ভাস্কর সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদের সঙ্গে আমার পরিচয় একার্থে কাকতালীয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী না হলে কিংবা সত্তরের দশকের শেষ ভাগে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা না করলে কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে যুক্ত না থাকলে কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদে নির্বাচিত না হলে তাঁকে ঘনিষ্ঠভাবে জানার সুযোগ আমার হতো না। কিন্তু ১৯৭৯ সালে যে ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে আমি তাঁকে জানতে পারি—তাঁর সাহচর্য ও নৈকট্য লাভের সুযোগ পাই, তা আমার ব্যক্তিগত জীবনের একটা বড় সম্পদ। কেবল ব্যক্তিগতভাবে আমার জীবন নয়, আমার বিশ্বাস সেই ঘটনাপ্রবাহ, সেই সময়ে ভাস্কর আবদুল্লাহ খালিদের অসামান্য সৃষ্টি বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অনন্য অধ্যায়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের এক অবিস্মরণীয় প্রতীক তৈরির কাজ তিনি সেই সময়ে শেষ করেছেন—‘অপরাজেয় বাংলা’।
খালিদ ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে ১৯৭৯ সালের গোড়ায় দিকে; আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। অপরাজেয় বাংলার কাজ আবার মাত্র শুরু হয়েছে। ভাস্কর্যটি তৈরি করা শুরু হয়েছিল ১৯৭৩ সালে; শিল্পী ও ভাস্কর আবদুল্লাহ খালিদ। উদ্যোগটা ছিল তৎকালীন ডাকসুর। অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন ডাকসুর সাংস্কৃতিক বিষয়ক সম্পাদক ম. হামিদ। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সামরিক আইন জারির পর ভাস্কর্যটি নির্মাণের কাজ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ১৯৭৮ সালের সেপ্টেম্বরে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ভাস্কর্যটির নির্মাণকাজ শেষ করার সিদ্ধান্ত নেয়। আবদুল্লাহ খালিদ সে সময় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। তাঁকে ঢাকায় আনার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ম. হামিদ ও বদরুল আলম বেনুর প্রচেষ্টায় ভাস্কর আবদুল্লাহ খালিদ আবার কাজে যোগ দেন এবং ভাস্কর্যের কাজ শেষ করার ব্যাপারে হাত দেন। সে সময় ১১ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। এর সভাপতি নিযুক্ত হন অধ্যাপক এ কিউ এম বি করিম, সম্পাদক নিযুক্ত হন অধ্যাপক কে এম সাদউদ্দিন এবং কোষাধ্যক্ষ নিযুক্ত হন অধ্যাপক এ এ এম বাকের। এই কমিটি নিয়োগের পর নতুন করে কাজের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কাজ শুরুও হয় ১৯৭৯ সালের ১৯ জানুয়ারি।
