December 23, 2024

Source: http://goo.gl/jHcIVN

আমাদের কি চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার বিশ্বনাথ কর্মকারের ছেলে নয়ন কর্মকারের কথা মনে আছে? আজ থেকে ঠিক এক দশক আগে নয়ন কর্মকারের বয়স ছিল ২৪ বছর। আমাদের কি কানসাটের দিনমজুর ওসমান আলীর ছেলে আবুল কাসেম কাজলের কথা মনে আছে? আমাদের সম্ভবত মনে নেই, মনে থাকার কথা নয়। মনে থাকার কথা নয় ১৪ বছরের কিশোর আবদুল জিলানির নাম। আমাদের কাছে এসব সাময়িকভাবে পরিচিত নাম মাত্র, যা আমরা সহজেই বিস্মৃত হই। সে কারণেই আজ থেকে এক দশক আগে বিদ্যুতের মিটারে অতিরিক্ত অর্থ আদায়, দুর্নীতি আর সরকারি দলের লাঠিয়ালদের বিরুদ্ধে এবং বিদ্যুতের দাবিতে কানসাটের গ্রামের গরিব মানুষের চার মাসের সংগ্রামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে প্রাণ দেওয়া এসব মানুষের নাম আমাদের স্মরণে আসেনি। আমরা বিস্মৃত ২০০৬ সালে শনির আখড়ায় কী ঘটেছিল। ফুলবাড়ী পৌরসভার কমিশনার মখলেছুর রহমানের ছেলে তরিকুল ইসলাম (২২), চুন্নু (২৪), আহসান হাবিব (৩০) খায়রুল ইসলাম (৩০) ও নাম না-জানা ১২ বছরের কিশোরের কোনো স্মৃতি আমাদের তাড়া করে না।
এসব ঘটনা নাহয় অনেক দিনের পুরোনো, আমরা কি মনে করতে পারি ২০১৫ সালের ঘটনা? সেপ্টেম্বর মাসে এক নারী ও তাঁর সন্তানের ওপর নির্যাতনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে প্রতিবাদে মুখর হয়েছিল সাধারণ মানুষ, নিরপরাধ মানুষের প্রাণনাশ ঘটেছিল পুলিশের গুলিতে। কালিয়া গ্রামের শামীম হোসেন, কুষ্টিয়া গ্রামের ফারুক হোসেন, সালেঙ্কা গ্রামের শ্যামল চন্দ্র দাস ও মোহাম্মদ রুবেল হোসেনের নাম কেবল সেই সময়ের পত্রিকার পাতায় আছে বলেই আমাদের মনে হতে পারে। সোমবার চট্টগ্রামের বাঁশখালীর গণ্ডামারা ইউনিয়নে যাঁরা নিহত হয়েছেন, চরপাড়ার মরতুজা আলী (৫৫), মো. আনোয়ারুল ইসলাম (৪৪), জাকের আহমদ (৬০) ও মো. জাকের হোসেন—তাঁদের নামও হয়তো আমরা কিছুদিনের মধ্যেই বিস্মৃত হব। হয়তো বুদ্ধদেব বসুর কথা ধার করে বলাই ভালো, ‘“ভুলিবো না” এত বড় স্পর্ধিত শপথে জীবন করে না ক্ষমা,/ তাই মিথ্যা অঙ্গীকার থাক।’
বাঁশখালীর ঘটনা এখনো পরিণতিতে উপনীত হয়নি। ইতিমধ্যেই যাঁদের প্রাণনাশ হয়েছে, তাঁদের পরিবার প্রিয়জনকে এসব মৃত্যুর ভার বইতে হবে কয়েক প্রজন্ম ধরে। যেকোনো মৃত্যুই তাই করে। কিন্তু যখন অকালে অপঘাতে প্রিয়জনেরা মৃত্যুবরণ করে, তখন সেই শূন্যতা পাহাড়ের খাদের চেয়েও বড়, সেই মৃত্যু বুকের ওপরে যে শোক বসিয়ে দেয়, তা পাথরের চেয়েও ভারী। লাশের ভার যতটা না বেশি প্রিয়জনের মৃত্যুর স্মৃতি তার চেয়ে অনেক বেশি ভারী, যা কোনো কবরেই আপনি নামাতে পারবেন না, কোনো শ্মশানই তাঁকে দাহ করতে পারবে না। যাঁরা আহত হয়েছেন, তাঁরা সমগ্র জীবন এর প্রতিক্রিয়া বহন করবেন।
