আসুন, আমরা সবাই মিলে একবার এই প্রশ্নগুলোর মুখোমুখি হই।
প্রথম আলো’তে প্রকাশিত, ১ এপ্রিল ২০১৫

থাম্বনেইলের ছবির সূত্র:

Leave a Reply