বগুড়ার শিবগঞ্জে (বৃহস্পতিবার ২৬ নভেম্বর) মসজিদের অভ্যন্তরে হামলা চালিয়ে হত্যার ঘটনাকে আমার ‘আরো একটি হামলার ঘটনা,’ কিংবা ‘আরো একটি হত্যাকান্ড’ বলে বিবেচনা করতে পারি। সরকারী ভাষ্যের মতো করে, যা শুধু বর্তমান সরকারই নয় অতীতের আরো অনেক সরকার এমনকি পাকিস্তানী উপনিবেশিক সরকারের ক্ষেত্রেও সমপরিমাণে সত্য, একে আমরা আরেকটি ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ বলে বিবেচনা করতে পারি। এটি যে একটি মর্মান্তিক ঘটনা এই বিষয়ে কোনো রকম ভিন্নমতের অবকাশ নেই, নিহত মুয়াজ্জিন মোয়াজ্জেম হোসেনের পরিবার-পরিজনের প্রতি আমাদের গভীর সহানুভূতি। কিন্ত এই হামলার ঘটনার পরিসর আপাতদৃষ্টে সীমিত হলেও এই হামলা ও হত্যাকাণ্ড গভীর তাৎপর্যপূর্ন। এই তাৎপর্য এই কারনে যে হামলা পরিকল্পিত, এই হামলা ঘটেছে মসজিদের অভ্যন্তরে এবং নামাজ পড়া অবস্থায় মুসল্লিরা আক্রান্ত হয়েছেন। এই মসজিদটি শিয়া সম্প্রদায়ের অনুসারীদের। ঢাকায় ২৩ অক্টোবর তাজিয়া মিছিলের প্রস্ততির সময়ে হোসেনি দালানে গ্রেনেড হামলার আগে শিয়া সম্প্রদায়ের ওপরে পরিকল্পিত হামলার ঘটনা বাংলাদেশে ঘটেনি। এই দুই ঘটনা প্রমান করে যে এই হামলা ও হত্যার ঘটনাগুল সেক্যুলার লেখক ও প্রকাশক হত্যা ও হত্যার হুমকি প্রদান, ইসলামী চিন্তাবিদদের হত্যা, খৃষ্টান পাদ্রীর ওপরে হামলা ও হুমকি এবং বিদেশী নাগরিক হত্যার ঘটনার ধারা বা প্যাটার্নের মধ্যে পড়ে। একটি প্যাটার্নের উপস্থিতি মানেই হল যে এগুলো বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়।
বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপরে হামলা, তাঁদের সম্পত্তি দখল, ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদের ঘটনা এখন অহরহই ঘটে। দেশের হিন্দু জনগোষ্ঠী এই অবস্থার মধ্যে কয়েক দশক ধরেই জীবন যাপন করছেন। কয়েক দশক আগে অবস্থা ছিলো এই যে, বড় বড় জাতীয় ঘটনার আড়ালে রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের জন্যে, শক্তি প্রদর্শনের জন্যে, ক্ষমতাসীন দল ও রাষ্ট্রের আনুকূল্যে এই সব ঘটনা ঘটতো; এই নিয়ে গণমাধ্যমে বিস্তর আলোচনা হতো। আমরা ২০০১ সালের নির্বাচনের পরে সংঘটিত অত্যাচারের ঘটনাবলি বিস্মৃত হইনি; ক্ষমতাসীন বিএনপি-জামাতের জোট কর্মিরা ত্রাসের রাজত্ব তৈরি করেছিলো। কিন্ত ২০০৮ সালের পর থেকে এই ধরণের ‘বিচ্ছিন্ন’ ‘বিক্ষিপ্ত’ ঘটনা প্রতিদিনের বিষয়ে পরিণত হয়েছে, এই নিয়ে প্রতিবাদের কন্ঠস্বর ক্ষীণতর হয়েছে, গণমাধ্যমে তার খবর সীমিত মাত্র। ক্ষমতাসীনদের আনুকূল্য ছাড়া এই ধরণের ঘটনা ঘটছে এমন মনে করার কারন নেই, ফলে তারাই এই সব ঘটনার সুবিধাভোগী। একই ভাবে দেশের বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী, যাদের এক বড় অংশ থাকেন পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায়, বিভিন্নভাবে আক্রান্ত হন, বৌদ্ধ উপসনালয়ে হামলা ঘটে এবং তা নিয়ে আলোচনা হয়, কিন্ত এর বেশি কিছু নয় যতক্ষন না আমরা আরেক ঘটনার মধ্য দিয়ে এই বৃত্তচক্রে সামিল হই।
