বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের দলবদলের ঘটনা তেমন কোনো বিস্ময়কর বিষয় নয়। বাংলাদেশে রাজনীতিবিদদের দলবদলের এই ধারা ঠিক কবে শুরু হয়েছিল, তা সুনির্দিষ্ট করে বলা মুশকিল। পাকিস্তানের শাসনামলের গোড়াতে এই প্রবণতা এতটাই প্রবল ছিল যে ১৯৫৪ সালের পর সকাল-সন্ধ্যা দলবদলের ঘটনা ঘটেছে, সরকার বদল হয়েছে। বাংলাদেশে এই ঘটনার শুরু একার্থে জাসদের উত্থানের সময়ই ঘটে বলে বলা যেতে পারে। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে ভিন্ন ভিন্ন দলের মানুষেরা তাতে যোগ দিয়েছিল। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিষিদ্ধঘোষিত দলের নেতা-কর্মীরা জাসদে আশ্রয় নিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁরা ঘটা করে দল বদল করেছিলেন এমন বলা যাবে না। সেই বিবেচনায় দলবদলের আনুষ্ঠানিক ঘটনা ১৯৭৫ সালের, বাকশাল গঠনের পর তাতে একাধিক দল ঘোষণা দিয়ে দল বিলুপ্ত করেই যোগ দিয়েছিলেন। শুধু তা–ই নয়, সরকারি কর্মকর্তারা, এমনকি সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান বা উপপ্রধানেরা বাদ যাননি। রাজনীতিবিদদের একাংশের মধ্যে এ নিয়ে প্রতিযোগিতাও ছিল।
দলের নামনিশানা মুছে দিয়ে বাকশালে যোগদানের ঘটনা নিশ্চয় অনেকের স্মরণে থাকবে। ক্ষমতায় বসে দল গড়ার ঘটনা বাংলাদেশে সেই প্রথম। ক্ষমতাসীনদের হাতে যে জাদুর কাঠি তার স্পর্শ পেতে আক্ষরিক অর্থেই প্রতিকূল আবহাওয়ায় মিছিল করে সারিবদ্ধভাবে লোকজন তাতে যোগ দিয়েছিল। কিন্তু তাদের একাংশ যে পরে খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বাধীন সরকার বা দলে যোগ দিয়েছিল, সেটা অবশ্যই পক্ষত্যাগ, যারা পরে মোশতাক আহমদের তৈরি দলে যোগ দিয়েছিল, তাদের জন্য এটি দলবদল। ১৯৭৯ সালে ক্ষমতায় বসে জিয়াউর রহমান যখন জাগদল এবং পরে বিএনপি গঠন করেন, সে সময় দলবদলের উৎসব শুরু হয়েছিল মনে পড়ে, স্বেচ্ছায়-অনিচ্ছায় নিজের দল গুটিয়ে যোগ দেওয়ার ঘটনা যেমন ছিল, তেমনি ছিল সন্তানের সাত খুন মাফের বিনিময়ে দলে যোগ দেওয়ার ঘটনা। গোয়েন্দা সংস্থাকে রাজনীতির কাজে লাগানোর, দল ভাঙার, রাজনীতিবিদদের দলবদলে ‘উৎসাহী’ করার যে রীতি শুরু হয়েছিল, সেই ঐতিহ্য অব্যাহত রেখেছিলেন আরেক সেনাশাসক জেনারেল এরশাদ। সেই ধারা যে এখন শেষ হয়েছে, সেটা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারবেন না।
