বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে হেফাজতে ইসলাম বলে একটি গোষ্ঠীর নাটকীয় উত্থানের পর আমরা আহলে সুন্নাত ওয়াল জমা’আতের উপস্থিতির সঙ্গে পরিচিত হয়েছি। বাংলাদেশের সমাজে এই দুই গোষ্ঠী অনুপস্থিত ছিল তা নয়, সাম্প্রতিক সময়ে সংগঠিত শক্তি হিসেবে তারা তাদের উপস্থিতির জানান দিয়েছে বলেই আমাদের ধরে নিতে হবে। ঢাকা ও চট্টগ্রামে বড় আকারের দুটি সমাবেশ অনুষ্ঠান ছাড়াও দুই সংগঠনই তাদের পরস্পরবিরোধী অবস্থান স্পষ্ট করেছে তাদের দেওয়া ১৩ ও ১২ দফা দাবিনামার মধ্য দিয়ে। আগামী দিনগুলোয় তাদের পক্ষ থেকে আরও কর্মসূচির কথাও ঘোষণা করা হয়েছে। সহজ করে বললে, এই গোষ্ঠীগুলোর উত্থান বা পরিচিতি খানিকটা অকস্মাৎ ঘটলেও তারা খুব শিগগির সমাজ ও রাজনীতির দৃশ্যপট থেকে অপসৃত হবে বলে আমি মনে করি না। আর সে কারণেই তাদের এই উপস্থিতি বাংলাদেশের রাজনীতির ভবিষ্যৎ পথরেখার ক্ষেত্রে কী ভূমিকা রাখবে, সেটা বোঝা দরকার। এটাও বোঝা দরকার, আমরা তাদের কীভাবে চিহ্নিত করব, কারা এই শক্তি, তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক কী। এসব প্রশ্নের উত্তর কেবল সমসাময়িক ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে খুঁজলে আংশিক উত্তর পাওয়া যাবে। বিষয়গুলো বোঝার জন্য আমাদের খানিকটা ইতিহাসের আশ্রয় নিতে হবে, বিভিন্নমুখী রাজনৈতিক প্রবণতা বিশ্লেষণ করতে হবে।
১. রাজনীতির মাঠে দুই নতুন খেলোয়াড়
হেফাজতে ইসলাম ও আহলে সুন্নাত ওয়াল জমা’আতের দাবি, তারা অরাজনৈতিক সংগঠন। তাদের সমর্থক ও শুভানুধ্যায়ীরা সেই বর্ণনায় সন্তুষ্ট হলেও তাদের দেওয়া দাবিনামা ও কর্মসূচি ভালো করে পাঠ করলেই বোঝা যায় এই বক্তব্যের অসারতা। হেফাজতে ইসলামের সংবিধান পরিবর্তনের দাবিকে যাঁরা ‘অরাজনৈতিক’ বলে বোঝানোর চেষ্টা করছেন, তাঁরা নিজেরাও জানেন যে রাজনীতির সবচেয়ে সীমিত সংজ্ঞায়ও এই দাবিকে রাজনীতির বাইরে রাখা যাবে না। রাজনীতির প্রথম পাঠই বলে দেয় যে সংবিধান ও রাষ্ট্র পরিচালনা রাজনীতির বাইরে নয়। এই দুই শক্তির আবির্ভাব ঘটেছে এমন এক সময়ে, যখন দেশে রাজনৈতিক সংকট চলছে।
তার পরও হেফাজতে ইসলামের নেতাদের সাম্প্রতিক বক্তব্য প্রমাণ করে যে তাঁদের রাজনৈতিক অভিলাষ যেকোনো রাজনৈতিক শক্তির মতোই। কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক মাওলানা মঈনুদ্দিন রুহী জার্মান বেতার ডয়চেভেলেকে গত ১৫ এপ্রিল বলেছেন, ‘হেফাজতে ইসলাম চায় দেশে ইসলামি শাসন কায়েম হোক। বাংলাদেশে একটি মুসলিম রাষ্ট্র, কিন্তু ইসলামি রাষ্ট্র নয়। ইসলামি শাসন কায়েমের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশ ইসলামি রাষ্ট্রে পরিণত হবে। আর সে জন্য ইসালামি রাজনৈতিক দলকে রাষ্ট্রক্ষমতায় যেতে হবে।’ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হেফাজতের সমাবেশে এটাও বলা হয়েছে, ‘৫ মের পূর্বে ১৩ দফা মানা না হলে এর পর থেকে দেশ চালাবে হেফাজতে ইসলাম।’ (দৈনিক ইনকিলাব, ২০ এপ্রিল ২০১৩)। আহলে সুন্নাত ওয়াল জমা’আত তাদের বক্তব্যে হেফাজত ও জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থার দাবি করলেও হেফাজতের সুরে এই দাবিও করেছে যে ‘সংবিধানে সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস সংযোজন’ করতে হবে। এই দাবি হেফাজতে ইসলাম তোলার কারণে যতটা রাজনৈতিক বলে বিবেচিত হওয়া উচিত, ঠিক ততটাই আহলে সুন্নাত ওয়াল জমা’আতের জন্য প্রযোজ্য। রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে অবস্থানের কারণে তাদের বর্তমান প্রেক্ষাপটে ইসলামি সংগঠন বলার চেয়ে ইসলামপন্থী রাজনৈতিক সংগঠন বলাই যথাযথ বলে আমার ধারণা।
ইসলামপন্থী বা ইসলামিস্ট বলতে প্রচলিত অর্থে তাদেরই বোঝানো হয়, যারা ইসলাম ও রাজনীতির সংমিশ্রণ ঘটায়। ইসলামপন্থী রাজনীতিকে ‘রাজনৈতিক ইসলাম’ বলেও বর্ণনা করা হয়। ইসলামপন্থী রাজনীতি বলতে আমি সেই সব রাজনৈতিক আদর্শ ও আন্দোলনকে বোঝাই, যারা ইসলামকে কেবল একটি ধর্ম হিসেবে বিবেচনা করে না, মনে করে যে এটি একটি রাজনৈতিক পদ্ধতিও এবং ইসলামের শিক্ষা সমাজের সর্বস্তরে, এমনকি আইন প্রণয়নেও অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত।
