মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা সলিডারিটি আর্মি (আরসা) দেশের সেনাবাহিনী ও পুলিশের বিরুদ্ধে সশস্ত্র অভিযান শুরুর পরিপ্রেক্ষিতে মিয়ানমার সেনাবাহিনী যে নিরাপত্তা অভিযান শুরু করেছে, তাতে সেখানে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সূচনা হয়েছে। এই পরিস্থিতির প্রতিক্রিয়া কেবল মিয়ানমারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। অতীতের মতোই তার প্রতিক্রিয়ার চাপ বাংলাদেশের ওপরে এসে পড়েছে—হাজার হাজার রোহিঙ্গা সীমান্ত অতিক্রম করে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে বাংলাদেশে আসছে শরণার্থী হিসেবে।
বাংলাদেশ এই শরণার্থীদের কেবল আশ্রয় দিতে অস্বীকার করেছে ও তাদের জোর করে ফেরত পাঠাচ্ছে তা-ই নয়, গত সোমবার বাংলাদেশ সরকার মিয়ানমারকে সীমান্ত এলাকায় যৌথ অভিযান চালানোর আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দিয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের দেওয়া এই প্রস্তাব উদ্বেগজনক। যদিও বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো এই প্রস্তাব দিল তা নয়। গত বছরের আগস্ট মাসেও বাংলাদেশ এ ধরনের যৌথ অভিযানের প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু এবারের দেওয়া এই প্রস্তাব আগের চেয়ে সুনির্দিষ্ট, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক (দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অনুবিভাগ) মঞ্জুরুল করীম খান চৌধুরীকে উদ্ধৃত করে সংবাদমাধ্যম জানাচ্ছে, ‘এবার সুনির্দিষ্টভাবে ইসলামি জঙ্গি, আরাকান আর্মি এবং রাষ্ট্রবিরোধী অন্য যেকোনো শক্তির বিরুদ্ধে দুই দেশের নিরাপত্তা বাহিনীর যৌথ অভিযানের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে (প্রথম আলো, ২৮ আগস্ট ২০১৭)।’ প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারকে দেওয়া বাংলাদেশের এই প্রস্তাব কেন উদ্বেগজনক সেটা বোঝার জন্য আমাদের লক্ষ করতে হবে গত বছরের আগস্টের চেয়ে এখনকার পরিস্থিতি কতটা ভিন্ন।
আমরা জানি গত শুক্রবার দেশের পশ্চিমাঞ্চলে কমপক্ষে ২৫টি পুলিশচৌকিতে আরসার সশস্ত্র সদস্যরা একযোগে হামলা চালালে সাম্প্রতিক এই ঘটনার সূত্রপাত হয়। এসব হামলায় নিহত হওয়ার সংখ্যা ১০০ ছাড়িয়ে গেছে বলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবর; এর মধ্যে হামলাকারীরাও আছে। কিছু সূত্রে দাবি করা হয়েছে যে, নিহত ব্যক্তির সংখ্যা আরও বেশি; বিশেষ করে গত শনিবার থেকে সেনা অভিযানের শিকার হয়েছে সাধারণ নাগরিকেরা। আরসার পক্ষ থেকে এক ভিডিও বার্তায় এই বলে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে, সেনাবাহিনীকে ‘যুদ্ধের’ মোকাবিলা করতে হবে।
প্রকৃতপক্ষে গত বছরের অক্টোবর থেকেই দৃশ্যত সশস্ত্র হামলার ঘটনাবলির সূত্রপাত। ৯ অক্টোবর মিয়ানমারের সীমান্তচৌকিতে হামলার পর সেখানে সেনা অভিযান শুরু হয়। সেই সময়েও হাজার হাজার রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে আশ্রয় নেয়। সেনা অভিযানের মাত্রা কয়েক মাস পরে হ্রাস পায়, কিন্তু মূল সমস্যা অর্থাৎ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া, তাদের মানবাধিকার নিশ্চিত করা এবং ওই অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নে তাদের অংশগ্রহণের পথ উন্মুক্ত করার লক্ষ্যে পদক্ষেপ নেওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যায় না।
মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের অবস্থা এবং ক্ষোভ বুঝতে হলে তাদের নাগরিক হিসেবে অস্বীকৃতি দেওয়ার যে আইন ১৯৮২ সালে প্রণীত হয়েছে এবং নাগরিকত্ব নিরূপণের যে প্রক্রিয়া ১৯৮৩ সালে চালু করা হয়েছে, সেটা আমাদের স্মরণে রাখতে হবে, স্মরণে রাখতে হবে যে ২০১৫ সালে তৎকালীন সামরিক সরকার কর্তৃক ১৫টি বিদ্রোহী জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পাদিত শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের ঘটনা, যা থেকে রোহিঙ্গাদের বাদ দেওয়া হয়েছে (দেখুন, আমার লেখা নিবন্ধ ‘জাতিগত নিধন চলছে’, প্রথম আলো ৩ ডিসেম্বের ২০১৬)। এই পটভূমিকাতেই রোহিঙ্গাদের একাংশের মধ্যে সশস্ত্র পথ অবলম্বনের জোর তাগিদ তৈরি হয়। অতীতে যেসব রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠী কার্যকর ছিল, তাদের যে আবেদন ছিল তা ছিল অত্যন্ত সীমিত। কিন্তু গত বছরগুলোতে নতুন যে সংগঠন তৈরি হয়েছে তার আবেদন আগের চেয়ে বেশি এবং গত কয়েক বছরে রোহিঙ্গাদের মধ্যে র্যাডিকালাইজেশনের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়েছে।
এরই পাশাপাশি মিয়ানমার সরকার আন্তর্জাতিক চাপের মুখে গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে রাখাইন রাজ্য সম্পর্কে নয় সদস্যের একটি উপদেষ্টা কমিশন নিয়োগ দেয়, ওই কমিশনের দায়িত্ব হয় রাখাইন রাজ্য বিষয়ে দীর্ঘমেয়াদি কিছু সুপারিশ মিয়ানমার সরকারকে দেওয়া। সিদ্ধান্ত হয় যত দ্রুত সম্ভব কমিশন তার সুপারিশ হাজির করবে। এই কমিশন মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য ও বাংলাদেশে শরণার্থীদের শিবিরগুলো সফর করে এবং সংশ্লিষ্ট সরকারগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে। ফলে রোহিঙ্গাদের বিষয়টি আন্তর্জাতিক বিবেচনায় কেবল ‘শরণার্থী সমস্যা’ হিসেবে না থেকে ‘রাজনৈতিক প্রশ্ন’ হিসেবে রূপ নিতে শুরু করে। এসব ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে গত বছরের ডিসেম্বরে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ’ (আইসিজি)-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের মধ্যে হারাকাহ আল-ইয়াকিন নামে যে নতুন সশস্ত্র বিদ্রোহী সংগঠনের উদ্ভব ঘটছে, তার সদস্যদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠনের সম্পর্ক স্থাপনের আশঙ্কা আছে, একধরনের সমর্থন তারা ইতিমধ্যেই লাভ করেছে (আইসিজি, মিয়ানমার: এ নিউ মুসলিম ইনসার্জেন্সি ইন রাখাইন স্টেট, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৬)। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, সৌদি আরবসহ অন্যত্র প্রবাসী রোহিঙ্গাদের মধ্যে এই বিদ্রোহকে ধর্মীয় রূপ দেওয়ার চেষ্টা আছে। যদিও আইসিজি এবং অন্য অনেকেই এই নতুন বিদ্রোহী গোষ্ঠীর পরিচয় হিসেবে ধর্মীয় দিককে, অর্থাৎ মুসলিম পরিচিতিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন, আরসার পক্ষ থেকে এখন সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে তারা একটি ‘জাতীয়তাবাদী সংগঠন’, তাদের কোনো আন্তর্জাতিক অ্যাজেন্ডা নেই। তাদের দাবি অনুযায়ী, রোহিঙ্গার জাতীয়তাবাদী আকাঙ্ক্ষাকে প্রতিষ্ঠার জন্য তাদের সশস্ত্র পথ বেছে নেওয়ার বিকল্প ছিল না।
তাহলে আমরা দেখতে পাচ্ছি গত এক বছরে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা প্রশ্নটি আন্তর্জাতিকভাবে রাজনৈতিক প্রশ্নে পরিণত হয়েছে, জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের র্যাডিকালাইজেশন ঘটেছে এবং সম্ভবত প্রবাসী রোহিঙ্গাদের কোনো কোনো অংশ একে ধর্মীয় পরিচয়ের মোড়কে আনতে চাচ্ছে, যা আন্তর্জাতিক ইসলামপন্থী সন্ত্রাসীদের জন্য এই সংঘাতে যুক্ত হওয়ার পথ উন্মুক্ত করে দেবে। কোনো দেশে জাতীয়তাবাদী বা গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সুযোগে উগ্রপন্থী এবং আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠনের অনুপ্রবেশের উদাহরণ মোটেই বিরল নয়।