বাংলাদেশে ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি’র দাবিতে সোচ্চার মানুষ নেই, কিন্তু অস্বাভাবিক মৃত্যুই এখন স্বাভাবিকে পরিণত হয়েছে। এখন রাজনৈতিক সহিংসতায় মানুষের প্রাণনাশ হয়, কার্যত বিরোধী দলহীন ‘স্থানীয় নির্বাচনে’ নির্বিকার নির্বাচন কমিশনের জ্ঞাতসারে মানুষের মৃত্যু হয়, মানুষ নিখোঁজ হয়ে যায়, গুম হয়ে যাওয়া মানুষ লাশ হয়ে ফিরে আসে, অপঘাতে মৃত্যু হয়, মৃত্যুর কালো ছায়া থেকে ত্বকী বা তরুণী তনুরা বাদ যায় না। সাত খুনের অভিযোগে অভিযুক্তদের কার্যত স্বাভাবিক জীবনযাপনে বিঘ্ন ঘটে না, বিঘ্ন ঘটে সন্তানহারা পিতামাতার—মধ্যরাতে, তাঁদের ঘরের কড়া নড়ে ওঠে। তার মধ্যে এসব মৃত্যু, বাঁশখালী, কালিহাতী, ফুলবাড়ীর ঘটনাপ্রবাহ দেশ, রাজনীতির ও রাষ্ট্রের প্রশ্নকে আমাদের সামনে স্পষ্ট করে দেয়।
২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে কালিহাতীর ঘটনার তিন দিন পরে পুলিশের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) এস এম মাহফুজুল হক নুরুজ্জামান ফরিদপুরে এক সভায় পুলিশ সদস্যদের উদ্দেশে যা বলেছিলেন, তা এই স্পষ্টতারই অংশ। ডিআইজি বলেছিলেন, ‘প্রয়োজন হলে সরাসরি গুলি করুন, দায়দায়িত্ব সব আমি নেব।’ (বিডিনিউজ ২৪, ‘গুলি চালান, দায়িত্ব আমার: ডিআইজি’, ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৫, ঢাকা সময় রাত ৮টা ৩৮ মিনিট)। কথাটা অত্যন্ত স্পষ্ট। যদিও এটা নতুন কিছু ছিল না। বছরের শুরুতে বিএনপি জোটের অবরোধ-হরতালে নাশকতার মধ্যেও আমরা এ রকম কথা শুনতে পেয়েছিলাম। ফলে বাঁশখালীতে গুলিবর্ষণের ঘটনাকে আমাদের অস্বাভাবিক মনে করার উপায় কোথায়? একে আমরা আইন বলতে পারব না বটে, কিন্তু প্রচলিত ব্যবস্থাকে যদি কানুন বলি, তবে এটাই যে কানুন, তা তো স্পষ্ট। যাঁরা ‘কারও জন্য গণতন্ত্র, কারও জন্য গণতন্ত্র নয়’ তত্ত্ব দেন, ‘গণতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার তত্ত্ব দেন, তাঁদের কাছে নিশ্চয় এর গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা আছে; কিন্তু আমার মনে প্রশ্ন, এর দায়িত্ব কে নেবেন? বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত বিএনপি আমলে ‘অপারেশন ক্লিন হার্ট’-এর সময়ে সেনাবাহিনীর সদস্যদের আচরণের জন্য সংসদের দেওয়া দায়মুক্তির বিধান-সংবলিত ‘যৌথ অভিযান দায়মুক্তি আইন, ২০০৩’ বাতিল করে যে ঐতিহাসিক রায় দিয়েছেন, তাতে পর্যবেক্ষণ হিসেবে বলেছেন কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়।
এ তো গেল আইনি দিক, অন্যদিক হচ্ছে রাজনীতি। বাঁশখালী বা কালিহাতী কিংবা তারও আগে ২০১০ সালে আড়িয়ল বিলে বিমানবন্দর স্থাপনের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে রাজনীতি কেবল ক্ষমতায় টিকে থাকার বা ক্ষমতায় যাওয়ার বিষয় নয়। রাজনীতি হচ্ছে মানুষের প্রতিদিনের বেঁচে থাকার অংশ। ফলে বলপ্রয়োগের মুখে কোনো দল দুর্বল হয়ে পড়ার অর্থ রাজনীতিই নিঃশেষ হয়ে যাওয়া নয়। সাধারণের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হলে তা প্রকাশের পথও তাঁরা করবেন।
রাজনীতির অঙ্গনে ও তার বাইরে সিভিল সোসাইটিতে যাঁরা প্রায়ই শক্তিপ্রয়োগের পক্ষে বলেন, তাঁদের কাছে প্রশ্ন, তাঁরা কি বুঝতে পারেন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে মোকাবিলায় শক্তির উপর্যুপরি ও জবাবদিহিহীন ব্যবহার কেবল প্রচলিত রাজনীতির সীমানায় থাকে না এবং থাকবে না? সরকারের ভিত্তি যদি শক্তিপ্রয়োগের ওপরে হয়, তবে তার শেষ কিন্তু কেবল তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনে হয় না, সমাজের যেকোনো অংশের মানুষের ক্ষোভের বিরুদ্ধেই তা প্রযুক্ত হয়, এমনকি তা যদিও যৌক্তিক ক্ষোভও হয়।
