দেশে বিরাজমান অস্বাভাবিক পরিস্থিতিকে ‘অচলাবস্থা’ ছাড়া আর কিছুই বলা যায়না। এই অবস্থা নিরসনের জন্যে দেশের ভেতরের বিভিন্ন মহলের এবং আন্তর্জাতিক সমাজের আবেদন নিবেদন স্বত্বেও অবস্থার আশু পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। যে কোনো অচলাবস্থার ক্ষেত্রে যা ঘটে এই ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম কিছু ঘটছে না। সরকার ও বিরোধী পক্ষ এখন আশু কোনো সমাধানের বিষয়ে ভাবিত বলে মনে হয় না। উভয়পক্ষ অনুমান বা আশা করছেন যে প্রতিপক্ষের সঞ্চিত শক্তি এবং তার প্রতি সমর্থন এক সময় শেষ হতে বাধ্য, সম্ভবত সেটা খুব দূরে নয়; ফলে তাঁরা অবশ্যই বিজয়ী হবেন, এটি কেবল সময়ের ব্যাপার মাত্র। সরকার ও সরকারী দলের অবস্থান এই রকম যে, যেহেতু সহিংসতা বিশেষত পেট্রোল বোমা হামলা এবং সংশ্লিষ্ট নির্মম হত্যাকাণ্ডের ঘটনাবলি অবরোধের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়েছে এবং তার সঙ্গেই যুক্ত বলে সাধারণ মানুষের কাছে মনে হচ্ছে সেহেতু বিএনপির পক্ষে এই পরিস্থিতি আর বেশি দিন অব্যাহত রাখা সম্ভব হবে না। তাঁরা এটাও আশা করছেন যে, ইতিমধ্যে যেহেতু বিএনপি’র নেতৃত্বাধীন জোটের ডাকা হরতাল কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলছে সেহেতু অচিরেই সাধারণ মানুষই সরকারের পক্ষে তা প্রতিহত করবেন। এই ধরণের আশা থেকেই সরকার গোড়াতে এক সপ্তাহের মধ্যে অবস্থার উন্নতি ঘটবে বলে ঘোষণা দিয়ে আসছিলো সেটা এখন দেড় মাসের বেশি সময় ধরে চললেও এর পরিণতি নিয়ে সরকারকে খুব বেশি উদ্বিগ্ন মনে হয় না। অন্যপক্ষে বিএনপি সম্ভবত এই আশা করছে যে বিরাজমান অনিশ্চয়তা এবং নিরাপত্তাহীনতার কারণে নাগরিকরা সরকারের ওপরে চাপ সৃষ্টি করবে, যা তাঁদের অনুকূলে আসবে। এই ধরণের মনোভাব ও সমস্যা সমাধানের এই ধরণের কৌশল অচলাবস্থার চিরায়ত লক্ষণ। দুইপক্ষ ধরে নেয় যে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সমাধান তৈরি হবে।
পৃথিবীতে সে সব দেশ দীর্ঘমেয়াদী অভ্যন্তরীণ সংকটে নিপতিত হয়েছে সে সব দেশের ঘটনাপ্রবাহ পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই যে গোড়াতে উভয় পক্ষ স্বল্পসময়ে বিজয়ী হবার আশায় দ্বন্ধ-সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে; সেক্ষেত্রে লক্ষ্যও থাকে সীমিত। কিন্ত কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থতা বা তা সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে না পারা এই সংকটকে দীর্ঘসূত্রী করে তোলে। এই প্রক্রিয়ায় একেক পক্ষ একেক সময়ে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকে এবং তাঁরা সেটাকে ঘটনাধারা তাঁদের অনুকূলে আসার লক্ষণ বলে মনে করে। ফলে তাঁদের মধ্যে দ্বন্ধ-সংঘাত নিরসনের আগ্রহ কমতে থাকে। এখানে এটাও স্মরণ করা দরকার সংকট যতই দীর্ঘমেয়াদী হয় ততই আশু লক্ষ্যের বিষয়গুলো থেকে দৃষ্টি সরে যায়, নতুন নতুন বিষয় তাতে যুক্ত হয়, সংকটের চরিত্র ও প্রকৃতিতেও পরিবর্তন ঘটে। শুধু তাই নয়, এই ধরণের ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে দুই পক্ষের শক্তিতে বদল ঘটে থাকে।