আরসার এই হামলার ঘটনা ঘটেছে ঠিক সেই সময়ে যখন আনান কমিশন তার প্রতিবেদন পেশ করেছে, যে প্রতিবেদনে রোহিঙ্গা প্রশ্নকে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিকভাবে মীমাংসা করার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। আরসা কেন এ সময়কেই হামলার জন্য বেছে নিল, সেই প্রশ্ন তোলাই যেতে পারে। কেননা এতে করে সেনাবাহিনীর পক্ষে নিরাপত্তা অভিযানের যুক্তি দেওয়া সম্ভব হচ্ছে এবং সরকারের পক্ষে যেকোনো ধরনের রাজনৈতিক সমাধানের প্রস্তাবকেই পেছনে ঠেলে দেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। তবে আমরা এ-ও বিবেচনায় রাখব যে আরসা সম্ভবত অনেক দিন ধরেই এ ধরনের হামলার পরিকল্পনা করছিল এবং আনান কমিশনের প্রতিবেদন পেশ করার বিষয়টি কাকতালীয়ও হতে পারে।
এখানে এসেই বাংলাদেশের যৌথ অভিযানের প্রস্তাবের বিষয়, বিশেষ করে এর উদ্বেগজনক দিকটি আমাদের বিবেচনা করতে হবে। মিয়ানমার সরকার (বা তার ভেতরের যে অংশ) রোহিঙ্গা ইস্যুর রাজনৈতিক সমাধানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের এই প্রস্তাব তাদের নিঃসন্দেহে শক্তিশালী করবে, তাদের যুক্তি ও কার্যকলাপকে বৈধতা প্রদান করবে। রোহিঙ্গাদের সামরিকভাবে মোকাবিলা করার জন্য মিয়ানমারের সমাজে উগ্রপন্থীরা যে দাবি করে থাকে, এ ধরনের প্রস্তাব তাতে প্রকারান্তরে সমর্থন জানাল। বাংলাদেশের প্রস্তাবের যে সুনির্দিষ্ট ভাষা আমরা সংবাদমাধ্যমে দেখতে পাচ্ছি তাতে প্রতীয়মান হয় যে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের এই বিদ্রোহকে ‘জাতীয়তাবাদী’ বিবেচনা না করে এককভাবে ‘ইসলামি জঙ্গি’ সমস্যা বলেই বিবেচনা করতে উৎসাহী।
এটি একার্থে বিস্ময়কর এই কারণে যে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সহিংস ও সশস্ত্র হয়ে ওঠার আশঙ্কার বিষয় বাংলাদেশের নীতিনির্ধারক এবং নাগরিকদের না বোঝার কোনো কারণ নেই। সে ক্ষেত্রে প্রতিবেশী দেশের একধরনের জাতীয়তাবাদী বিদ্রোহের বিরুদ্ধে সামরিক অবস্থান নেওয়ার ফলে ওই বিদ্রোহীদের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে বৈরী সম্পর্ক স্থাপনের আশঙ্কাই তৈরি হলো বলে আমার ধারণা। মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা বাংলাদেশকে সেভাবে বিবেচনা করলে তা কি বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য ইতিবাচক হবে? মিয়ানমার সরকার অতীতে বাংলাদেশের দেওয়া এ ধরনের প্রস্তাবে সাড়া দেয়নি, কিন্তু এখন পরিস্থিতি ভিন্ন এবং বাংলাদেশ এখন এই অবস্থান নেওয়ার ফলে নিজেকে আরও বেশি ভালনারেবল করে ফেলল কি না, সেটাও বিবেচ্য।
যদি মিয়ানমার এই প্রস্তাবে সাড়া দেয়, তবে এই অভিযানের সূত্রে তাদের নিরাপত্তা বাহিনী কি বাংলাদেশে প্রবেশের অধিকার রাখবে? এ ধরনের নিরাপত্তা অভিযানের সীমানা কীভাবে নির্ধারিত হবে? এই সব প্রশ্ন অভিযান যদি হয়, তবে তার বিস্তারিত কৌশল, পদ্ধতি ও পদক্ষেপের সঙ্গে যুক্ত। আমরা সেই বিষয়ে ‘যখন প্রয়োজন দেখা দেবে’ তখন আলোচনা করব। কিন্তু এখন যেটা অবশ্যই আলোচনা করা দরকার তা হলো, এই প্রস্তাবের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ এমন একটি পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেছে বলেই মনে হতে পারে, যাদের পক্ষপাত রাজনৈতিক সমাধানের চেয়ে সামরিক সমাধানের দিকেই। বাংলাদেশের সীমান্তে সংঘাত, অব্যাহত শরণার্থীদের প্রবেশ, একটি বিদ্রোহী গোষ্ঠীর উপস্থিতি অবশ্যই বাংলাদেশের নিরাপত্তার যখন হুমকি তৈরি করে; কিন্তু সংঘাতকে প্রলম্বিত করার মধ্য দিয়ে সেই হুমকি মোকাবিলা করা সম্ভব নয়।
আনান কমিশনের প্রতিবেদনের পর অব্যাহত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সীমান্ত পার হওয়ার প্রেক্ষাপটে এই সমস্যাকে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক সমস্যায় রূপ দেওয়ার যে সুযোগ বাংলাদেশের জন্য তৈরি হয়েছে, বাংলাদেশ প্রত্যক্ষভাবে নিরাপত্তা অভিযানে যুক্ত হয়ে পড়লে সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে সক্ষম হবে না। ফলে বাংলাদেশের উচিত মিয়ানমারের সঙ্গে যৌথ নিরাপত্তা অভিযানের চেয়ে অন্যান্য দেশের সঙ্গে যৌথভাবে আনান কমিশনের আলোকে রাজনৈতিক সমাধানের জন্য মিয়ানমারের ওপরে চাপ সৃষ্টি করা।
প্রথম আলো’তে প্রকাশিত ৩০ আগস্ট ২০১৭