ইসলামপন্থা কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের রাজনৈতিক অবস্থানকে বর্ণনা করে, তাকে কোনো বিশেষণে ভূষিত করে না; সে কারণেই গত দুই দশকে এটি ব্যাপকভাবে ব্যবহূতও হয়েছে। যেকোনো রাজনৈতিক আদর্শের অনুসারীদের মধ্যেই বিভিন্ন ধরনের মতামত থাকে; বিভিন্ন কৌশল ও কার্যপ্রণালির অনুসারী থাকে। ইসলামপন্থীদের ক্ষেত্রেও তা একইভাবে কার্যকর। পাশাপাশি এটাও বলা দরকার, যেকোনো ধরনের পরিভাষা (টার্ম) ব্যবহারের ক্ষেত্রে সময়ে সময়ে ব্যত্যয় ঘটে, কারও কারও আপত্তিও থাকে। এ ক্ষেত্রেও আমরা তার ব্যতিক্রম দেখি না। তবে সাধারণভাবে বলতে পারি, ইসলামপন্থা একটি রাজনৈতিক অবস্থান। ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী হওয়ার সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগ নেই এই অর্থে যে মুসলিম হওয়া মানেই ইসলামপন্থী হওয়া নয়। আদর্শিকভাবে বিবেচনা করলে, তত্ত্বগত দিক থেকে দেখলে একজন অমুসলিমও ইসলামপন্থী রাজনীতির সমর্থক হতে পারেন।
গত কয়েক দশকে বিভিন্ন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে যেসব ইসলামপন্থী দল ও সংগঠনের উদ্ভব ও বিকাশ হয়েছে, তাদের আদর্শিক অবস্থান ও কার্যক্রম পর্যালোচনা করে আমরা কিছু প্রবণতা ও বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করতে পারি, যা এই দুটি ইসলামপন্থী সংগঠনকে বুঝতে সাহায্য করবে। প্রথমত, ইসলামপন্থী রাজনীতি কোনো সমপ্রাকৃতিক (বা হোমোজেনাস) রাজনীতি নয়। অর্থাৎ, ইসলামপন্থী রাজনীতি মানেই একধরনের দল নয়। এই ধারায় কোনো একক আদর্শস্থানীয় দল নেই, যা থেকে আমরা বলতে পারি যে ইসলামপন্থী দল মানেই এ রকম। এই রাজনীতির দলগুলোর মধ্যে কতিপয় বিষয়ে ঐকমত্য যেমন থাকে, তেমনি থাকে তাদের মতভিন্নতা ও বিরোধ। দ্বিতীয়ত, ইসলামপন্থী দলের উদ্ভব ঘটে সমকালীন রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ ও ইস্যুর প্রত্যুত্তর হিসেবে। ইসলামপন্থী রাজনীতিসংশ্লিষ্ট দেশের সমকালীন সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রবণতা দিয়ে প্রভাবিত হয়, এসব দলের আকৃতি ও প্রকৃতি নির্ধারিত হয় সমকালীন রাজনীতি দিয়ে। তৃতীয়ত, এই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে রাষ্ট্র বা আরও সুস্পষ্ট করে বললে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রশ্ন। ব্যক্তির ধর্মনিষ্ঠা ও সামাজিক মূল্যবোধের শুদ্ধীকরণের প্রশ্নটি গৌণ বা অপ্রধান প্রশ্ন। কেননা, তারা মনে করে, রাষ্ট্রের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা গেলে তাদের লক্ষ্যগুলো রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন কাঠামো বা সংগঠনের মাধ্যমে অর্জন করা যাবে।
হেফাজতে ইসলাম বা আহলে সুন্নাত ওয়াল জমা’আতের দিকে ভালো করে তাকালেই আমরা এসব বৈশিষ্ট্যকে ক্রিয়াশীল দেখতে পাব। প্রথমত, হেফাজতে ইসলাম ও আহলে সুন্নাত ওয়াল জমা’আত নিজেদের যতই বাংলাদেশে ইসলামের প্রকৃত প্রতিনিধি বলে দাবি করুক না কেন, তাদের পরিধির বাইরে দেশের কোটি কোটি মানুষ রয়েছে, যাদের ধর্মনিষ্ঠা সংশয়াতীত। তার চেয়েও বড় কথা, ইসলামপন্থী রাজনীতিতেও তারাই কেবল সংগঠিত শক্তি নয়; আরও অনেক ইসলামপন্থী দল আছে। বাংলাদেশ ইসলামী আন্দোলন তার একটা বড় প্রমাণ। হেফাজতে ইসলাম, অর্থাৎ এই সংগঠনের পতাকাতলে যেসব দল ও ব্যক্তি সমবেত হয়েছে তারা আজই বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রবেশ করেনি। তাদের প্রায় সবারই একটা রাজনৈতিক অতীত রয়েছে। তাদের এই অতীত ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে তারা এই রাজনৈতিক বক্তব্য নিয়ে অনেক দিন ধরেই সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে এসেছে। হেফাজতের নেতারা যদিও বলছেন যে তাঁরা ইসলাম ও মহানবীর মর্যাদা রক্ষার জন্য সক্রিয় হয়েছেন, তাঁরা এটা অস্বীকার করেন না যে এর তাগিদ এসেছে বর্তমান রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটেই। হেফাজতের ১৩ দফা দাবিতে অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে নারী উন্নয়ন নীতি ও শিক্ষানীতির কথা সুস্পষ্টভাবে রয়েছে, তাতে এ কথা স্পষ্ট যে সমসাময়িক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেই তারা রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তা ছাড়া ব্যাপক অর্থে বাংলাদেশে ৪২ বছর ধরে রাষ্ট্রীয় আদর্শ ও নীতিমালার যে অনুকূল পরিবর্তন ঘটেছে, তার ফলে সংগঠিত শক্তি হিসেবে তাদের আবির্ভাব সম্ভব হয়েছে। অন্যদিকে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে দ্বিদলীয় ব্যবস্থায় দুই দলের রাজনৈতিক ব্যর্থতাই সুযোগ তৈরি করেছে এসব সংগঠনের শক্তি প্রদর্শনের। বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো যদি পারস্পরিক শত্রুমনোভাবাপন্ন আচরণের বৃত্তচক্রে পতিত না হতো, তবে এই উত্থানের সুযোগ যে হতো না, তা সহজেই অনুধাবন করা যায়। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হলে, নাগরিকের অধিকার সুরক্ষিত হলে, ক্ষমতার হাতবদলের স্থায়ী গ্রহণযোগ্য ব্যবস্থার নিশ্চয়তা বিধান করা গেলে, রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক নীতিমালায় দারিদ্র্য মোচনে সাফল্য লাভ করলে এ ধরনের রাজনৈতিক শক্তির উত্থানের তাগিদ ও সুযোগ কোনোটাই থাকে না।
রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রশ্নটা এই রাজনীতির প্রধান বিষয় তা হেফাজতের এই বক্তব্যেই স্পষ্ট যে তারা বাংলাদেশে ‘ইসলামি হুকুমত’ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। ঢাকায় ৬ এপ্রিলের সমাবেশের একাধিক বক্তাই এ কথা জোর দিয়ে বলেছেন। তাঁরা বাংলাদেশের গণপ্রজাতান্ত্রিক চরিত্রের অবসান চান। কেননা, সমাজে ইসলামি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা, সমাজ ও অর্থনীতিতে নারীর ভূমিকা, শিক্ষাব্যবস্থা, এমনকি শিল্পকলা বিষয়ে তাঁদের ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য রাষ্ট্রক্ষমতার প্রয়োজন তাঁরা বোঝেন এবং একে অস্বীকার করেন না, লুকিয়েও রাখেননি। হেফাজতে ইসলামের পক্ষ থেকে যতই বলা হোক না কেন যে সমাজের শুদ্ধীকরণ, সমাজ থেকে নাস্তিক্যবাদের অপসারণ কিংবা মহানবীর অবমাননা রোধ কিংবা ‘বেহায়াপনা, অনাচার, ব্যভিচার’ অবসান তাদের দাবি, লক্ষণীয় যে তারা এ জন্য ধর্মীয় পুনর্জাগরণমূলক বা শুদ্ধীকরণ আন্দোলনের পথে অগ্রসর হয়নি, রাজনীতির পথই বেছে নিয়েছে। এই বিবেচনায় আহলে সুন্নাত ওয়াল জমা’আতের অবস্থান অনেকটাই পেছনে। তারা এখনো রাষ্ট্রের চরিত্র বদলে দেওয়ার দাবিকে তাদের প্রধান লক্ষ্যে পরিণত করেনি। কিন্তু রাজনৈতিক পরিবেশের পরিবর্তন ঘটলে তাদের সেই দাবি তোলার আশঙ্কা যে নেই, তা বলা যায় না।
ফলে হেফাজতে ইসলাম ও আহলে সুন্নাত ওয়াল জমা’আতকে বর্তমান প্রেক্ষাপটে দুটি ইসলামপন্থী রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে বিবেচনা করাই হচ্ছে তাদের বোঝার প্রাথমিক পদক্ষেপ। প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের ইসলামপন্থী রাজনীতির মাঠে তাদের অবস্থান কোথায়?
২.হারানো অবস্থান পুনরুদ্ধারের চেষ্টা
দক্ষিণ এশিয়ায় তো নয়ই, এমনকি রাজনৈতিক মানচিত্রের বিবেচনায় আজকের বাংলাদেশ বলে পরিচিত ভূখণ্ডে ইসলামপন্থী রাজনীতি কোনো নতুন বিষয় নয়। বর্তমান পরিবেশে হেফাজতে ইসলাম ও আহলে সুন্নাত ওয়াল জমা’আতের রাজনীতিকে সেই কারণেই একটি সাময়িক ও অকস্মাৎ তৈরি হওয়া সংগঠন বলে বিবেচনা করা এবং সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিশ্লেষণ করা সমীচীন নয়।
এ দেশে ইসলামপন্থী রাজনীতির কার্যত সূচনা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে, বিদেশি শাসনের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের মধ্যে। সেই সময়কার আন্দোলনসমূহকে ‘ইসলামপন্থী’ বলে তখন বর্ণনা করা না হলেও, মর্মবস্তুর বিবেচনায় আজকে আমরা সহজেই সেভাবে বিবেচনা করতে পারি। এই আন্দোলনগুলো হলো ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ায় হাজি শরীয়তউল্লাহর নেতৃত্বে সংগঠিত ফারায়েজি আন্দোলন এবং তিতুমীরের নেতৃত্বে তারিক-ই-মুহাম্মাদিয়ার প্রভাবে ‘বাঁশের কেল্লা’ বলে পরিচিত আন্দোলন। এই দুই আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল ইসলামি চিন্তার পুনরুজ্জীবন এবং মুসলিম সমাজের সামাজিক সংস্কারের জন্য, কিন্তু উভয়ই বোধগম্য কারণে রাজনৈতিক রূপ লাভ করেছিল।
বিংশ শতাব্দীতে এসে ভারতে ‘জাতীয়তাবাদী’ আন্দোলন যখন কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের নেতৃত্বে চলে যায় এবং আন্দোলন যখন সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের পথে অগ্রসর হয়, তত দিনে গ্রামের দরিদ্র মানুষের বিভিন্ন ধরনের সংগ্রামের ধারা হয় বিলুপ্ত বা সুপ্ত হয়ে গেছে। ইসলামপন্থী রাজনীতির এই ধারাটি ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর পাকিস্তানি শাসনামলে (১৯৪৭-১৯৭১) আর বেগ লাভ করতে পারেনি, তার কারণ বহুবিধ। এর মধ্যে রয়েছে পাকিস্তান রাষ্ট্রের আদর্শ হিসেবে ইসলামকে গ্রহণ, পাকিস্তানি শাসকদের শোষণ, আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন ও জামায়াতে ইসলামীর আবির্ভাব। ইসলামপন্থী রাজনীতির আদর্শিক নেতা হিসেবে আবুল আলা মওদুদীর আবির্ভাব এবং ১৯৪১ সালে জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ইসলামি রাজনৈতিক চিন্তা ও নেতৃত্ব দুইয়েরই পরিবর্তন ঘটে। এত দিন পর্যন্ত ভারতে মুসলিম সমাজের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক আন্দোলনের নেতৃত্বে প্রথাসিদ্ধ ইসলামি শিক্ষায়, অর্থাৎ মাদ্রাসা শিক্ষায়, বিশেষত দেওবন্দি ধারায় শিক্ষিত আলেম সমাজের যে ভূমিকা ছিল তা ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়। তার পরিবর্তে নেতৃত্বে আসীন হতে থাকে আলিয়া মাদ্রাসার ধারায় শিক্ষিত, ক্ষেত্রবিশেষে এমনকি মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিত নয়, এমন ব্যক্তিরা। স্মরণ করা যেতে পারে, জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা মওদুদী শৈশবের পর আর প্রচলিত অর্থে মাদ্রাসায় পড়ালেখা করেননি। সর্বোপরি অতীতে নেতৃত্বে আসীন হতেন তাঁরা, যাঁরা ইতিমধ্যেই আলেম বলে পরিচিত, এখন তার আবশ্যকতা আর থাকল না। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে আলেম সমাজ ভূমিকা রাখতে চেষ্টা করতে সমর্থ হলেও এবং ক্ষেত্রবিশেষে ভূমিকা রাখতে পারলেও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের আলেমরা রাজনীতির মুখ্য ভূমিকা থেকে অপসৃত হন। ইসলামপন্থী রাজনীতিতে ক্রমবর্ধমান জামায়াতে ইসলামীর প্রভাব বোঝা যায় যে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার স্বল্প সময়ের মধ্যেই এই অঞ্চলের সবচেয়ে পুরোনো ইসলামপন্থী দল জামায়াতে উলেমায়ে ইসলাম তার আবেদন হারিয়ে ফেলে। ফলে পাকিস্তানি আমলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে দেওবন্দি, যা সাধারণ ভাষায় কওমি মাদ্রাসা বলে পরিচিত ধারায় শিক্ষিত আলেমরা কার্যত প্রভাবহীন ও শক্তিহীন হয়ে পড়লেন। কিন্তু সমাজের বিভিন্ন স্তরে মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন থেকে শুরু করে গ্রামসমাজে প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবে তাঁদের ভূমিকা থাকল আগের মতোই।
পঞ্চাশের ও ষাটের দশকে সাধারণ শিক্ষার প্রসার, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিকাশ, নগরায়ণ, সর্বোপরি বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রভাব বিস্তারের ফলে আলেমসমাজ ক্রমেই সমাজের মূলধারা বলে পরিচিত অংশের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল। তাদের প্রতিনিধিত্ব করার মতো রাজনৈতিক সংগঠন থাকল না। জামায়াতে ইসলামীই হয়ে উঠল ইসলামপন্থী রাজনীতির ‘প্রতিনিধি’। ষাটের দশকে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনের জোটে আওয়ামী লীগ, ন্যাপের পাশাপাশি জামায়াতের উপস্থিতিই তার প্রমাণ। এগুলো থেকে বোঝা যায় যে ষাটের দশকের মধ্যেই ইসলামি আন্দোলনে একটা বড় ধরনের বিভাজন তৈরি হয়ে যায়। একদিকে দেওবন্দি শিক্ষায় শিক্ষিত ধারা, যাঁরা ইসলামি সংগঠন এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠানে প্রভাবশালী, যারা ইসলামি সমাজ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন; অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী, রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত, ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই যার লক্ষ্য।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে জামায়াতে ইসলামী দীর্ঘদিন ধরে কার্যক্রম চালাতে না পারলেও দেওবন্দি ধারার প্রতিনিধিরা সামাজিকভাবে সক্রিয় থাকেন, তাঁদের রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষার অবসান হয়েছিল এমন কোনো লক্ষণ যেমন আমরা দেখি না। ১৯৭৮ সালের পর ইসলামপন্থী রাজনীতির পুনরুত্থান ঘটলে আমরা কেবল যে জামায়াতেরই উত্থান দেখতে পাই তা নয়, আমরা দেখতে পাই, প্রথাসিদ্ধ ইসলামি শিক্ষায় শিক্ষিত আলেম ও শায়েখরাও রাজনীতিতে প্রবেশের উদ্যোগ নিচ্ছেন। জামায়াতে ইসলামীকে রাজনীতিতে পুনঃপ্রবেশ করতে নেজাম-ই-ইসলামীর সঙ্গী হতে হয়েছিল, কিন্তু সে ঐক্য বেশি দিন স্থায়ী হয়নি, তার কারণ জামায়াতের উচ্চাভিলাষ তো বটেই, রাজনৈতিক পার্থক্যও। ১৯৮১ সালে মওলানা মোহাম্মদ উল্লাহর (হাফেজ্জি হুজুর) প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী হওয়ার মধ্য দিয়ে উপলব্ধি করা যায় জামায়াতে ইসলামীর বাইরে ইসলামি রাজনৈতিক শক্তি রয়েছে, যার ভিত্তি মাদ্রাসাগুলো ও মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিত আলেমরা এবং তাঁদের রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষাও রয়েছে।
