জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বীকৃতির পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে যে প্রস্তাব পাস হয়েছে, তা যুক্তরাষ্ট্র, বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের জন্য যে একটা বড় ধরনের পরাজয়, সেটা অনস্বীকার্য। কিন্তু এ বিষয়ে সাধারণ পরিষদের ভোটে যে এই ধরনের ফলাফলই হবে, সেটা মোটেই বিস্ময়কর নয়। এটাই স্বাভাবিক ছিল যে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ যুক্তরাষ্ট্রকে সমালোচনা করবে এবং অত্যন্ত কঠোর ভাষায় যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তকে প্রত্যাখ্যান করবে। ইসরায়েলের অন্যায় আচরণের সমালোচনা, ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীর অধিকার, অধিকৃত এলাকায় ইসরায়েলের বেআইনি বসতি স্থাপনের বিরোধিতা-বিষয়ক প্রশ্নে সাধারণ পরিষদের সদস্যরা সব সময়ই এ ধরনের অবস্থান নিয়ে এসেছে।
ভোটের আগে কোনো কোনো বিশ্লেষক ধারণা করেছিলেন, ১৯৩টি দেশের মধ্যে ১৫০ টির বেশি দেশই তুরস্ক ও সুদানের আনা এই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেবে। এ ধারণার পেছনে প্রধানত কাজ করেছিল ১৮ ডিসেম্বর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে জেরুজালেম-বিষয়ক প্রস্তাবের প্রতি ১৪টি দেশের সমর্থন। যুক্তরাষ্ট্রের ভেটোর কারণে প্রস্তাবটি পাস হয়নি। সাধারণ পরিষদে ভোট গণনার পরে দেখা যাচ্ছে যে এই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট পড়েছে ১২৮ টি, বিপক্ষে ৯ টি, ৩৫টি দেশ ভোটদানে বিরত থেকেছে এবং ২১টি দেশ অধিবেশনে অনুপস্থিত থেকেছে। অতীতে এই ধরনের বিষয়ে সমর্থনের মাত্রা একই ধরনের ছিল।
২০১২ সালের ২৯ নভেম্বর সাধারণ পরিষদ যখন ফিলিস্তিনকে পর্যবেক্ষকের মর্যাদা (নন-মেম্বার অবজারভার স্ট্যাটাস) দেয়, সেই সময়ও পক্ষে ভোট পড়েছিল ১৩৮ টি, বিপক্ষে ৯ টি, ৪১টি দেশ ভোটদানে বিরত ছিল,৫টি দেশ অনুপস্থিত ছিল। সেই অর্থে সমর্থনের মাত্রায় বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি।
বৃহস্পতিবার যে প্রস্তাব পাস হয়েছে, সেই প্রস্তাবের মর্মবস্তু হচ্ছে এই, ১২৮টি দেশ যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি জেরুজালেম-বিষয়ক সিদ্ধান্ত বাতিলের আহ্বান জানাচ্ছে। ৬ ডিসেম্বর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কয়েক দশকের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত রীতি এবং জাতিসংঘের সব ধরনের প্রস্তাবকে উপেক্ষা করে ইসরায়েলের এই দাবিকেই স্বীকৃতি দেন যে জেরুজালেমকে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে গ্রহণ করছে এবং তার দূতাবাস তেল আবিব থেকে জেরুজালেমে সরিয়ে আনবে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে পাস হওয়া প্রস্তাবে বলা হচ্ছে যে পরিষদ সাম্প্রতিক কালে জেরুজালেম-বিষয়ক বিভিন্ন সিদ্ধান্তে দুঃখ প্রকাশ করেছে (যা স্পষ্টত যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের প্রতি ইঙ্গিত করছে), ১৯৮০ সালে নিরাপত্তা পরিষদে গৃহীত প্রস্তাব ৪৭৮-এর প্রতি সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছে এবং বলেছে, কোনো দেশ যেন পবিত্র জেরুজালেম শহরে তাদের দূতাবাস স্থাপন না করে।
