বিজ্ঞানী স্যার জগদীশচন্দ্র বসু(১৮৫৮-১৯৩৭), অবিভক্ত ভারতবর্ষে আধুনিক পদার্থ বিজ্ঞান চর্চার পথিকৃৎ এবং প্রথম গবেষক যিনি পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণ করেন যে প্রানি এবং উদ্ভিদ কোন উদ্দীপকের বিপরীতে একইরূপ সাড়া দেয় অর্থাৎ উদ্ভিদেরও প্রাণ আছে, অনুভূতি আছে আমাদের মতই। জগদীশচন্দ্র বসু যখন তরুণ পদার্থ বিজ্ঞানী অর্থাৎ ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দশক, তখন তরঙ্গ পদার্থবিদ্যা গবেষণার অবস্থান তুঙ্গে। হেনরিখ হার্টজ (১৮৫৭-১৮৯৪) ছিলেন তার আদর্শ। হার্টজ এর মৃত্যু তাকে প্রভাবিত করে এবং সল্পদৈর্ঘের বেতার তরঙ্গ নিয়ে গবেষণা এগিয়ে নিতে উত্সাহ দেয়। বিলাত থেকে ফিরে জগদীশচন্দ্র বসু প্রফেসর এর চাকুরী নিয়েছিলেন কলকাতার বিখ্যাত প্রেসিডেন্সী কলেজে। কলেজের শিক্ষকতার চাকুরীতে নানা বৈষম্য ও প্রতিবন্ধকতার মাঝেও বিশ বর্গফুটের একটি কক্ষে শুরু করেছিলেন সল্পদৈর্ঘের বেতার তরঙ্গ নিয়ে গবেষণা। এই সময়ে (১৮৯৪-১৯০১) তাঁর অনেক গুলো গবেষণাপত্র প্রসিদিংস অফ দি রয়্যাল সোসাইটিতে ছাপা হয় আর পশ্চিমা বিজ্ঞানী মহলে প্রচুর প্রশংসা কুড়ায়। জগদীশচন্দ্র বসু ছিলেন ভারতীয়দের মধ্যে প্রথম যার পদার্থ বিজ্ঞানে মৌলিক গবেষণার জন্য পেটেন্ট ছিল( গালেনা ডিটেকটর, ইউ এস: ৭৫৫৮৪০) । কিন্তু বরাবরই পেটেন্ট করার বিষয়ে তিনি অনাগ্রহী ছিলেন। পদার্থবিদ জগদীশচন্দ্র বসুর জীবনের গল্পটি এভাবেই এগিয়ে যেতে পারত যদিনা তাঁর বিদ্যুৎ তরঙ্গ উৎপাদক যন্ত্র কোহেরার এর কর্ম ক্ষমতা পরীক্ষা করার সময় অদ্ভুত ভাবে যন্ত্রটির আচরণের সাথে জীবের মিল তিনি খুঁজে পেতেন। যেহেতু তিনি লন্ডনের ক্রাইস্ট কলেজে পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন এবং উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিষয়ে অধ্যয়ন করেছিলেন তাই একথা অনুমান করা যেতে পারে যে উদ্ভিদ বিজ্ঞান অধ্যয়নের অভিজ্ঞতা তাঁকে জড় ও জীবের মাঝে এই সাদৃশ্য খুঁজে পেতে হয়ত সাহায্য করেছিল । তিনি দেখেছিলেন ক্রমাগত উদ্দীপনা প্রয়োগ করার ফলে কোন যন্ত্র বা ধাতব পাত ক্লান্ত হয়ে পরে অর্থাৎ সাড়ার পরিমান কমে যায় অপর পক্ষে উত্তেজক রাসায়নিক প্রদানে সাড়া অনেক বৃদ্ধি পায়। তাঁর গবেষণা জীবনের মোড় ঘুড়িয়ে দেয়া এই ঘটনাকে আরও পঁচিশ বছর পর, ১৯২৬ সালে The nervous mechanism in plants বইতে, জীব এবং জড়ে একইরূপ ভৌত রাসায়নিক বিক্রিয়া হিসেবে তিনি বিবৃত করেছেন। বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই জীব সংক্রান্ত গবেষণার জন্য তিনি উদ্ভিদকেই বেছে নিয়েছিলেন আর পদার্থবিদের দৃষ্টিভঙ্গিকে ব্যবহার করেছিলেন উদ্ভিদের নানা শারীরবৃত্তিক পদ্ধতি বোঝার জন্য। একইসঙ্গে উদ্ভাবন করেছিলেন এমন সব যন্ত্র যার সাহায্যে উদ্ভিদের অব্যক্ত অনুভূতি গুলি ব্যক্ত হয়ে উঠেছিল।
