November 23, 2024

http://gulfnews.com/business/property/international/3-000-acres-to-be-reclaimed-from-realty-firms-1.645776

সারওয়ার জাহান, রুখসানা হাফিয, মোহাম্মদ শাকিল আখতার, আফসানা হক, রেজওয়ানা রফিক, অনিন্দ্য কিশোর দেবনাথ

(লেখকেরা বুয়েটের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের শিক্ষক)

নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনার শিক্ষক হিসেবে ঢাকাসহ সারা দেশের পরিকল্পনার ব্যাপারে দৃষ্টি রাখা আমাদের পেশাগত ও গবেষণার দায়বদ্ধতার অংশ। নানা বৈশ্বিক সূচকে ঢাকার বসবাসযোগ্যতা, বায়ুর মান ইত্যাদির মাত্রা তলানিতে গিয়ে ঠেকার চিত্র প্রকাশিত হওয়ার পর সাধারণ মানুষমাত্রই ঢাকার পরিকল্পনা, এর প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন নিয়ে জানতে উৎসাহী হবেন, এটাই স্বাভাবিক। উল্লেখ্য, যেকোনো পরিকল্পনাই আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতার মধ্যে প্রণীত হয়। তার পরও নিয়মতান্ত্রিকভাবে জনস্বার্থ রক্ষাই পরিকল্পনাবিদের কাজ। কোনো গোষ্ঠীস্বার্থে গৃহীত পরিকল্পনায় কেবল নৈতিকতাই লঙ্ঘিত হয় না, দেশ-জাতি ভয়াবহ বিপর্যয়ে পড়তে পারে, সামাজিক ন্যায়বিচার বিঘ্নিত হতে পারে, আর দুর্নীতি বা ফৌজদারি অপরাধের আশঙ্কা তো থাকেই।

এমতাবস্থায় রাজউক যখন ঢাকার জন্য ২০ বছর (২০১৬-২০৩৫) মেয়াদি পরিকল্পনা করছে, তখন আমরা স্বভাবতই এর বিস্তারিত জানতে উৎসাহী হই। কিন্তু আমরা অবাক বিস্ময়ে জানতে পারলাম, এর প্রক্রিয়া নগর পরিকল্পনার ব্যাকরণ বা পদ্ধতির সঙ্গে শুধু অসামঞ্জস্যপূর্ণই নয়; বরং পরিকল্পনাবিদ্যার সামগ্রিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যর সঙ্গে সাংঘর্ষিক। উল্লেখ্য, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, জার্মান উন্নয়ন ব্যাংক ও সুইডিশ আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার অর্থায়নে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) সিটি রিজিয়ন ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের (সিআরডিপি) আওতায় রাজউক রিজিওনাল ডেভেলপমেন্ট প্ল্যানিং (আরডিপি) প্রকল্পটি হাতে নিয়েছে। কিন্তু প্রকল্প প্রণয়নকারীরা সুকৌশলে কতিপয় ‘চাওয়া’র মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেছেন যেগুলো অবাস্তব ও জনস্বার্থবিরোধী। তাই বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সে (বিআইপি) প্রকল্পটির পরিচিতিমূলক সভাতেই সাধারণ পরিকল্পনাবিদ কমিউনিটি ঢাকার ভবিষ্যৎ নিয়ে আরও আতঙ্ক ও আশঙ্কা প্রকাশ করেছে।

প্রস্তাবিত আরডিপির প্রধান কম্পোনেন্টগুলো হলো: (ক) ঢাকার পূর্ববর্তী স্ট্রাকচার প্ল্যান (১৯৯৫-২০১৫) পর্যালোচনা করা ও পরবর্তী ২০ বছর মেয়াদি স্ট্রাকচার প্ল্যান প্রণয়ন করা, (খ) ঢাকার অদূরে এক বা একাধিক স্যাটেলাইট টাউনের স্থান নির্বাচন করা এবং (গ) রাজউকের পরিকল্পনা-সক্ষমতা বাড়ানো। তৃতীয় কম্পোনেন্ট নিয়ে ‘আপাতত’ কোনো আপত্তি না থাকলেও প্রথম দুটি কম্পোনেন্ট নিয়ে আপত্তি উত্থাপনের যথেষ্ট যুক্তিসংগত কারণ রয়েছে।

আরডিপির প্রথম কম্পোনেন্টটির দুটি ভাগ কখনো একই প্রকল্পের অধীনে হতে পারে না। কারণ, পূর্ববর্তী স্ট্রাকচার প্ল্যানের পর্যালোচনা শেষ হওয়ার আগে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভব নয় যে নতুন আরেকটি স্ট্রাকচার প্ল্যান প্রণয়ন করা দরকার কি না। পূর্ববর্তী স্ট্রাকচার প্ল্যানের আলোকে প্রণীত ড্যাপ ২০১০ সালে গৃহীত হওয়ার পর বিগত চার বছরে ড্যাপের কতখানি বাস্তবায়িত হয়েছে, না হলে কেন হচ্ছে না, তার কোনো পর্যালোচনা কি হয়েছে? যদি বাস্তবায়ন না-ই হয়ে থাকে, সেই স্ট্রাকচার প্ল্যান ও ড্যাপ বাস্তবায়ন না করে নতুন পরিকল্পনা করার জন্য অতি উৎসাহ কি পূর্বের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন এড়িয়ে যাওয়ার জন্য?