শিয়া সম্প্রদায়ের ওপরে হামলার ঘটনাগুলোকে আমরা দেশে ‘সংখ্যালঘু’ জনগোষ্ঠীর সদস্যদের ওপরে হামলার অংশ বলে বিবেচনা করতে পারি। কেননা শিয়া সম্প্রদায়ের সদস্যরা সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠীর সদস্য হলেও ধর্মীয় সম্প্রদায়গত বিবেচনায় তাঁরা সংখ্যালঘু। সুন্নি সম্প্রদায়ের কেউ কেউ শিয়াদের ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মীয় আচরণ বিষয়ে প্রশ্ন তোলেন এবং তাঁদের ইসলাম থেকে বাতিল করে দেয়ার মত সমর্থন করেন। একই বিবেচনায় দেশের আহমাদিয়া সম্প্রদায়ের সদস্যরাও সংখ্যালঘু। বাংলাদেশে আহমাদিয়া সম্প্রদায়ের সূচনা হয় ১৯১২ সালে ব্রাক্ষনবাড়িয়াতে আহমাদিয়া মুসলিম জামাত প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। সেই থেকেই আহমাদিয়াদের বিরুদ্ধে প্রচারনা চালু রয়েছে। ১৯১৪ সালে ব্রাক্ষনবাড়িয়ায় দেওবন্দ ধারা অনুসারিরা জামিয়া ইউনুসিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন, এই মাদ্রাসার প্রধান উদ্দেশ্যই হচ্ছে আহমাদিয়া সম্প্রদায়ের মতের প্রসার বন্ধ করা। ২০১৩ সালে হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা দাবি যারা পাঠ করেছেন তাঁরা জানেন যে এতে আহমাদিয়াদের অমুসলিম ঘোষণার দাবি করা হয়েছিলো। হেফাজতের বিরুদ্ধে যে সংগঠন আমাদের মনোযোগ আকর্ষন করে সেই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের পক্ষ থেকে যে দাবিদাওয়া তোলা হয়েছিলো তাতেও এই দাবি ছিলো। জামাতে ইসলামীর নেতা এবং যুদ্ধাপরাধী হিসেবে সাজাপ্রাপ্ত দেলওয়ার হোসেন সাঈদি ২০০৩ সালে এই বিষয়ে একটি পুস্তিকা লিখে উত্তেজনার সৃষ্টির চেষ্টা করেন। ক্ষমতাসীন দলের অনুসারী বা সহযোগী সংগঠন ওলামা লীগের দুই অংশই আহমাদিয়াদের অমুসলিম ঘোষণার দাবি করে আসছে। আহমাদিয়ারা ১৯৯০-এর দশক থেকেই বিভিন্ন রকম হামলা ও নিপীড়নের শিকার হয়েছে, তাঁদের প্রকাশনা নিষিদ্ধ ঘোষনা করা হয়েছে। ১৯৯৯ সালের ৮ অক্টোবর খুলনায় জুমার নামাজের সময় এক বোমা বিস্ফোরনে নিহত হন ৭ জন। পাকিস্তানভিত্তিক খতমে নবুওত আন্দোলনের প্রভাব বাংলাদেশে বিস্তার লাভ করার পর থেকে আহমাদিয়ারা বিভিন্নভাবে আক্রান্ত হয়েছেন। ২০০৩ সালে ৩১ অক্টোবর যশোরের ঝিকরগাছায় আহমাদিয়া সম্প্রদায়ের একজন ইমাম মোহাম্মদ শাহ আলমকে আক্রমণ চালিয়ে হত্যা করা হয় (এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা দেখুন আমার গ্রন্থ ইসলামিক মিলিট্যান্সি ইন বাংলাদেশঃ এ কমপ্লেক্স ওয়েব, লন্ডনঃ রাটলেজ, ২০০৮, পৃ ৩৫-৩৬)। লক্ষ্যনীয় আহমাদিয়াদের ওপরে এই ধরণের হামলা স্বত্বেও শিয়া সম্প্রদায়ের সদস্যদের ওপরে হামলার ঘটনা ঘটেনি।
