November 21, 2024

গবেষণার একটা অবাক দিক আছে। যে বিষয়ে, যে জায়গায় বা যাদের নিয়ে গবেষণা করছি তার সাথে জড়িত খুঁটি নাটি বহু বিষয় আসয় জানা হয়ে যায়। ক্ষেত্র বিশেষে এই জানাগুলো খুব বেশি ব্যক্তি, জায়গা বা বিষয় নির্ভর। অনেকসময় ঐ বিশেষ পরিস্থিতি বা প্রেক্ষাপটের বাইরে এই জানাগুলো প্রায় অপ্রোয়জনীয় ঠেকে। খানিকটা সময় পেরুলে এই ছোট খাট আবিষ্কারগুলো হয়ে ওঠে খাপছাড়া টুকরো স্মৃতি। আরও কিছুদিন পরে টুকরো স্মৃতি হয়ে দাড়ায় কেবল অনুভূতি। 

স্মৃতির সাথে মানুষের সম্পর্ক আসলে অদ্ভুত! এই সম্পর্ক ঠিক কোনদিনই একইরকম না, কোনদিনই ঠিক সম্পূর্ণ বোঝাপড়ার না। জীবন্ত মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক জটিল, নিয়ত পরিবর্তনশীল। নিজের স্মৃতির সাথেও মানুষের সম্পর্ক তেমনি জটিল আর বহুমাত্রিক। জীবনী গবেষণার এই কাজটা ছিল অনেকটা একজন মৃত মানুষকে স্মৃতির কবর খুঁড়ে বের করে নতুন জীবন দেয়ার মত। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের একজন ভাইস চেয়ারম্যানের জীবনী লেখার কাজ ছিল আমাদের। গবেষণার শুরু থেকে চট্টগ্রাম শহর নিয়ে যেসব বয়ান শুনে আসছিলাম তাতে ৬০, ৭০, ৮০র দশকে চট্টগ্রাম শহরকে কেউ বাংলাদেশের শিল্প সংস্কৃতির কেন্দ্র বলে ভেবে বসতে পারে, তাতে তাকে দোষ দেয়া যাবেনা। প্রথমবার তথ্য সংগ্রহের জন্য চট্টগ্রামে পা দেয়ার পর থেকে আমার চোখ আতিপাতি করে সেই স্মৃতির শহর খুঁজছিল। আকার, ব্যাপ্তি কোনভাবেই আমি একটা মফঃস্বলের অবয়বের বেশি কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না। হবারই কথা। একটা শহরকে বোঝবার জন্য যে সাংস্কৃতিক আদানপ্রদান দরকার তা তো একদিনে হবার বিষয় না। অনুমান করি নিজের জীবনের উজ্জ্বলতম অধ্যায়ের স্মৃতিচারণের সময় অতিশায়োক্তিও কাজ করেছে তথ্যদাতাদের মধ্যে।

ঐদিনটা স্পষ্ট মনে আছে। চিড়বিড়ে রোদ থেকে বাঁচতে ছাতা মাথায় দিয়ে নামলাম চট্টগ্রামের শুটিং ক্লাবে। বাইরে যতটা ঝকঝকে রদ্রুজ্জল ছিল শুটিং ক্লাবের ভেতরটা ছিল ঠিক ততটাই অন্ধকার আর বিবর্ণ। বড় একটা প্র্যাকটিস গ্রাউন্ডের পাশ দিয়ে, আরও একটা গলির মত জায়গা পার হয়ে রফিকুল ইসলামের কামরায় ঢুকলাম। ভাবলে এখনো বিব্রত হই! এক পেশে ছিল আমাদের কৌতূহল, উৎসাহ, উদ্দিপনা। যে কোন গবেষণায় একজন তথ্যদাতা তথ্য দিতে অনিচ্ছুক, অনাগ্রহী হতেই পারেন এই সাধারণ বিষয়টা জানতাম। রফিকুল ইসলামের ক্ষেত্রে এই সম্ভাবনা ঘুণাক্ষরেও আমাদের মাথায় উঁকি দেয়নি। আলোকচিত্রির সাক্ষাতকার যে! আমরা নিজেরাও তো আলোকচিত্রি! তারপরে আবার দেশের সবচাইতে বড় আলোকচিত্র প্রতিষ্ঠানের গবেষণার কাজ! আমরা সেই প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিত্ব করছি! কিভাবে সম্ভব যে তথ্যদাতা তথ্য দিতে অনাগ্রহী হবেন?! প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতাবলে কি মানুষ মানুষের স্মৃতির মালিকানাও লাভ করে?! আমি আজও নিশ্চিত না ঠিক কোন বিষয়টা আমাদের মধ্যে ওউদ্ধত্ব তৈরি করে। আমরা যেন ধরেই নিয়েছিলাম রফিকুল ইসলামের কাছে যাওয়ামাত্র তিনি আমাদের সামনে তার জীবন স্মৃতির পসরা খুলে বসবেন। তারুণ্য সুন্দর, তারুণ্য নিষ্পাপ কিন্তু তারুণ্য স্বার্থপর আর অন্ধও বটে। একটা যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতা, স্মৃতির ভার কি অবলীলায় আমরা গিলে ফেলতে চাইছিলাম! রফিকুল ইসলামের নীরব প্রত্যাখ্যানের জন্য আমরা একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না।