জীব নিয়ে গবেষণার শুরুতেই জগদীশচন্দ্র বসু এই মতে অটল ছিলেন যে যদি শুধুমাত্র বহিঃ ক্রিয়ার বিপরীতে অভ্যন্তরীণ সাড়াকে বিবেচনা করা হয় তবে জড় ও জীবের মধ্যে প্রকৃত অর্থে কোন পার্থক্য নেই। তাঁর এই বিষয়ে গবেষণা পত্র গুলো ছাপা হয়েছিল রয়েল সোসাইটি, লিনিয়ান সোসাইটির প্রকাশনার মত বিখ্যাত সব জার্নালে। জড় ও জীবের সাড়া নিয়ে ১৯০২ সালে প্রকাশিত হয় তার বই Response in the Living and Nonliving । এই বইটিতে তিনি বিভিন্ন পরিস্থিতিতে জীব ও জড়ের যান্ত্রিক এবং বৈদ্যুতিক সাড়া দেয়ার প্রবণতা গাল্ভানোমিটারের কাটার বিচ্যুতি আর লিপিগ্রাফের মাধ্যমে দেখিয়েছিলেন। জীবের সাড়া পরিমাপের জন্য প্রাণি টিস্যু ব্যবহার না করে উদ্ভিদ টিস্যু ব্যাবহারের পক্ষে তিনি কারণ হিসাবে বলেছিলেন যে প্রাণি টিস্যু খুব জটিল এবং অল্পসময় বেঁচে থাকে ফলে দীর্ঘ সময় ধরে পরীক্ষার জন্য উদ্ভিদ টিস্যু বেশি উপযোগী। তিনি একই ভাবে দেখতে চেয়েছিলেন কোন নির্দিষ্ট উদ্দীপকের বিপরীতে উদ্ভিদ ও প্রাণিতে অনুরূপ সাড়া পাওয়া যায় কিনা। তার ভাষায় “ My own attempt, however, was directed, not towards the obtaining of a mere qualitative response, but rather to determination of wheather throughout the whole range of response phenomena a parallalism between animal and vegetable could be detected”. তিনি তাঁর রেসনান্ট রেকর্ডার যন্ত্রের সাহায্যে দেখিয়েছিলেন যে প্রাণিদেহ থেকে বিছিন্ন স্নায়ুকোষকে কৃত্তিম উপায়ে উত্তেজিত করলে যেমন সাড়া পাওয়া যায় তার সাথে বহুলাংশে মিল আছে একই ভাবে উদ্দীপিত উদ্ভিদ টিস্যু থেকে প্রাপ্ত সাড়ার। উদ্ভিদের সাড়া সংক্রান্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য তাঁর প্রিয় ছিল লজ্জাবতী কারণ এটি খুবই স্পর্শকাতর উদ্ভিদ এবং উদ্দীপিত করলে সাড়া বাইরে থেকেই দেখা যায়। কিন্তু তিনি আপাত দৃষ্টিতে সাড়াহীন উদ্ভিদ যেমন, গাজর, মূলা, আঙ্গুর লতা, শালগম, বাঁধাকপি ইত্যাদিতেও একইরূপ গাল্ভানমেট্রিক সাড়া পেয়েছিলেন। উদ্ভিদকে উদ্দীপিত করার জন্য তিনি বিভিন্ন পদ্ধতি বেছে নিয়েছিলেন। উদ্ভিদকে আহত করলে তা কী রকম সাড়া প্রদান করে তা যেমন তিনি লিপিবদ্ধ করেছিলেন তেমনি দেখিয়েছিলেন চেতনানাশক রাসায়নিক দিয়ে উদ্ভিদকেও অচেতন করা যায়। উদ্ভিদের সাড়া সংক্রান্ত গবেষণার ফলাফল নিয়ে পরবর্তীতে জগদীশচন্দ্র বসু আরও দুইটি বই প্রকাশ করেন – Plant response: as a means of physiological investigations (1906) এবং Comparative Electro-Physiology: A Physico-Physiological Study।