এই প্রস্তাবে বলা হচ্ছে, কোনো সিদ্ধান্ত বা কাজ, যা জেরুজালেমের চরিত্র, মর্যাদা (স্ট্যাটাস) বা এর জনমিতিমূলক গঠন বদলে দেওয়ার ধারণা দেয়, তার কোনো আইনি কার্যকারিতা নেই এবং তা বাতিল (নাল অ্যান্ড ভয়েড) বলে বিবেচিত হবে। প্রস্তাবে সদস্যরাষ্ট্রগুলোর কাছে দাবি করা হয়েছে, তারা যেন জেরুজালেম বিষয়ে জাতিসংঘের অতীতের নেওয়া প্রস্তাবগুলো মেনে চলে এবং এমন কিছু না করে, যা ওই সব প্রস্তাবের বিরুদ্ধে যায়। প্রস্তাবের এই ভাষ্য নিরাপত্তা পরিষদে আলোচিত এবং ১৪ দেশের সমর্থিত। তা ছাড়া, ঘনিষ্ঠভাবে পাঠ করলে দেখা যায় যে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ নতুন কোনো অবস্থান নেয়নি, বরং স্থিতাবস্থা বজায় রাখার পক্ষেই আহ্বান জানাচ্ছে। তদুপরি এই প্রস্তাব হচ্ছে ‘নন-বাইন্ডিং’, অর্থাৎ তা সদস্যরাষ্ট্রগুলো মানতে বাধ্য নয়।
জাতিসংঘের এই প্রস্তাব নতুন কোনো নীতি প্রস্তাব করেনি, এই প্রস্তাব নতুন গুরুত্বপূর্ণ দেশের সমর্থন লাভ করেনি এবং এই প্রস্তাব মানার কোনো বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করেনি। ফলে আপাতদৃষ্টে এর মূল্য প্রতীকী প্রতিবাদের বেশি বলে মনে না হওয়াই স্বাভাবিক। তা ছাড়া, ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে অধিকৃত এলাকায় ইসরায়েলের বসতি স্থাপনের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের নিন্দা প্রস্তাবে ভেটো না দেওয়া ছাড়া এমন কোনো প্রস্তাব নেই যেখানে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের পক্ষে দাঁড়ায়নি। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাও এ ক্ষেত্রে কোনো ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু এত কিছু সত্ত্বেও এবারের এই প্রস্তাব পাসের তাৎপর্য অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে ভিন্ন এবং বেশি। তার প্রধান কারণ হচ্ছে, এই ভোটের আগে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বক্তব্য এবং জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী প্রতিনিধি নিক্কি হ্যালির হুমকি। ট্রাম্প ও হ্যালি হুমকি দিয়েছিলেন, যারা যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ভোট দেবে, তাদের অর্থনৈতিক সহায়তা বন্ধ করে দেওয়া হবে। হ্যালি বলেছিলেন, যারা প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেবে, তাদের ‘নামধাম লিখে রাখা’ হবে।
যুক্তরাষ্ট্র অতীতে ক্ষেত্রবিশেষে তার পক্ষে ভোট দেওয়ার জন্য অন্য দেশগুলোকে অনুরোধ করেছে বা পরোক্ষভাবে চাপ দিয়েছে, সেটা কোনো অজানা বিষয় নয়। কিন্তু এই প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট প্রকাশ্যে সরাসরি হুমকির ভাষা ব্যবহার করলেন। এতে বোঝা গেল যে ট্রাম্প প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রের ‘সফট পাওয়ার’ বা নরম শক্তির ওপরে আর ভরসা রাখছে না। তারা মনে করে যে হুমকি দিয়েই কাজ হবে। এটা যে কেবল আন্তর্জাতিক রীতিনীতির সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ তা-ই নয়, একাদিক্রমে বিশ্ব রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব হ্রাসের স্বীকৃতি এবং যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমাগতভাবে একা হয়ে পড়ারই লক্ষণ।
প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে প্রত্যাহার, ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়া, ইউনেসকো থেকে প্রত্যাহারসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যুক্তরাষ্ট্রের আচরণ ইতিমধ্যেই দেশটিকে একাকী অবস্থানে নিয়ে গেছে। এই আচরণের ফলে যুক্তরাষ্ট্র যে আরও বেশি বিচ্ছিন্ন অবস্থার দিকেই অগ্রসর হলো, তা স্পষ্ট। তবে ট্রাম্প প্রশাসনের হুমকির কারণে কোনো কোনো দেশ যে অনুপস্থিত থেকেছে বা ভোটদানে বিরত থেকেছে, সেটা ঠিক। ট্রাম্প সম্ভবত এতেই খুশি হবেন যে এতে কাজ হয়।