শিয়া সম্প্রদায়ের সদস্যদের ওপরে হামলার যে সব ঘটনা সেগুলোকে একাদিক্রমে সাধারনভাবে সংখ্যালঘুদের ওপরে হামলার এবং সংখ্যাগুরু ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের মধ্যেকার সম্প্রদায়গত বিভাজনের প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করতে হবে। বাংলাদেশে ধর্মীয় সম্প্রদায়গত সহিংসতার একটি ধারা যে একেবারেই ছিল না তা নয়, আহমাদিয়াদের ব্যাপারে অসহিষ্ণুতা ও প্রচার তার প্রমান। কিন্ত শিয়া সম্প্রদায়ের ওপরে উপুর্যপুরি হামলা প্রমাণ করেছে যে এখন এই বিভাজনকে সামনে নিয়ে আসার চেষ্টা হচ্ছে। কিন্ত এই হামলাগুলোকে কেবল এইভাবে বিবেচনা করলে তার সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপট, বিশেষত এই হামলা ও হত্যাকাণ্ডগুলোর অধিকতর উদ্বেগের দিকটি আমাদের বিবেচনার বাইরে থেকে যাবে।
সেই বৃহত্তর প্রেক্ষাপট হচ্ছে দেশে জঙ্গিবাদের বিস্তার, জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর শক্তি সঞ্চয়, আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আইসিসের উপস্থিতির দাবি এবং দেশের অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি। একথা বলার অপেক্ষা রাখেনা যে দেশে জঙ্গী গোষ্ঠীগুলো কয়েক দশক ধরেই উপস্থিত, তাঁদের আঞ্চলিক যোগাযোগও অতীতেই সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে। কিন্ত দেশে আইসিস বা ইসলামিক ষ্টেটের উপস্থিতি বিষয় নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে দেয়া বক্তব্য বিভ্রান্তি তৈরি করেছে। গত কয়েক সপ্তাহের ঘটনাবলী এই বিষয়ে অবস্থার এক ধরণের পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। কয়েক মাস আগেও সাংঠনিকভাবে আইসিসের উপস্থিতি যতটা নিশ্চিতভাবে নাকচ করে দেয়া সম্ভব হতো এখন তা সম্ভব নয় বলেই মনে হচ্ছে। আইসিস বা ইস্লামীক স্টেট তার কৌশল পরিবর্তন করেছে যা সাম্প্রতিক বৈশ্বিক ঘটনাগুলোতে স্পষ্ট। আইসিসের সাম্প্রতিক প্রকাশনা ‘দাবিক’-এ বাংলাদেশ বিষয়ে প্রকাশিত নিবন্ধে এটা দাবি করা হয়েছে যে বাংলাদেশের জঙ্গী গোষ্ঠীগুলো তাঁদের অভ্যন্তরীণ মতপার্থক্য আপাতত হলেও মেটাতে পেরেছে, শুধু তাই নয় তাঁরা নিজেদের মধ্য থেকে নেতা নির্বাচন করতেও সক্ষম হয়েছে। সর্বোপরি এই রচনায় বলা হচ্ছে বাংলাদেশের জঙ্গীরাই যে আইসিসের আহবানে সাড়া দিয়ে এগিয়ে এসেছে এবং ‘দ্রুততার সঙ্গে’ আইসিসের ডাকে সাড়া দিয়ে ‘সামরিক অভিযানগুলো’ চালাচ্ছে। নিঃসন্দেহে আমরা এগুলোর আত্মপ্রচার বা প্রোপাগান্ডার দিক বিবেচনায় রাখবো। কিন্ত আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আইসিসের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও সংগঠনের উপস্থিতির বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয় যখন আমরা এই ধরণের হামলা দেখতে পাই যা বাংলাদেশে অতীতে জঙ্গি সংগঠনগুলোর যে আক্রমণের ধারা তা থেকে ভিন্ন। শুধু তাই নয় খৃষ্টান ধর্মযাজকদেরও আক্রমণের লক্ষ্যবস্ত হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশে আইসিসের উপস্থিতির বিষয়ে ভারতের পক্ষ থেকে এ বছরের মে