তারপরে তো রয়েছে বিপদগ্রস্তদের কিংবা হঠাৎ করে ‘আলো দেখা’ মানুষের দলবদলের ঘটনা, তার উদাহরণের জন্য খুব বেশি দূর যেতে হবে না। জামায়াত-বিএনপির কর্মীদের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে যোগদানের খবর পাওয়া যাচ্ছে বেশ নিয়মিতভাবেই। গত কয়েক মাসে তা বেড়েছে কয়েক গুণ। এদের মধ্যে জামায়াতের কর্মীদের সংখ্যা কম না বেশি তা গুনে দেখার সুযোগ হয়নি, তবে বেশি বলেই জনশ্রুতি। এটা বেশ আগ্রহোদ্দীপক বিষয় এই কারণে যে গত কয়েক বছর ধরে প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগের কর্মীরা পর্যন্ত হরহামেশা বিএনপিকে শুধু জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগের পরামর্শই দেন না, ওই সঙ্গ ত্যাগকে ভবিষ্যতে বিএনপির টিকে থাকার শর্ত বলেও বলেন। তার কারণ, ১৯৭১ সালে জামায়াতের স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকা এবং গত কয়েক বছরে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে সহিংস আচরণ। বিএনপি-জামায়াতের সখ্য বিএনপির জন্য এখন আর লাভজনক নয় এ কথা বলা যেতে পারে। দলগতভাবে বিএনপি জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করেছে বা জামায়াত বিএনপির সঙ্গ ত্যাগ করেছে এমন খবর পাওয়া না গেলেও, এই দুই দলের কর্মীদের অনেকে তাঁদের নিজ দলের সঙ্গ ত্যাগ করছেন।
অনেকেই বলতে পারেন যে নিজেদের রাজনৈতিক বিশ্বাসে পরিবর্তন ঘটা খুব দুরূহ নয়, বিশেষ করে যদি দলের নেতৃত্বের প্রতি অনাস্থা থাকে, দলের কার্যক্রম ভুল বলে মনে হয়। এই যুক্তিকে একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। কিন্তু যদি কারও বিরুদ্ধে
হত্যার মামলা থাকে এবং পুলিশের হাতে আটকের পর তিনি গিয়ে সরকারি দলে যোগদান করেন, তখন একে কি আমরা তাঁর রাজনৈতিক বোধোদয়ের বিষয় বলে বিবেচনা করতে পারব? চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক সালামত আলী আটক হন রোববার সন্ধ্যায়, সোমবার সকালে তিনি ছাড়া পান, বিকেলেই তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেন। তা-ও ঘটেছে প্রকাশ্যে, জনসমক্ষে, সাংবাদিকদের জানিয়ে।
বিএনপি থেকে ছালামাত আলী যে প্রথম সরকারি দলে যোগ দিলেন এমন নয়। দেশের বিভিন্ন স্থানে এমন অনেক ছালামত আলীই আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন। জয়পুরহাটে গত পাঁচ মাসে কমপক্ষে তিন হাজার বিএনপি-জামায়াত কর্মী ও নেতা আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন বলে সংবাদমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে। রাজশাহীর বিভিন্ন এলাকায় দলবদলের হিড়িক পড়েছে এই খবর দিয়ে গণমাধ্যম জানাচ্ছে যে তাতে স্থানীয় আওয়ামী লীগ কর্মীরা পর্যন্ত হতাশ, তাঁরা এতে দলের আদর্শিক বিজয় এবং প্রতিপক্ষের সাংগঠনিক বিপর্যয় ভেবে উল্লসিত হচ্ছেন না। কারণটা স্পষ্ট হয় যখন তাঁদের সঙ্গে আমরাও জানতে পারি ‘নাশকতার মামলার আসামিরাও আছেন যোগদানের তালিকায়।’ শুধু তাই নয়, পুলিশ যোগদান করা ব্যক্তিদের নাম বাদ দিয়ে আদালতে অভিযোগপত্র দিয়েছে। তাহলে কি আগে যেসব অভিযোগ ছিল তা অসত্য, নাকি অপরাধ থেকে মুক্তিলাভের উপায় সরকারি দলে যোগদান?