বাংলাদেশে এখন যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে তাতে মনে হয় যে দেশ সেই পথেই অগ্রসর হতে শুরু করেছে। দেড় মাস আগে যখন এই পরিস্থিতির সূচনা হয় তখন যে সব বিষয় ছিলো রাজনীতির মুখ্য বিষয় ক্রমাগতভাবে তা থেকে আলোচনা সরে এসেছে বলেই মনে হয়। এক্ষেত্রে সরকার ও সরকারি দল সফল। এক সময় যারা বিএনপি ও বিরোধী জোটকে শক্তিহীন বলে উপহাস করেছেন, তাঁরা এখন দেখাতে চান যে দলটি সারা দেশে, তাঁদের ভাষায় ‘বিচ্ছিন্নভাবে’ হলেও, অব্যাহতভাবে সহিংসতা চালানোর মতো একটি জোট। এ ক্ষেত্রে বিএনপি যে তাঁর দাবির পক্ষে তাঁর কর্মিদের রাজপথে সমবেত করতে ব্যর্থ হয়েছে, বিশেষত বড় শহরগুলোতে তাঁদের সাংগঠনিক উপস্থিতির কোনো প্রমাণ রাখতে পারেনি সেটা সরকারের পক্ষেই গেছে। এই জন্যে বিএনপি যা যুক্তিই দাঁড় করাক না কেন সেটা দেশে ও দেশের বাইরে কেউ গ্রহণযোগ্য বলে মনে করছে না। সামগ্রিক রাজনৈতিক সংকটের পেছনে যে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির একপাক্ষিক নির্বাচনের কোনো ভূমিকা রয়েছে এবং পরিস্থিতির সমাধানের লক্ষে সে বিষয়ে মনোনিবেশ করা জরুরি সেখান থেকে সাধারন মানুষের আলোচনা কেবলমাত্র সহিংসতা-কেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে। যদিও বিএনপি এই দাবি করতে পারে যে দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিষয়ে আন্তর্জাতিক সমাজের মনোযোগ আকর্ষন করতে পারাটা তাঁদের সাফল্যের দিক।
যে কোনো সংকটের দীর্ঘসূত্রী হয়ে ওঠার লক্ষণ হল যে সমাজে ও রাজনীতিতে কিছু কিছু প্রবণতার গ্রহণযোগ্যতা লাভ। অর্থাৎ নাগরিকদের মধ্যে কিছু কিছু বিষয়ে মেনে নেবার প্রবণতা। গত দেড়মাসের ঘটনা প্রবাহ এবং আগে ২০১৩ সাল থেকে বিরাজমান রাজনৈতিক সংকটের প্রেক্ষিতে দুই ধরণের সহিংসতা আমরা প্রত্যক্ষ করছি। একদিকে বিরোধী দল কর্তৃক এবং তাঁদের নামে সংঘটিত সহিংসতা। বাংলাদেশে অতীতে সরকারবিরোধী আন্দোলনে বিরাজমান সহিংতাকে সাময়িক ও ব্যতিক্রমী বলে বিবেচনা করা হলেও এখন মনে হয় তা স্বাভাবিক বলেই মেনে নেয়ার প্রবণতা তৈরি হচ্ছে। এই সব ঘটনার তদন্ত, দোষীদের চিহ্নিত করা, তাঁদের বিচারের সম্মুখীন করার কোনো তাগিদ যেমন সরকারের পক্ষে দেখা যায় নি, তেমনি সমাজের ভেতরে থেকেও এই নিয়ে দাবি ওঠেনি। এটি নাগরিকদের মধ্যে আইন ও বিচার প্রক্রিয়ার ব্যাপারে