১৯৭৮ সালের পর থেকে গত কয়েক দশকে দেশের আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনের কারণে এই শক্তির সামাজিক প্রভাব যেমন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি, তেমনি কওমি মাদ্রাসার প্রসারে তাদের ভিত্তিও জোরালো হয়েছে। আন্তর্জাতিক রাজনীতির পরিবর্তনও ইসলামপন্থীদের জন্য অনুকূল হয়েছে; যেমন আগ্রাসী মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন। শক্তি বৃদ্ধির পাশাপাশি ইসলামপন্থীদের মধ্যে বিভাজনেরও সৃষ্টি হয়; অসংখ্য ছোট ছোট দল ও গোষ্ঠীর উদ্ভব ঘটে এই সময়ে, নেতৃত্বের প্রশ্নে বিবাদ-বিসংবাদ দেখা যায়। ব্যক্তিত্বের লড়াই এবং বিভিন্ন ধরনের প্রবণতাও লক্ষণীয় হয়ে ওঠে। অনেকেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে, অনেকের উপস্থিতি কাগজে-কলমের চেয়ে বেশি নয়। নির্বাচনে অংশগ্রহণের হিসাবে ১৯৭৯ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোতে কমপক্ষে ৩৫টি দল অংশ নিয়েছে, যাদের নামে বা ইশতেহারে ইসলামি শাসন, ইসলামি রাষ্ট্র বা ইসলামি সমাজ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করা হয়েছে। ২০০৮ সালে রাজনৈতিক দলগুলোর নিবন্ধনের ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর নির্বাচন কমিশনে যে দলগুলো নিবন্ধিত হয়েছে, তার মধ্যে ১০টি দলকে এই তালিকাভুক্ত করা যেতে পারে।
গত কয়েক দশকের অভিজ্ঞতায় বাংলাদেশের ইসলামপন্থী দলগুলোকে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যে বিভক্ত করা যায়। বলা যায় হেফাজতে ইসলাম নামের সংগঠনটি দেশের কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক আদর্শবাদী ও রক্ষণশীলদের ঐক্যকেন্দ্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। হেফাজতে ইসলামের প্রতিষ্ঠা ২০১১ সালে হলেও সংগঠনটি এককভাবে ২০১৩ সালের মার্চের আগে কোনো রকম গুরুত্ব লাভ করেনি। গত ৯ মার্চ হাটহাজারী মাদ্রাসায় সম্মেলনের মধ্য দিয়ে এই ধারার দলগুলোর ঐক্য তৈরির পরই হেফাজতে ইসলামের প্রভাব সৃষ্টি হয়। এই ধরনের রাজনৈতিক শক্তিগুলো অতীতেও বিভিন্ন সময়ে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা চালিয়েছে। সেই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবেই ১৯৯০ সালে মাওলানা আজিজুল হক ও মুফতি ফজলুল হক আমিনীর নেতৃত্বে ইসলামী ঐক্যজোট গঠিত হয়েছিল। সময়ের ব্যবধানে সেই ঐক্যেরই কেবল অবসান হয়নি, ঐক্যজোট নামেই অনেক দলের উদ্ভব হয়েছে। তাদের এই অনৈক্যের ফলে ২০০৮ ও ২০১১ সালে নারী উন্নয়ন নীতি এবং ২০১০ সালে শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে এই ধারার প্রচলিত দলগুলো আলাদা আলাদাভাবে এবং ছোট ছোট জোটের আকারে সংগঠিত হয়েও কোনো রকম কার্যকর আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে ‘দেশ ও ইমান রক্ষা পরিষদ’ বলে যে জোটের উদ্ভব ঘটেছিল, তাদের অনেক শরিকই এখন হেফাজতের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। এই দলগুলো নিকট অতীতেই ‘ইসলামি ও সমমনা ১২ দল’ বলে মোর্চা তৈরি করেছিল, যা পরে আটদলীয় জোটে পরিণত হয়। এই দলগুলোর মধ্যে অনেক দলের সঙ্গে যেমন জামায়াতের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে, তেমনি অন্ততপক্ষে দুটি দল খেলাফত আন্দোলন ও খেলাফত মজলিসের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সুসম্পর্কের অতীত প্রমাণ রয়েছে। চারটি দল এখনো বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮-দলীয় জোটের শরিক। কিন্তু আদর্শিকভাবে এবং অতীত ইতিহাসের বিবেচনায় দেখা যায় যে এই মোর্চার দলগুলো সাধারণত জামায়াতে ইসলামীর বিরোধী।
অন্যদিকে, আহলে সুন্নাত ওয়াল জমা’আতের সমর্থনের ভিত্তি হলো পীর ও মাজারকেন্দ্রিক। পীর ও মাজারকেন্দ্রিক ব্যক্তিদের বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ চেষ্টা আমরা প্রত্যক্ষ করি জাকের পার্টি প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। আটরশির পীর মাওলানা শাহ সুফি হাশমতউল্লাহ জেনারেল এরশাদের শাসনামলে সরকারি আনুকূল্যে যে পরিচিতি লাভ করেন এবং মুরিদদের মধ্যে যে জনপ্রিয়তা প্রত্যক্ষ করেন, তার রাজনৈতিক রূপ দেওয়ার আশায় দলটির প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৮৯ সালে। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে দলটির রাজনৈতিক বিপর্যয় সত্ত্বেও এই ধারার প্রতিনিধিস্থানীয়দের রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা হ্রাস পায়নি। সেই ধারাবাহিকতায়ই বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের উদ্ভব হয় ২০০৫ সালে, বিএনপির সাবেক নেতা নজিবুল বশর মাইজভান্ডারির নেতৃত্বে। ২০০৫ সালে বিভিন্ন মাজারে বোমা বিস্ফোরণের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তুলে মাইজভান্ডারি বিএনপি ত্যাগ করে তরিকত প্রতিষ্ঠা করেন ২০০৫ সালে। এতেই বোঝা যায় যে জামায়াতে ইসলামীর প্রশ্নে এই ধরনের দলগুলোর অবস্থান কী। তা ছাড়া বর্তমানে আদালতে বিচারাধীন জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধকরণের বিরুদ্ধে দায়ের করা ২০০৯ সালের রিটটির আবেদনকারীদের অন্যতম হচ্ছেন মাইজভান্ডারি, জাকের পার্টির সাধারণ সম্পাদক মুন্সি আবদুল লতিফ ও সম্মিলিত ইসলামী জোটের সভাপতি মাওলানা জিয়াউল হক।
জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে আদর্শিক অবস্থান সত্ত্বেও হেফাজতে ইসলামের দাবিনামায় জামায়াতের বিরুদ্ধে বক্তব্যের অনুপস্থিতি, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গে নীরবতা, গণজাগরণ মঞ্চের বিরুদ্ধে জামায়াতে ইসলামীর ভাষায় আক্রমণ এবং এই সংগঠনের উদ্ভবের পটভূমি থেকে তাদের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ উঠেছে। তাদের কার্যক্রম, ক্রমাগতভাবে জামায়াতে ইসলামীর দাবিগুলোকে সামনে নিয়ে আসা এবং তাদের উত্থানের পর জামায়াতের কার্যক্রমে নীরবতাও এই অভিযোগের সত্যতারই ইঙ্গিত দেয়। তার কারণ প্রধানত চারটি; প্রথমত, হেফাজত নেতারা জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে যেকোনো ব্যবস্থাকেই দেখছেন ইসলামপন্থী রাজনীতির ওপর আক্রমণ বলে। তাতে করে তাঁদের আশঙ্কা যে ভবিষ্যতে তাঁরাও একই ধরনের বিরূপ পরিস্থিতির মুখোমুখি হবেন। দ্বিতীয়ত, তাঁরা সেক্যুলার রাজনীতির ধারণার বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম চালিয়ে এসেছেন, তাঁরা মনে করেন দেশের রাজনৈতিক সংকটের মুখে এই সংগ্রামকে অনেকটা পথ এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন। তৃতীয়ত, গত দুই দশকে জামায়াতে ইসলামী রাজনীতিতে যে অবস্থান তৈরি করেছে এবং রাজনৈতিক সুবিধা লাভ করেছে, সে অভিজ্ঞতা থেকে হেফাজতের নেতারা আশা করেন তাঁরাও ভবিষ্যতে এই অবস্থানে যেতে পারবেন; জামায়াতের বর্তমান দুর্বল অবস্থান এবং ভবিষ্যতে দলটি নিষিদ্ধ হলে তাঁরা ইসলামপন্থী রাজনীতির প্রতিনিধি হয়ে উঠতে চান। চতুর্থত, বাংলাদেশে তাঁরা চান ইসলামপন্থী রাজনীতিতে মধ্যবিত্ত, শহরনির্ভর, সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিতদের যে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা হয়েছে, তার বদলে প্রচলিত ইসলামি শিক্ষায় শিক্ষিত গ্রামনির্ভর ব্যক্তিদের নেতৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে। বিংশ শতাব্দীতে যা তাঁরা হারিয়েছেন, তাকে তাঁরা ফিরে পেতে চান একবিংশ শতাব্দীতে।
হেফাজতে ইসলামের এই প্রচেষ্টা স্পষ্টতই আহলে সুন্নাত ওয়াল জমা’আতের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ তারা মোকাবিলা করে আসছে বিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকেই। সেই পার্থক্যের কারণে দক্ষিণ এশিয়ায় মুসলিমদের মধ্যে দুটি আলাদা ধারা বা মাসলাক তৈরি হয়েছে.
৩. কোন দিকে এগোচ্ছে বাংলাদেশ?
হেফাজতে ইসলামের ঢাকায় সমাবেশের এক বড় অংশ যে কওমি মাদ্রাসার সঙ্গে যুক্ত ছাত্র-শিক্ষকেরা ছিলেন, তা বিভিন্ন গণমাধ্যমেই প্রকাশিত হয়েছে। আপাতদৃষ্টেও বোঝা যায়, সংগঠনটির ভিত্তি দেশের সেসব কওমি মাদ্রাসায়, যেগুলো দেওবন্দ ধারার শিক্ষাব্যবস্থা ও পাঠ্যক্রম অনুসরণ করে থাকে। এ সমাবেশে এবং সংগঠনে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের ব্যাপক অংশগ্রহণ অনেককেই বিস্মিত করেছে। কিন্তু ভারতের উত্তর প্রদেশে অবস্থিত দারুল উলুম দেওবন্দের ইতিহাস কমবেশি যাঁদেরই জানা আছে, তাঁদের জন্য এটি মোটেই বিস্ময়কর হওয়া উচিত নয় যে, এ ধারার আলেম ও শিক্ষার্থীরা রাজনীতিতে এতটা প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত হবেন। ১৮৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কেবল যে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে পুরোনো, পরিচিত ও সম্মানিত ইসলামি ধারার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তা-ই নয়; এর প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ভারতে সিপাহি বিপ্লবের পটভূমিকায় মুসলিম সমাজের ভেতরে আত্মপরিচয়ের প্রশ্ন সামনে রেখেই।
