আমাদের যাদের জন্ম ষাটের দশকে এবং কৈশোর কেটেছে সত্তরের দশকে এবং যাদের সামান্য বই পড়ার অভ্যাস ছিল তাদের কাছে আলী ইমাম খুব পরিচিত নাম। তিনি যেমন ছোটদের পত্রপত্রিকায় প্রচুর লিখতেন, তেমনি অনুষ্ঠান করতেন টিভি-বেতারে। বইয়ের সঙ্গে ছিল তার ভালোবাসা। বই ও পত্রিকা ছিল তার কাছে অসীম আনন্দের আধার। আমার সঙ্গে যে সময় তার চাক্ষুষ পরিচয় হয় তখনই আমি তার বাড়িতে বইয়ের ব্যক্তিগত সংগ্রহ দেখে উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠেছিলাম। তার প্রথম ছোটদের গল্পের বই ‘দ্বীপের নাম মধুবুনিয়া’ বেরিয়েছিল ১৯৭৫ সালে, তখনকার রুচিশীল প্রকাশনা বর্ণমিছিল থেকে। আমি অবশ্য প্রথম পড়ি ১৯৭৮ সালে ‘কিশোর বাংলা’য় প্রকাশিত উপন্যাস ‘অপারেশন কাঁকনপুর’। বই হয়ে প্রকাশ হয় ১৯৭৯ সালে। বাংলা একাডেমির ‘ধানশালিকের দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশ হয় ঢাকার মসলিন তৈরির পটভূমির উপন্যাস ‘তিরিমুখীর চৈতা’। কাছাকাছি সময়েই একে একে বের হয় ছোটদের গল্প-সংকলন ‘শাদা পরী’ ও ‘চারজনে’, ‘সোনার তশতরী’, ‘নীল নেশা’, ‘আলোর ফুল’, ‘সবুজ বাড়ির কালো তিতির’ এবং ‘প্রবাল দ্বীপের আতঙ্ক’, ‘নীল শয়তান’, ‘রক্তমাখা পুঁথি’, ‘বাদাবনে লড়াই’, ‘পিশাচের ছায়া’, ‘ভয়াল ভয়ঙ্কর’, ‘জাফলঙ্গের বিভীষিকা’, ‘জীবনের জন্য’।
আলী ইমামের ছোটদের গল্প-উপন্যাসগুলোর সম্পদ হচ্ছে অনুভূতিময় ভাষা। তার সে সময়কার বইগুলোতে আমরা পেতাম দেশপ্রেম, ইতিহাসের গৌরব ও বঞ্চনার কাহিনি এবং প্রকৃতির স্পর্শমাখা রহস্যময়তা।
কেবল গল্প-উপন্যাসই নয়, পাশাপাশি তিনি কিশোরদের জন্য লিখেছেন সিনেমার নানা দিক নিয়ে। ছোটদের সাপ্তাহিক ‘কিশোর বাংলা’য় ধারাবাহিকভাবে তিনি লিখতেন ‘রুপালী ফিতে’ নামে একটি রচনা। একসময় ‘মন্তাজ’ নামে একটা সিনে ক্লাব গড়ে তোলায় তার অংশগ্রহণ ছিল। চলচ্চিত্র-সংসদ আন্দোলনের সঙ্গেও ছিলেন। বিখ্যাত সতীশ বাহাদুরের কাছে ভারতীয় দূতাবাস আয়োজিত চলচ্চিত্রবিষয়ক কর্মশালায় হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ নেন। সেই কোর্সে উজ্জ্বল ফলাফল ছিল আলী ইমামের। পরে সিনেমার স্ক্রিপ্টও লিখেছেন তিনি। জনপ্রিয় সিনেমা ‘এপার ওপারে’র চিত্রনাট্য তার লেখা। তার রায়বাড়ির ওপর তার অনুরাগ কতটা গভীর ছিল তার পরিচয় আমরা ব্যক্তিগতভাবে পেয়েছি। বিশেষ করে সত্যজিৎ রায়ের অসম্ভব ভক্ত ছিলেন তিনি। জীবনভর তিনি সত্যজিৎ চর্চা করেছেন। ‘রুপালী ফিতে’ বইটা বাংলাদেশ শিল্পকলা অ্যাকাডেমি থেকে বের হয় ১৯৭৯ সালে। বাংলাদেশে তো বটেই, বাংলা ভাষাতেই তখন পর্যন্ত সিনেমা নিয়ে বেশি বই বের হয়নি।
কিশোর উপযোগী সুকুমার রায়ের জীবনী ‘খেয়াল খুশির রাজা’, ‘আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের জীবনী ‘ধূসর পুঁথি’, ‘উপেন্দ্রকিশোরের জীবনী’, ‘ভোরের পাখি উপেন্দ্রকিশোর’ এবং রূপকথা, উপকথা ও লোককাহিনির বই ‘জাদুর তুলি’ বইগুলো চিনিয়ে দেয় তার স্বকীয়তা। ছোটদের জন্য জীবনী খুব বেশি না লিখলেও যে কয়টি লিখেছেন সবই ছোটদের মনকে জাগিয়ে তোলার প্রেরণা দেয়। লিখেছেন বাংলাদেশের ইতিহাস সম্পর্কিত বই ‘বাংলা নামে দেশ’।