রফিকুল ইসলামেরসাথেসাক্ষাতকারেরদিনটাতাই একাধিককারনেলম্বাসময়আমারস্মৃতিতে গেঁথে থাকবে। তিনি একজন ‘স্বনামধন্য’ আলোকচিত্রি যার কাছ থেকে ৬০, ৭০, ৮০র দশকের  চট্টগ্রাম শহরের দুষ্প্রাপ্য কিছু ছবি দেখতে পাব বলে আমরা আশা করেছিলাম। রফিকুল ইসলাম ছিলেন বি কে সামাদের পারিবারিক আলোকচিত্রি। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ভাইস চেয়ারম্যানের পারিবারিক আলোকচিত্রি খুবি স্বাভাবিকভাবে পারিবারিক মুহূর্তগুলোর সবচাইতে বৈধ এবং  গ্রহণযোগ্য সাক্ষী। তিনি বি কে সামাদের পরিবারের বিয়ের ছবি তুলেছেন। তিনিই সবচাইতে ভালো বলতে পারবেন চট্টগ্রাম শহরের কোন ব্যবসায়ী, কোন আমলা, কোন মন্ত্রী বি কে সামাদের ছেলের বিয়েতে হাজির ছিলেন। রফিকুল ইসলামই সবচাইতে ভালো জানবেন বি কে সামাদ কোন সভায় ফিতা কাটতে, কোন এলাকায় ত্রাণ দিতে কোন গোল টেবিলে হাজির থাকেন উদ্যক্তা সম্মেলন করতে। কেবল বি কে সামাদ না আমরা আশায় ছিলাম রফিকুল ইসলামের ছবি থেকে এক বিস্ময়কর চট্টগ্রাম আমরা আবিষ্কার করতে পারবো যা হয়তো সময়ের গর্ভে হারিয়ে গেছে। প্রথম দর্শনে শুটিং ক্লাবের বিবর্ণ, বিষণ্ণ পরিবেশে একজন ৮০ বছরের সাবেক আলোকচিত্রিকে দেখতে পেয়েছিলাম। তাকে আপাতদৃষ্টিতে সুস্থ-সচল মনে হয়। তার কোঁচকানো ধূসর শার্ট যা তার গায়ে হাস্যকরভাবে ঝুলছিল, তার বিবর্ণ অফিসটা ঠিক ঠিক বলে দিচ্ছিল সময় কাটানোটা এখন তার প্রধান সমস্যা। রফিকুল ইসলাম স্বল্পভাষী। একটা প্রশ্ন করার পর দু এক শব্দে উত্তর করে লাজুক হেসে তিনি মাটির দিকে তাকান। তারপর কয়েক সেকেন্ডের নীরবতা। কিন্তু অবচেতন মনে আমরা হয়তো একজন প্রত্যক্ষদর্শী ফটোসাংবাদিকের ক্ষিপ্রতা প্রত্যাশা করছিলাম। কয়েক সেকেন্ড নীরবতার পর তাকে নতুন নতুন প্রশ্ন করে যাচ্ছিলাম। প্রথম সাক্ষাৎকার শুরুর কিছু পরেই ভুল বুঝতে পারলাম। যে ক্ষিপ্রতায় তার কাছ থেকে নতুন তথ্য আবিষ্কারের আশায় ছিলাম মেথোডোলোজিকালি সেটা ভুল ছিল। প্রথম কিছু প্রশ্নের পরে মনে হোল দুটো প্রশ্নের মাঝখানের বিরতির সময় বাড়াতে হবে। বি কে সামাদ  সম্পর্কে, তার ছবি সম্পর্কে প্রশ্ন করার পর যে আশ্চর্য নীরবতা তিনি আমাদের উত্তর হিসেবে দিচ্ছিলেন তখনো তাকে বিস্মৃতি ভেবে নিচ্ছিলাম আমি। সবাই মিলে এদিক সেদিকের কিছু আলাপের পর বোঝা গেল বি কে সামাদ এবং তার নিজের কাজ সম্পর্কে জানতে চাইলেই