মাস থেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করে বলা হয়েছিলো যে ইসলামিক ষ্টেটের প্রতিনিধি চট্টগ্রামে জেএমবি’র নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছে। কিন্ত দুজন বিদেশি নাগরিক হত্যার ঘটনার পর ভারতীয় গণমাধ্যমে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে উদ্ধৃত করে এর জন্যে ইসলামিক স্টেট নয়, জামায়াতে ইসলামী দায়ী বলে বলা হয়। ভারতীয় সংবাদপত্র দ্য হিন্দুতে ২৫ নভেম্বর প্রকাশিত এক খবরে বলা হচ্ছে যে জাপানি নাগরিকের হত্যাকারী আইএসের সঙ্গে যুক্ত দুজন ভারতে পালিয়ে গেছে এবং তাদের বিষয়ে বাংলাদেশ ভারতকে তথ্য দিয়েছে এবং ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তাদের অনুসরণ করছে। বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অবশ্য দ্য হিন্দুকে এ ধরনের কোনো তথ্য দেওয়ার কথা অস্বীকার করেছেন। সম্প্রতি নদীয়া এবং মুর্শিদাবাদে ইসলামিক স্টেটের পোস্টার পাওয়া বিষয়ে ভারতীয় গোয়েন্দাদের তথ্যে আস্থা রাখলে এই বিষয়ে বাংলদেশ সরকারের অস্বীকারের প্রবণতাকে সন্দেহের চোখেই দেখতে হবে। একই সঙ্গে এটাও বিস্ময়ের উদ্রেক করে যে, এই সপ্তাহে ঢাকার এক আদালতে এক মামলা শুরু হয়েছে যেখানে অভিযুক্তদের আইএসের সদসস্য বলে বলা হচ্ছে এবং তাঁদের একজনকে ‘আইএসের সমন্বয়কারী’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে।
এই পরিস্থিতির আরেকটি প্রেক্ষাপট হচ্ছে দেশে বিরাজমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা। অনেকেই বলবেন যে দেশে যেখানে কার্যত কোন বিরোধী দল উপস্থিত নেই এবং সর্বত্রই ক্ষমতাসীনদের দলের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠিত সেখানে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার প্রশ্ন উঠছে কেন। উঠছে কেননা এখন দেশে কার্যত রাজনীতিই অনুপস্থিত হয়ে গেছে। রাজনীতির অনুপস্থিতি, মৌলিক অধিকারগুলো ক্রমাগত সংকুচিত হওয়া, মত প্রকাশের ক্ষেত্রগুলো সীমিত হওয়া, আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের উপস্থিতি এই সবই এই ধরণের জঙ্গীবাদ বিকাশের পথে অবদান রাখছে। মনে রাখতে হবে যে এই ঘটনাবলি ঘটছে এমন সময়ে যখন বৈশ্বিকভাবে উত্তেজনা তুঙ্গে এবং আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো তাঁদের পভাবের পরিধি বাড়াতে চাইছে। দেশের অস্থিতিশীল রাজনীতির সুযোগে উগ্র সহিংস চরমপন্থার বিস্তার একবার শুরু হলে তার রাশ টেনে ধরা সম্ভব হয় না। জাতীয় স্বার্থের বিবেচনায় জাতীয় নিরাপত্তা, সহিংস চরমপন্থা মোকাবেলা এবং তাঁর অনুকূল রাজনৈতিক পরিস্থিতির অবসানের জন্যে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টার বিকল্প নেই। তা জন্যে উদযোগ আসতে হবে ক্ষমতাসীনদের কাছ থেকেই, কিন্ত তাঁরা এই বিষয়ে কতটা আগ্রহী সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ।
প্রথম আলো’তে প্রকাশিত, ২৮ নভেম্বর ২০১৫