জগদীশচন্দ্র বসু উদ্ভাবিত উদ্ভিদের অনুভূতি মাপার যান্ত্রিক কৌশল পশ্চিমা পদার্থবিদদের মাঝে প্রশংসিত হলেও উদ্ভিদের অনুভূতি আছে বা সে আঘাতের স্মৃতি মনে রাখতে সক্ষম এই ধারনা গুলোকে তাঁর সমসাময়িক জীববিজ্ঞানীরা অসম্ভব বলে আখ্যা দেয়। এই সব গবেষণার মাধ্যমে তিনি প্রকৃত পক্ষে জড় বস্তু, প্রাণি এবং উদ্ভিদ, আমাদের চারপাশের এইসব অস্তিত্বের মাঝে যে আনবিক মিল তাই নির্দেশ করেছিলেন। কিন্তু তাঁর পরীক্ষা লব্ধ ফলাফলের পর্যাপ্ত ব্যাখ্যা না থাকায় বিজ্ঞানী মহলে তা সমালোচনার মুখে পরে ।
পরবর্তীকালে জগদীশচন্দ্র বসু উদ্ভিদ শারীর বিজ্ঞান নিয়ে আগ্রহী হয় উঠেন আর একজন প্রকৃত পদার্থবিদের যায়গা থেকেই উদ্ভিদ শারীরতাত্ত্বিক বিষয় নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। এই সময়ে তিনি উদ্ভিদের বৃদ্ধির হার মাপার জন্য আবিষ্কার করেন তার বিখ্যাত ক্রেস্কোগ্রাফ যন্ত্রটি। ক্রেস্কোগ্রাফ প্রকৃত অর্থে একটি বিবর্ধক যন্ত্র যা অপরিধান যোগ্য বৃদ্ধিকেও বহুগুন বিবর্ধিত করে প্রকাশ করে। প্রাথমিক অবস্থায় ক্রেস্কোগ্রাফ দিয়ে প্রতি সেকেন্ডে উদ্ভিদের বৃদ্ধি দশহাজার গুন বিবর্ধিত করে লিপিবদ্ধ করা যেতো। এই যন্ত্রের সাহায্যে তিনি সবাইকে প্রদর্শন করতেন যে বিভিন্ন উদ্দীপকের বিপরীতে বা আঘাতের দ্বারা উদ্ভিদের স্বাভাবিক বৃদ্ধি কিভাবে থমকে যায় আবার কখন নতুন উদ্দমে বৃদ্ধি শুরু হয়। জগদীশচন্দ্র তার ক্রেস্কোগ্রাফ যন্ত্রটির কর্মক্ষমতা পরবর্তীতে বহুগুন উন্নত করেন এবং পরিবর্তিত ক্রেস্কোগ্রাফ উদ্ভিদের বৃদ্ধি পাঁচকোটি গুন বিবর্ধিত করে লিপিবদ্ধ করতে পারত।
উদ্ভিদের জৈবিক সঞ্চালন নিয়ে চার খণ্ডের বই life Movements in Plants এ জগদীশচন্দ্র পরিবেশের বিভিন্ন নিয়ামক যেমন আলো, তাপমাত্রা এমনকি মাধ্যাকর্ষণের প্রভাবে উদ্ভিদের বিভিন্ন অংশের সঞ্চালন নিয়ে তার গবেষণা লব্ধ ফলাফল বর্ণনা করেন। এই বইটিতে জগদীশচন্দ্র দেখিয়েছেন যে উদ্ভিদের উপর দৃশ্যমান আলোর অনুরূপ প্রভাব রয়েছে বেতার তরঙ্গের। ফলে তরঙ্গ অনুভব করার ক্ষমতা মানুষের চাইতে উদ্ভিদের অধিক। মাধ্যাকর্ষণের প্রভাবে কেন গাছের মূল মাটির দিকে আর কাণ্ড আলোর দিকে বেড়ে উঠে এই বিষয়টি তিনি ভূ-বৈদ্যুতিক সাড়া পরিমাপের মাধ্যমে দেখান যে একই উদ্দীপক