একুশে গ্রন্থমেলার প্রস্তুতি-বিষয়ক তথ্য জানাতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক প্রকাশকদের উদ্দেশে সাবধানতা অবলম্বনের উপদেশ দিয়েছেন বলে বিভিন্ন মাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, গত বছরের মেলায় রোদেলা প্রকাশনীর স্টল বন্ধ করে দেওয়ার বিষয়ে একজন সাংবাদিক জানতে চাইলে একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান বলেন, ‘আমরা চাই প্রকাশকেরা এমন কিছু বই প্রকাশ না করুন, যেটা উসকানিমূলক। আর এ ধরনের কিছু করা হলে অঘটন ঘটতে পারে।’
এবারের বইমেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে গত বছর সংঘটিত তিনটি ঘটনার প্রেক্ষাপটে—এর একটি রোদেলা প্রকাশনীর স্টল বন্ধ করে দেওয়া, দ্বিতীয়টি হচ্ছে বইমেলা থেকে ফেরার পথে লেখক অভিজিৎ রায়ের হত্যাকাণ্ড এবং তৃতীয়টি হচ্ছে গত বছর ৩০ সেপ্টেম্বর দুটি প্রকাশনা সংস্থায় একই সঙ্গে হামলা, যাতে জাগৃতি প্রকাশনীর ফয়সল আরেফিন দীপন নিহত হন। এর আগে ২০০৪ বাংলা একাডেমির বইমেলা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পথে আক্রান্ত হয়েছিলেন লেখক হুমায়ুন আজাদ, সৌভাগ্যবশত তিনি সেই যাত্রা বেঁচে যান; কিন্তু অভিজিৎ সবার সামনেই নিহত হন, তাঁর স্ত্রী রাফিদা বন্যা গুরুতরভাবে আহত হন। এই ঘটনার এখনো সুরাহা হয়নি, তদুপরি তাঁর প্রকাশক দীপন নিহত হয়েছেন, হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন আরও চারজন লেখক। এসব কারণে এই বছর মেলার নিরাপত্তার বিষয়ে সবার উদ্বেগ আছে, সেই প্রেক্ষাপটে একাডেমির মহাপরিচালক যখন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে জানান যে বইমেলায় ‘রেকর্ড নিরাপত্তার’ ব্যবস্থা হচ্ছে, দুই শতাধিক সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে পুরো বইমেলা ‘পর্যবেক্ষণ করা হবে’ এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পর্যাপ্তসংখ্যক সদস্য মেলার নিরাপত্তায় থাকবেন, তখন নিশ্চয় মানুষের ভেতরে খানিকটা হলেও আশা তৈরি হয়।
কিন্তু সেই সংবাদ সম্মেলনে ‘উসকানিমূলক’ প্রকাশনা থেকে বিরত থাকার আহ্বান আমাদের উদ্বিগ্ন করে। কোন প্রকাশনা কার কাছে ‘উসকানি’ বলে বিবেচিত হবে, আমরা কখনোই তা বলতে পারব না। প্রশ্ন হচ্ছে, কে তা নির্ধারণ করবে? তা ছাড়া কে, কবে এই মানদণ্ড তৈরি করেছে, কারা এই শনাক্তকরণের দায়িত্বপ্রাপ্ত হবে—এসব প্রশ্নের উত্তর আমরা জানি না। প্রকাশনার ক্ষেত্রে এমন ব্যবস্থা আসলে চিন্তার স্বাধীনতাকে নিয়ন্ত্রণের রূপ। বাংলাদেশে আমরা যে ইতিমধ্যেই এই অবস্থার মধ্যে পতিত হয়েছি, তা আমাদের স্বীকার বা অস্বীকারের ওপর নির্ভর করে না। বিরাজমান এই পরিস্থিতি বিষয়ে আলাদা করে বলার দরকার কতটা, সেটা পাঠকেরা জানেন। কিন্তু তার আগে শুধু স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, এই বইমেলা ‘একুশের গ্রন্থমেলা’। একুশে ফেব্রুয়ারির মর্মবাণী কি এই নয় যে আমরা প্রচলিত কিছুকে অস্বীকারে পিছপা হব না? ১৯৭৮ সালে আবুল ফজলের প্রকাশিত গ্রন্থের নাম ছিল একুশ মানে মাথা নত না করা। আজকের বিবেচনায় ওই প্রকাশনা কি উসকানিমূলক বলেই বিবেচিত হতো?