তিনি আশ্চর্য এক নীরবতার আশ্রয় নিচ্ছেন। হীনমন্যতা কি?! কথায় কথায় জানালেন তার স্টুডিও ফটোহাট চট্টগ্রাম শহরে সেই সময়ে প্রথম স্টুডিও। বি কে সামাদ পরিবারের পারিবারিক আলোকচিত্রি তিনি। চিটাগং সিটি কোর্পোরেশনের ভাইস চেয়ারম্যান বি কে সামাদ, ব্যবসায়ী বি কে সামাদ, দানবীর বি কে সামাদ। প্রতিবার পারিবারিক, অফিশিয়াল অনুষ্ঠানের আগে রফিকুল ইসলামকে বাসা থেকে তার গাড়িতে তুলে নেয়ার কষ্টটুকু করতে হত বি কে সামাদকে। এই ঝক্কি এড়াতে একদিন হুট করে নিউ মার্কেটে দোকান বরাদ্দ দিলেন রফিকুল ইসলামের নামে, মুহুর্তের মধ্যেই জন্ম হোল ফটোহাটের। সত্যি কি বিস্মৃতি?! নাকি পৃষ্ঠপোষক পরিবারের কাছে নিজের পরিচয়টা নির্ভরশীল থাকার হীনমন্যতা?! আরো ভালো করে তাকাই রফিকুল ইসলামের দিকে। একটা ধাক্কা খেয়ে ভেতরে একদম দমে গেলাম। তার তর্জনীর প্রথম অংশ কাটা। ঠিক সেই অংশটা যেটা দিয়ে আলোকচিত্রিরা ক্যামেরার শাটার টেপেন, আঙুলের দাগ ধরে তার তর্জনীর সেই অংশটা নেই। আমি একবার খুব অসুখে পরেছিলাম। অনেকদিন স্বাভাবিক হাঁটাচলা করতে পারিনি। শারীরিক কষ্টের চাইতেও আমার জন্য বেদনাদায়ক ছিল ঐ আতংকটা যে সুস্থ না হতে পারলে আর হয়তো কোনদিন আমার ছবি তোলা হবেনা। আমার ভুল হতে পারে কিন্তু রফিকুল ইসলামের আশ্চর্য মৌনতার সাথে আমি একটা ট্রমার সম্পর্ক দেখতে পেলাম। কথায় কথায় আরও জানতে পারলাম ফটোহাটের এক অংশে এখন জামা কাপড়ের দোকান হয়েছে। উনি যে সময়ে আলোকচিত্রি ছিলেন সে সময়ের কথা অনুমান করতে পারি। আলোকচিত্রের ছাত্রী বলেই পারি। আলোকচিত্রকে আর্ট এবং একটা সন্মানজনক পেশা হিসেবে প্রমাণ করার যে বিপুল ভার আমি আজও বোধ করি তার পূর্বসূরি তিনি। নিজেকে আলোকচিত্রি হিসেবে পরিচয় দেয়ার সাথে যে সংকট জড়িত তা তিনি আমার থেকে আরো ভালো বোঝেন। তার সময় আমার চেয়ে বহুগুণ বৈরী ছিল। ভেতরে ভেতরে খানিকটা বিপন্ন বোধ করি আমি। আমার অনুমানগুলো যদি সত্যি হয় তাহলে তার জায়গায় আমি থাকলেও হয়তো এরকম মৌনতারই আশ্রয় নিতাম। ফটোহাটের এক অংশে যে তার ছেলেকে এখন কাপড়ের দোকান করতে হয়েছে তা একজন শিল্পী হিসেবে, আলোকচিত্রি হিসেবে আমি কখনোই মেনে নিতে পারতাম না। রফিকুল ইসলামের সাথে আমাদের প্রথম দিনের সাক্ষাতকার আশানরুপ হোল না। চার সদস্যের গবেষণার দলের সকলের সমস্ত চেষ্টা ব্যার্থ করে দিয়ে তিনি চুপ রইলেন। 

