বাংলাদেশের রাজনীতিতে গত কয়েক মাসে চমকপ্রদ পরিবর্তন এসেছে। নানারকম চড়াই উৎরাই পার হয়ে তৈরি হয়েছে ঐক্যফ্রন্ট। বিএনপি এখানে সবচেয়ে বড় দল হলেও নেতৃত্বে এসেছেন এমন কিছু মুখ যা নানা আলোচনার জন্ম দিয়েছে। অপরদিকে সরকারে থাকা আওয়ামী লীগ তাদের জোট কে আরো সমৃদ্ধ করতে গাঁটছড়া বেঁধেছে হেফাজতে ইসলামের মত কট্টর ধর্মভিত্তিক সংগঠনের সাথে। এই দুই জোট গঠন কি বাংলাদেশের ভবিষ্যত রাজনীতিতে কোন পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে?
আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুটোই মূলত: মধ্যপন্থী দল। ভোটের রাজনীতি ও আন্দোলনের মাঠে ফায়দা নেবার জন্য তারা বিভিন্ন সময়ে একদিকে যেমন ধর্মভিত্তিক দলগুলোর সাথে জোট করেছে, অন্যদিকে বামপন্থি দলগুলোর সাথেও সুসম্পর্ক বজায় রেখেছে। দুই দলের জন্যই মুখ্য বিষয় হচ্ছে নির্বাচনে জয়ী হওয়া, আদর্শগত রাজনীতি নয়। গত এক দশকে আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সাফল্যের সাথে নিজেদের বয়ানে (ন্যারেটিভে) যুক্ত করতে সক্ষম হয়েছে। তাই মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত যেকোন বিষয়ে তাদের একাধিপত্য একটি মহাবয়ানের (গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ) জন্ম দিয়েছে। এই মহাবয়ানের বাইরে যে কেউ অবস্থান নিলে, তাদের মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধী বলে অভিহত করার নজির আমরা দেখেছি। এমনকি মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশ নেয়া অথবা মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে যথেষ্ট অবদান রাখা মানুষদেরও এই মহাবয়ানের বাইরে গেলে নিগৃহিত হবার নজির রয়েছে। নি:সন্দেহে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে আওয়ামীলীগের আধিপত্য ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ফলে সুশীল সমাজ, বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে দলটির শক্ত অবস্থান তৈরি হয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে সামঞ্জস্য রেখে আওয়ামী লীগ তাদের বয়ানে এতদিন পর্যন্ত নিজেদের সেক্যুলারিজমের চ্যাম্পিয়ন হিসেবে দেখিয়ে এসেছে। তীব্র সন্ত্রাসবাদ বিরোধী দল হিসেবে তুলে ধরেছে। মিত্র দেশগুলো, বিশেষ করে ভারত আওয়ামী লীগকে এ বয়ানের জন্যই মূলত গত নির্বাচনেও সুষ্পষ্ট সমর্থন দিয়েছে। কিন্তু হেফাজতে ইসলামের সাথে সুসম্পর্ক তৈরিতে আওয়ামীলীগের আপ্রাণ চেষ্টা দলটির ‘সেক্যুলার’ বয়ানের ক্যানভাসে একটি জ্বলজ্বলে কালো দাগ দিয়ে দেয়। হেফাজত ছাড়াও তাদের নির্বাচনী জোটে কট্টর ধর্মভিত্তিক দলের সংখ্যা কিন্তু কম নয়। এসব দলের মধ্যে অন্যতম ইসলামী ঐক্যজোট, বাংলাদেশ ইসলামী ঐক্যজোট, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস ও তরিকত ফেডারেশন।
অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামের সাথে গাঁটছড়া বেধে অতীতে বিএনপির ভোটের রাজনীতিতে কিছু লাভ হয়েছে, আন্দোলনে শক্তিশালি অবস্থান তৈরি করতে পেরেছে। কিন্তু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বিএনপি ক্ষতির সম্মুখিন হয়। এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে নির্বাচন এবং আন্দোলন ছাড়া আর কোথায় ক্ষতি হওয়ার জায়গা কোথায়? জায়গা রয়েছে। এ প্রসঙ্গে দার্শনিক প্লেটোর একটি চমৎকার উদ্ধতি উল্লেখ করা যায়- ‘দোজ হু টেল দে স্টোরিজ রুল সোসাইটি’ অর্থাৎ ‘যারা গল্প বলে তারাই সমাজ শাসন করে’। এখানে প্লেটো গল্প বলতে বুঝিয়েছেন