November 20, 2024
http://pixgood.com/khaleda-zia-and-sheikh-hasina.html

গত কয়েক সপ্তাহে, বিশেষত এক সপ্তাহে, দেশে সহিংসতার মাত্রা কমে এসেছে। বিক্ষিপ্ত-বিচ্ছিন্নভাবে পেট্রলবোমা বা ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটলেও বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের ডাকা অবরোধ ও হরতালের এখন আর কার্যকারিতা নেই; যদিও জোটের পক্ষ থেকে এখনো হরতাল বা অবরোধ কোনোটাই তুলে নেওয়া হয়নি এবং মানুষের মধ্যে শঙ্কা দূর হয়নি। এই প্রেক্ষাপটে অনেকের আশা ছিল যে বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়া তাঁর ‘সংবাদ সম্মেলনে’ হয়তো এই ধরনের কর্মসূচি তুলে নেবেন কিংবা নতুন কর্মসূচি দেবেন। এর কোনোটিই ঘটেনি। তবে তাঁর বক্তব্যে যে পরিবর্তন ঘটেছে, সেটা ভালো করে তাকালেই বোঝা যায়।
তাঁর দাবিনামায় এখন আর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা নেই, সরকার পতনের ডাক নেই। যা আছে তা হলো, ‘আন্দোলনের যৌক্তিক পরিণতি’, আছে ‘সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য সরকারের অধীনে সকলের অংশগ্রহণে অনতিবিলম্বে জাতীয় সংসদের অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সুনির্দিষ্ট তারিখের মধ্যে সংলাপের আয়োজন’ করার দাবি। এগুলো নিঃসন্দেহে বিএনপির পিছিয়ে আসার লক্ষণ। একে বিএনপির নমনীয় অবস্থান বলেও কেউ কেউ চিহ্নিত করেছেন। খালেদা জিয়া যে শক্তিশালী অবস্থানে দাঁড়িয়ে, পরিস্থিতি তাঁর অনুকূলে জেনে এসব কথা বলছেন, আমি তা মনে করি না। মাস খানেক আগে হলে আমরা হয়তো সেভাবেই বিবেচনা করতে পারতাম। বিএনপির পক্ষে থেকে আন্দোলন অব্যাহত রাখার কথা বলা হলেও কৌশলের দিক থেকে এমন কিছু বলা হয়নি, যা বিএনপির আন্দোলনের এত দিনকার ঘাটতি মোচন করে নতুনভাবে তাকে এগিয়ে নেবে। ফলে দাবি বিষয়ে অবস্থান বদলালেও কৌশলের দিক থেকে, ‘আন্দোলনের’ গতি-প্রকৃতি পরিচালনার দিক থেকে বিএনপি যে জায়গায় ছিল এখনো সেখানেই আছে। ফলে প্রশ্ন হচ্ছে বিএনপি এখন কী করতে পারে? সরকারি দলের করণীয় কী? কী ঘটতে পারে? এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে পরিস্থিতির দিকে তাকানো দরকার, কী কী বিবেচনা মাথায় রেখে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজব সেটা নির্ধারণ করা দরকার।
গত জানুয়ারি মাস থেকেই সরকারি দল বলে আসছে যে তার অবস্থান অপরিবর্তনীয়। বিএনপির আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যে সহিংসতার সূচনা হয়েছে, তা তারা রাষ্ট্রীয় শক্তি দিয়ে মোকাবিলা করতে চায়। সরকারি দল মনে করেছে, সব সহিংসতার দায় বিএনপির—এই মনোভাব সমাজে যত বেশি প্রতিষ্ঠিত হবে, তত বেশি অবস্থা সরকারের অনুকূলে যাবে এবং শেষ পর্যন্ত সাধারণ নাগরিকেরা জীবন-জীবিকার তাগিদেই বিএনপির কর্মসূচি প্রত্যাখ্যান করবে। সহিংসতায় যে ১২১ জন মারা গেছেন, তার অধিকাংশ যেহেতু মারা গেছেন পেট্রলবোমা হামলায়, ফলে তার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছে সাধারণ মানুষের ওপরে। সরকারের এই কৌশল কার্যত সফল হয়েছে যে একসময় সাধারণ মানুষের কাছেই আর এই পরিস্থিতি সহনীয় মনে হবে না। সহিংসতার জন্য তারা দায়ী নয় বলে দাবি করলেও বিএনপি এটা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়নি যে এর সব দায় তাদের নয়। এর অন্যতম কারণ হলো সহিংসতা ছাড়া আর কোনো ধরনের কার্যক্রম বিএনপি দেখাতে পারেনি। বিএনপির দাবির যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন থাকার কারণে নাগরিকদের সম্পৃক্ততার অভাব ঘটেছে, এমন প্রমাণ করা যাবে না, কিন্তু বিএনপির পক্ষ থেকে জনসম্পৃক্ততার সুযোগ তৈরি না করতে পারা যে তার কারণ, সেটা মানতেই হবে।
তদুপরি, রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলোর আচরণ সমাজে ভীতির সঞ্চার করতে সক্ষম হয়েছে। সংবাদপত্রের হিসাব অনুযায়ী, জানুয়ারি মাস থেকে ১৪ মার্চ পর্যন্ত ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বা ‘ক্রসফায়ারে’ মারা গেছে কমপক্ষে ৩১ জন; মানবাধিকার সংস্থার হিসাবে শুধু গত ফেব্রুয়ারি মাসেই বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনায় মারা গেছে ৩৭ জন, জানুয়ারি মাসে ১৭ জন। আইনপ্রয়োগকারী বাহিনীর হাতে আটক অবস্থায় গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনার তালিকা মোটেই ছোট নয়—আটকের পর হাঁটু লক্ষ৵ করে গুলি করার ঘটনার খবর সবার জানা। জানুয়ারি মাসে ১৪ জন নিখোঁজ হয়ে যায়, যাদের মধ্যে নয়জনকে পরে থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে, দুজনের মৃতদেহ পাওয়া গেছে; ফেব্রুয়ারি মাসে গুম হয়ে যাওয়া মানুষের সংখ্যা ছিল সাত, তাদের মধ্যে একজনকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে, তিনজনের মৃতদেহ পাওয়া গেছে। মার্চ মাসের হিসাব না থাকলেও বিএনপি নেতা সালাহ উদ্দিন আহমদের ‘নিখোঁজ’ হয়ে যাওয়ার ঘটনা জানেন সবাই; ফেব্রুয়ারি মাসে মাহমুদুর রহমান মান্নার আটকের সময়েও ২১ ঘণ্টার জন্য তাঁকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। এই সময়ে আটকের সংখ্যা কম করে হলেও ১৮ হাজার। ফলে জানুয়ারির শুরু থেকেই আমরা দেখতে পাচ্ছি সরকারের অনমনীয় অবস্থান এবং রাষ্ট্রশক্তির লাগামহীন ব্যবহার।
এখন সরকার ও সরকারি দলের মনে এই ধারণা বদ্ধমূল হবে, যেহেতু রাষ্ট্রীয় শক্তি প্রয়োগ করে তারা বিএনপিকে দুর্বল এবং আন্দোলনকে অকার্যকর করে ফেলেছে, এই অবস্থা অব্যাহত রাখতে পারলে তাদের পক্ষে চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করা সম্ভব হবে। এই চূড়ান্ত বিজয় বা লক্ষ্য কী? সেটা সরকারি দলের আচরণে স্পষ্ট, যদিও তারা সুস্পষ্ট করে বলে না। তবে আমরা বিএনপি–জায়ামাতবিরোধী এবং সরকারের প্রতি সহানুভূতিশীল বুদ্ধিজীবীদের কথায় একটা ধারণা পাই। এর সর্বসাম্প্রতিক ভাষ্যটি পাওয়া যায় এম এম আকাশের লেখা একটি নিবন্ধে। এই সময়ে, যাকে তিনি প্রগতিশীল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি বলে মনে করেন, তাদের করণীয় নির্দেশ করে বলেছেন, ‘ঘটনা যা-ই ঘটুক, প্রগতিশীল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির এ ক্ষেত্রে যা করণীয়, সেটা হচ্ছে ১৯৭১ সালের পরাজিত প্রতিক্রিয়াশীল সন্ত্রাসী শক্তিকে যদি আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় বল প্রয়োগ করেও দুর্বল ও নিঃশেষিত করতে পারে, তাতে বাগড়া না দেওয়া।’ (ড. এম এম আকাশ, ‘এই রাউন্ডেও কি শেখ হাসিনা জয়ী হবেন?’ সমকাল, ১৬ মার্চ ২০১৫)। এম এম আকাশের বিবেচনায় যেহেতু বিএনপি ১৯৭১ সালের পরাজিত প্রতিক্রিয়াশীল সন্ত্রাসী শক্তির সঙ্গে জোট বেঁধেছে, সেহেতু তার ওপর বলপ্রয়োগ করা অন্যায় নয়।
সামগ্রিকভাবে প্রতিপক্ষকে নিঃশেষিত করাই হচ্ছে লক্ষ্য এবং তার কৌশল হচ্ছে রাষ্ট্রশক্তির নির্বিচার ব্যবহার, যার একটি সংক্ষিপ্ত চিত্র আমি একটু আগেই তুলে ধরেছি। কিন্তু এই লক্ষে৵ সরকার, সরকারি দল এবং তাদের সমর্থকদের কার্যক্রম পরিচালিত হলে তার পরিণতি কী হতে পারে, তার একটা ধারণা আমার ড. আকাশের লেখায়ই পাই। তিনি বলছেন, ঘটনা যা-ই ঘটুক ‘একই সঙ্গে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন আপসকামিতা, দুর্নীতি, অনাবশ্যক বাড়াবাড়ি ও ফ্যাসিবাদী প্রবণতার বিরুদ্ধেও সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে হবে’। অর্থাৎ, ক্ষমতাসীনদের মধ্যে হয় এখনই ‘অনাবশ্যক বাড়াবাড়ি ও ফ্যাসিবাদী প্রবণতা’ উপস্থিত বা রাষ্ট্রশক্তি ব্যবহারের ফলে এই প্রবণতা তৈরি হবে। যে উদ্দেশ্যে বা যার বিরুদ্ধেই পরিচালিত হোক না কেন, রাষ্ট্রের জবাবদিহিহীন ‘বলপ্রয়োগ’ এবং ‘ফ্যাসিবাদী প্রবণতা’ যে গণতান্ত্রিক রাজনীতির পরিবেশ তৈরি করতে পারে না, সেটা সহজেই বোধগম্য। আর গণতান্ত্রিক পরিবেশের অনুপস্থিতি বিশেষ করে বিএনপির জন্যই প্রযুক্ত হবে, এমন মনে করার কারণ নেই। কোনো দেশে গণতন্ত্র যেমন ‘কারও জন্য আছে কারও জন্য নেই’, এমন হতে পারে না, তেমনি গণতন্ত্রহীনতাও ‘বাছবিচার করে প্রযুক্ত’ হয় না। উদার গণতন্ত্রের একটি দিক এই যে গণতান্ত্রিক শক্তি হিসেবে যাদের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ, তারাও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সুযোগ গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু ‘ফ্যাসিবাদী প্রবণতা’ যেখানে উপস্থিত, সেখানে গণতান্ত্রিক শক্তিও (কিংবা গণতান্ত্রিক শক্তিই) তার অধিকারবঞ্চিত হয়, নাগরিকদের প্রশ্ন না হয় বাদই দিলাম।
রাষ্ট্র যখন কেবল বলপ্রয়োগের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, যে রাজনৈতিক শক্তি তা পরিচালনা করে, তার মধ্যে যদি ‘দুর্নীতি, অনাবশ্যক বাড়াবাড়ি ও ফ্যাসিবাদী প্রবণতা’ বহাল থাকে, প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তি দুর্বল অবস্থানে থাকে এবং অন্যান্য শক্তির প্রকাশ্য কার্যকলাপ সীমিত হয়ে পড়ে, তখন সমাজে উগ্রপন্থা প্রসারের পরিবেশ তৈরি হয়, চরমপন্থী শক্তির জন্য সেটাই হচ্ছে সবচেয়ে অনুকূল আবহাওয়া। বাংলাদেশে সে ধরনের শক্তি অনুপস্থিত নয়। ক্রমাগতভাবে গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক শক্তি, যাদের সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক বলে বিবেচনা না করলেও, তাদের রাজনৈতিকভাবে পরাজিত না করে নিঃশেষ করে ফেললে এই চরমপন্থী শক্তি বিস্তারের পথই তৈরি হবে। এই বিবেচনা মাথায় রেখেই আমাদের দেখা দরকার সরকারি দল এবং বিএনপির করণীয় কী।