একুশের বইমেলার সঙ্গে বাংলাদেশের অধিকাংশ লেখকের ব্যক্তিগত অনেক স্মৃতি জড়িত আছে। আমি তার ব্যতিক্রম নই। মেলার ইতিহাস যাঁরা জানেন, তাঁদের স্মরণে থাকবে ১৯৭৮-৭৯ সালে মেলা হতো সপ্তাহব্যাপী, বড়জোর ১৫ দিন। উৎসবের আলোকচ্ছটাহীন সেই মেলার আয়োজক বাংলা একাডেমি নয়, যদিও তার প্রাঙ্গণেই এই আয়োজন, কিন্তু আয়োজক হাতে গোনা প্রকাশকেরা। নির্ধারিত কয়েকটি স্টলের বাইরে খোলা জায়গায়, বটতলায় তরুণ লেখকেরা নিজেরাই টেবিল-চেয়ার জোগাড় করে নিজেদের অর্থে প্রকাশিত বই সাজিয়ে বসতেন বিক্রির জন্য। লেখকদের সেই আয়োজনে যশের আকাঙ্ক্ষা যে থাকত না তা নয়, কিন্তু তার সবটাই খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠার জন্য ছিল, তা বললে সত্যের অপলাপ হবে। প্রাতিষ্ঠানিকতার বিরুদ্ধে তরুণদের দ্রোহের প্রকাশও ছিল সেসব প্রকাশনা। ১৯৭৮ সালের শেষে আমরা কয়েক বন্ধু মিলে নিজেদের অর্থে কিংবা বন্ধুদের দেওয়া সাহায্যে নিজেদের বই বের করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ১৯৭৯ সালের বইমেলায় নিজেদের বই নিজেরাই ছেপে নিয়ে হাজির হয়েছিলাম। আমরা মানে আমি, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ, মোহন রায়হান ও আবিদ রহমান। রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর কবিতার বই উপদ্রুত উপকূল যদিও শেষ মুহূর্তে আহমদ ছফার কল্যাণে বুক সোসাইটির নাম দিয়ে বের হয়েছিল, উদ্যোগটা ব্যক্তিগতই ছিল। সেই বইয়ের কবিতাগুলোর মধ্যে ছিল ‘বাতাসে লাশের গন্ধ’ শিরোনামের কবিতা। সেই কবিতার এই পঙ্ক্তি, ‘জাতির পতাকা আজ খামচে ধরেছে সেই পুরোনো শকুন’ নিশ্চয় কারও কাছে উসকানিমূলক বলেই বিবেচিত হয়েছিল। মোহন রায়হানের কাব্যগ্রন্থের নাম ছিল জ্বলে উঠি সাহসী মানুষ—এর চেয়ে প্রত্যক্ষ প্ররোচনা আর কি কিছু হতে পারে? মেলায় প্রকাশিত আমার প্রথম প্রবন্ধগ্রন্থ বাঙালি জাতীয়তাবাদ-এর অন্যতম প্রবন্ধ ছিল আগের বছরের গ্রীষ্মকালে ‘স্বরূপ অন্বেষা’ সংকলনে প্রকাশিত প্রবন্ধ ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদের পরিবর্ধিত রূপ’।
১৯৭৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলা একাডেমির এক আলোচনা সভায় খন্দকার আবদুল হামিদের দেওয়া বক্তৃতায় ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের’ যে ধারণা বলা হয়েছিল, ১৯৭৮ সাল নাগাদ তা সেনাশাসক জিয়াউর রহমানের পৃষ্ঠপোষকতায় রাষ্ট্রীয় আদর্শে রূপ নিয়েছে। কিন্তু সামরিক শাসকের সেই আদর্শিক অবস্থানকে চ্যালেঞ্জ করার তাগিদ থেকেই সেদিন এই প্রবন্ধ এবং বই লেখার সাহস করেছিলাম। হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত সাহিত্য সাময়িকী সমকাল-এর ১৯৭৮ সালের এপ্রিল সংখ্যায় (বর্ষ ১৯, সংখ্যা ৪) বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক আবদুল হকের লেখা ‘দোদুল্যমান জাতীয়তা’ শিরোনামের প্রবন্ধ ছাড়া আর কারও লেখায় সেদিন এই বিষয়কে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছিল বলে মনে পড়ে না। এই রকম একটা বই প্রকাশের ক্ষেত্রে ভরসা ছিল বইমেলা—পাঠকের হাতে তুলে দেওয়া যাবে। এক অপরিচিত তরুণের এই বই প্রকাশের দায়িত্ব কেউ নেবে—এমন আশা করিনি, বন্ধুর প্রেসের নামে প্রকাশনীর নাম দিয়ে সেই বই বেরিয়েছিল। বইয়ের ভূমিকায় সেই কারণেই লিখেছিলাম ‘তারুণ্য একধরনের শক্তি ও সাহস জোগায়, একধরনের ঔদ্ধত্যের প্ররোচনাও দেয় বৈকি—এই গ্রন্থ তার প্রমাণ।’ শক্তি দিয়ে নয়, যুক্তি ও তথ্য দিয়েই যে প্রতিপক্ষকে মোকাবিলা করতে হয়, আমাদের অগ্রজ লেখক ও শিক্ষকদের সেই শিক্ষা আমার ঔদ্ধত্যের উৎস ছিল। আত্মপ্রচারের উদেশ্যে এই প্রসঙ্গের অবতারণা করিনি, শুধু এ কথা বলার জন্যই এই প্রসঙ্গের অবতারণা যে সেদিন এবং তার পরে প্রতিবছর প্রতিটি বইমেলা আমাদের মতো আরও অসংখ্য তরুণকে ‘উসকানিমূলক’ লেখা লেখার এবং প্রকাশ করার, রাষ্ট্রযন্ত্রের অনাচারের বিরুদ্ধে, সমাজে প্রচলিত পশ্চাৎপদ ধ্যানধারণা ও বিশ্বাসের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহস জুগিয়েছে।
লেখক-প্রকাশকদের এ ধরনের উসকানিমূলক লেখা ও প্রকাশনার বাইরেও বইমেলা অনেক কথিত উসকানির গৌরবের অংশীদার। একটা উদাহরণ দিই। ১৯৭৭ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভোরে একাডেমির কবিতা পাঠের আসরে নির্মলেন্দু গুকণ পাঠ করেছিলেন ‘আমি আজ কারও রক্ত চাইতে আসিনি’ কবিতাটি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর ‘শেখ মুজিব’—এই দুটি শব্দ যখন প্রায় নিষিদ্ধ, সেই সময় নির্মলেন্দু গুাণ পাঠ করলেন, ‘সমবেত সকলের মতো আমিও গোলাপ ফুল খুব ভালোবাসি,/ রেসকোর্স পার হয়ে যেতে সেই সব গোলাপের একটি গোলাপ গতকাল/ আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।/আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।’
প্রচলিত চিন্তা ও শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর উসকানি কেবল তরুণদের বিষয় নয়; যেকোনো স্বাধীন চিন্তাশীল লেখক ও বুদ্ধিজীবীর দায়িত্বই হচ্ছে এই চ্যালেঞ্জ অব্যাহত রাখা। একজন স্বাধীন বুদ্ধিজীবী কিসের উসকানি দেবেন? এই প্রশ্নের উত্তরের জন্য আমরা কাজী মোতাহার হোসেনের শরণাপন্ন হতে পারি। বিংশ শতাব্দীর কুড়ির দশকে শিখা গোষ্ঠীর দ্বিতীয় বার্ষিক প্রতিবেদনে বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন কী, তা ব্যাখ্যা করে তিনি লিখেছিলেন, ‘আমরা চক্ষু বুঝিয়া পরের কথা শুনিতে চাই না বা শুনিয়াই মানিয়া লইতে চাই না; আমরা চাই চোখ মেলিয়া দেখিতে, সত্যকে জীবনে প্রকৃতভাবে অনুভব করিতে। আমরা কল্পনা ও ভক্তির মোহ আবরণে সত্যকে ঢাকিয়া রাখিতে চাই না। আমরা চাই জ্ঞান শিক্ষা দ্বারা অসার সংস্কারকে ভস্মীভূত করিতে এবং সনাতন সত্যকে কুহেলিকা মুক্ত করিয়া ভাস্বর ও দীপ্তিমান করিতে।…এক কথায় আমরা বুদ্ধিকে মুক্ত রাখিয়া প্রশান্ত জ্ঞান দৃষ্টি দ্বারা বস্তু জগৎ ও ভাবজগতের ব্যাপারাদি প্রত্যক্ষ করিতে ও করাইতে চাই।’ লেখকের কাজ হচ্ছে সব ধরনের সাবধানবাণীকে অগ্রাহ্য করে যাঁরা ভক্তির মোহ আবরণে সত্যকে ঢেকে রাখতে চান, তাঁদের বিরুদ্ধে উসকানি দেওয়া।
প্রথম আলো’তে প্রকাশিত, ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৬