সে সময়েই আমি তাঁকে দেখি—দূরে থেকে। কিন্তু সেই বছরের ২৪ জুলাই ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। আমি ডাকসুর সাহিত্য-বিষয়ক সম্পাদক নির্বাচিত হলাম। নির্বাচনে মাহমুদুর রহমান মান্না ডাকসুর সহসভাপতি এবং আখতারউজ্জামান সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হলেন, ১১ জনের কমিটিতে তাঁরাও অন্তর্ভুক্ত হলেন। সেই সময়ে আমরা অনুভব করি এবং সিদ্ধান্ত নিই যে যতটা দ্রুত সম্ভব এই ভাস্কর্যের কাজ শেষ করতে হবে। এই বিষয়ে মান্না ভাইয়ের উৎসাহ ছিল অপরিসীম। নির্বাচনের পরপরই তৎকালীন উপাচার্য ফজলুল হালিম চৌধুরী এবং ডাকসুর কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, যিনি ভাস্কর্য নির্মাণ কমিটিরও সদস্য ছিলেন, আমাদের উৎসাহে সাগ্রহে সাড়া দিলেন। কার্যত তাঁরা দুজনই ভাস্কর্যটির নির্মাণকাজ শেষ করার তাগাদাও দিতে থাকেন।
এই উৎসাহের পেছনে একটা কারণও ছিল। আমরা আশঙ্কা করছিলাম অর্ধসমাপ্ত ভাস্কর্যটি ভেঙে ফেলা হতে পারে। ১৯৭৭ সালের ২৮ আগস্ট এই ভাস্কর্যের ওপরে হামলা হয়েছিল; তখন এটা ভেঙে ফেলার অপচেষ্টা সাধারণ ছাত্রদের প্রতিরোধের মুখে ভেস্তে যায়। ১৯৭৯ সালের গোড়াতে আমরা শুনতে পাই যে একদল ‘শিক্ষার্থী’ বিশ্ববিদ্যালয়ে আবারও ‘স্বাক্ষর কর্মসূচি’ শুরু করেছে বা করতে যাচ্ছে। তাদের বক্তব্য ছিল এই ভাস্কর্য ইসলাম ধর্মের জন্য অবমাননাকর, তাই এটি ভেঙে ফেলা উচিত।
এই সময়ে আমার দায়িত্ব হলো খালিদ ভাই এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের মধ্যে যোগাযোগ রাখা; খালিদ ভাইয়ের যা দরকার সেই বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা এবং তা পাওয়ার ব্যবস্থা করে দেওয়া। দায়িত্বটা যতটা না লিখিতভাবে দেওয়া তার চেয়ে বেশি স্বেচ্ছায় তুলে নেওয়া। উৎসাহের অনুপ্রেরণা দিয়েছিলেন সিরাজ স্যার। এই কাজের পাশাপাশি আরেক কারণে আমার সঙ্গে খালিদ ভাইয়ের নৈকট্য তৈরি হয়েছিল। আমার সহপাঠী ও বন্ধু মিশুক মুনীর সম্ভবত মার্চ-এপ্রিল থেকেই কাজের অগ্রগতির ছবি তুলেছিল। ডাকসুতে বিজয়ী হওয়ার পরে আমি মিশুককে উৎসাহ জোগালাম ওই ছবিগুলো ডাকসুর প্রকাশনা ছাত্রবার্তায় প্রকাশের জন্য। মিশুক তার আগ্রহেই ইতিমধ্যেই নেশার মতো দিনরাত খালিদ ভাইয়ের সঙ্গেই কাটাচ্ছিল। আমি তার সঙ্গে জুড়ে গেলাম। সেই সময়টিতেই আমি দিনরাত ধরে খালিদ ভাইকে কাছে থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম। বন্ধুবৎসল, আন্তরিক, কাজপাগল মানুষ খালিদ ভাইয়ের বাইরে আর কোনোভাবেই মনে করতে পারি না তাঁকে। শিল্পী ছিলেন খালিদ ভাই—আপাদমস্তক শিল্পী, জীবনযাপনেও শিল্পী, আচরণেও শিল্পী।
অনেক দিন আমার আর মিশুকের মনে হতো খালিদ ভাই সম্ভবত সারা দিন না খেয়েই কাজ করছেন। যখন রাতেও কাজ করতে শুরু করলেন খালিদ ভাই, বেনু ভাই ও হামিদ ভাই—তখন মিশুক আর আমি অনেক দিন খালিদ ভাইকে প্রায় জোর করেই কাজ থেকে বিরত করে বটতলায় বসতে বাধ্য করেছি। এই কাজপাগল মানুষটি শেষ পর্যন্ত না অসুস্থ হয়ে পড়েন, এমন আশঙ্কাও করেছি। কাজপাগল, খামখেয়ালি মানুষ অনেক সময়ে আমাদের ওপর রাগ করেছেন; রাগ করেছেন অন্যদের ওপরও। কিন্তু তারপরও তাঁর দিকে তাকিয়ে বুঝেছি আমাদের প্রতি, তাঁর কাজের সঙ্গে যুক্ত মানুষদের প্রতি ভালোবাসা কতটা গভীর।
