পেশওয়ারের স্কুলে পাকিস্তানী তালেবান যে বর্বরোচিত হামলা চালিয়েছে তা অত্যন্ত পরিকল্পিত, সংগঠিত এবং ঠাণ্ডা মাথায় বিভিন্ন বিষয় বিচার বিবেচনা করেই চালানো হয়েছে; সে কথা ঘটনার পরে তালেবানের মুখপাত্রের দেয়া বক্তব্যেই স্পষ্ট। তাহরিক-ই-তালেবানের মুখপাত্র মুহাম্মদ খোরাসানী বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন যে এই হামলা হচ্ছে প্রতিশোধ। জুন মাস থেকে উত্তর ওয়াজিরস্থানে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর জঙ্গী বিরোধী সেনা অভিযানে নিহতদের হত্যার প্রতিশোধ নেবার জন্যেই এই হামলা। তাঁর ভাষায় ‘আমরা চাই তাঁরা আমাদের কষ্ট বুঝতে পারুক’। তাঁরা মানে সেনাবাহিনীর সদস্যরা, আর সেই কারণেই বেছে নেয়া হয়েছে সেনানিবাসের দোড়গোড়ায় সেনা বাহিনীর সদস্যদের সন্তানদের স্কুলকে। তালেবানের মুখপাত্রের এই কথাও লক্ষনীয় যে, যে দলটিকে পাঠানো হয়েছিলো তাঁরা ছিলো আত্মঘাতী স্কোয়াড; এই কথার সত্যাতা আমরা দেখতে পাই নিহত আক্রমণকারীদের ছবিতে। তিনি এই দাবিও করেন যে ছোট শিশুদেরকে হত্যা না করে বের করে দেয়ার নির্দেশ ছিলো হত্যাকারীদের ওপরে, কিন্ত তুলনামূলকভাবে বড়দের কোনোভাবেই রেহাই না দেয়ার নির্দেশ আক্রমণকারীরা যতক্ষন পেরেছে অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে। তালেবান, অন্য অনেক সময়ে তাঁদের কার্যকলাপের যে ধরণের ব্যাখ্যা দিয়ে থাকে, এবার একার্থে তা থেকে ভিন্ন ব্যাখ্যাই দিয়েছে। তাঁদের বক্তব্য হচ্ছে এটা তাঁরা যুদ্ধের কৌশল হিশেবে বেছে নিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে তাঁরা একটা বার্তা দিতে চেয়েছে আর তা হলো তাঁরা এখন যুদ্ধে নতুন কৌশল গ্রহণ করেছে যা লড়াই কেবল ওয়াজিরস্থানে সিমাব্দধ থাকবেনা । তালেবান তাঁদের কার্যক্রমের বৈধতার জন্যে এখন আর ধর্মের অপব্যাখ্যার দারস্থ হয়নি, কেননা ধর্ম নয়, রাজনৈতিক ইসলামের মোড়ক নয়, আদর্শিক বিবেচনা নয় – তাঁরা প্রত্যক্ষ যুদ্ধে প্রবৃত্ত এবং প্রতিহিংসাই তাঁদের লক্ষ্য। এখন থেকে তালেবানকে এই বিবেচনায়ই বিচার করতে হবে, এমনকি যদি আমরা একে অসম যুদ্ধ বলেও বর্ণনা করি।