এবার আসা যাক দ্বিতীয় কম্পোনেন্ট-স্যাটেলাইট টাউনের স্থান নির্বাচন করার উদ্দেশ্য প্রসঙ্গে। এটি শুধু প্রথম কম্পোনেন্টের সঙ্গে সাংঘর্ষিকই নয়, বরং অনেকাংশে স্থূল পক্ষপাতদুষ্ট। আগের স্ট্রাকচার প্ল্যানে (১৯৯৫-২০১৫) ঢাকার বিবর্ধন ব্যবস্থাপনার (গ্রোথ ম্যানেজমেন্ট) জন্য স্যাটেলাইট টাউনের অপ্রয়োজনীয়তা ও অকার্যকারিতার কথা বলা হয়েছে। যদি আগের স্ট্রাকচার প্ল্যান পর্যালোচনা শেষে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে ঢাকার জন্য নতুন স্ট্রাকচার প্ল্যান দরকার এবং নতুন স্ট্রাকচার প্ল্যানে ঢাকার বিবর্ধন ব্যবস্থাপনার জন্য স্যাটেলাইট টাউনের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত ও এর কার্যকারিতা প্রমাণিত হয়, তাহলে স্যাটেলাইট টাউন নিয়ে চিন্তা করার সুযোগ থাকত। সেটাও করতে হতো অন্য আরেকটি প্রকল্পের মাধ্যমে। অবশ্যই পলিসি আর বাস্তবায়ন পর্যায়ের পরিকল্পনা একসঙ্গ তৈরি করার মাধ্যমে নয়। সুতরাং আবারও প্রশ্ন জাগে, পরবর্তী স্ট্রাকচার প্ল্যান প্রণয়নের যথার্থতাই যেখানে প্রশ্নবিদ্ধ, সেখানে স্যাটেলাইট টাউনের মাধ্যমে সমস্যার সমাধানের কথা চিন্তা করা হয় কী করে? স্যাটেলাইট টাউনের মাধ্যমে যে সমস্যার সমাধান হবে বা হলেও কীভাবে হবে, তা নিয়েও কোনো গবেষণা বা পর্যালোচনাই তো করা হয়নি। উল্লেখ্য, পূর্ববর্তী স্ট্রাকচার প্ল্যানেও স্যাটেলাইট টাউনকে সমাধান হিসেবে অকার্যকর বলা হয়েছে। তাহলে রাজউক আসলে কার স্বার্থ দেখছে?

এ প্রশ্ন বা সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয় যখন দেখা যায় যে স্ট্রাকচার প্ল্যান প্রণয়ন শেষ হওয়ার আগেই ড্যাপ (২০১৬-২০৩৫), যা অবশ্যই স্ট্রাকচার প্ল্যান নির্দেশনা নির্ভরের জন্য তোড়জোড় শুরু হয়েছে। এ ক্ষেত্রে আর বিদেশি অর্থায়নের জন্য অপেক্ষা করা হচ্ছে না, নিজস্ব অর্থায়নেই করা হচ্ছে। এটা অবশ্যই ভালো যে আমরা নিজেদের কাজ নিজেরাই করার চেষ্টা করছি। আর বাংলাদেশের নগর ও অঞ্চল বা গ্রামীণ পরিকল্পনাবিদদেরই এটা করার সক্ষমতা আছে। রাজউকের প্রকল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিগত ড্যাপের ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতা এবং বাস্তবায়নে ‘রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক’ জটিলতা নাকি এ তাড়াহুড়ার কারণ। এটা ভালো যে রাজউক ভুল থেকে শিখছে। কিন্তু বিগত ড্যাপ, যাতে কিনা ঢাকার প্রতিটি প্লট বা জমি খণ্ডের জন্য পরিকল্পনা থাকার কথা। এর সবচেয়ে বড় কৌশলগত ভুল ছিল সুবিশাল এলাকার জন্য এ ধরনের পরিকল্পনা করার চেষ্টা করা। তখন ঢাকাকে পাঁচটি ভাগে ভাগ করে কনসালটেন্টদের দিয়ে পাঁচটি ড্যাপ তৈরি করা হয়। কিন্তু বিগত ড্যাপ নিয়ে পরিকল্পনাবিদ ও নানা মহলের সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এত বিশাল এলাকার জন্য প্লট পর্যায়ের বিশদ পরিকল্পনা করা সম্ভব না বলে কনসালটেন্টরা মন্তব্য করেন। কনসালটেন্টদের কাজের মান নিয়ে আমাদের আপত্তি ও প্রশ্ন থাকলেও ড্যাপের এলাকার বিশালতা নিয়ে তাঁদের মন্তব্যের সঙ্গে সহমত পোষণ করে আমরা বলেছিলাম, এত বিশাল এলাকার জন্য ড্যাপ প্রণয়নের চিন্তা অবিবেচনাপ্রসূতও বটে। লক্ষণীয় যে রাজউক এই ভুল থেকে শিক্ষা নেয়নি। বরং এই ভুলের মাত্রা আরও বড় করে ঢাকাকে মাত্র দুই ভাগ করে আগের তুলনায় আড়াই গুণ বড় প্রতিটি ভাগের জন্য ড্যাপ (২০১৬-২০৩৫) প্রণয়নের কাজ শুরু করেছে। আর এভাবে নতুন ড্যাপের নামে নিঃসন্দেহে দেশের তথা আমার-আপনার ৩৩ কোটি টাকা অপব্যয় হতে যাচ্ছে। এর ফলে আরও লাখো কোটি টাকার বিনিয়োগ বিপথে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে।