১৯৭৯ সালের ডিসেম্বরে ভাস্কর্যটির কাজ প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল, অল্প কিছু চূড়ান্ত ঘষামাজার কাজ বাকি ছিল। ডাকসু এটি উদ্বোধন করার সিদ্ধান্ত নিল এবং খালিদ ভাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাজি হলেন। খালিদ ভাইয়ের অনিচ্ছা প্রকাশের কারণ ছিল তিনি তখন পর্যন্ত সন্তুষ্ট ছিলেন না; তিনি এটার ওপর আরও কাজ করতে চেয়েছিলেন, যাতে করে এটা যথাসম্ভব নিখুঁত হয়। কিন্তু কবে কোন স্রষ্টা তাঁর সৃষ্টিকর্ম নিয়ে সন্তুষ্ট হন? খালিদ ভাইয়ের ক্ষেত্রেও তা-ই ঘটল। ডাকসুর পক্ষ থেকে আমরা সবাই তাঁকে নিশ্চয়তা দিয়েছিলাম যে তাঁর যদি ইচ্ছে থাকে তবে উদ্বোধনের পরও তিনি ভাস্কর্যটি নিয়ে কাজ করতে পারেন। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭৯ সাল ভাস্কর্যটি উদ্বোধন হলো—একজন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা এর উদ্বোধন করেছিলেন। আমার মনে আছে যেদিন আমি খালিদ ভাইকে বলেছিলাম, এর উদ্বোধন করবেন একজন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা। তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন।
মিশুকের তোলা অপরাজেয় বাংলা নির্মাণের ছবিগুলোর প্রথম সংকলনটি প্রকাশিত হয়েছিল উদ্বোধনের দিন স্মরণিকায়; দ্বিতীয় সংকলন প্রকাশিত হয়েছে সম্প্রতি মন জানালা নামে৷ মিশুকের অনুজ তন্ময়ের কারণেই বইটা প্রকাশ সম্ভব হয়েছে। আমার ভূমিকা ছিল সামান্যই। প্রকাশনা উৎসবে খালিদ ভাই উপস্থিত ছিলেন, আমি উপস্থিত থাকতে পারিনি; প্রবাসে থাকার কারণে যেসব বেদনা জীবনের সঙ্গী হয়ে থাকে, এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত না থাকতে পারা তার একটি। রোববার খালিদ ভাইয়ের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে অনেক স্মৃতি মনে পড়ল, মনে হলো এই অনুষ্ঠানে না যাওয়ার বেদনাটি চির সঙ্গী হয়ে থাকল—খালিদ ভাইয়ের সঙ্গে আর দেখা হবে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের প্রাঙ্গণে খালিদ ভাই কেবল ঋজু, সাহসী একটি ভাস্কর্য—‘অপরাজেয় বাংলা’—তৈরি করেননি, তিনি ধারণ করেছেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মর্মবস্তুকে। বাংলাদেশের নাগরিকদের কেবল তাঁকে মনেই রাখার কথা নয়, প্রজন্ম-প্রজন্মান্তর ধরে তাঁর কাছে ঋণী থাকার কথা। কিন্তু এখন বড় দুঃসময়।
খালিদ ভাই, এক দুঃসময়ে আপনাকে বলেছিলাম যেভাবেই হোক ভাস্কর্যের কাজ শেষ হবেই, জানি না আজ খুব সাহস করে এই প্রতিশ্রুতি দিতে পারব কি না যে আপনি যা রেখে গেলেন, আমরা তার যথাযথ সম্মান দিতে পারব। বাংলাদেশ যেন আপনাকে বিস্মৃত না হয়, সেটাই আজকের দিনের প্রত্যাশা৷ ভালো থাকুন খালিদ ভাই৷
প্রথম আলো’তে প্রকাশিত ২২ মে ২০১৭