গ্রীষ্মকাল থেকে চলা সেনা অভিযানের লক্ষ্য কেবল যে পাকিস্থানী তালেবান তা নয়; ঐ এলাকায় লস্কর-ই-জংভি, জুনাদ-আল্লাহ, আল কায়েদা, আফগান তালেবানের হাক্কানী নেটওয়ার্ক পর্যন্ত সব ধরণের জঙ্গী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধেই চলছে অভিযান। সেনাবাহিনী তাতে যথেষ্ট সাফল্যের দাবি করছিলো, যদিও অনেকে এই দাবিকে অতিরঞ্জন বলেও সমালোচনা করেছে। কিন্ত সেনা অভিযানের পর তালেবানের হামলার সংখ্যা যে হ্রাস পেয়েছিলো সেটা সত্য। এখন তালেবানের এই পরিকল্পিত হামলা প্রমাণ করে যে প্রায় ছয় মাস ধরে চলা সেনা অভিযানে তালেবানের শক্তি ক্ষয় হলেও, তাঁদের ক্ষমতা একেবারে নিঃশেষিত হয়ে যায়নি। বিপরীতক্রমে এইভাবেও এই হামলাকে ব্যাখা করা যায় যে, তাঁদের ঘাঁটি বলে পরিচিত এলাকায় ক্রমাগতভাবে দুর্বল হয়ে পড়ার ফলে তালেবান এখন যুদ্ধকে সেনাবাহীনির দরজায় হাজির করতে চাইছে। এটা তাঁদের বেপরোয়া হয়ে ওঠারই লক্ষণ। তাঁরা এখন চাইছে সেনাবাহিনী যদি অন্যত্র নিরাপত্তা রক্ষায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে তবে ওয়াজিরস্থানে তাঁদের শক্তি কমাতে হবে, তাঁরা মানসিক চাপের মুখেও পড়বে। কিন্ত যেই অংক করেই এই আক্রমণ চালনো হোক না কেন এই হামলা থেকে তালেবান লাভবান হতে পারবেনা। কেননা এই হামলা, আকারে অন্য হামলা থেকে বড় হোক অথবা না হোক, এমনকি তালেবানের অতীত সব নৃশংসতার বিবেচনায়ও নৃশংস। কোনো যুক্তিতেই এই ধরণের হামলা জনসমর্থন পায় না। ২০০৪ সালে রাশিয়ার বেসালনে চেচেন বিচ্ছিন্নতাবাদীদের একটি স্কুলে অবরোধ এবং ৩০০ জন শিক্ষার্থীকে হত্যার ঘটনা তাঁদের জন্যে মোটেই ইতিবাচক হয়নি।
এই হত্যাকান্ড, তার প্রকৃতির কারণে পাকিস্তানের রাজনীতিকে বদলে দেবার একটি সুযোগ তৈরি করেছে। পাকিস্তানীর রাজনীতিবিদরা – প্রধানমন্ত্রী নাওয়াজ শরিফ থেকে ইমরান খান – এর নিন্দা করেছেন, বলেছেন তাঁরা ঐক্যবদ্ধ। বুধবার সব সংসদীয় দলের যৌথ বৈঠকের ব্যবস্থা হয়েছে। কিন্ত এই পরিস্থিতি সৃষ্টির দায় থেকে রাজনীতিবিদরা নিজেদের মুক্ত ভাবতে পারেন না। জঙ্গী গোষ্ঠী হিশেবে তালেবান দমনের কৌশল এবং তালেবানের প্রতি সমর্থন তৈরির জন্যে যে সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক অবস্থা খাইবার পাখতুনখোয়াতে গত কয়েক দশক ধরে বিদ্যমান সেগুলো মোকাবেলা করার উপায় নিয়ে রাজনীতিবিদদের অনৈক্য যে এই পরিস্থিতিতে ইন্ধন যুগিয়েছে তা অস্বীকারের উপায় নেই। অতীতেও এই ধরণের আক্রমণের পর আশা করা হয়েছে যে রাজনীতিবিদরা পথ খুঁজে পাবেন, কিন্ত তা হয় নি। এবারো ঠিক তাই হবে এমন আশংকা যেমন আছে তেমনি মনে রাখা দরকার যে এইবার আক্রমণের লক্ষ্যবস্ত হয়েছে সেনাবাহিনী – কেবল প্রতিষ্ঠান হিসেবে নয়, পারিবারিকভাবে। এই যুক্তিতে যদি সেনাবাহিনী এখন সীমাহীন ক্ষমতার দাবি তুলে বেসামরিক শাসক রাজনীতিবিদদের ওপরে চাপ প্রয়োগ করে তবে যে সব