মাধ্যাকর্ষণের প্রভাব কাণ্ডে প্রত্যক্ষ এবং মূলে পরোক্ষ। জগদীশচন্দ্র বসু যে সাধারণ শারীরবিজ্ঞান নিয়ে আগ্রহী হয়েছিলেন সে কথাও তিনি বইটির ২য় খণ্ডের শুরুতেই বলেন। তাঁর ভাষায় সাধারণ শারীরতাত্ত্বিক বিক্রিয়া গুলো উদ্ভিদ এবং প্রাণী তে একইরূপ হওয়াতে একটিতে গবেষণা লব্ধ জ্ঞান অন্যটিতে ব্যবহার করা যেতে পারে। উদাহরণ হিসাবে তিনি বলেন যে উদ্ভিদে আকস্মিক স্নায়ুবিক তাড়না নিয়ন্ত্রণ করার একটি পদ্ধতি তাকে প্রাণির আকস্মিক স্নায়ুবিক তাড়না নিয়ন্ত্রণে সাফল্য এনে দিয়েছে। উদ্ভিদ এবং প্রাণী টিস্যুর অনেক আচরণই যে অনুরূপ তা জগদীশচন্দ্র দেখিয়েছিলেন। উদ্ভিদের সঞ্চালনকে তিনি তিন ভাবে ব্যাখ্যা করেন। প্রথমত, কোন একটি উদ্দীপকের বিপরীতে সাড়া প্রদাণ করে সঞ্চালন। স্পর্শ করলে লজ্জাবতী উদ্ভিদ তৎক্ষণাত পাতা ভাঁজ করে যে সাড়া প্রদান করে তাই তিনি উদাহরণ হিসেবে দেখান। দ্বিতীয়ত, তিনি পরীক্ষা সহ যুক্তি দেখান যে প্রাণিদেহের হৃদ-স্পন্দনের মত উদ্ভিদ দেহে টিস্যুর স্বতঃসঞ্চালন বিদ্যমান। যেমন বনচাঁড়ালের ত্রিপত্রক পাতার দুইপাশের পাতা দুইটির সময়ের সাথে স্বতঃস্ফূর্ত চক্রাকার ঘূর্ণন। তৃতীয়ত, তিনি বৈদ্যুতিক উত্তেজনা পরিবহনের সাথে উদ্ভিদ টিস্যু সঞ্চালনের সম্পর্ক বর্ণনা করেন। উদ্ভিদের সব ধরনের সঞ্চালন বর্ণনা করতে যেয়ে তিনি বলেন “It has been shown that direct stimulation induces contraction and retardation of growth, and that indirect stimulation induces an expansion acceleration”। ফলে বলা যায় তিনি তাঁর উদ্ভিদ সঞ্চালন নিয়ে গবেষণা কর্মে পূর্বতন উদ্ভিদ বিজ্ঞানীদের মত শুধুমাত্র সঞ্চালন প্রক্রিয়াটির বর্ণনা করেই থেমে যান নি, এর অন্তর্নিহিত কার্যকরণ এবং কৌশলও অনুসন্ধান করেছেন।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে উদ্ভিদ বিজ্ঞানীদের কাছে গবেষণার একটি প্রিয় বিষয় ছিল উদ্ভিদের রসাকর্ষণ (ascent of sap) ফলে এই বিষয়টি জগদীশ চন্দ্রকেও আকৃষ্ট করে। একশো বছর পরে আজো আকাশ ছোঁয়া উদ্ভিদ গুলোতে কি প্রক্রিয়াতে রস-উত্তলন ঘটে তার সর্বজনগ্রাহ্য কোন ব্যাখ্যা নেই। বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু উদ্ভিদের রসাকর্ষণ ব্যাখ্যা করতে একটি মতবাদ দিয়েছিলেন যা “Pulsation Theory of Ascent of Sap” নামে পরিচিত। তার মতবাদের বিশদ বর্ণনা এবং এ সংক্রান্ত গবেষণা গুলো লিপিবদ্ধ করে প্রকাশ করেন The Physiology of ascent of sap (1923) নামক বইটি। এই মতবাদ অনুযায়ী কাণ্ডের কর্টেক্স টিস্যুর সর্বনিম্নস্তরের কোষগুলো