আরেকদিন তার সাথে কথা বলার জন্য সময় চেয়ে নিলাম। রাতে দিনের কাজ নিয়ে আলাপ করতে বসে নিজেদের কৌশলগত ভুলগুলো বুঝে নিলাম এবং রফিকুল ইসলামের সাথে পরবর্তী সাক্ষাৎকারের সময় সতর্কতা এবং ভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে বলে সিদ্ধান্ত নিলাম। 

মে, ২০১৭, দৈনিক আজাদী হেডলাইন করেছে “হুঁশিয়ার! মোড়া অ্যাইয়ের!” কোন প্রলয়ংকারি ঝড়ের দেখা পেলামনা কিন্তু বৃষ্টি ভেজা বিষণ্ণ চট্টগ্রাম ছোটবেলার বেলার মফস্বলের স্মৃতি মনে করিয়ে দিল। বৃষ্টি, পানি ভেঙ্গে যখন শুটিং ক্লাবে পউছালাম তখন গেট বন্ধ দেখে ভয় হচ্ছিল তিনি হয়তো আসেননি। কিন্তু দারোয়ান গেট খুলে দিলে রফিকুল ইসলামকে দেখা গেল। উৎসুকভাবে সব প্রশ্নের উত্তর না দিলেও উনি এই বৃষ্টি বাদলের দিনে সঠিক সময়ে, তার তোলা চট্টগ্রাম শহরের পুরানো একটা ছবি নিয়ে ঠিকি হাজির ছিলেন। উনি এত কষ্ট করে এসেছেন ভেবে খারাপ লাগলো, তাকে লিফট দিতে চাইলাম। প্রথমে আপত্তি করলেও পরে রাজি হলেন। তখন আমরা এক প্রকার মেনেই নিয়েছি ওনার কাছ থেকে কোন তথ্য আমরা পাবনা। কিন্তু আশা ও চেষ্টা কোনটাই ছাড়বনা পণ করেছিলাম। নিজেদের মধ্যেই বি কে সামাদের প্রতিষ্ঠান ওয়েবারস ট্রেডিং কোম্পানির আমদানি করা পণ্যগুলো নিয়ে কথা বলছিলাম। গাড়ির সামনের সিটে বসে উনি যে আমাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছেন আমরা তা লক্ষ্য করিনি। হঠাত করে উনি জানালেন উনি ওয়েবারস ট্রেডিং কোম্পানির সাথে ট্রেডিং করেছেন। গল্পের ঢঙেই কথা বলতে স্বস্তি বোধ করেন উনি বুঝলাম। তাই যে বিষয়টা জানতে আমরা পুরো টিম উদগ্রীব ছিলাম সেই প্রশ্নটাই করলাম।

“আপ্নিকি ওয়েবারস ট্রেডিং কোম্পানির জন্য প্রোডাক্ট ফটোগ্রাফি করেছেন?” 

“অবশ্যই… ওভাল্টিন, হরলিক্স… আরও কিছু নাম”  

“সেই ছবিগুলো কি পাওয়া যাবে বা দেখা যাবে?”

কোথায় আছে সেগুলো?!… (বোঝাতে চাইলেন খুঁজে পাওয়া যাবেনা হয়তো)