এ মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা মওলানা মুহাম্মদ কাসিম নানুতুভি (১৮৩৩-১৮৭৭) এবং মওলানা রশিদ আহমেদ গাঙ্গোহি (১৮২৯-১৯০৫) সিপাহি বিদ্রোহে অংশ নিয়েছিলেন এবং মুসলিম সমাজের পুনর্জাগরণের আকাঙ্ক্ষা থেকেই দেওবন্দের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। দেওবন্দ ছিল সে সময়ের রাজনীতির প্রেক্ষাপটে রক্ষণশীল আলেমদের প্রতিক্রিয়া। তদুপরি দেওবন্দের প্রথম শিক্ষার্থী মাহমুদ-উল হাসান (১৮৫১-১৯২০) যখন এ মাদ্রাসার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন, তখন এ মাদ্রাসা রাজনৈতিক কার্যক্রমে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করে। তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘সামারাতুত তারবিয়া’ (প্রশিক্ষণের ফলাফল), যা ছিল জামিয়াত-উল আনসারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। জামিয়াত-উল আনসার ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াইয়ের সূচনা করেছিল।
দেওবন্দের প্রচেষ্টা কেবল ব্রিটিশদের শাসনের বিরুদ্ধেই ছিল না, ছিল মুসলিম সমাজের সংস্কারের বিরুদ্ধেও। দেওবন্দের আলেমরা মনে করতেন, এসব সংস্কারপ্রচেষ্টা ইসলামকেই বিপন্ন করে তুলেছে। ফলে তাঁরা সে সময়কার অন্যান্য সামাজিক ও শিক্ষা আন্দোলনের বিরোধিতা করেছেন, অনেককেই চিহ্নিত করেছেন ‘কাফের’ বলে এবং তাঁদের প্রচেষ্টাকে ‘অনৈসলামিক’ বলে বর্ণনা করেছেন। যেমন সৈয়দ আহমেদ খানের আলীগড় মোহামেডান-অ্যাংলো-ওরিয়েন্টাল কলেজ, যা দেওবন্দিদের আক্রমণের অন্যতম লক্ষ্যবস্ত ছিল।
মুসলিম সমাজের মধ্যে দেওবন্দের আলেমদের কঠোর মনোভাবাপন্ন দৃষ্টিভঙ্গি, তাঁদের ব্যাখ্যাকে একমাত্র গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা বলে দাবি করা, তাকলিদ (অন্ধ অনুকরণ) বিষয়ে তাঁদের আপসহীন অবস্থান নিয়ে আপত্তি ও অসন্তোষের সূচনা হয়। এ পটভূমিকায় ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষে মুসলিম সমাজে উদ্ভব হয় আহলে সুন্নাত ওয়াল জমা’আত নামের চিন্তাধারার। বর্তমান ভারতের উত্তর প্রদেশের বারেলভির মওলানা আহমেদ রিজা খানের (১৮৪৪-১৯২১) নেতৃত্বে গড়ে ওঠা এ চিন্তাধারার মূল কথা হচ্ছে, তাঁরাই সুন্নাহর প্রকৃত অনুসারী এবং সেই সূত্রে তাঁরাই প্রকৃত সুন্নি ঐতিহ্যের প্রতিনিধিত্বকারী। মওলানা রিজা খানের জন্মস্থানের সূত্রে এ ধারাকে বারেলভি বলেই বলা হয়ে থাকে। দেওবন্দি আলেমরা ভারতে প্রচলিত বহু ইসলামি ঐতিহ্য ধারা—যেমন পীর-দরবেশ অনুসরণ, সুফিদের মতবাদ, মিলাদ মাহফিলের আয়োজন ইত্যাদি—অনৈসলামিক বলে বাতিল করে দেন; বিপরীতক্রমে বারেলভি বা আহলে সুন্নাত ওয়াল জমা’আতের অনুসারীরা তাঁকে অতীন্দ্রিয়বাদী বা মিস্টিক ধারার অংশ বলে মনে করেন। এসবকে কেন্দ্র করে এ দুই ধারার মধ্যে সূচনা হয় তীব্র বিতর্কের। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে এবং বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় এ বিতর্ক ফতোয়াযুদ্ধে পরিণত হয়।
এ সময়কার বিভিন্ন ধারার চিন্তার মধ্যকার পার্থক্যগুলো বিভিন্ন মাসলাকের মধ্যে এক অন্তহীন বিরোধের সূচনা করেছে ঊনবিংশ শতাব্দীতে, যারই প্রতিফলন আমরা দেখতে পাচ্ছি আজকের বাংলাদেশে একদিকে দেওবন্দি ধারার প্রতিনিধি হিসেবে হেফাজতে ইসলামের সংগঠিত রূপের মধ্যে এবং তার বিপরীতে এ দেশের প্রচলিত ইসলামের প্রতিনিধি হিসেবে আহলে সুন্নাত ওয়াল জমা’আতের উপস্থিতির মধ্য দিয়ে। ভালো করে লক্ষ করলে এটা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কারণ নেই যে, কেন মাজারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, বিভিন্ন তরিকার গদিনসীনরা আহলে সুন্নাতের পতাকাতলে একত্র হয়েছেন।
দেওবন্দি ধারার আলেমরা ভারতে, পাকিস্তানে ও বাংলাদেশের রাজনীতিতে ১৯৪৭-পরবর্তী সময়ে জমিয়তে উলেমায়ে ইসলাম নামের রাজনৈতিক দলের মধ্য দিয়ে তাঁদের কার্যক্রম পরিচালনা অব্যাহত রেখেছেন। ভারতে এ সংগঠনের নাম জমিয়তে উলেমায়ে হিন্দ, যারা প্রত্যক্ষ রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নয়। যদিও দেওবন্দি ধারার আলেমরা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার গোড়ায় বারেলভি চিন্তাধারার অনুসারীরাই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। কালক্রমে সেখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দেওবন্দি ধারার আধিপত্য। আহলে সুন্নাতের অনুসারীদের রাজনৈতিক দল হলো জমিয়তে উলেমায়ে পাকিস্তান।
দেওবন্দিদের প্রভাব বিস্তারের কাজটি প্রধানত ঘটে ১৯৭৯ সালে ক্ষমতায় সেনাশাসক জিয়াউল হক অধিষ্ঠিত হওয়ার পর। আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসনের পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে দেওবন্দি ধারার আফগান ও পাকিস্তানি রাজনৈতিক দলগুলো। ১৯৮৯ সালের পর এগুলোর মধ্য থেকেই গড়ে ওঠে তালেবান। কিন্তু তার প্রভাব কেবল যে আফগানযুদ্ধের মধ্যেই সীমাদ্ধ থেকেছে তা নয়, পাকিস্তানে তৈরি হয়েছে বিভিন্ন ধরনের জঙ্গিগোষ্ঠী। পাকিস্তানের গত দুই দশকের ইতিহাস যাঁরা জানেন, তাঁদের কাছে এ কথা বলার প্রয়োজন নেই যে তার পরিণতি কী হয়েছে।