প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে শুরু করেছে সেগুলোও ভেঙ্গে পড়বে। মনে রাখা দরকার যে এই অবস্থা তৈরিতে সেনাবাহিনীর দায় রাজনীতিবিদদের চেয়ে কনো অংশেই কম নয়। কেবল এই কারণে নয় যে তাঁরা তাঁদের ঘরের দরজায় নিজের সন্তানদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন, এই কারনেও যে সেনা অভিযানের সময়ে তাঁরা জবাদিহির ব্যবস্থাকেও পদদলিত করেছেন। তদপুরি সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের, বিশেষ করে গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই’র একাংশের, সঙ্গে তালেবানের সম্পর্কের অভিযোগকে তারা কখনোই দূর করতে পারেননি। এমনকি সাম্প্রতিককালে সেনা অভিযানের সময়েও তাঁদের বিরুদ্ধে এই ধরণের অভিযোগ উঠেছে। ফলে সেনাবাহিনীকেও সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তাঁরা কতটা বদলাতে প্রস্তত আছে। এ সব প্রশ্ন যতই অপ্রতিকর হোক না কেন তালেবানের হামলা এই সব প্রশ্নকে নগ্নভাবে তুলে ধরেছে, এখন পাকিস্থানের শাসক গোষ্ঠীর সামনে এগুলোই চ্যালেঞ্জ হিশেবে উপস্থিত হয়েছে।
প্রকৃতপক্ষে এই চ্যালেঞ্জ একদিনে বা গত কয়েক বছরে তৈরি হয়েছে এমন মনে করাও ঠিক নয়। দীর্ঘ মেয়াদে সামরিক ও বেসামরিক অগণতান্ত্রিক শাসন, নিয়ন্ত্রনহীন সেনাবাহিনীর কার্যকলাপ ও তার ওপরে রাজনীতিবিদদের নির্ভরতা, জাত্যাভিমানের কারণে ছোট জাতিসমূহকে অস্বীকার, কোনো কোনো অঞ্চলের যৌক্তিক দাবির প্রতি অবহেলার যে কাঠামো পাকিস্তানী রাষ্ট্র তৈরি করেছে এবং টিকিয়ে রেখেছে তার সঙ্গে উগ্র ধর্মবাদী আদর্শের সংমিশ্রনের ফলেই তালেবানের মতো শক্তির উদ্ভব ও বিকাশ সম্ভব হয়েছে। ফলে পাকিস্তানে এবং পাকিস্তানের বাইরে যারা তালেবান তৈরির খন্ডিত ইতিহাসকে আশ্রয় করে অন্যকে দোষারোপ করতে বেশি স্বাছন্দ্য বোধ করেন তাঁরা এক বিচারে এই ব্যবস্থাকেই টিকিয়ে রাখতে চান যা তালেবানের জন্ম দেয়, তাঁদের লালন করে। পাকিস্তানের সাধারণ নাগরিকরাই এই ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় ভিকটিম, তাঁরাই প্রতিদিন এই কারণে প্রাণ দিচ্ছেন। পাকিস্তান রাষ্ট্র তাঁদের কেবল নিরাপত্তা দিতেই ব্যর্থ হয়েছে তা নয়, তাদের ভবিষ্যতকেও করে তুলেছে সংকটাপন্ন। তালেবান সেই অনিশ্চয়তার একটি দিক। তাঁদের ক্রমবর্ধমান নৃশংসতা নাগরিক ও রাষ্ট্র উভয়ের জন্যেই ভয়াবহ ইঙ্গিতবাহী।
প্রথম আলো’তে প্রকাশিত, ১৮ ডিসেম্বর ২০১৪
থাম্বনেইলের ছবিসূত্র: করাচির একটি স্কুলে পেশওয়ারে নিহতদের স্মরণ করছে ছাত্র-ছাত্রীরা (লিঙ্ক)