দেশের বিরাজমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির দিকে তাকিয়ে নির্দ্বিধায় বলা যায় যে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের আন্দোলনে সাফল্যের আশু সম্ভাবনা নেই এবং বিএনপির নেতা খালেদা জিয়া ইতিমধ্যেই তাঁর দাবি থেকে খানিকটা সরে এসেছেন, কিন্তু অকার্যকর রাজনৈতিক কৌশল অনুসরণ করে চলেছেন; সরকার ও সরকারি দল রাষ্ট্রশক্তির জোরে আন্দোলন দমনের প্রক্রিয়ায় এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করেছে, যাতে সাময়িক সাফল্য অর্জিত হয়েছে, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে এক অনিশ্চয়তার পথ উন্মুক্ত হয়েছে; এবং সাধারণ নাগরিকেরা একটি অস্বস্তিকর শঙ্কাজনক অবস্থার মধ্যে জীবন যাপন করছে। এই অবস্থায় সরকার ও বিএনপির কী করণীয় এবং কী ঘটতে পারে, সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা দরকার।
যদিও সরকার এত দিন ধরে কোনো ধরনের আলোচনা না করার কথা বলে এসেছে। কেননা এতে তাদের দুর্বলতার প্রকাশ ঘটবে বলেই তাদের মনে হয়েছে। তারা বিরোধীদের আন্দোলনের মুখে দুর্বল অবস্থান থেকে আলোচনায় অংশ নিতে চায়নি। কিন্তু এখন যেহেতু বিএনপি তুলনামূলকভাবে দুর্বল অবস্থানে উপনীত হয়েছে, সেহেতু সরকারের জন্য এটাই হচ্ছে রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক বিষয়ে আলোচনা শুরু করার অনুকূল সময়। মনে রাখা দরকার যে আলোচনা বলতে আমি সরকার ও বিএনপি কিংবা ‘দুই নেত্রী’র আলোচনার কথা বলছি না। কেবল দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে বর্তমান সংকটের সমাধান হবে, এমন মনে করারও কারণ নেই। যদিও এটা ঠিক যে ২০১৪ সালের একপক্ষীয় নির্বাচনের কারণে বর্তমান সংকটের সূচনা হয়েছে, কিন্তু এখন তড়িঘড়ি আরেকটা নির্বাচনই এই সমস্যার পেছনে যেসব কারণ বিদ্যমান, তার সমাধান দেবে না। একটি বা দুটি দলের হাতে এই সমস্যার সমাধান আছে মনে করার কোনো কারণ নেই।
বর্তমান পরিস্থিতির পেছনে যেসব বিষয় উপস্থিত—নির্বাচনপদ্ধতি, আগামী নির্বাচনের সময়ে সাংবিধানিক কাঠামো ও সময়, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার ও স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিতকরণ, নির্বাচনে প্রশাসনের ভূমিকা ও তার নিরপেক্ষতার নিশ্চয়তা বিধান, প্রশাসনে দলীয়করণ বন্ধ করা, ভবিষ্যতে সহিংসতার পথ বন্ধ করা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারপ্রক্রিয়া অব্যাহত রাখার প্রক্রিয়া ইত্যাকার বিষয় নিয়েই জাতীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক দল ও শক্তির মধ্যে আলোচনা হতে হবে। তার জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরির কাজে সরকার এগিয়ে এলে অন্যান্য রাজনৈতিক দল, যারা এই অবস্থার স্থায়ী সমাধান চায়, তাদের পক্ষে পিছিয়ে থাকার সুযোগ থাকবে না। এ ধরনের চেষ্টায় বিএনপিকে ছাড় দেওয়ার অর্থ হলো তাদের এই প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়ার বাধ্যবাধকতার মধ্যে ফেলে দেওয়া। এসব ছাড় কী, সেটা সহজেই বোঝা যায়, দলের কার্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে, তাদের আটক রেখে সে আলোচনা হবে না। বিএনপি এই প্রচেষ্টায় অংশ না নিলেও অন্যান্য দল এবং নাগরিকদের কাছ থেকেই তারা চাপের মুখে পড়বে।
এখানে অনেকেই বিএনপির শরিক দল জামায়াতে ইসলামীর ভূমিকার প্রশ্ন তুলবেন। বিএনপি গত বছর থেকে বলে এসেছে সে জামায়াতের সঙ্গে তার ঐক্য আদর্শিক নয়, চিরস্থায়ীও নয়; নির্বাচনের ঐক্য মাত্র। সে ক্ষেত্রে তাদের জন্য এটা প্রমাণ করার সুযোগ থাকবে যে দলগতভাবে রাজনৈতিক কাঠামোগত পরিবর্তনের স্বার্থে তারা এই পদক্ষেপ নেবে কি না। গত বছরগুলোয় সহিংসতায়, বিশেষ করে যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে দেওয়া রায়ের পর সহিংসতায়, জামায়াতের সংশ্লিষ্টতা স্পষ্ট হলেও সে বিষয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ায় সরকারের অনীহা প্রশ্নসাপেক্ষ। বিএনপিকে জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগের পরামর্শ দেওয়ার বদলে মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াতের ভূমিকার জন্য দলটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ ও নিষিদ্ধ করার যে দাবি, সেটা বাস্তবায়নে সরকারের আগ্রহ সম্ভবত এই অবস্থার অবসানের সবচেয়ে কার্যকর পদক্ষেপ।
অনেকেই হয়তো আমাকে স্মরণ করিয়ে দেবেন যে সরকার আলোচনায় আগ্রহী নয় এবং আলোচনার কথা যাঁরা বলেন, তাঁদের আওয়ামী লীগের নেতারা বিএনপির পক্ষের লোক বলেই মনে করেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমি অধ্যাপক রেহমান সোবহানের বক্তব্য উদ্ধৃত করতে চাই: ‘সাধারণ মানুষের জীবনে স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনার যেকোনো প্রচেষ্টাকে অগ্রসর হতে হবে রাজপথের সহিংসতার কিংবা রাষ্ট্রের বলপ্রয়োগের শক্তির ওপরে নির্ভর করে নয় বরঞ্চ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। এর পরিণতি অবশ্যই হতে হবে এমন এক রাজনৈতিক সমঝোতা, যা একটি অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে, যার ভিত্তি হবে বর্তমান সরকারের জন্য ন্যায্যভাবে অর্জিত একটি গণতান্ত্রিক ম্যান্ডেট। এই রাজনৈতিক সমাধান সুনির্দিষ্টভাবে কীভাবে অর্জন করা যাবে, তা বেরিয়ে আসবে আলোচনার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে; যে আলোচনার ভিত্তি হচ্ছে এই ধারণা যে গণতান্ত্রিক রাজনীতি আপসের ওপরে নির্ভর করে গড়ে ওঠে; এক পক্ষ তার সবচেয়ে বেশি শক্তি ব্যবহার করে সব লক্ষ্য অর্জন করবে, সেটার ওপরে ভিত্তি করে নয়।’ ২০ ফেব্রুয়ারি ঢাকা ট্রিবিউন-এ প্রকাশিত নিবন্ধে তিনি সাম্প্রতিক কালে কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তির সমন্বয়ে গঠিত উদ্বিগ্ন নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে সংলাপের বিষয়ে সরকারি দলের প্রতিক্রিয়া প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘সম্ভবত তাঁরা বিস্মৃত হয়েছেন ১৯৭১ সালের মার্চে বঙ্গবন্ধু ও ইয়াহিয়ার মধ্যে, অথবা ইয়াসির আরাফাত ও ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে, অথবা ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় কিসিঞ্জার ও লি ডাক থোর মধ্যে, এমনকি সাম্প্রতিক কালে গোপনে ইউএইতে যুক্তরাষ্ট্র ও আফগান তালেবানের মধ্যে সংলাপের কথা’ (ঢাকা ট্রিবিউন, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৫)। অধ্যাপক সোবহানের মতোই অধ্যাপক মইনুল ইসলাম লিখেছেন: ‘পাকিস্তানি মডেল রুখতে চাইলে সংলাপের নীতিগত সম্মতি দিতে শেখ হাসিনার বিলম্ব করা উচিত হবে না।’ (প্রথম আলো, ১০ মার্চ ২০১৫)।
সরকারের এই ধরনের পদক্ষেপ ত্বরান্বিত করার জন্য বিএনপির পক্ষ থেকে ছাড় দেওয়ার সুস্পষ্ট ঘোষণা দেওয়া জরুরি। এখন বিএনপির অবস্থানগত দুর্বলতার কারণে তাদেরই এখন সুস্পষ্টভাবে বলতে হবে যে অকার্যকর কৌশলের পথ থেকে তারা সরে আসছে। এই পদক্ষেপ যদিও তাদের সাফল্যের ইঙ্গিত দেয় না এবং তারা এই পদক্ষেপ আগে নিলে হয়তো আরও বেশি জনসমর্থন আশা করতে পারত এবং অবশ্যই অনেক মানুষের জীবননাশ ঘটত না। কিন্তু এর আপাতত বিকল্প সামান্যই। বিএনপিকে বিবেচনায় নিতে হবে যে তাদের আন্দোলনের কারণে রাষ্ট্রশক্তির লাগামহীন ব্যবহার যদি বৈধতা লাভ করে, তবে দীর্ঘ মেয়াদে তার দায় তাকেও নিতে হবে। সেটা কেবল সাংগঠনিকভাবে হবে, তা নয়। আমি আগেই বলেছি যে রাষ্ট্রশক্তির ব্যবহার এবং গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম সীমিত হলে উগ্রপন্থীদের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হবে। বলা বাহুল্য, ওই পরিস্থিতিতে বাক ও ব্যক্তিস্বাধীনতা ইতিমধ্যে যতটা সংকুচিত হয়েছে, তার চেয়েও বেশি মাত্রায় সংকুচিত হয়ে পড়বে—এর কোনোটাই বিএনপির জন্য ইতিবাচক নয়। ইতিমধ্যে সাংগঠনিকভাবে যে ক্ষতি হয়েছে, সেই বিবেচনার পাশাপাশি সাধারণ জনগণের মনোভাব ও জীবন-জীবিকার বিষয়ে তার দায়িত্বশীলতা প্রদর্শন করা জরুরি। বিএনপির এই পদক্ষেপের জবাবে সরকারের পক্ষ থেকে ইতিবাচক সাড়া না পাওয়া গেলে সেটি নিশ্চয় নাগরিকদের দৃষ্টি এড়িয়ে যাবে না।
এই আলোচনার পর এই প্রশ্ন অবশ্যই উঠবে—কে পদক্ষেপ আগে নেবে, আদৌ এসবের কিছু হবে কি না। সেটা নির্ভর করে নেতৃত্বের দূরদর্শিতার ওপর। সরকারের পক্ষে যেকোনো পদক্ষেপ নেওয়া সহজতর, ফলে তার ওপরেই দায়িত্ব বেশি বর্তায়। তার পরও বিএনপির নেতৃত্ব বিষয়গুলো বিবেচনা করে দেখতে পারে যে তারা এই ঝুঁকি নিতে চায় কি না।
প্রথম আলো’তে ১৮ ও ১৯ মার্চ ২০১৫ প্রকাশিত
ছবির সূত্রঃ লিঙ্ক

Leave a Reply