পাখি বিষয়ে ‘পাখিদের নিয়ে’, ‘পাখির জগৎ’, ‘পাখি আর পাখি’ বইগুলো যখন লেখেন তখনও বাংলাদেশে বাংলা ভাষায় পাখি বিষয়ে তেমন লেখালেখি হতো না। এই ধরনের বইয়ের প্রতি আলী ইমামই আমাদের আগ্রহী করে তুলেছিলেন।
গদ্যের বই এত লিখেছেন যে টেরই পাওয়া যায় না কিশোর কবিতার বইও আছে কয়েকটা। এগুলোও বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত রচনা। প্রচলিত ছন্দ ও বাংলার প্রকৃতি ও লোকায়ত আবহে প্রাণিত কিশোর-কবিতাগুলোও আলী ইমামীয় বৈশিষ্ট্যে মণ্ডিত। কিশোর কবিতার বইগুলোর নামের মধ্যেও এই বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। তার কিশোর-কবিতার বইগুলো হচ্ছে, ‘ধলপহর’, ‘হিজল কাঠের নাও’, ‘তোমাদের জন্যে’, ‘সবুজ খাতা’।
ইতিহাস-ঐতিহ্য, বিজ্ঞান সম্পর্কে ছোটদের কাছে তিনি তুলে ধরতে চাইতেন। ‘বাংলাদেশের কথা’, ‘সোনালী তোরণ’, ‘আলোয় ভুবন ভরা’, ‘দুঃসাহসী অভিযাত্রী’, ‘প্রিয়-প্রসঙ্গ’, ‘বুনোহাঁসের পালক’, ‘সেসুলয়েডের পাঁচালী’, ‘কাছের পাহাড় দূরের পর্বত’, ‘সাগর থেকে সাগরে’, ‘বিদেশি পর্যটকদের চোখে বাংলাদেশ’, ‘দূরের দ্বীপ কাছের দ্বীপ’, ‘প্রাচীন বাংলা বৌদ্ধ বিহার’, ‘বাঙলা নামে দেশ’, ‘ডানা মেলার দিন’, ‘দেখোরে নয়ন মেলে’। লিখেছেন ‘ভ্রমণ কাহিনি : কাছে থেকে দূরে’। আলী ইমাম বই লিখেছেন প্রায় ৬০০টি। আমরা এখানে মাত্র কয়েকটি বইয়ের নাম উল্লেখ করতে পারলাম।
কর্মজীবনে আলী ইমাম ছিলেন টেলিভিশনের মানুষ। ছোটদের জন্য বই লেখা ছিল তার সবচেয়ে প্রিয় বিষয়। ছোটদের সংগঠন কচিকাঁচার মেলা, চাঁদের হাটের সঙ্গে তিনি ওতপ্রোত জড়িত ছিলেন। শিক্ষা ও সংস্কৃতিধর্মী বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বই পড়া কর্মসূচির ছেলেমেয়েদের প্রাণিত করতে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের আমন্ত্রণে প্রায়ই বিভিন্ন স্কুলে যেতেন বক্তৃতা দিতে। এ ছাড়াও তিনি যুক্ত ছিলেন শিশুসাহিত্য কেন্দ্র, ঢাকা নগর জাদুঘর, গণহত্যা জাদুঘসহ নানা সংগঠনের সঙ্গে। আলী ইমাম ছিলেন সদাচঞ্চল ও প্রাণবন্ত একজন মানুষ। সারাক্ষণ কর্মে ব্যাপৃত থাকতে ভালোবাসতেন। তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বাংলা শিশুসাহিত্য তার একজন অতিপ্রজ লেখককে হারাল।
শিশুসাহিত্যিক হিসেবে এবং টিভির অনুষ্ঠান নির্মাতা হিসেবে বাঙালি সংস্কৃতির আত্মাকে তিনি অনুভব করতেন। এ ক্ষেত্রে তার সত্তা মননের চেয়ে বেশি ইন্দ্রিয়জ অধিগ্রহণের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছে। তার জীবনের সব পরিচয় ছাপিয়ে শিশুসাহিত্যিকের পরিচয়টাই হয়ে উঠেছে সবচেয়ে বড়। আমাদের কাছে তিনি সবচেয়ে বেশি স্মরণীয় তিনি ছোটদের লেখক বলে। আমাদের প্রজন্মের শিশুসাহিত্যিকদের অনেকেই তার কাছ থেকে কোনো না কোনোভাবে উপকৃত হয়েছেন।
প্রথম প্রকাশ: সময়ের আলো, ২৫ নভেম্বর, ২০২২। দেখুন, বইপাগল শিশুসাহিত্যিক আলী ইমাম (shomoyeralo.com)