স্পন্দনের ফলে রস-উত্তলন ঘটে। কর্টেক্সের স্তরের কোষে স্পন্দনের উপস্থিতি তিনি বৈদ্যুতিক প্রব, সূক্ষ্মাগ্র সুঁই ও গাল্ভানমিটার দিয়ে দেখিয়েছিলেন। যখন সুঁইটি কর্টেক্স টিস্যুর একদম অভ্যন্তরীণ স্তরে প্রবেশ করান হয় তখন গাল্ভানমিটারের কাঁটার উঠানামা পরিলক্ষিত হয়ে ছিল যা স্পন্দনের উপস্থিতি প্রমাণ করে। তার মতে এই স্পন্দনের ফলে জাইলেম টিস্যু দিয়ে উদ্ভিদে রস উত্তলিত হয়। পরবর্তীতে ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে শ্যাল, মাকডুগাল, বেনেডিক্ট প্রমুখ বিজ্ঞানী গন দেখান যে স্পন্দনের সাথে রসাকর্ষণের কোন সম্পর্ক নাই। কিন্তু এই একবিংশ শতাব্দীতেও যখন ২০০ ফিট উঁচু উদ্ভিদে রস উত্তলন কিভাবে ঘটে তার কোন একক ব্যাখ্যা পাওয়া যায়না তখন অনেক বিজ্ঞানীই জগদীশের স্পন্দন মতবাদকে গুরুত্ব দেন।
বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু উদ্ভিদ-স্নায়ু সম্পর্কে সর্বপ্রথম ধারনা দেন। উদ্দীপনা একস্থান থেকে অন্যস্থানে প্রেরনের যে স্বাভাবিক স্নায়ু চরিত্র প্রাণিদেহে দেখা যায় তাই তিনি উদ্ভিদে দেখেছিলেন। এই সম্পর্কে Plant response বইটিতে তিনি দেখান যে উদ্ভিদ টিস্যুকে উদ্দীপিত করলে তাতে উত্তেজক মেরুক্রিয়ার (excitatory polar action) ফলে তড়িৎ-বিদ্যুৎ তৈরি করে এবং তা দুরাঙ্গে পরিবহন ঘটে, আর এতে এটাই প্রমাণ হয় যে উত্তেজনা পরিবহনের প্রক্রিয়া উদ্ভিদ এবং প্রানি স্নায়ুতে একই। বহুকোষী প্রাণিতে স্নায়ুতন্ত্রের ক্রমাগত বিবর্তন এবং এই জটিল স্নায়ুতন্ত্রের মাধ্যমে প্রাণির বিভিন্ন অঙ্গের মাঝে সমন্বয় সাধনের প্রক্রিয়া বিজ্ঞানীরা আগে থেকেই জানত। এই রূপ স্নায়ুতন্ত্রের কথা উদ্ভিদের ক্ষেত্রে জগদীশচন্দ্রের আগে কেউ কল্পনাই করেনি। তার ভাষায় ”It can only be a virtue of a system of nerves that the plant constitutes a single organised whole, each of whose parts is affected by every influence that falls on any other”। জগদীশচন্দ্র বসু তার The nervous mechanism of plants বইতে বর্ণনা করেন যে উদ্ভিদে শুধুমাত্র স্নায়ুতন্ত্র উদ্ভবই হয়নি বরংতা এক পরম উৎকর্ষতায় পৌঁছেছে যেমন এখানে পরিলক্ষিত হয় প্রতবর্তি ক্রিয়া কলাপ অর্থাৎ ইন্দ্রিয়বার্তা মোটর-ঝোঁকে বা সঞ্চালনে অনুদিত হয়। উদাহরণ হিসাবে তিনি বর্ণনা করেছেন বনচাঁড়াল ও লজ্জাবতির পাতার সঞ্চালন। এই দুইটি উদ্ভিদের পাতার সঞ্চালনের ক্ষেত্রে মোটর অঙ্গ হল পাতার গোরায় অবস্থিত পাল্ভিনাস। পাল্ভিনার টিস্যুতে রস-চাপ হ্রাস পেলে লজ্জাবতির পাতা নুয়ে পরে। জগদীশচন্দ্র বসু