বয়ানকে, মানে যারা একটি দেশের বক্তব্য ঠিক করেন, পরিচিতি নির্ধারণ করেন, আদর্শিক পথ দেখান। দু:খের বিষয় হচ্ছে বিএনপি তার সাম্প্রতিক রাজনীতিতে কোন সঠিক বয়ান নির্মাণ করতে পারেনি, তাদের বয়ান মূলত ‘আওয়ামী-লীগ’ বিরোধীতার উপর নির্ভরশীল। নিজস্ব বয়ান না থাকার কারণে আওয়ামী ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ ও ‘উন্নয়ন’ বয়ানের বিপরীতে বিএনপিকে ক্রমশ: দূর্বল হতে হয়েছে। অথচ বিএনপিতে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা কম নয়। এমনকি অনেকেই বলেন এ সংখ্যা বিএনপিতে আওয়ামীলীগের চাইতেও বেশি। জামায়াতের সাথে সখ্যতার ফলে বিএনপি ‘মুক্তিযুদ্ধ’ বয়ানের উপর নিজেদের দাবি কখনোই জোরালো ভাবে তুলে ধরতে পারেনি। বরং তাদের প্রতিষ্ঠাতা একজন খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা হওয়া সত্ত্বেও দলটিকে ‘যুদ্ধাপরাধী-সহযোগি’ হিসেবে আওয়ামী লীগ প্রায় প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছে। আওয়ামী লীগের এই ‘সাফল্যের’ পেছনে যেমন বিএনপির জামায়াত-ঘনিষ্টতা দায়ী, তেমনি বিএনপির নিজের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সফল বয়ানের অনুপস্থিতিও দায়ী। বিএনপিপন্থি বুদ্ধিজীবিদের দুর্বল অবস্থান আওয়ামী লীগের সাথে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর সখ্যতার বিষয়টি তুলে ধরতে এখন পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছে। সেইসাথে আওয়ামী লীগের ‘উন্নয়ন-বয়ান’ দলটির স্বেচ্ছাচারিতাকেও বৈধতা দিয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে গত কয়েক মাসে বিএনপি ঐক্যফ্রন্টে যোগ দিয়েছে। বিষয়টি চমকপ্রদ কারণ বিএনপি তাদের ভোটের রাজনীতির সংখ্যাতত্বের চেয়ে ‘গল্প-বলিয়ে’ বা বয়ান তৈরিকে এবার বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। ঐক্যফ্রন্টের মূল নেতারা, যেমন ড. কামাল হোসেন, মইনুল হোসেন, জাফরুল্লাহ, আ স ম আব্দুর রব, বা মান্না, কেউই নির্বাচনে খুব বেশি ভোট বিএনপিকে উপহার দিতে পারবেন না। কিন্তু একটি ‘বয়ান’ তৈরি করতে তারা পারদর্শী। এদিকে জামায়াতে ইসলামির রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধন বাতিল বিএনপিকে একটি কৌশলগত সুবিধা দিয়েছে। কারণ আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপিকে তার কট্টর ডানপন্থি মিত্রের সাথে জোটও বাঁধতে হচ্ছেনা, তাদের মুক্তিযুদ্ধে বিতর্কিত অবস্থানের দায়ভার এখন বিএনপির এড়িয়ে যেতে পারে স্বাচ্ছন্দে।
বিএনপি যখন ডানপন্থা থেকে উদারপন্থিদের সাথে নিয়ে মধ্যপন্থার দিকে ঝুঁকছে, তখন আওয়ামী লীগ তার ভোটের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য মধ্যপন্থা থেকে ডানের দিকে যাচ্ছে। সম্ভবত আওয়ামী লীগ ভাবছে যে তাদের ‘মুক্তিযুদ্ধ চেতনা ও সেক্যুলারিজম’ বয়ান এতই শক্তিশালি যে কট্টর ধর্মপন্থী দলগুলোর সাথে জোট বাধলেও তার ক্ষতি তারা সামলিয়ে নিতে পারবে। আওয়ামীপন্থী বুদ্ধিজীবি ও গণমাধ্যমের সরব সমর্থনও তাদের এ ভাবনাকে হয়তো শক্তিশালি করেছে। অন্যদিকে ঐক্যফ্রন্ট ও বিএনপির জোট এখনো সম্পূর্ণ কৌশলগত। পার করছে শিশু পর্যায়। তাদের ভবিষ্যত নির্ভর করছে কতটা সমৃদ্ধ ‘গল্প’ বা ‘বয়ান’ তারা তৈরি করেন, এবং জনগণের কাছে সেই বয়ান গ্রহণযোগ্যতার সাথে পৌছে দিতে পারেন।
সূত্রঃ https://www.priyo.com/articles/201811191628-political-polarization-is-going-to-change?fbclid=IwAR3xeWCPBJCM2SJ-zt3MliPzzxQGEHm4JTHUp1zrZ-FXOhWZ1WCJ-kz5EII