বিআইপিতে অনুষ্ঠিত প্রকল্পটির অগ্রগতি অবহিতকরণ অনুষ্ঠানে প্রকল্পের পরিচালক বলছিলেন যে ২০১৫ সালে পুরোনো প্ল্যানের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু মনে রাখা প্রয়োজন, প্রকল্প বা প্ল্যানের মেয়াদ আর খাদ্যবস্তুর মেয়াদ এক বিষয় নয়, প্রকল্প বা প্ল্যানের মেয়াদ মানে এর প্রণয়ন শেষে বাস্তবায়নকাল। তাই ২০০৪ সালে ড্যাপ প্রণয়ন শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা না হওয়ায় ঢাকার আরবান এরিয়া প্ল্যানের (১৯৯৫-২০০৫) মেয়াদ কয়েক দফায় ২০১০ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। আর যে প্ল্যান প্রণয়নই হয়েছে দেরিতে, সেটা বাস্তবায়ন করতে বেশি সময় লাগবে, এটাই স্বাভাবিক। সুতরাং পূর্ববর্তী ড্যাপ তথা স্ট্রাকচার প্ল্যানের মেয়াদ বাড়ানো অবশ্যই যৌক্তিক। আর একটি সাধারণ সরকারি পরিপত্র বা অধ্যাদেশের মাধ্যমে তা করা যেতে পারে। কিন্তু সেটা করার চেয়ে নতুন প্ল্যান প্রণয়নেই অতি উৎসাহ রাজউকের। আরও অবাক করার বিষয়, বিআইপিতে অনুষ্ঠিত ওই অনুষ্ঠানে প্রকল্পের পরিচালক ও কনসালটেন্টদের প্রতিনিধি এমন সুর মিলিয়ে কথা বলছিলেন যে কে কার্যাদেশদাতা আর কে গ্রহীতা, সেটার কোনো তফাত বোঝা মুশকিল হয়ে যাচ্ছিল। অথচ কার্যাদেশদাতার ভূমিকাই হওয়া উচিত ছিল কনসালটেন্ট পরিকল্পনাবিদদের উপস্থাপিত টেকনিক্যাল প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারছেন কি না, সেটা দেখা।

আগামীর ঢাকার জন্য পরিকল্পনা প্রণয়নে এ অব্যবস্থাপনা, অবিবেচনা, নির্বুদ্ধিতা ও জনসাধারণের স্বার্থবিরুদ্ধতার ব্যাপারে আমরা সরকার, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, রাজউকের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ, দেশি-বিদেশি অর্থায়নকারী, নাগরিক সমাজ এবং সর্বোপরি সাধারণ জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। আমরা যদি চাই অনাগত দিনগুলোতে প্রক্রিয়া ও পরিকল্পনাগত ত্রুটি ও অনিয়মের কারণে ঢাকা নিম্নবাসযোগ্য শহরের তালিকায় না থাকুক, তাহলে সবাইকে যার যার অবস্থান থেকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে বলে আমাদের বিশ্বাস।

(৭ এপ্রিলের প্রথম আলোয় প্রকাশিত)/ ছবিসত্ত্বঃ Rex features

Leave a Reply