যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণের পর অভিষেক অনুষ্ঠানে দেওয়া ডোনাল্ড ট্রাম্পের বক্তৃতার প্রধান সুর হিসেবে তিনটি বিষয়কে চিহ্নিত করা যায়। তা হলো সংরক্ষণবাদ, লোকরঞ্জনবাদ ও জাতীয়তাবাদ। এটা একার্থে বিস্ময়কর নয় যে ট্রাম্পের বক্তৃতায় এই বিষয়গুলো প্রাধান্য পাবে। কেননা, প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনী প্রচারণায় তিনি এই বিষয়গুলোই গুরুত্ব দিয়েছিলেন।
এ যাবৎ যে ৫৭টি অভিষেক বক্তব্য দেওয়া হয়েছে, বিশেষত গত কয়েক দশকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে যাঁরা নির্বাচিত হয়েছেন, তাঁরা তাঁদের অভিষেক বক্তব্যে নির্বাচনী প্রচারণায় বিভক্তিসূচক বিষয়গুলো সরিয়ে রেখে দেশের নাগরিকদের মধ্যে ঐক্যের দিকগুলো তুলে ধরেছেন এবং আশাবাদের বার্তাই দিয়ে এসেছেন। ট্রাম্পের বক্তব্যে সে ধারার কোনো লক্ষণই ছিল না।
প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেওয়া প্রথম বক্তব্যে নির্বাচিত নেতারা তাঁর নিজের সমর্থকদের বাইরে যে অসংখ্য লোক তাঁদের কাছে পৌঁছাতে চান, তাঁদের আশ্বস্ত করতে চান—প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি তাঁদের মতকেও গুরুত্ব দেন, তাঁদেরও প্রতিনিধিত্ব করেন। ট্রাম্পের বক্তব্যের বিষয়, ভাষা ও উপস্থাপনে এটা স্পষ্ট ছিল—তিনি তাঁর সমর্থকদের বাইরে কারও কাছেই পৌঁছানোর চেষ্টা করছেন না। তদুপরি যুক্তরাষ্ট্রের যে চিত্র তিনি তুলে ধরেছেন, তাকে এক ক্ষুব্ধ হতাশাবাদীর ভাষ্য ছাড়া আর কোনোভাবে দেখার সুযোগ নেই; যদিও তিনি তাঁর লোকরঞ্জনবাদী প্রতিশ্রুতি দিয়ে বোঝাতে চেয়েছেন, এই অবস্থার বদল ঘটাবেন তিনি।
যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থা বর্ণনায় ট্রাম্পের ব্যবহৃত ‘কার্নেজ’ বা ধ্বংসলীলা নিঃসন্দেহে বাস্তবের প্রতিফলন নয়। কেননা, আট বছর আগে দেশের অর্থনীতি যে খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে ছিল, সেখান থেকে তা শুধু সরেই আসেনি, অনেক ক্ষেত্রেই সাফল্যের ধারায় ফিরে এসেছে—গত এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে কম বেকারত্বের হার এবং ক্রমবর্ধমান প্রবৃদ্ধিই তার প্রমাণ।
ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর বক্তৃতার কেন্দ্রে যে ‘সবার আগে আমেরিকা’র ধারণাকে স্থাপন করেছেন, আপাতদৃষ্টিতে তা দেশপ্রেমের প্রকাশ বলে মনে হলেও একে শুধু নির্ভেজাল জাতীয়তাবাদ বলে মনে করার অবকাশ নেই। তাঁর ব্যবহৃত আমেরিকা ফার্স্ট ধারণাটির একটি ইতিহাস আছে এবং সে ইতিহাস অত্যন্ত উদ্বেগজনক। গত শতাব্দীর ত্রিশের দশকে এ ধারণাটির উৎপত্তি হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গোড়াতে এই আন্দোলনের অনুসারীরা চেষ্টা করেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র যেন যুদ্ধে যোগ না দেয় এবং নাৎসিবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান না নেয়। তাঁরা মার্কিন স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়ার নামে শুধু যে একলা চলো নীতির কথাই বলছিলেন, তা নয়; তাঁদের বক্তব্য ছিল ইহুদি জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের বক্তৃতায় এবং ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই হোয়াইট হাউসের ওয়েবসাইটে যে বক্তব্য দেওয়া হয়েছে, তাতে বোঝা যায়—ট্রাম্পের চোখে সারা পৃথিবী এক ভয়ংকর জায়গা, যেখানে কেবল অপরাধী আর তস্করদের বাস, যেখানে মার্কিনদের চাকরি কেড়ে নেওয়ার জন্য সারা পৃথিবীর শ্রমজীবী মানুষ আর কোম্পানিগুলো অপেক্ষা করছে। ‘অন্য দেশগুলোর লুটপাট থেকে আমাদের সীমান্তকে রক্ষা করতে হবে। আমাদের উৎপাদিত সামগ্রী এবং আমাদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে ছিনিয়ে নেওয়া থেকে রক্ষা করতে হবে। আমাদের চাকরিগুলো রক্ষা করতে হবে।’ তাঁর এ কথার মধ্যে এটাই স্পষ্ট যে ট্রাম্পের বাণিজ্য ও পররাষ্ট্রনীতির ভিত্তি হচ্ছে এই ধারণা—এসব হচ্ছে একটা ‘জিরো-সাম’ গেম—হয় যুক্তরাষ্ট্র জিতবে, নাহয় অন্য কেউ। বিভিন্ন দেশের মধ্যে ‘বিনিময়’ যে সব সময়ই শুধু এক পক্ষের আশু স্বার্থের বিবেচনার বাইরে সবার স্বার্থের অনুকূলেও হতে পারে, তা তিনি মানতে রাজি নন। এই নীতি যে বিশ্বব্যবস্থার ভিত্তিকেই দুর্বল করে করবে, সেটা সহজেই বোধগম্য।
ট্রাম্প যখন বলেন, মার্কিন নীতি এই ধারণা দিয়ে পরিচালিত হবে—নিজ স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়ার অধিকার সব দেশেরই আছে; তখন তিনি শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতিরই ইঙ্গিত দেন না, অন্য ক্ষমতাশালী দেশগুলোর জন্যও একটি বার্তা পাঠান। এতে করে জাতীয় স্বার্থের নামে এখন বড় আঞ্চলিক দেশগুলো ছোট ও তুলনামূলকভাবে দুর্বল দেশগুলোর নিরাপত্তাকে বিপন্ন করার কাজে উৎসাহ পাবে, এমন আশঙ্কা করা নিশ্চয় বাড়াবাড়ি হবে না; এই নীতির আওতায় জাতিসংঘের মতো আন্তর্জাতিক কাঠামোগুলো যে অকার্যকর হয়ে পড়বে, সেটাও নিশ্চয় অনুমেয়। কিন্তু এসবের চেয়েও বড় বিষয় হচ্ছে, সবাই জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিলে তার যে বৈশ্বিক পরিণতি হবে, সেটার দায়িত্ব কে নেবে? এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন। মিস্টার ট্রাম্পের অভিষেকের রাতেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের ওয়েবসাইট থেকে জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গীকার ও কার্যক্রমের বিবরণ পুরোটাই তুলে নেওয়া হয়েছে। এতে এই আভাসই মেলে, জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে তাঁর সন্দেহবাদী নীতিই কার্যকর হতে চলেছে; জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর জন্য যা একটি বড় দুঃসংবাদ। বড় দেশগুলোর জাতীয় স্বার্থ—উন্নয়নের নামেই হোক, কি বাণিজ্যের নামেই হোক—যখন দরিদ্র দেশগুলোর অস্তিত্বকেই বিপন্ন করবে, তখন সেখানে তাদের স্বার্থ কে দেখবে?
ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই বক্তৃতায় দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির জন্যও ইতিবাচক ইঙ্গিত নেই। ট্রাম্প যখন বলেন, ‘আমাদের রাজনীতির ভিত্তি হবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি সম্পূর্ণ আনুগত্য’, তখন যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের শক্তি যে বহুত্ববাদিতা ও ভিন্নমতের প্রকাশের মধ্যে, তার প্রতি একধরনের উষ্মাই প্রকাশিত হয়। এই অভিষেক বক্তৃতার যে বার্তা, তাতে ট্রাম্প-সমর্থকেরা নিশ্চয় আনন্দিত। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের যে পথরেখা এতে দৃশ্যমান, তাতে বিশ্বের উদ্বেগের কারণ অনেক।
প্রথম প্রকাশঃ প্রথম আলো, জানুয়ারি ২২, ২০১৭