উদ্ভাবন করেন যে বিভিন্ন উদ্দীপক যেমন স্পর্শ, হঠাৎ তাপমাত্রার পরিবর্তন, আবেশন ধাক্কা ইত্যাদির কারণে বৈদ্যুতিক উত্তেজেনা তৈরি হয় এবং তা পাল্ভিনাসের রস-চাপ হ্রাস করে ফলে পাতা নুয়ে পরে। তিনি দেখেন যে যদি মধ্যম তীব্রতার বা ক্ষণস্থায়ী ভাবে আলো পাতার উপর প্রয়োগ করা হয় তবে পাল্ভিনাসের রস-চাপ বৃদ্ধি পায় এবং পাতা উত্তলিত হয়, অপরপক্ষে তীব্রতর আলো প্রয়োগে বিপরীত প্রভাব দেখা যায় অর্থাৎ পাতা নুয়ে পরে। পরীক্ষার মাধ্যমে তিনি এ সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে বৈদ্যুতিক উত্তেজেনা পাতার সঞ্চালনকে নিয়ন্ত্রণ করে। যেখানে পাতার উত্তোলন একটি পুরপুরি কোষে রসচাপ বৃদ্ধির কারণে হয়, সেখানে পাতার নুয়ে পরা একটি প্রকৃত উত্তেজনার ফলাফল যা বৈদ্যুতিক প্রবাহে পরিবর্তিত হয় এবং পাল্ভিনাসের রস-চাপ হ্রাস করে। এভাবেই উদ্ভিদে উত্তেজনা পরিবহনের ক্ষেত্রে হাইড্রলিক এবং বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা একসাথে কাজ করে। উদ্ভিদে উত্তেজনা পরিবহণ দুই ভাবে হতে পারে, প্রথমত, উত্তেজনার মাধ্যমে হায়ড্র-মেকানিকাল ঝামেলা তৈরি করে এবং দ্বিতীয়ত, উদ্ভিদ দেহ-রস এর সাথে রাসায়নিক উদ্দীপক চলাচলের মাধ্যমে।
বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু এভাবেই জীবিত টিস্যুর ক্রিয়াশীল প্রতিক্রিয়া বৈদ্যুতিক সাড়ার মাধ্যমে নিরূপণ করে অজানা অনেক উদ্ভিদ শারীরতাত্ত্বিক প্রক্রিয়ার উপর আলোকপাত করেন। তিনি একজন পদার্থ বিজ্ঞানীর চোখ দিয়েই জীবদেহের শারীরিক প্রক্রিয়ার বাখ্যা দিয়েছেন। তিনি উপমহাদেশে জীব-পদার্থবিজ্ঞানের পথিকৃত। কালজয়ী এই বাঙালী বিজ্ঞানীকে আমরা কতটুকু মনে রেখেছি তা তাঁকে নিয়ে লিখা বাংলা বইয়ের সংখা দেখে সহজেই অনুধাবন করা যায়। কিন্তু সামনে এগুতে হলে প্রাতস্মরনীয়দের পথ ধরেই আমাদের হাঁটতে হবে তাতে আর সন্দেহ কি?
থাম্বনেইলের ছবি: লণ্ডনের রয়েল ইন্সটিটিউটে আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু সূত্র: http://goo.gl/s7Jvox
খুবই উদ্দীপক লেখা। ক্লোরোফর্ম প্রয়োগে উদ্ভিদের সংগা লোপ বিষয়ে লেখা প্রথম পড়েছিলাম পরমহংস যোগানন্দের লেখা “Autobiography of a Yogi” বইতে। যোগানন্দ তখন ছোট; জগদীশ চন্দ্র বসু একটা এক্সপেরিমেন্ট উনাকে দেখিয়েছিলেন। শ্রদ্ধেয় বসুর লেখা অনেকদিন ধরেই পড়বো পড়বো করে শুরু করতে পারছি না অন্য আরো কিছু পড়ার কারণে। আপনার এই লেখা পড়ে আবার উনার লেখা পড়ার উদ্দীপনা পাচ্ছি। ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ শামীম রেজা