আমরা তখনো নিশ্চিত না তার সাথে র‍্যাপোর্ট বিল্ড করতে পারবো কিনা। মনে হচ্ছিল তার বাসার দোরগোড়া থেকেই বিদায় নিতে হবে, কিন্তু তবুও চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম একটা মানবিক সম্পর্ক তৈরি করতে। আর কিছু না হোক,তিনি যেন আমাদের সাথে কথা বলতে অন্তত স্বস্তি বোধ করেন। কথার একপর্যায়ে তিনি জানালেন তিনি আলোকচিত্র শুরু করেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের তৃতীয় বর্ষে থাকা কালীন। অর্থাৎ একজন হোয়াইট কলার প্রোফেশোনালের স্বস্তির জীবন তিনি নিতে পারতেন কিন্তু তিনি আলোকচিত্রের প্রতি ভালোবাসা বা নেশা যে কোন কারনেই হোক সেই তুলনামুলক নিরাপদ রাস্তাটা নিতে চাননি। আজকের দিনেও আমাদের দেশে একজন ডাক্তারের সাথে একজন আলোকচিত্রি বা শিল্পীর আর্থ-সামাজিক মর্জাদার তুলনা বোকামি তা তো সবাই বোঝে। কথার মাঝেই আমরা তার বাড়ি পৌঁছে গেলাম। পৌছাতেই তিনি বৃষ্টির ছাঁট বাঁচিয়ে দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির সদর দরজায় পৌঁছে গেলেন। হতচকিত হয়ে আমরা ধরে নিলাম ওটাই হয়তো তার বিদায়। ভালো করে বিদায় জানানোর জন্য আমরা গাড়ি থেকে নেমে তাকে অনুসরণ করলাম। তখন একেবারে অপ্রত্যাশিতভাবে তিনি আমাদের তার বাসায় যাওয়ার জন্য বললেন।                      

“তিনি সবুজ বৃক্ষ হইতে অগ্নি সৃষ্টি করিয়াছেন, তাহা দ্বারা তোমরা অধিক অগ্নি প্রজ্বলিত কর।” সুরা ইয়াসিন, ৮০ 

প্রথম সাক্ষাৎকারের সময় আমরা জানতে পেরেছি তার একটা ব্যক্তিগত আর্কাইভ আছে। আমাদের উৎসাহ ছিল যদি কোন উপায়ে সেটা খুঁজে আমরা বি কে সামাদ, চট্টগ্রাম, ওয়েবারস ট্রেডিং কোম্পানির প্রোডাক্ট ফটোগ্রাফির ছবি পাই সেটা হয়তো গবেষণার কাজে সহায়ক হতে পারে। প্রায় ঘণ্টা খানেক আলাপের মধ্যে দিয়ে তার সাথে র‍্যাপোর্ট তৈরির ছেলেমানুষি, পরিপক্ব চেষ্টার পর; বি কে সামাদকে নিয়ে করা গবেষণায় তিনি কিভাবে প্রাসঙ্গিক তা যথাসাধ্য ভেঙ্গে বলার পর তিনি তার নিজের ছবির পেপার কাটিংএর তিনটা বই আমাদের দেখতে দিলেন।  

রফিকুল ইসলাম তার বসার ঘরে সোফায় বসে আছেন। তার সামনের কাঠের পুরনো সেন্টার টেবিলে ভারী ভারী দুটা বড় স্ক্র্যাপ বুক রাখা। আমরা তার বিপরীত দিকে রাখা বড় সোফায় বসে পেপার কাটিংএর পাতা ওলটাচ্ছি। ধীরে ধীরে। বাইরে বৃষ্টি ধরে এসেছে বেশ আগেই। ঐদিন, ঐ মুহূর্তে ছবির বই দুটো হাতে পাওয়ার সাথে সাথে আমার মনে হল রফিকুল ইসলামের ছবির জগতে ঝাপ দিলাম। মাথার উপরে ধীরে ধীরে চক্কর কাটছে ফ্যানটা। সময়ের গতি কিভাবে যেন শ্লথ হয়ে এল। 