আস্থাহীনতাই প্রমাণ করে। তাঁরা ধরেই নিচ্ছেন যে এই বিষয়ে বাক্যব্যয় নিরর্থক। ২০১৩ সালে থেকে এ যাবত রাজনৈতিক সহিংসতা বিষয়ে সরকার ও সরকারী দলের নেতারা যত কথা বলেছেন, বিরোধীদের বিরুদ্ধে হুমকি দিয়েছেন সেই তুলনায় আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের উদযোগ অকিঞ্চিৎকর। এগুলোকে ব্যবহার করে বিরোধী নেতাদের আটকের ঘটনা ঘটেছে বিস্তর। যদিও এ সব একার্থে নতুন নয়, কিন্ত সহিংসতার মাত্রা বৃদ্ধি স্বত্বেও নাগরিকদের মধ্যে এটা মেনে নেয়ার মানসিকতা সহিংসতা অব্যাহত রাখার অনূকুল অবস্থা তৈরি করেছে।
দ্বিতীয় ধরণের সহিংসতা হচ্ছে বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। গত দেড় মাসে বোমা হামলায় প্রায় ৭০ জনের বেশি মানুষের অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর পাশাপাশি কমপক্ষে ২০ জন মানুষ নিহত হয়েছেন কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ বা এই ধরণের ঘটনায়। লক্ষনীয় যে কোন ক্ষেত্রেই বিচারিক ব্যবস্থার মাধ্যমে দোষীদের চিহ্নিত করার কোনো চেষ্টা হয়নি। উপরন্ত সরকার ও আইনরক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিরা এমন সব কথা বলেছেন যেগুলো আইনি প্রক্রিয়ার প্রতি হুমকি বলেই মনে হয়। এসব বক্তব্য নিয়ে সমালোচনার পরও পুলিশের মহাপরিদর্শক যখন বলেন ‘যে পুলিশের গুলিতে নিহত হবে সে নিঃসন্দেহে সন্ত্রাসী’ তখন এই আশঙ্কাই সত্য মনে হয় যে শক্তি প্রয়োগের এই পদ্ধতি অব্যাহত রাখারই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
এই পরস্পর বিরোধী কিন্ত পরস্পর সংশ্লিষ্ট প্রবণতার উপস্থিতি, সেগুলোকে স্বাভাবিক বলে গ্রহণ করা, এবং তার সমর্থনে সমাজে ‘যুক্তি প্রদর্শনের’ নগ্ন প্রচেষ্টা যে কোন সমাজে দীর্ঘমেয়াদী সংকটের লক্ষণ। আপাতদৃষ্টে এই মুহুর্তে বিবাদমান পক্ষগুলোর যেই মনে করুক না কেন তাঁরা এগিয়ে আছে এবং সময়ের ব্যবধানে তাঁরাই বিজয়ী হবে তাঁরা আসলে শক্তি প্রয়োগের এই ধারাকে অব্যাহতভাবে বৈধতা প্রদান করছে, জ্ঞাতসারে বা বিবেচনাহীনভাবে। এই ধরণের পরিস্থিতিতে রাষ্ট্র ক্ষমতার শক্তি যেহেতু বেশি থাকে, রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিতরা মনে করে থাকেন যে তাঁদের জন্যে অবস্থা অনুকূলেই থাকবে; যে সব দেশে দীর্ঘ মেয়াদী সংকটের ঘটনা ঘটেছে সেখানেও আমরা তাই দেখতে পেয়েছি। কিন্ত তাঁরা এটা বিবেচনা করতে ব্যর্থ হন যে তাতে করে মধ্য-মেয়াদেই দেশের জন্যে এটা ক্ষতিকর পরিণতি বহন করে। ক্ষমতাসীন হিশেবে তাঁদের ওপরেই এই দায়িত্ব বর্তায় দেশকে সেই পরিণতি থেকে রক্ষা করার।
প্রথম আলো’তে প্রকাশিত, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৫
থাম্বনেইলের ছবি: ফক্স নিউজ [লিঙ্ক]