কিন্তু এ পরিস্থিতির পেছনে কাজ করেছে আরও একটি কারণ, তা হলো দেওবন্দি ধারাকে মোকাবিলা করার জন্য আহলে সুন্নাতের অনুসারী রাজনৈতিক দলের বিস্তার। একসময় এমনও মনে করা হতো যে, আহলে সুন্নাত ধারার অনুসারীরা দেওবন্দিদের মতো সহিংসতায় বিশ্বাসী নন। গত এক দশকে সেই ধারণা ভুল বলেই প্রমাণিত হয়েছে। দেওবন্দিদের উপর্যুপরি হামলার বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার কারণেই হোক কি তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক লক্ষ্য হাসিলের প্রয়োজনেই হোক, এখন পাকিস্তানে বারেলভি মতানুসারীদের জঙ্গি সংগঠন সুন্নি তাহরিকের উদ্ভব ঘটেছে। তাদের শক্তি দেওবন্দি ধারার জঙ্গি সংগঠন সিপাহ-ই-সাহাবা, সিপাহ-ই-জংভি, তাহরিক-ই-তালেবানের চেয়ে বেশি না হলেও তাদের হাতেও প্রাণ দিতে হয়েছে বহু মানুষকে।
পাকিস্তানে একসময় কারও কারও ধারণা হয়েছিল যে দেওবন্দি ধারা, যা পাকিস্তানের মুসলিম জনগোষ্ঠীর মাত্র ১৫ শতাংশ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে, তাদের মোকাবিলা করার জন্য দেশের অধিকাংশ মুসলমানের প্রতিনিধি ঐতিহ্যবাহী ধারার সমর্থক আহলে সুন্নাতের রাজনৈতিক ভূমিকা ইতিবাচকই হবে। কিন্তু তার পরিবর্তে যা ঘটেছে তা হলো, মুসলিম সমাজ সম্প্রদায়গতভাবে (সেক্টেরিয়ান) বিভক্ত হয়েছে এবং সহিংসতায় জড়িয়ে পড়েছে। তাদের মধ্যকার এ বিরোধের পেছনে ধর্মের তত্ত্বগত ব্যাখ্যার কথা বলা হলেও রাজনৈতিক কারণই মুখ্য। তাদের মধ্যে বিবাদ-বিসংবাদ সত্ত্বেও তারা শিয়া জনগোষ্ঠীকে অমুসলিম বিবেচনা করার প্রশ্নে একমত; তাতে করে শিয়া ও আহমদিয়া সম্প্রদায়কে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকের জীবন, তা ছাড়া ব্লাসফেমি আইনের প্রশ্নে তাদের মধ্যে কোনো রকম ফারাক নেই।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে হেফাজতে ইসলাম ও আহলে সুন্নাত ওয়াল জমা’আতের উত্থানের মুখে তাদের ভবিষ্যৎ পথরেখা বোঝার জন্যই পাকিস্তানের ইতিহাসের এ দিকগুলো তুলে ধরা। ঊনবিংশ শতাব্দীতে যা ছিল দেওবন্দি-বারেলভি ফতোয়াযুদ্ধ, গত কয়েক দশকে পাকিস্তানে তা রূপ নিয়েছে সংঘাত, সংঘর্ষে। তাদের উভয়েরই লক্ষ্যবস্তু হয়েছে সংখ্যালঘু মুসলিমরা, আক্রান্ত হয়েছে খ্রিষ্টানরা। বাংলাদেশে এ দুই পক্ষের মধ্যে সংবিধান পরিবর্তনের প্রশ্নে, কাদিয়ানিদের প্রশ্নে, ব্লাসফেমিবিষয়ক আইনের প্রশ্নে এবং কথিত নাস্তিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি বিষয়ে মতৈক্য অবশ্যই সবার মনোযোগের দাবিদার। দেশের বিরাজমান রাজনৈতিক সমীকরণে দেশের ক্ষমতাসীন দল বা অন্য কেউ যদি দেওবন্দি ধারার উত্থানের পাশাপাশি আহলে সুন্নাতের সাংগঠনিক শক্তি প্রদর্শনকে সাময়িকভাবে হলেও ইতিবাচক মনে করে, একটি শক্তি অন্য শক্তিকে নিষ্ক্রিয় করবে বলে আশা করে, তবে তাদের আরেকবার পাকিস্তানের দিকে তাকাতে অনুরোধ করব।
………………………………………………………………………………………………………………………………
দুই মাস্লাকের পার্থক্য
দেওবন্দি
ইসলাহ (ইসলামি সংস্কারবাদ): কোরআন ও হাদিসের সম্মান বৃদ্ধি করা, নিজের জীবনের ও সমাজের সংস্কার।
তাকলিদ (যেসব ঐতিহ্য অনুসরণ করা বাধ্যতামূলক): হানাফি আইনশাস্ত্র (ফিকহ), ব্যক্তিগত পরামর্শদাতা (বা মেন্টর), গোষ্ঠীর নেতাদের দেওয়া ফিকহের ব্যাখ্যা (ফতোয়া)।
বিদ’আ (যেসব ঐতিহ্য আপত্তিকর বা মোকাবিলা করা জরুরি): সাধু/ঋষি/পীর, শায়েখ, সমাধিপূজা, অলৌকিক ঘটনায় বিশ্বাস, নবীর প্রতি অতিরিক্ত ভক্তি প্রদর্শন।
যেসব গোষ্ঠীর সঙ্গে বিরোধ: বারেলভি, আহমদিয়া, আহলে হাদিস, শিয়া।
বারেলভি
ইসলাহ (ইসলামি সংস্কারবাদ): মহানবী (সা.)-এর দেখানো পথ (সুন্নাহ) পুনরুজ্জীবন ও পুনঃপ্রতিষ্ঠা।
তাকলিদ (যেসব ঐতিহ্য অনুসরণ করা বাধ্যতামূলক): হানাফি আইনশাস্ত্র (ফিকহ), অতীন্দ্রিয়বাদী (বা মিস্টিক) ঐতিহ্য, সাধু/ঋষি/পীর, মাজার ও সমাধির প্রতি
শ্রদ্ধা প্রদর্শন; গোষ্ঠীর নেতাদের দেওয়া ফিকহের ব্যাখ্যা (ফতোয়া)।
বিদ’আ (যেসব ঐতিহ্য আপত্তিকর বা মোকাবিলা করা জরুরি): মহানবী (সা.)-এর, অতীন্দ্রিয়বাদী (বা মিস্টিক) ঐতিহ্যের, মাজার বা সাধু/ঋষি/পীর ও তাকলিদের অবমাননা বা এসবের ওপর কলঙ্ক লেপন।
যেসব গোষ্ঠীর সঙ্গে বিরোধ: দেওবন্দি, তাবলিগ, আহমদিয়া, আহলে হাদিস, শিয়া।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………