ট্র্যাডিশনাল জার্নালিস্টিক ছবিই বেশি দেখলাম। একটা ছবি আমার স্পষ্ট মনে আছে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের খালি ওয়ার্ডের ছবি। সাদাকালো ছবিটা বেশ ভালো লেগেছিল। বন্যা থেকে শুরু করে রাজনৈতিক সভা এমন কোন বিষয় নেই যার ছবি তিনি তোলেননি। এমন দিন ও গিয়েছে যে পুরো  সংবাদপত্রে যে কয়টা  ছবি আছে সবই তার তোলা। ছবি তোলার সাল, ঘটনা বাৎলে দিয়ে তিনি আমাদের সাহায্য করছেন। লোকটা সত্যিকার অর্থেই চাপা স্বভাবের, সাথে স্বল্পভাষী। বি কে সামাদ, ওয়েবারস ট্রেডিং কোম্পানি, চিটাগং খোঁজার তালে প্রায়ই ভুলে যাচ্ছিলাম তিনি দৃশ্যে সশরীরে উপস্থিত। পাতা ওল্টাতে ওলটাতে রফিকুল ইসলামের তোলা ৭০ দশকের চিটাগং সার্কিট হাউজের একটা অদ্ভুত একটা ছবি পেলাম। চিটাগং সার্কিট হাউজে আগুণ, ছবিতে দেখা যাচ্ছে ক্রিসমাস ট্রিয়ের মত দুটো গাছে আগুণ লেগেছে, সে আগুন ছড়িয়ে পরছে সার্কিট হাউজের চালে। আগুনের সাল, কারণটা জানতে চাইলাম। তিনি বললেন গ্রিষ্মের সময়ে গাছের সাথে গাছের ঘর্ষণে আগুন লেগেছে। স্বগতোক্তির মত যোগ করলেন “সুরা ইয়াসিনে আছে গাছের সাথে গাছের ঘর্ষণে আগুন লাগে!” কি অদ্ভুত সমাপতন! বি কে সামাদ সুরা ইয়াসিনের মাজেজায় গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন। তিনি নিজের পকেটের পয়সা খরচ করে এই সুরা ছাপিয়ে মানুষকে বিলি করতেন। বি কে সামাদের সাথে সুরা ইয়াসিনের সম্পর্ক, গাছের সাথে গাছের ঘর্ষণে সার্কিট হাউজে আগুন, সুরা ইয়াসিনে প্রকৃতির এই জ্বালাময়ী রূপের ইঙ্গিত! মুর্তজা তৌফিক যতটা চমকপ্রদ ছিলেন আমার জন্য ততটাই চমকপ্রদ ছিল তার এই স্বগতোক্তি! ধূসর হাফ শার্ট পরা, স্বল্পভাষী, লাজুক, ৮০ বছরের যে লোকটাকে আমার সামনে দেখতে পাচ্ছি তার কি আসলেও বিস্মৃতির সমস্যা আছে? সার্কিট হাউজের আগুনের ছবি দেখার সাথে সাথে তড়িৎ গতিতে যে সুরা ইয়াসিনের গাছের সাথে গাছের ঘর্ষণে আগুন লাগার গল্প মনে করতে পারেন তার কি বি কে সামাদের পারিবারিক অনুষ্ঠানের একটা ঘটনা, একটা মুহুর্তও মনে নেই? 

আমার আমাদের বোধ বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে নানান উপায়ে রফিকুল ইসলামের বয়ান উস্কে দেয়ার চেষ্টা করছিলাম। তিনি তার স্ত্রীকে ডাকার জন্য অন্দরে গেলে আমার সহকর্মী আমার সাথে পরামর্শ করলো যে আমি আলোকচিত্রির ছাত্রী হিসেবে যদি তার কাজ দেখতে আগ্রহ প্রকাশ করি, শিখতে চাই এমন ভঙ্গিতে তার সাথে আলাপ করি তাহলে হয়তো উনি কথা বলতে আগ্রহী হবেন। আমি ছোট্ট করে হুম দিলাম। রফিকুল ইসলামের সাথে সাক্ষাৎকারের পর থেকে আমার ভেতরে যা চলছিল তা ওকে অল্প কথায় বোঝানোর উপায় ছিলনা। আমি বুঝতে পেরেছি ওর কৌশল, আমি যথা সাধ্য চেষ্টাও করেছি আমার আগ্রহ দেখাতে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে অবশ করে দেয়া একটা কষ্ট বোধ করছিলাম। সৈয়দ মুজতবা আলীর একটা কথা আছেনা? গুরুদেব ও শান্তিনিকেতন লেখায়? “কবি, শিল্পী- স্রষ্টামাত্রই স্পর্শকাতর হয়ে থাকেন। এবং সেই কারনেই আর পাঁচজনের তুলনায় এ জীবনে তারা এমন সব বেদনা পান যার সঙ্গে আমাদের কোন পরিচয় নেই।” মনে মনে রফিকুল ইসলামের সেই অব্যক্ত বেদনার কথা ভাবছিলাম আমি। তার আশ্চর্য মৌনতা, বয়সের ভারে কোঁচকান চামড়া ভেদ করেও যে লাজুক হাসি দেখতে পাচ্ছিলাম, আমার মন বলছিল তার গভীর কোন তাৎপর্য আছে। নাকি আমি নিজের উপলব্ধি, অনুভূতিগুলো এই প্রবীণ আলোক চিত্রির উপর আরোপণ করছিলাম?! হতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশে ছবি দিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়া, শিল্পী হিসেবে পরিচিত হওয়া আলোকচিত্রীদের চকচকে উপস্থিতির পাশে রফিকুল ইসলামের বিষণ্ণ মৌনতা আর কোনভাবেই ব্যখ্যা করতে পারছিলাম না। এখনো পারিনা। 