বাঁশখালীর ঘটনার সূত্রপাত হয়েছে দেশি-বিদেশি যৌথ উদ্যোগে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনকে কেন্দ্র করে। কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে পরিবেশ বিপর্যয় হবে ও পৈতৃক বসতভিটা হারাবেন অনেকে—এমন শঙ্কা থেকে বসতভিটা রক্ষা সংগ্রাম কমিটির আহ্বানে সাড়া দিয়ে মানুষ তার প্রতিবাদ করেছে। স্থানীয়ভাবে এই নিয়ে পক্ষ-বিপক্ষ তৈরি হয়েছে বলেও গণমাধ্যমের খবর। কিন্তু এর পেছনে যে বড় বিষয় রয়েছে উন্নয়নের জয়ডঙ্কা। গত কয়েক বছরে ক্ষমতাসীনেরা সোল্লাসে যে উন্নয়নের বার্তা দিচ্ছেন, তার প্রথম শিকার হয়েছে গণতন্ত্র ও মানুষের ভোটাধিকার, তারপর হয়েছে পরিবেশ—রামপালের বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সরকারের সিদ্ধান্ত তার উদাহরণ, আড়িয়ল বিল সেই পথেই যাচ্ছিল। সেই উন্নয়নের ধারায় মানুষের ভিটেমাটির প্রশ্ন যে বাদ যাচ্ছে, তার প্রমাণ কেবল বাঁশখালী নয়, হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলার চান্দপুর-বেগমখান চা-বাগানের শ্রমিকদের ধানি জমিও। এসব ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীনদের কার্যক্রম, বলপ্রয়োগের চেষ্টা এই প্রশ্নকেই সামনে এনে দিচ্ছে যে উন্নয়নের লক্ষ্য যদি হবে মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন, তবে তাকে কেন শক্তির জোরে প্রতিষ্ঠিত করতে হচ্ছে?
বলপ্রয়োগের এই ধারা যে একসময় ক্ষমতাসীনদের আদর্শের বৈধতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করবে, তা তাঁদের কানে কে পৌঁছে দেবে? বলপ্রয়োগ যখন ক্ষমতার একমাত্র উপায় হয়ে ওঠে, তখন যে আদর্শের ভিত্তিতে ক্ষমতাসীনেরা নৈতিক বৈধতা দাবি করেন, সেটাই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। বিশ্বের সমসাময়িক ইতিহাস ও ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে যাঁরা পরিচিত, তাঁরা জানেন পূর্ব ইউরোপে গত শতকের নব্বইয়ের দশকে কেবল ক্ষমতার হাতবদল হয়নি, ক্ষমতাসীনেরা যে আদর্শিক ভিত্তির ওপরে দাঁড়িয়ে দেশ শাসনের নৈতিক অধিকারের দাবি করতেন, তা সম্পূর্ণ অপসৃত হয়েছে। একইভাবে মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার দেশে দেশে শাসকগোষ্ঠীই কেবল ক্ষমতার সংকটে পড়েছে তা নয়, যে আদর্শের কথা বলে তারা রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকেছে এবং নিপীড়ন চালিয়েছে, সেই আদর্শই এখন সংকটে পড়েছে।
কেবল রাজনৈতিক আদর্শের প্রশ্নটি উত্থাপন যথেষ্ট নয়। বাংলাদেশের মতো দেশে রাষ্ট্র একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রতিষ্ঠান হিসেবে তার ভূমিকা ও প্রভাব অপরিসীম। সেই রাষ্ট্রের অন্তর্গত প্রধান প্রতিষ্ঠানগুলো ইতিমধ্যেই মানুষের আস্থার জায়গা থেকে সরে গেছে। এ রকম অবস্থায় রাষ্ট্র যদি কেবল দমন-পীড়নের পথই বেছে নেয়, তবে সেই প্রতিষ্ঠানগুলোর বৈধতা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের বৈধতা হ্রাস কেবল ক্ষমতাসীনদের জন্য উদ্বেগের বিষয় নয়, এটি দেশের সবার জন্যই চিন্তার বিষয় হওয়া বাঞ্ছনীয়।
প্রথম আলো’তে প্রকাশিত ৬ এপ্রিল ২০১৬

Leave a Reply