এই ভোটকে কেন্দ্র করে নিক্কি হ্যালি মনে করিয়ে দিয়েছেন যে যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘে সবচেয়ে বেশি অর্থ দিয়ে থাকে। প্রতিবছর যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘে মোট ১০ বিলিয়ন ডলার দেয়; এর মধ্যে ৪ বিলিয়ন সদস্য হিসেবে তাকে অবশ্যই দিতে হয়, ৬ বিলিয়ন দেয় স্বেচ্ছায়। এর বাইরে যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের অন্যান্য কার্যক্রমেও অর্থ দেয়। যেমন শান্তিরক্ষা বাহিনীর জন্য দেয় প্রায় আড়াই বিলিয়ন ডলার। এসব অর্থ দেওয়ার ক্ষেত্রে যদি ভিন্ন সিদ্ধান্ত নেয়, তবে জাতিসংঘের কার্যক্রমে বাধা পড়বে তা নয়, তা হবে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আত্মঘাতী। দেশের কংগ্রেস এই ধরনের পদক্ষেপের সঙ্গে একমত হবে, এমন মনে করার কোনো কারণ নেই। কিন্তু এই নিয়ে হুমকি দিয়ে ট্রাম্প প্রশাসন আদৌ কোনোভাবে লাভবান হচ্ছে না।
বিভিন্ন দেশকে দেওয়া অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধ করার যে হুমকি দেওয়া হয়েছে, সেই বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র হেদার নোয়ার্ট বলেছেন, এই বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি এবং কেবল এই ভোটের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে না। যারা বিপক্ষে ভোট দিয়েছে, আদৌ যুক্তরাষ্ট্র তাদের অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধ করবে কি না এবং যুক্তরাষ্ট্র তাতে আদৌ লাভবান হবে কি না, সেটা খতিয়ে দেখা যেতে পারে। অর্থের সাশ্রয় হবে বলে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বক্তব্য শুনে মনে হতে পারে যে এই খাতে যুক্তরাষ্ট্র প্রচুর ব্যয় করে। আসলে উন্নয়ন সাহায্য, যার মধ্যে সামরিক সাহায্যও আছে-২০১৫ সালে ছিল ৪৯ বিলিয়ন, ২০১৬ সালে ছিল মোট ৪৩ বিলিয়ন ডলার।
২০১৫ সালের হিসাবে এই পরিমাণ যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল বাজেটের ১ দশমিক ৩ শতাংশ। এই সাহায্য যে দেশটি পায়, সেটি হচ্ছে ইসরায়েল। গত বছরে দেওয়া হয়েছে ৩ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার। দ্বিতীয় ও তৃতীয় হচ্ছে আফগানিস্তান ও ইরাক। চতুর্থ হচ্ছে মিসর, যার সামরিক বাজেটের প্রায় এক-চতুর্থাংশ আসে মার্কিন সামরিক সাহায্য থেকে। এই তালিকা থেকেই বোঝা যায় যে এসব দেশের সাহায্য বন্ধের কোনো কারণ নেই। সাব-সাহারা অঞ্চলের আফ্রিকান দেশগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র গত বছর দিয়েছে ১৩ বিলিয়ন ডলার। এসব দেশে যুক্তরাষ্ট্র যদি সাহায্য বন্ধ করে, তবে ওই দেশগুলো একেবারে সাহায্যবঞ্চিত হবে, এমন মনে করার কারণ নেই। কেননা, তাদের ভিন্নভাবে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসতে চীন মোটেই পিছপা হবে না। ইতিমধ্যেই আফ্রিকায় চীনের বিনিয়োগ এবং প্রভাব দুই-ই বেড়েছে। ফলে এ ধরনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের অর্থ হবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব আরও দ্রুত হ্রাস করা। সেই সিদ্ধান্ত প্রেসিডেন্টের একার পক্ষে নেওয়া সম্ভব নয়।
জাতিসংঘের এই প্রস্তাবের কারণে যুক্তরাষ্ট্র তার সিদ্ধান্ত বদলাবে না। এর ফলে ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘাতের ক্ষেত্রে বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন ঘটবে, তা-ও নয়। কিন্তু এই প্রস্তাবকে কেন্দ্র করে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আচরণ যুক্তরাষ্ট্রের আরেকটি নৈতিক পরাজয় নিশ্চিত করল।
প্রথম আলো’তে প্রকাশিত ২৩ ডিসেম্বর ২০১৭