ঐদিন রফিকুল ইসলামের বাসায় আমরা অনেকটা সময় পার করি। বহু অনুনয় বিননয় করার পর তিনি তার আর্কাইভ থেকে কিছু ছবি আমাদের দেখতে দেন। কাজের ছেলেটাকে দিয়ে তিনি অন্দরে তার স্ত্রীর কাছে একটা বিশেষ বাক্সের খোঁজে পাঠান। স্ত্রী বলে পাঠালেন তিনি ঐ ছবির বাক্সটা ফেলে দিয়েছেন। কাজের ছেলের মুখে এই কথা শুনে রফিকুল ইসলাম বললেন ‘ভালো করেছে!’ রফিকুল ইসলামের সাক্ষাতকার নিচ্ছি জানানোর পর আমরা কয়েকজনের মুখে শুনতে পাই তার ছেলে নাকি তার ছবি পুড়িয়ে ফেলেছে। এটা বেশ আগের ঘটনা। আমি অনুমানও করতে পারিনা একজন বাবার কাছে এই ঘটনাটা কতটা পীড়াদায়ক হতে পারে। ঐদিন আমরা তার ব্যক্তিগত আর্কাইভের এক বাক্স স্টুডিওতে তোলা পাসপোর্ট সাইজের ছবি দেখতে পাই। আরেক বাক্স ছিল কিছু টেস্ট প্রিন্টের। এই টেস্ট প্রিন্টের কিছু ছবি পেপার কাটিং এর বইতে দেখা ছবির পুনরাবৃত্তি। রফিকুল ইসলামের ব্যক্তিগত আর্কাইভের বাকি ছবি আমার আর দেখা হয়ে ওঠেনি। ঢাকা ফেরার পর আমাদের প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার এই অদ্ভুতুরে সাক্ষাতকারের কথা শোনের। তিনি রফিকুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করে তার ব্যক্তিগত আর্কাইভ থেকে ছবিগুলো প্রাতিষ্ঠানিক আর্কাইভে নিতে চান। যেন ছবিগুলো ভালোভাবে সংরক্ষিত হয়। জানতে পারি তিনি রাজি হয়েছেন। স্বস্তির একটা নিশ্বাস ফেলি। চট্টগ্রামে দ্বিতীয় দফায় তথ্য সংগ্রহে যাবার সময় ঘনিয়ে আসলো। জানতে পারলাম তিনি ছবি দেননি। তার সাথে আরেকবার সাক্ষাতকারের জন্য যোগাযোগ করলে জানান তিনি গ্রামের বাড়ি আছেন। সাথে বুঝিয়ে দিলেন এই যাত্রায় তার সাথে দেখা হবার সম্ভাবনা ক্ষীণ। এর আরও পরে আমি এই গবেষণার কাজে আর যুক্ত থাকিনি। জানিনা রফিকুল ইসলামের ছবির, তার স্মৃতির কেউ কোন হদিস করতে পেরেছে কিনা। জানতে চাইও না। এই অতি সাধারন, বিনয়ী, লাজুক স্বভাবের লোকটা প্রথম যৌবন পার করেন আলোকচিত্রের ক্রাফট টা হস্তগত করতে, বার্ধ্যক্যে সেই অর্জন আগুনে জ্বালিয়ে দেন ছেলে। শেষ বয়সে তার স্মৃতিগুলো, একটা যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতাগুলোও ‘কাজে লাগাতে’ আসি আমরা! যেন কোন সেভিয়ার! এই গোটা গবেষণায় সবচাইতে কম কথা বলা লোকটা, মাটির দিকে তাকিয়ে লাজুক হাসা লোকটা নীরব স্পর্ধায় আমাকে শিখিয়ে গেলেন কাজের মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ একটা সমাজকে কিভাবে প্রত্যাখ্যান করতে হয়।                             

Leave a Reply