জামায়াতের নেতা ও কর্মীদের যোগদানের পক্ষে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাদের যুক্তিও শোনা যেতে পারে। রাজশাহীর বাগমারা উপজেলা জামায়াতের সাবেক সেক্রেটারি মাওলানা নুরুল ইসলাম ১০ এপ্রিল যখন সরকারি দলে যোগদান করেন, তখন উপজেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতা বলেন, ‘জামায়াতে অনেক ভালো লোক আছেন। খোঁজখবর নিয়েই তাঁকে দলে নেওয়া হয়েছে।’ রাজশাহীর চারঘাটের বিএনপির নেতা মোখলেসুর রহমান আওয়ামী লীগে যোগ দেন, তখন তাঁর কাছে একজন সাংবাদিক জানতে চেয়েছিলেন, তাঁর বিরুদ্ধে যেসব মামলা আছে, সেগুলো তুলে নেওয়ার শর্তে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন কি না, উত্তরে তিনি বলেছেন, বিষয়টি আওয়ামী লীগ নেতারা ‘দেখবেন’ বলে জানিয়েছেন।
৬ জুন জয়পুরহাট জেলার পাঁচবিবি উপজেলা জামায়াতের মজলিশে শুরার কর্মপরিষদ সদস্য আবদুস সালাম জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও স্থানীয় সাংসদ সামছুল আলমের উপস্থিতিতে এক সংবাদ সম্মেলনে পাঁচ শতাধিক নেতা-কর্মী নিয়ে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। ২০১৪ সালের মাঝামাঝি থেকে জামায়াত নেতা-কর্মীদের সরকারি দলে যোগ দেওয়ার অনেক ঘটনা রয়েছে। ২৮ মে ২০১৪ ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলা জামায়াতের সাবেক সভাপতি আবু বক্কর খান শিল্পমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেনের হাত ধরে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। এর আগে ১৯ এপ্রিল গোপালগঞ্জ জেলা জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি ইসমাইল হোসেন, জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি এম এ নাসির আহমেদও সাধারণ সম্পাদক মেজবাউদ্দিনের হাত ধরে আওয়ামী লীগে যোগদান করেছেন। ১৬ মার্চ ২০১৪ পাবনা সদর আসনের সরকারদলীয় সাংসদ ও জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক গোলাম ফারুক খন্দকার প্রিন্সের হাত ধরে পাবনার আতাইকুলা ইউনিয়ন জামায়াতের নায়েবে আমির মাওলানা রাজ্জাক হোসেন, রোকন মাওলানা, ফরিদ হোসেন, ম উদ্দিন শেখ, মাওলানা আজিজ, মাওলানা উজ্জ্বলসহ জামায়াত-শিবিরের দুই শতাধিক কর্মী-সমর্থক আওয়ামী লীগে যোগ দেন।
জামায়াতের নেতা-কর্মীদের দলবদলের অধিকার প্রশ্নাতীত, একইভাবে বিএনপির কর্মীদের জন্যও তা প্রযোজ্য। যে কেউ চাইলেই দল বদলাতে পারেন। আওয়ামী লীগ দলে কাকে গ্রহণ করবে, সেটা দলের বিবেচ্য বিষয়। কিন্তু গত কয়েক বছরে সংঘিটত বিভিন্ন সহিংস ঘটনার কোনো রকম বিচার হয়নি, এ নিয়ে বাক্য বিস্তার হয়েছে অনেক। যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছে, মামলা দায়ের করা হয়েছে, এখন তাঁদের সাদরে দলে টেনে নেওয়া হচ্ছে। ফলে এত দিন ধরে যেসব অভিযোগ করা হয়েছে, সেগুলোর সত্যতা যে আরও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ছে, আশা করি সরকারি দলের নেতারা তা বুঝতে পারেন। আদর্শের প্রশ্নটা না হয় অন্য কোনো সময়ের জন্য তোলা থাকল, সাংগঠনিকভাবে আওয়ামী লীগের লাভ কতটা, সে বিষয়ে আমি সন্দিহান। আর এসব দেখে প্রশ্ন জাগে, জামায়াতের এই নেতা-কর্মীরা যদি অন্য কোনো দলে যোগ দিতেন, তবে তার কী প্রতিক্রিয়া হতো?
প্রথম আলো’তে প্রকাশিত, ৯ জুলাই ২০১৫
[থাম্বনেইলের ছবির সূত্র: লিঙ্ক]